“এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়
এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়”
এ দুটি লাইন শোনেনি, এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া বেশ দুষ্কর। একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে দেয়ালে চিকামারা হয়েছে কবিতার এ দুটি লাইন। কবিতার নাম ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’। কবির নাম হেলাল হাফিজ। একটি মাত্র কবিতার বই দিয়ে বাংলা সাহিত্যে হয়েছেন অমর। নাম লিখিয়েছেন ইতিহাসের পাতায়। তার ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ বইটির কবিতাগুলো যেন একেকটি প্রেম আর দ্রোহের খনি। ভাষার এমন সুন্দর ব্যবহার, শব্দের এমন চমৎকার চয়ন, বিমোহিত করে তাবৎ কাব্যপ্রেমীকে।
১৯৪৮ সালের ৭ অক্টোবর নেত্রকোনা জেলায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা খোরশেদ আলী তালুকদার ছিলেন নামকরা শিক্ষক। মায়ের নাম কোকিলা বেগম। মাত্র তিন বছর বয়সে মাকে হারান। ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলার প্রতি অসম্ভব ঝোঁক ছিলো হেলাল হাফিজের। খেলেছেন ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন, ফুটবল, ভলিবল। এমনকি নেত্রকোনার মতো জায়গায় তিনি লন টেনিসও শিখেছিলেন। কিন্তু বয়স যত বাড়তে থাকলো, মাতৃবিয়োগের বেদনা ধীরে ধীরে তাকে গ্রাস করতে থাকলো। এই বেদনা থেকে মুক্তি পেতেই তিনি ঝুঁকে পড়লেন কবিতায়। একটু মমতা, একটু ভালোবাসার জন্য ছুটেছেন এদিক-সেদিক। পেয়েছেন লাঞ্ছনা, অনাদর; পেয়েছেন ভালোবাসাও। আর সেসব অনুভূতি থেকেই রচিত হয়েছে কালজয়ী সব কবিতা।
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সময় তিনি ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ কবিতাটি লিখেন। এই একটি কবিতা লিখেই তিনি রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যান। তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের সবাই তখন হেলাল হাফিজকে চিনতো ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ এর কবি হিসেবে। হেলাল হাফিজ স্মৃতিচারণ করেছিলেন এই বলে, তিনি নাকি এতটাই জনপ্রিয় ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে, মনে হতো যেন ভিসির পরেই তার স্থান। বিদ্রোহ আর প্রেমকে তিনি মিলিত করেছিলেন এক বিন্দুতে। তিনি তাঁর ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ কবিতাতেই বলেছেন,
“কোনো কোনো প্রেম আছে প্রেমিককে খুনী হতে হয়।
যদি কেউ ভালোবেসে খুনী হতে চান
তাই হয়ে যান
উৎকৃষ্ট সময় কিন্তু আজ বয়ে যায়।”
কবি হওয়ার তার কোনো ইচ্ছে ছিলো না। যুক্ত ছিলেন নানা সাহিত্যকর্মে। উপস্থিত বক্তৃতা, কবিতা আবৃত্তি করে পেয়েছেন অনেক পুরস্কার। নিজের ভেতরকার হাহাকার মেটাতেই তিনি কবি হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এই কবিতা দিয়ে তিনি টাকা পয়সা কামাতে চাননি। তার ভাষায়,
“সাহিত্য করে বা কবিতা দিয়ে আমি বিত্ত-বৈভব কামাতে চাইনি, আমার আকাঙ্ক্ষা ছিলো এই কবিতা দিয়ে আমি যাতে মানুষ কামাতে পারি।”
হেলাল হাফিজ নির্ঝঞ্ঝাট একজন মানুষ। ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছে ছিলো তার। কিন্তু ডাক্তার হলে পড়াশোনার চাপে আর কবিতা লিখতে পারবেন না বলে ডাক্তারিতে ভর্তি হননি। পরে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। থাকতেন তৎকালীন ইকবাল হলে, যা বর্তমানে ‘শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল’ নামকরণ করা হয়েছে। ইকবাল হল ছিল সেসময়ের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মূল ঘাঁটিগুলোর একটি। তৎকালীন দাপুটে সব ছাত্রনেতারা থাকতেন ইকবাল হলে। হেলাল হাফিজ ইকবাল হলে থাকাকালীনই এসেছিল ২৫ মার্চের সেই গণহত্যার রাত। সেদিন তিনি নিউমার্কেটে আড্ডা দিয়ে হলে ফিরে গোসল করে চিন্তা করলেন, তার নেত্রকোনার এক বন্ধুর সাথে দেখা করবেন। সেই বন্ধু থাকতেন ফজলুল হক হলে। হেলাল ফজলুল হক হলে গল্পগুজব করতে থাকলেন। রাত এগারটার দিকে গোলাগুলি শোনা গেলো। হেলাল ফজলুল হক হলেই রয়ে গেলেন। কারফিউ শেষে ২৭ তারিখ তিনি ইকবাল হলে ঢুকতেই দেখলেন ৩০-৩৫টি লাশের একটি স্তূপ। কোনোমতে কিছু জিনিসপত্র নিয়ে বের হতেই হলের গেটে নির্মলেন্দু গুণের সাথে দেখা হলো তার! নির্মলেন্দু গুণ এসেছিলেন হেলাল হাফিজ ঠিক আছেন কিনা তা দেখার জন্য। দুঃসময়ের এ মুহূর্তে দু’জন দু’জনকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কান্নাকাটি করলেন। তারপর তারা কেরানীগঞ্জ চলে গিয়েছিলেন। একটি কথা বলতেই হয়, ঘটনাগুলো যদি এভাবে না ঘটতো, যদি হেলাল ইকবাল হলে থাকতেন সে রাতে, তাহলে হয়ত আজকে আমরা এই কবিকে আর পেতাম না।
হেলাল হাফিজের সারা জীবনের অমর সৃষ্টি হলো ‘যে জলে আগুন জ্বলে‘। সতেরো বছর কবিতার লেখার পর ১৯৮৬ সালে এই বইটি তিনি প্রকাশ করেন। বইয়ের প্রায় সবগুলো কবিতাই তিনি লিখেছেন ঢাকা প্রেস ক্লাব লাইব্রেরিতে বসে। লেখার ব্যাপারে তিনি খুবই খুঁতখুঁতে। প্রায় তিনশ’ কবিতা থেকে মাত্র ৫৬টি কবিতা তিনি বাছাই করেন ‘যে জলে আগুন জ্বলে’র জন্য। কবিতাগুলো বাছাই করতেই তিনি সময় নেন ছয় মাস। এরপর তিনি সমস্যায় পড়েন বইয়ের নাম নির্বাচন নিয়ে। এমনিতেই একদিন ওয়াশরুমে দাঁত মাজতে গিয়ে হঠাৎ ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ নামটি তার মাথায় আসে। প্রকাশের পরেই বইটি ইতিহাসের অংশ হয়ে যায়। দুর্দান্ত জনপ্রিয় এই কবিতাগুলোর সাথে সাধারণ মানুষ নিজেদের একাত্ম করে নেয়। এই বইটির প্রায় ছাব্বিশটি সংস্করণ বের হয়েছে এখনও পর্যন্ত, যা একটি কবিতার বইয়ের জন্য এক অবিশ্বাস্য ব্যাপার। আর তার সাথে তো অনলাইন ভার্শন আর পাইরেটেড কপি আছেই। সব মিলিয়ে নামে-বেনামে এখনও পর্যন্ত এই বইটির সর্বমোট কতটি সংস্করণ বের হয়েছে, তার কোনো হিসেব নেই।
হেলাল হাফিজ যখন খ্যাতির একেবারে শিখরে, তখনই তিনি চলে যান লোকচক্ষুর আড়ালে। এরপর আর কোনো বই প্রকাশ হয়নি অনেক বছর। কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, “খ্যাতির বিড়ম্বনা আছে।” তিনি ভয় পেয়েছিলেন, তার পরের বই ‘যে জলে আগুন জ্বলে’কে ছাপিয়ে যেতে পারবে কিনা। তার এই নীরবে আত্মগোপনের পেছনে কোনো অভিমান আছে কিনা জানতে চাইলে, তিনি কবিসুলভ উত্তর দিতে দিতে বলেন, “এর পেছনে অনেক কারণই রয়েছে , অভিমানও আছে।” তবে তিনি মনে করেন, এর পেছনের মূল কারণ আলস্য। আর কবিদের কাছে আলস্যও যেন এক অন্য মাত্রার বিষয়। আবার আরেক সময় তার এই অগোচরে চলে যাওয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, তার কবিতা স্থায়ীত্ব পাবে কিনা তা দেখার জন্যই তিনি এ কাজ করেছেন। তার ভাষায়,
“আমার কবিতা যখন অসম্ভব জনপ্রিয় হয়ে উঠলো, তখন আমার একটা সন্দেহ জাগলো মনে। যে আচ্ছা, এই যে সমকালে এতো নন্দিত হলাম, এতো ভালোবাসা পেলাম মানুষের, এতো পাঠকপ্রিয়তা হলো আমার কবিতার। একদিন তো আমাকে শারীরিকভাবে বিদায় নিতে হবে। প্রস্থান হবেই। প্রত্যেকেরই হবে, আমারও হবে। তো যেদিন আমি উপস্থিত থাকবো না, সেদিন কি রাতারাতি মানুষ আমাকে ভুলে যাবে? আমি শুধু একটু পরীক্ষা করার জন্য যে, আমার কবিতা টিকবে কি টিকবে না। মহাকালের স্রোতে কি ভেসে যাবে নাকি একটা স্থায়ীত্ব পাবে? সেটা পরীক্ষা করার জন্য আমি জুয়াটুকু খেলেছি। ”
আসলে কবি বলে কথা। একেক সময় একই প্রশ্নের আলাদা উত্তর দেবেন, এটাই স্বাভাবিক। কোনো প্রশ্নেরই কেবল একটি উত্তর হয় না। কোনো কিছুকেই বেঁধে-ধরে তার সংজ্ঞা বলা যায় না। হেলাল হাফিজ তার প্রমাণ।
হেলাল হাফিজ আজীবন কবিতাই লিখে গেছেন। প্রেমে পড়েছেন অসংখ্য নারীর। তার কবিতায় ব্যবহার করা নাম হেলেন, হিরণবালা, সাবিতা মিস্ট্রেস সবই বাস্তবের রমণী। তসলিমা নাসরিনকে নিয়ে তিনি লিখেছেন,
“ভালোবেসেই নাম দিয়েছি ‘তনা’,
মন না দিলে
ছোবল দিও তুলে বিষের ফণা।”
কবি যখন দুঃখের সাগরে নিমজ্জিত, নিজেকে হারিয়ে যখন তিনি দিশেহারা হয়ে ঘুরে বেড়ান পাপ-পঙ্কিলতার পথে; তার কবিতার ভাষায়, নারীই তখন তার উদ্ধারের পথ।
“আমাকে স্পর্শ করো, নিবিড় স্পর্শ করো নারী।
অলৌকিক কিছু নয়,
নিতান্তই মানবিক যাদুর মালিক তুমি
তোমার স্পর্শেই আমার উদ্ধার।”
তাই বলে তিনি যে কেবল সাধারণ প্রেম করে যাবার বন্দনা করে গেছেন, তা নয়। তাই তো তিনি লিখেছেন,
“মানব জন্মের নামে হবে কলঙ্ক হবে
এরকম দুঃসময়ে আমি যদি মিছিলে না যাই,
উত্তর পুরুষে ভীরু কাপুরুষের উপমা হবো
আমার যৌবন দিয়ে এমন দুর্দিনে আজ
শুধু যদি নারীকে সাজাই”
আজীবন করেছেন দুঃখের চাষাবাদ। বেদনাকে করেছেন নিজের বোন। জীবনও তাঁকে হতাশ করেনি। দু’হাতে দুঃখ দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছে তার জীবন। আর যেখানে দুঃখের কিছুটা কম পড়েছে, সেখানে নিজেই নিজের মত করে দুঃখ বানিয়ে নিয়েছেন। তার ভাষায়,
“বেদনা আমার খুব প্রিয়। আমি মনে করি সুখ আমার জন্য অতটা জরুরি নয়। কারণ সুখ শিল্পের জন্যে তেমন কোনো প্রেরণা দেয় বলে আমি মনে করি না। শিল্পের জন্যে জরুরি হচ্ছে বিরহ, বিচ্ছেদ, বেদনা।”
এই বেদনার ফলেই যুগে যুগে সৃষ্টি হয়েছে সব অনবদ্য সাহিত্য। এই কষ্টের ফেরিওয়ালা তাই কষ্ট বিলিয়েছেন সারা জীবন। মানুষের ভেতরের বোধকে করেছেন জাগ্রত। কবি বলেন,
“এটা এমনই একটা আকালের দেশ, যেখানে নান্দনিক দুঃখ দেওয়ার মানুষের বড্ড অভাব। ফলে কিছু বেদনা, কিছু দুঃখ আমি নিজেই আমার ভেতর তৈরি করে নিয়েছি এবং চেষ্টা করেছি এই বেদনাকে শিল্পে রুপান্তরিত করার।”
এই কষ্ট তিনি ফেরি করেছেন তার ফেরিওয়ালা কবিতায়,
“কষ্ট নেবে কষ্ট
হরেক রকম কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট”
কষ্টকে কতটুকু কাছ থেকে দেখলে, কতটুকু গভীরে গেলে তিনি এমন উপমা দিতে পারেন, “পাথর চাপা সবুজ ঘাসের সাদা কষ্ট”; ভাবতেই অবাক লাগে। তিনি কষ্টের ফেরি করেছেন কষ্টগুলো নিজের করে নেওয়ার জন্য। বিনিময়ে দিয়েছেন ভালোবাসা আর শুভ্রতা।
“আমার যতো শুভ্রতা সব দেবো,
আমি নিপুণ ব্লটিং পেপার
সব কালিমা, সব ব্যথা ক্ষত শুষেই নেবো।”
আবার কখনও কখনও কষ্টের ভারে তার দাঁড়িয়ে থাকাও হয়েছে কঠিন।
“কে আছেন?
দয়া করে আকাশকে একটু বলেন-
সে সামান্য উপরে উঠুক,
আমি দাঁড়াতে পারছি না।”
হেলাল হাফিজ সম্বন্ধে শুধু একটি কথাই বলা যায়, এমন মায়া ভরা মানুষ খুব একটা দেখা যায় না। তাই তো তিনি লিখতে পেরেছেন,
“তুমি আমার নিঃসঙ্গতার সতীন হয়েছো!”
“জলের আগুনে পুড়ে হয়েছি কমল,
কী দিয়ে মুছবে বলো আগুনের জল।”
দীর্ঘ ছাব্বিশ বছর পর ২০১২ সালে আবার বই নিয়ে হাজির হন হেলাল হাফিজ। বইয়ের নাম ‘কবিতা একাত্তর’।
কিন্তু এটি আসলে একেবারে নতুন কোনো বই নয়। ‘যে জলে আগুন জ্বলে’র ছাপ্পান্নটি কবিতার সাথে আরও নতুন পনেরোটি কবিতা যোগ করে এই বইটি প্রকাশ করা হয়। তবুও হেলাল প্রেমীদের এটাই পরম পাওয়া। ২০১৩ সালে হেলাল হাফিজকে বাংলা একাডেমি পুরস্কার দেওয়া হয়। তবে তার মতো প্রতিভাকে মূল্যয়ন করতে বাংলা একাডেমি হয়ত বেশ দেরিই করে ফেলেছে।
কবি তার বয়সের একেবারে শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে এখন। তিনি গ্লুকোমা নামক চোখের রোগে আক্রান্ত। খুশির বিষয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার চোখের চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছেন।
হেলাল হাফিজের একলা জীবন চলছে প্রেস ক্লাবের বিপরীতে থাকা একটি হোটেল রুমে। খাওয়া-দাওয়া করেন প্রেস ক্লাবের ক্যান্টিনে। বেশিরভাগ সময় তার প্রেস ক্লাবেই কাটে।
হেলাল হাফিজ বর্তমানে নতুন বই নিয়ে কাজ করছেন। বইয়ের সম্ভাব্য নাম ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’। সকল হেলাল ভক্ত তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করছেন এই বইটির জন্য। তার একটি কবিতা দিয়েই এই লেখা শেষ হোক।
“নিউট্রন বোমা বোঝ
মানুষ বোঝ না।”