Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বিয়েট্রিক্স পটার আর খরগোশ পিটারের গল্প

নাস্তা শেষ করে চার পুত্রকে ডেকে নিলেন মা খরগোশ। ফ্লপসি, মপসি, কটনটেইল আর পিটার এসে জড়ো হলে মায়ের সামনে। মা তখন তৈরি হয়েছেন বাইরে যাবার জন্য।

বাছারা, মা খরগোশ সন্তানদের উপর দৃষ্টি বুলালেন, আমি একটা কাজে বাইরে যাচ্ছিতোমরা খেলতে যেতে পারো। তবে যেখানেই যাও, ভুলেও ম্যাকগ্রেগর সাহেবের সবজিবাগানে ঢুকো না। তোমাদের পরলোকগত পিতা শেষবার ম্যাকগ্রেগর সাহেবের বাগানে গিয়েছিলেন, দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মা খরগোশ, এরপর ম্যাকগ্রেগর সাহেবের স্ত্রী তাকে খাবারের তালিকায় স্থান দেন।

সন্তানদের সাথে মা খরগোশ; image source: beatrix-potter-shop.co.uk

ছেলেপুলেদের সতর্ক করে দিয়ে মা খরগোশ বেরিয়ে গেলেন। ফ্লপসি, মপসি আর কটনটেইল মায়ের কথা মেনে ম্যাকগ্রেগর সাহেবের বাগান থেকে একশ হাত দূরত্ব বজায় রাখল। কিন্তু দুষ্টু পিটার ঠিকই চলল নিষিদ্ধ সেই ক্ষেতে। মনের আনন্দে ম্যাকগ্রেগর সাহেবের কষ্টে বোনা সবজি দিয়ে উদরপূর্তি শুরু করে দিল। নানারকম সবজি পেটে চালান করতে করতে পিটার যখন সুখের সাগরে ভাসছে, তখনই মূর্তিমান বিভীষিকার মতন তার সামনে হাজির হলেন ম্যাকগ্রেগর স্বয়ং।

উপরোক্ত বর্ণনাটি শিশুতোষ গল্প পিটার র‍্যাবিটে’র অংশবিশেষ। সারা বিশ্বে এখনো বাচ্চাদের জন্য তুমুল জনপ্রিয় আর পঠিত এই গল্পটি যার মস্তিস্কপ্রসূত, তিনি ভিক্টোরিয়ান যুগের এক লেখিকা এবং অঙ্কনশিল্পী, বিয়েট্রিক্স পটার

বিয়েট্রিক্স পটার

হেলেন বিয়েট্রিক্স পটারের জন্ম ১৮৬৬ সালের ২৮ জুলাই, লন্ডনের কেনসিংটনে। বাবা রুপার্ট উইলিয়াম পটার আইনজ্ঞ হলেও প্র্যাকটিসের ধার ধারতেন না। দিনের বেশিরভাগ সময়ই কাটিয়ে দিতেন সঙ্গীসাথীদের সাথে ক্লাবে। মা হেলেন পটার ধনী তুলা ব্যবসায়ীর কন্যা। তার মূল কাজ ছিল অতিথিদের দেখভাল করা, যাদের ভিড় পটার বাড়িতে লেগেই থাকত। তাদের আয়ের মূল উৎস ছিল উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তি।    

বিয়েট্রিক্স পটার © Encyclopedia Britannica

বিয়েট্রিক্সের বয়স যখন ছয়, তখন তার ভাই ওয়াল্টার বারট্রামের জন্ম। ভাই-বোনে ভাব ছিল বেশ। তারা দুজনেই আগ্রহী ছিলেন আঁকাআঁকিতে। বিশেষ করে পশুপাখির ছবি আঁকাতে তারা বেশ পটু হয়ে ওঠেন।বিয়েট্রিক্সের বাবা-মা মেয়ের অঙ্কন প্রতিভাকে উৎসাহ দিতেন। নিজেরা সামাজিক কাজেকর্মে ব্যস্ত থাকায় ছেলেমেয়ের ভার তুলে দিয়েছিলেন গভর্নেসের কাছে। নানা সময় কয়েকজন গভর্নেস বিয়েট্রিক্সের দেখভাল করতেন। এদের সান্নিধ্যে থেকেই বিয়েট্রিক্স পড়াশোনা শিখতে থাকেন। তার সর্বশেষ গভর্নেস, অ্যানি মুরের প্রতি তার আলাদা টান ছিল এবং তাদের যোগাযোগ বজায় ছিল আজীবন। বিয়েট্রিক্সের বয়স যখন বার, তখন রুপার্ট আর হেলেন চিত্রকলা শেখানোর জন্যে ক্যামেরন নামে একজন শিক্ষিকাকেও নিযুক্ত করেন। তিনি পাঁচ বছর বিয়েট্রিক্সের সাথে ছিলেন।  

ধীরে ধীরে বিয়েট্রিক্সের আঁকার হাত আরো খোলতাই হতে থাকে। যে পশুপাখির ছবি আঁকতে তিনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন, সেই পশুপাখির প্রতি ভালবাসা থেকেই বিয়েট্রিক্স আর বারট্রাম বাসায় প্রচুর জন্তুজানোয়ার পুষতে আরম্ভ করেন। এদের বসবাস ছিল বিয়েট্রিক্সের পড়ার ঘরে। পোষা প্রাণীদের মধ্যে ছিল ইঁদুর, খরগোশ, ব্যাঙ, কচ্ছপ, টিকটিকি, বাদুড়, এমনকি সাপও। তার প্রথম পোষা খরগোশের নাম ছিল বেঞ্জামিন বাউন্সার, পরবর্তীতে যা বিয়েট্রিক্সের গল্পে ধরা দেয় বেঞ্জামিন বানি হিসেবে। পিটারের কাজিন হিসেবে বেঞ্জামিন বানি’কে সৃষ্টি করেন বিয়েট্রিক্স। তার সর্বাধিক জনপ্রিয় চরিত্র, পিটার র‍্যাবিটে’র অনুপ্রেরণাও তার পোষা অন্য একটি খরগোশ, পিটার পাইপার। পিটার পাইপার বিয়েট্রিক্সের অন্যতম প্রিয় ছিল এবং বাবা-মায়ের সাথে গ্রীষ্মকালীন অবকাশে গেলে প্রায়ই বিয়েট্রিক্স আর বারট্রাম তাকে নিয়ে বাইরে যেতেন।      

বারট্রাম কিছুটা বড় হলে তাকে বোর্ডিং স্কুলে দিয়ে দেয়া হলো। বিয়েট্রিক্স কিন্তু থেকে গেলেন ঘরেই। বয়সকালে উপনীত হলে তার বাবা-মা তাকে বাড়ি দেখাশোনার ভার দেন। কিশোরি বিয়েট্রিক্স ১৫ বছর থেকে ডায়েরি লেখার অভ্যাস করেছিলেন, যা অনেক বছর বজায় ছিল। কিন্তু সেখানে সব লেখাই ছিল তার নিজস্ব সাংকেতিক ভাষায়।

গ্রীষ্মের ছুটি

প্রতি গ্রীষ্মেই বিয়েট্রিক্সের বাবা-মা ছেলেমেয়েদের নিয়ে বেড়াতে যেতেন। ১৮৭১-৮১ সাল পর্যন্ত তাদের গন্তব্য ছিল স্কটল্যান্ডের পার্থশায়ার। তিন মাস তারা স্কটল্যান্ড থাকতেন। এই সময়ের জন্যই সারা বছর অপেক্ষা করতেন বিয়েট্রিক্স। পার্থশায়ারে পা দিয়েই তিনি ব্যস্ত হয়ে উঠতেন আশেপাশের প্রকৃতিতে হারিয়ে যাবার জন্য। বারট্রামও প্রায়শই তার সঙ্গী হতেন। বিয়েট্রিক্স অনেক সময় ব্যয় করতেন গভীর মনোযোগে প্রকৃতির নানা দিক পর্যবেক্ষণে।

বিয়েট্রিক্সের বয়স যখন ষোল, তখন তার পরিবার গ্রীষ্মকালীন অবকাশের জন্যে স্কটল্যান্ডের পরিবর্তে বেছে নেয় লেক উইন্ডারমেয়ারের রাই ক্যাসল (Wray Castle)। ইংল্যান্ডের লেক ডিস্ট্রিক্টের এই এলাকা বিয়েট্রিক্সের মানসে গভীর প্রভাব ফেলেছিল, এতটাই যে পরবর্তীকালে একেই তিনি বেছে নিয়েছিলেন নিজ আবাসস্থল হিসেবে।

লেক ডিস্ট্রিক্ট; image source: leisurelydrives.com

১৮৮২ সালে বিয়েট্রিক্সরা প্রথমে রাই ক্যাসল আসা শুরু করেন। এ সময় তাদের পরিচয় হয় প্রভাবশালী এক স্থানীয় ব্যক্তি, রন্সলির সাথে। ইংল্যান্ডে তখন শিল্পকারখানার জোয়ার। চারদিকে গজিয়ে উঠছে ছোট-বড় নানা ইন্ডাস্ট্রি। পরিবেশের উপর এর ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে রন্সলি ছিলেন উদ্বিগ্ন। বিশেষ করে লেক ডিস্ট্রিক্টের পাহাড়-পর্বত আর সবুজে ছাওয়া অঞ্চলের ব্যাপারে তিনি অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। বিয়েট্রিক্সের সাথে তিনি এসব নিয়ে আলোচনাও করতেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিয়েট্রিক্সও পরিবেশ সংরক্ষণের ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা আরম্ভ করেন।

রন্সলি; image source: nationaltrust.org.uk

১৮৯৫ সালে রন্সলি ন্যাশনাল ট্রাস্ট নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এর মূল উদ্দেশ্যই ছিল লেক ডিস্ট্রিক্ট ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের পরিবেশ রক্ষা। বিয়েট্রিক্সও এই ব্যাপারে তার পাশে ছিলেন।

বৈজ্ঞানিক হবার চেষ্টা

বিয়েট্রিক্স পশুপাখি ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে প্রকৃতিতে দেখা ফুলের ছবি আঁকতে হাত পাকিয়ে ফেলেছিলেন। মিস ক্যামেরনের শিক্ষা সমাপ্ত হলে তিনি অঙ্কন বিষয়ে কমিটি অফ কাউন্সিল অন এডুকেশনে’র বিজ্ঞান ও শিল্পকলা বিভাগ থেকে একটি সার্টিফিকেটও লাভ করেন।

বিয়েট্রিক্স তার অঙ্কন প্রতিভা বিজ্ঞানের কাজে লাগাতে চাইলেন। এজন্য প্রকৃতিতে খুঁজে পাওয়া নানা বস্তুর ছবি নিখুঁতভাবে আঁকতে তিনি মনোযোগী হন। লন্ডনের কিউ রয়্যাল বোটানিক্যাল গার্ডেনে তখন এই বিষয়ে পাঠ্যক্রম ছিল। বিয়েট্রিক্সের চাচা চেষ্টা করেন ভাগ্নিকে সেখানে ভর্তি করে দিতে, তবে নারী বলে রয়্যাল বোটানিক্যাল গার্ডেন নাক সিঁটকাল।

এবার বিয়েট্রিক্স তার কেনসিংটনের বাসার কাছে ব্রিটিশ ন্যাচারাল হিস্টোরি মিউজিয়ামে সময় দিতে থাকলেন। এখানে তিনি ফসিলের ছবি আঁকা শুরু করেন, একইসাথে ছত্রাক নিয়ে পড়াশোনা চালু হয়। চার্লস ম্যাকিনটশ নামে এক স্কটিশ বিশেষজ্ঞ তাকে উৎসাহ দেন। তার অনুপ্রেরণাতেই বিয়েট্রিক্স অনুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে রেখে দেখা ছত্রাকের নিখুঁত ছবি আঁকার দক্ষতা অর্জন করেন। 

১৮৯৬ সালে বিয়েট্রিক্স ছত্রাকের বংশবৃদ্ধি নিয়ে একটি তত্ত্ব দাঁড়া করান। এই বিষয়ে তার লেখা প্রবন্ধ রয়্যাল বোটানিক্যাল গার্ডেনের পরিচালক উইলিয়াম থিসেল্টন-ডায়ার প্রত্যাখ্যান করেন। তখনকার দিনে বৈজ্ঞানিক হিসেবে মেয়েদের মেনে নিতে চরম আপত্তি ছিল। ফলে বিয়েট্রিক্সের লেখা পড়ে দেখারও প্রয়োজন মনে করেননি থিসেল্টন-ডায়ার।

১৮৯৭ সালে বিয়েট্রিক্সের মাশরুম বিষয়ক একটি লেখা অবশেষে পঠিত হলো লন্ডনের নামকরা বৈজ্ঞানিক সংঘ লিনিয়ান সোসাইটিতে (Linnean Society)। এখানেও তাকে অবহেলা করা হয়। যে সভায় তার লেখা পাঠ হবে সেখানে তার প্রবেশাধিকারও ছিল না। তার লেখা নিয়ে বক্তব্য দেন জর্জ ম্যাসি নামে এক ছত্রাক বিশেষজ্ঞ।

লিনিয়ান সোসাইটির লোগো; image source: youtube.com

অঙ্কনশিল্পী বিয়েট্রিক্স

তৎকালীন ভিক্টোরিয়ান সমাজে বয়সকালে উপনিত হলেই মেয়েদের বিয়ে দেয়ার জন্য পরিবার ব্যস্ত হয়ে উঠত। বিয়েট্রিক্সের ক্ষেত্রেও হেলেন আর রুপার্ট মেয়ের বিশ বছর হতে না হতেই একগাদা পাত্র হাজির করলেন। কিন্তু তীব্রভাবে স্বাধীনচেতা বিয়েট্রিক্স সকলকেই ফিরিয়ে দেন। নিজের আঁকাআঁকিতে নিবিষ্ট হয়ে পড়েন তিনি।

১৮৯০ সালেই বিয়েট্রিক্স তার আঁকা কিছু ছবি লন্ডনের এক কার্ড ছাপানোর প্রতিষ্ঠানকে দেন। তারা বিয়েট্রিক্সের কাজ পছন্দ করে। ফলে নানা উৎসব উপলক্ষে তাদের কার্ডের জন্য ছবি আঁকতেন বিয়েট্রিক্স। এই পথ ধরে ফ্রেডেরিক ওয়েদারলি নামে এক কবির প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের (A Happy Pair) জন্য ইলাস্ট্রেশনের দায়িত্বও পান তিনি। 

আগেই বলা হয়েছে, বিয়েট্রিক্সের সাথে তার গভর্নেস, অ্যানি মুরের যোগাযোগ ছিল। মুরের পাঁচ বছর বয়সী ছেলে নোয়েল প্রায়ই অসুস্থ থাকত। শয্যাশায়ী নোয়েলকে মানসিকভাবে ভাল রাখতে বিয়েট্রিক্স চিঠিতে গল্প লিখে পাঠাতেন। ১৮৯৩ সালের ৪ সেপ্টেম্বর ফ্লপসি, মপসি, কটনটেইল আর পিটার নামে চার খরগোশের গল্প তিনি নোয়েলকে লিখে পাঠান।

১৮৯৫ সালে রন্সলির সাথে ন্যাশনাল ট্রাস্ট নিয়ে বিয়েট্রিক্স যখন কাজ করছিলেন তখন রন্সলি তাকে পরামর্শ দিলেন নোয়েলকে লিখে পাঠানো গল্প নিয়ে বাচ্চাদের একটি বই প্রকাশ করতে। বিয়েট্রিক্স গল্প আর ছবি মিশিয়ে লিখে ফেললেন তার প্রথম পিটার র‍্যাবিটে’র বই। ছ’জন প্রকাশকের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হলো পিটার র‍্যাবিট।   

বিয়েট্রিক্স এবার নিজেই নিজের বই প্রকাশ করলেন। সাদা-কালো ছবি আর লেখা দিয়ে ১৯০১ সালের ডিসেম্বরে ২৫০ কপি ছাপিয়ে বন্ধুবান্ধব আর আত্মীয়স্বজনের মধ্যে ছড়িয়ে দিলেন। পাঠকমহলে বেশ সাড়া ফেলল শিশুতোষ এই গল্প। এবার আগ্রহী হলো ফ্রেডেরিক ওয়ার্ন (Frederick Warne & Co) নামে এক প্রকাশনা সংস্থা, যারা বিয়েট্রিক্সের গল্প প্রাথমিকভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিল।

বিয়েট্রিক্সের বই যে খুব চলবে এমন আশা প্রকাশকের ছিল না। ফলে এর দায়িত্ব দেয়া হয় ওয়ার্ন পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ ভাই নরম্যানকে। প্রকাশক হিসেবে নতুন শুরু করা নরম্যান কিন্তু বিয়েট্রিক্সের ব্যাপারে আস্থাশীল ছিলেন। তার চাপাচাপিতে বিয়েট্রিক্স পিটার র‍্যাবিটের ছবি রঙিন করে আঁকেন।

১৯০২ সালের অক্টোবরে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত হলো বিয়েট্রিক্স পটারের বই। তারপর যা হলো তা ইতিহাস। এক বছরের মাথায় ৫০,০০০ কপি বিক্রি হয়ে যায়। দোকান খালি হয়ে গেলেও লোকজন লাইন দিয়ে থাকত বই কখন আসবে। তখন থেকে আজ পর্যন্ত পিটার র‍্যাবিটের বই বছরে গড়ে ৭৫,০০০ কপি করে বিক্রি হয়ে। ত্রিশটি ভাষায় আজ অবধি অনূদিত হয়েছে বিয়েট্রিক্স পটারের এই অমর সৃষ্টি।

পিটার র‍্যাবিটের প্রথম বই; image source: rarebookcellar.com

পিটার র‍্যাবিটের সাফল্যের পর বিয়েট্রিক্স নিয়মিত লিখতে থাকেন। ১৯০৩ সালে তিনি পিটার র‍্যাবিটের পুতুল এবং অন্যান্য সামগ্রী প্যাটেন্ট করে নেন। এসব থেকে তার অনেক উপার্জন হতে থাকে। অল্প সময়েই বেশ ধনী হয়ে ওঠেন বিয়েট্রিক্স। নিজের চরিত্রগুলোকেও বিয়েট্রিক্স কপিরাইট করে নিয়েছিলেন। পিটার র‍্যাবিট পরিণত হয় গল্পের কপিরাইট করা প্রথম চরিত্রে।     

প্রণয় এবং ট্র্যাজেডি

নরম্যান আর বিয়েট্রিক্স ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার সুবাদে একে অপরের খুব কাছাকাছি চলে আসেন। তাদের মধ্যে মন দেয়া-নেয়া শুরু হয়। বিয়েট্রিক্সের বাবা-মা তাদের সম্পর্কের বিরুদ্ধে ছিলেন। তাদের চোখে নরম্যানের প্রকাশক পেশা বিয়েট্রিক্সের বংশ পরিচয়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

মিস পটার চলচ্চিত্রে বিয়েট্রিক্স এবং নরম্যান; image source: pluggedin.com

বিয়েট্রিক্স বাবা-মায়ের মতের তোয়াক্কা না করেই নরম্যানের সাথে ১৯০৫ সালের জুলাইয়ে বাগদান করে ফেলেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এর ঠিক এক মাস পর নরম্যান মারা যান, সম্ভবত তার লিউকেমিয়া ছিল।

নতুন সূচনা

নরম্যানের মৃত্যুর পর ভাঙা মন নিয়ে বিয়েট্রিক্স কাম্ব্রিয়ার সয়রি (Sawrey) অঞ্চলের হিল-টপ (Hill Top Farm) খামার কিনে নেন। খামারের পূর্বের বাসিন্দাদের তিনি থেকে যাবার অনুমতি দেন। বিয়েট্রিক্সের হয়ে তারাই হিল-টপের কাজকর্ম দেখাশোনা করত। বিয়েট্রিক্স বেশিরভাগ সময় লন্ডনেই থাকতেন।

বর্তমানে হিল-টপ ফার্ম; image source: visitlakedistrict.com

১৯০৯ সালে বিয়েট্রিক্স হিল-টপের নিকটবর্তী ক্যাসল ফার্ম নামে আরেকটি খামার কিনে নেন। এ কাজে তাকে সহায়তা করেন স্থানীয় এক আইন বিশারদ, উইলিয়াম হিলিস। পরিচয় খুব দ্রুতই প্রণয় হয়ে পরিণয়ে গড়াল। ১৯১৩ সালের অক্টোবরে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন বিয়েট্রিক্স এবং হিলিস। 

বিয়েট্রিক্স এবং হিলিস; image source: johnericson.co.uk

বিয়ের পর খামারের কাজেই বেশি মনোযোগী হয়ে পড়েন বিয়েট্রিক্স। হাতেগোনা কয়েকটি বই এই সময় প্রকাশিত হয়। ১৯১৮ সালের পর থেকে দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পাওয়ায় লেখা একেবারেই কমিয়ে দেন তিনি।  

বিয়েট্রিক্সের বিয়ের অব্যবহিত পরেই তার বাবা ও ভাই মারা যান। উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া সম্পত্তি দিয়ে বিয়েট্রিক্স সয়রিতে একটি ভেড়ার খামার কিনে নেন। সেখানে ১৯২৩ সালে বিয়েট্রিক্স-হিলিস দম্পতি বসবাস আরম্ভ করেন।

শেষ জীবন

বিয়েট্রিক্স এরপর যতদিন বেঁচে ছিলেন, সয়রিতেই কাটিয়েছেন। খামারের ব্যাপারে তার মনোযোগ ঢেলে দিয়ে বইয়ের পাতায় তার সৃষ্ট চরিত্রগুলো থেকে দূরে সরে আসেন তিনি। ন্যাশনাল ট্রাস্টের সাথে মিলে পরিবেশ সংরক্ষণেও অনেক সময় ব্যয় করেন। পকেটের অর্থ খরচ করে আশেপাশের অনেক জমি কিনে নেন কেবল কলকারখানার কাছে সেগুলো যাতে বিক্রি হয়ে না যায় সেজন্য। জীবদ্দশায় পনেরটির মতো খামার কেবল এ কারণেই কিনে নেন বিয়েট্রিক্স।   

১৯৩৬ সাল থেকে লেখালেখি থেকে একপ্রকার অবসরে চলে যান বিয়েট্রিক্স। ওয়াল্ট ডিজনি পিটার র‍্যাবিটকে রুপালি পর্দায় তুলে আনতে চাইলেও তিনি অনুমতি দেননি। মার্গারেট লেন নামে এক লেখিকা বিয়েট্রিক্সের জীবনই লিখতে চাইলে তাকেও তিনি প্রত্যাখ্যান করেন।

বৃদ্ধ বিয়েট্রিক্স; image source: peterrabbit.com

৭৭ বছর বয়সে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ১৯৪৩ সালের ২২ ডিসেম্বর মারা যান বিয়েট্রিক্স পটার। শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তার মরদেহ পুড়িয়ে ছাই ছড়িয়ে দেয়া হলো তার প্রিয় হিল-টপ ফার্মে।

মরণোত্তর খুঁজে পাওয়া বিয়েট্রিক্সের আরো দুটি গল্প প্রকাশিত হয়। তার কোনো সন্তান ছিল না। নিজের সম্পত্তি থেকে হিল-টপ আর ক্যাসল ফার্ম বিয়েট্রিক্স দিয়ে যান ন্যাশনাল ট্রাস্টকে। তারা অবিকৃতভাবে এই সম্পত্তি সংরক্ষণ করে আসছে। তার নিজ আবাস পরিণত হয় জাদুঘরে। ১৯৪৬ সালে জাদুঘর উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। একই বছর মার্গারেট লেন বিয়েট্রিক্সের স্বামী হিলিসের সহায়তা নিয়ে প্রকাশ করেন তার জীবনীগ্রন্থ।  

১৯৬৭ সালে বিয়েট্রিক্সের প্রাথমিক জীবনে আঁকা ছত্রাকের কিছু ছবি ইংল্যান্ডের ছত্রাক বিষয়ক বইয়ে অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৯৭ সালে লিনিয়ান সোসাইটি বিয়েট্রিক্সের প্রতি তাদের অপমানজনক আচরণের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করে।

বিয়েট্রিক্সের ডায়েরি

সাংকেতিক ভাষায় লেখা বিয়েট্রিক্সের ডায়েরির কথা বহু বছর ছিল অজানা।১৯৫২ সালে তার এক আত্মীয় স্টেফানি ডিউক এর খোঁজ পান। দুর্ভাগ্যজনকভাবে কেবল ১৮৯১-৯৭ সাল অবধি লেখা ডায়েরির অংশই টিকে ছিল। স্টেফানি এই লেখার রহস্য উদ্ধারে লেসলি লিন্ডার নামে এসেক্সের এক ব্যবসায়ীর শরণাপন্ন হন।

লেসলি লিন্ডার ছিলেন বিয়েট্রিক্স পটারের লেখার অন্যতম বড় ভক্ত। টানা পাঁচ বছর প্রিয় লেখিকার ডায়েরি নিয়ে পড়ে রইলেন তিনি। এরপর সংকেত ভাঙার চাবি পেয়ে গেলেন। আরো চার বছর নেন পুরো ডায়েরি সহজবোধ্য করে তুলতে। এরপর সবকিছু সাজিয়ে গুছিয়ে ১৯৬৬ সালে প্রকাশ করেন। 

বিয়েট্রিক্স পটারের ডায়েরিতে তিনি লিখে গেছেন শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান, প্রকৃতি, সমাজ ও রাজনীতি নিয়ে তার না বলা ভাবনাগুলো। এতে ফুটে উঠেছে বিয়েট্রিক্সের পাওয়া-না পাওয়ার বেদনাও। এতটাই পরিশীলিত ছিল তার লেখাগুলো যে এরপর সমালোচকেরা তাকে কেবল শিশুতোষ গল্পের লেখিকা না বলে একজন পরিপূর্ণ সাহিত্যিক হিসেবে স্বীকৃতি দেন।

মূল্যায়ন

বিয়েট্রিক্স পটার সব মিলিয়ে লিখেছেন ২৩টি শিশুতোষ বই। এর মধ্যে পিটার র‍্যাবিট আলাদাভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রতি বছর বিয়েট্রিক্সের প্রায় চার মিলিয়ন বই বিক্রি হয়, যা প্রতি মিনিটে প্রায় চারটি।

মিস পটার চলচ্চিত্র; image source: fr.fanpop.com

শিশু সাহিত্যে পিটার র‍্যাবিটের গল্প সম্ভবত সর্বাধিক পঠিত। মায়ের আদেশ অমান্য করে বিপদে পড়া, অ্যাডভেঞ্চার এবং শেষে নিরাপদে বাড়ি ফিরে আসার এই কাহিনীর কোনো না কোনো অংশের সাথে বেশিরভাগ মানুষই তাদের ছোটবেলার কোনো না কোনো ঘটনার যোগসূত্র খুঁজে পান। তাই পিটার র‍্যাবিটের আবেদন আজও হারায়নি। সমালোচকদের চোখেও শিশুতোষ সাহিত্যে বিয়েট্রিক্স পটারের অনবদ্য সৃষ্টি পিটার র‍্যাবিট অনেক সময় তার স্রষ্টাকেই ছাপিয়ে যায়।

পিটার র‍্যাবিট; image source: amazon.com

লেখিকা ছাড়াও পরিবেশবাদী এবং ছত্রাক বিষয়ে বিয়েট্রিক্স পটারের অবদান নিয়ে মূল্যায়ন হচ্ছে। হলিউডও পিছিয়ে নেই। ২০০৭ সালে বিয়েট্রিক্স পটারকে উপজীব্য করে নির্মাণ করা হয়েছে মিস পটার চলচ্চিত্র। ২০১৮ সালে পর্দায় আসে পিটার র‍্যাবিটকে নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্র। এই বছরেই যার সিকুয়েল মুক্তি পেয়েছে।

Related Articles