Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বিস্তৃত জীবনের খোঁজে শাহাদুজ্জামান

এক

“আমি কোনো কবি হতে চাইনি, কোনো ছোট গল্পকার হতে চাইনি, প্রাবন্ধিক হতে চাইনি, ঔপন্যাসিকও হতে চাইনি”

এক সাক্ষাৎকারে এমনটাই বলেছিলেন পশ্চিমের মেঘে সোনার সিংহ দেখতে পাওয়া লেখক শাহাদুজ্জামান। তবে কি তিনি বেড়ে উঠতে চেয়েছেন কেবল একজন সাহিত্যিক হিসেবে? বোধহয়, হ্যাঁ। সাহিত্যাঙ্গনে সকল ধারার মিশ্রণকে নিংড়ে তিনি নিজেকে পরিচয় করিয়েছেন কেবল একজন সার্থক লেখক হিসেবে, যাকে তিনি বলেছেন ‘হরাইজন্টাল লেখক’।

তিনি হলেন সেই হরাইজন্টাল লেখক, যিনি সাহিত্যের অনেক ধারাকে একই সুতোয় গেঁথে তৈরি করেছেন সাহিত্যমালা, যিনি নানা আঙ্গিকের ছোট ছোট উপাদানকে এক করে তৈরি করেছেন তার স্বকীয় সাহিত্য বাগান। 

প্রতিটি শাখাকে স্পর্শ করেছেন তার কোমল হাতে, কখনোবা আঘাত করেছেন তার শব্দের অপরিসীম শক্তি দিয়ে, কখনোবা এসব শাখা-প্রশাখার দেয়াল ভেঙে চুরমার করে দিয়েছেন। তিনি সাহিত্যকে সংজ্ঞায়িত করেছেন সম্পূর্ণ এক ভিন্ন আঙ্গিকে,

“সাহিত্য হলো অক্ষরের ভেতর দিয়ে একটি দ্বিতীয় জীবন তৈরি করা।”

ইহজগতের মানুষ এক জীবনে সীমাবদ্ধ থাকলেও তিনি বিশ্বাস করেন, একটা জীবনের মধ্য দিয়েও হাজারটা জীবনকে যাপন করা সম্ভব কেবল সাহিত্য জগতে। সাহিত্যের সুন্দরতম সংজ্ঞা বোধহয় তিনি দিয়েছেন তার গল্প লেখার পেছনে মূল ভাবনাটি প্রকাশের মাধ্যমে। শব্দের পাশে শব্দ বসালে যে সাহিত্যের সৃষ্টি হয় না, তা তিনি আমাদের বুঝিয়েছেন অতি সুনিপুণভাবে। তিনি বলেন,

“গল্পদাদুরা যে গল্প বলে, সে গল্প আমি বলতে চাই না, আমি বলতে চেয়েছি যে, আমার গল্পটা শেষ করার পরে পাঠকের মনে কোনো গল্প থাকবে না, বরং একটি ভাবনা থাকবে।”

কথার সাথে কাজের শতভাগ মিল রেখে হরহামেশা বৈচিত্র্যময় সব ভাবনা দিয়ে তিনি তাড়িত করেছেন তার পাঠকদের। সমসাময়িক সমাজকে ভাবতে বাধ্য করার কাজই বোধহয় সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ দিক। এছাড়াও পাঠককে এক বিচিত্র দ্বন্দ্বে ফেলে দেওয়া যেন তার লেখার দৈনন্দিন বৈশিষ্ট্য। ‘মৃত্যু সম্পর্কে আমার অবস্থান খুব পরিষ্কার’, ‘কতিপয় ভাবুক’ গল্পে যেমন পাঠকের মানসপটে এক গভীর দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে, ঠিক তেমনই ‘আয়নার ওপিঠ লাল’, ‘মিথ্যা তুমি দশ পিঁপড়া’, ‘স্যুট টাই অথবা নক্ষত্রের দোষ’, ‘পৃথিবীতে হয়তো বৃহস্পতিবার’ সহ নানান গল্প পাঠককে এক নিবিড় ভাবনায় তাড়িত করেছে, গল্প শেষ হবার পরও পাঠককে স্থির করে জীবনের নাজুক সে বাস্তবতার সামনে এনে দাঁড় করিয়ে ভাবতে বাধ্য করার কাজটি সর্বদাই লেখক করেছেন অতি যত্ন সহকারে।

দুই

লেখক শাহাদুজ্জামানের লেখালেখির হাতেখড়ি তার বাবার হাত ধরেই। কিছুটা পারিবারিক এবং কিছুটা ব্যক্তি জীবনের পরিবেশ তাকে ধীরে ধীরে গড়ে তুলেছে ব্যক্তি শাহাদুজ্জামান থেকে কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামান হিসেবে। এসব কিছু তার লেখক হওয়ার সহায়ক হলেও তার লেখার পেছনে আরও কিছু বিষয় ভীষণভাবে তাড়িত করেছে। অনেক জায়গায় তিনি উল্লেখ করেছেন, তার লেখালেখির মূল প্রণোদনা হলো আকস্মিকতা, জীবন জিজ্ঞাসা কিংবা জীবন সম্পর্কে কৌতূহল। তিনি যখন আকস্মিকতার বিষাদময় প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন, ঠিক তখনই আকস্মিকভাবে ১৯৯৬ সালে বাংলা সাহিত্যে অবতরণ ঘটে কয়েকটি বিহ্বল গল্পের।

৩৬ বছর বয়সে প্রকাশ করেন তার প্রথম বই ‘কয়েকটি বিহ্বল গল্প’। যে আকস্মিকতার বিষাদময় প্রেমে লেখক শাহাদুজ্জামানকে গ্রাস করে তুলেছিল, তার দেখা মেলে তার প্রকাশিত প্রথম বইয়ের প্রথম গল্প- ‘এক কাঁঠাল পাতা আর মাটির ঢেলার গল্প’।

এক পৃষ্ঠার এই অণুগল্পটি কতজন উপলব্ধি করেছেন, কিংবা কতজন কেবল নিছক এক সাধারণ গল্প হিসেবে পাঠ করেছেন- তা মাঝে মাঝে চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু অতি সাধারণ এই গল্পটি দু’টি ভিন্ন ভাবনা, দু’টি ভিন্ন বোধ জাগ্রত করার দাবি রাখে। প্রথম ভাবনাটি তৈরি হতে পারে গল্পটি নিয়ে, আর দ্বিতীয় ভাবনাটি তৈরি হতে পারে গল্পকারকে নিয়ে। প্রথম ভাবনা ব্যাখ্যার স্বার্থে গল্পটির শেষ অংশটি তুলে ধরা হলো- 

“… একদিন এক কাঁঠাল পাতা আর মাটির ঢেলার মধ্যে বন্ধুত্ব হয়ে গেল। কাঁঠাল পাতা মাটির ঢেলাকে বললো, যেদিন বৃষ্টি নামবে আমি তোমায় ঢেকে রাখবো আর মাটির ঢেলা কাঁঠাল পাতাকে বললো, যেদিন ঝড় উঠবে সেদিন আমি তোমায় আটকে রাখবো। তারপর দিন যায়। বৃষ্টি এলে কাঁঠাল পাতা ঢেকে রাখে মাটির ঢেলাকে আর ঝড় উঠলে মাটির ঢেলা আটকে রাখে কাঁঠাল পাতাকে। কিন্তু একদিন কী যে হলো, একই সথে শুরু হলো ঝড় আর বৃষ্টি। ঝড়ে কাঁঠাল পাতা উধাও হয়ে গেল আকাশে আর বৃষ্টিতে মাটির ঢেলা আবার হারিয়ে গেল মাটিতে…” 

‘এক কাঁঠাল পাতা ও মাটির ঢেলার গল্প’ দিয়ে তিনি পাঠকদের জীবনের আকস্মিকতার এক গভীর বোধের মধ্যে ফেলে দিয়েছেন। তবে ঝড় আর বৃষ্টির মতো কত কত হঠাৎ ঘটে যাওয়া কোনো এক মুহূর্ত যে একটি জীবনে কতটা আলোড়ন সৃষ্টি করে, তা নিয়ে আমাদের ভাবতে বাধ্য করেছেন লেখক শাহাদুজ্জামান। 

লেখক শাহাদুজ্জামান; Source: Facebook

দ্বিতীয় ভাবনার জায়গাটিতে স্থান পেয়েছে খোদ গল্পটির স্রষ্টা শাহাদুজ্জামান। এ  লেখার শুরুটির দিকে দৃষ্টিপাত করলে সে ভাবনার জায়গাটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তিনি যেকোনো গল্পকার, অনুবাদক, কবি কিংবা প্রাবন্ধিক হতে চাননি- তার একটি দলিল মিলতে পারে এই কাঁঠাল পাতা আর মাটির ঢেলার গল্পটির মধ্য দিয়ে। এটিকে গল্প বললেও লেখক শাহাদুজ্জামান তার গল্পটি শুরু করেছেন প্রবন্ধ লেখার আঙ্গিকে এবং শেষ হওয়ার আগমুহূর্ত পর্যন্ত লেখাটি প্রবন্ধের সব বৈশিষ্ট্য ধারণ করলেও আকস্মিকভাবে প্রবন্ধ থেকে ঢুকে পড়েছেন গল্পে। গল্পটি সে আকস্মিকতা ধারণ করে পাঠককে মগ্ন করেছে গভীর ভাবনায়৷ পরিধিকে অতিক্রম করে দেখবার কিংবা আঙ্গিকের নিরীক্ষা করবার প্রবণতা যে সার্বক্ষণিক তার মানসপটে ঘুরপাক খেতে থাকে, এটি হয়তো তারই বহিঃপ্রকাশ। 

তিন

আকস্মিকতার সাথে সাথে শাহাদুজ্জামান তার লেখায় বলতে চেয়েছেন বিশ্বাস-অবিশ্বাসের গল্প, দ্বিধান্বিত ভাবনার গল্প। বিষাদময় দ্বন্দ্ব দ্বারা প্ররোচিত করতে চেয়েছেন পাঠককে। লেখকের ব্যক্তি অভিজ্ঞতা সাহিত্যমঞ্চে উঠে আসা অসাধারণ কিছু নয়। লেখকের দ্বিধান্বিত হওয়ার গল্প বলতে গেলে চলে যেতে হয় তার প্রথম বই প্রকাশেরও অনেক আগে, অদূর অতীতে। যে অতীত জানত না, শাহাদুজ্জামানের শেষ গন্তব্য কোথায়। সেই অতীতে তাকে দেখা যায় একজন দাবাড়ু হিসেবে।

স্কুল-কলেজ জীবনের দাবা খেলার নেশা তাকে জেঁকে ধরে, বেশ গুরুত্বের সাথে নিয়েছিলেন তিনি দাবা খেলাকে। নিজেকে প্রস্তুত করেছিলেন একজন গ্র্যান্ডমাস্টার হিসেবে। তবে কাঁঠাল পাতা আর মাটির ঢেলার গল্পের মতো এক ঝোড়ো বাতাস কোনো একদিন যেন সে নেশা উড়িয়ে নিয়ে গেল। পরে মেডিক্যাল জীবনে তিনি ছুটলেন গানের দিকে, রবীন্দ্র বিমোহিত হয়ে বেছে নেন গান করাকে। চট্টগ্রাম রেডিওতে নিয়মিত গান করতেন, পুরস্কারও জিতেছেন অনেক। গানের গুরু ছিলেন ওস্তাদ প্রিয়দারঞ্জন।

একদিন গুরু তার অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে শিষ্যকে বলেছিলেন,

“গান বড় কঠিন নেশা, এর ভেতর ঢোকো না। গান ছেড়ে দাও। মেডিকেলের পড়াশোনায় মনোযোগ দাও।”

এরপর সত্যিই তিনি ছেড়ে দেন গান। লেখক হওয়ার পেছনে যেমন তার বাবার ছায়া দেখা যায়, ঠিক তেমন দাবা খেলার হাতেখড়িও হয়েছিল বাবার হাত ধরেই, গান করাতেও যেন বরাবরের মতোই ছায়া হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন তার বাবা। গানের পর যে তীব্র নেশা তার জাগে, তা ফিল্মের নেশা। চলচ্চিত্রকে বরং পেশা হিসেবেই নিতে চেয়েছিলেন তিনি। জীবনের দোটানায় কিংবা পারিবারিক বন্ধনের টান অথবা নিজের দ্বিধান্বিত সব প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে চলচ্চিত্রকার হয়ে ওঠা হয়নি তার।

চলচ্চিত্র নির্মাতা না হলেও তাকে এখনো সক্রিয় দেখা যায় চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলন এবং সিনেমার চিত্রনাট্য লেখায়। চলচ্চিত্র নিয়ে একটি বইও বের করেছিলেন। তার বেশ কিছু গল্প নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে এবং এদের মধ্যে আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়েছে ‘কমলা রকেট’।

বলছিলাম দ্বিধান্বিত হওয়ার গল্প, শাহাদুজ্জামানের উপর কোন দ্বিধা ভর করেছিল, তা বোঝা মুশকিল। এ সময়টাতে তার মধ্যে দেখা মিলেছে রহস্যজনক এক মুড সুইংয়ের। বিস্তৃত জীবনের খোঁজেই যেন তিনি বিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন। নেশা আর আনন্দের সেই দ্বন্দ্বে শাহাদুজ্জামান বিস্তৃত জীবনের খোঁজ পেয়েছিলেন লেখায়। নেশা আনন্দের সৃষ্টি করে, নাকি আনন্দ মানুষকে নেশাগ্রস্ত করে তোলে- তা নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে; কিন্তু শাহাদুজ্জামান যে লেখায় নেশা এবং আনন্দ দুটিই খুঁজে পেয়েছিলেন, তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।

বিহ্বলতাকে সঙ্গে করে শাহাদুজ্জামান ছুটলেন দ্বিধান্বিত পথে, যে পথের গন্তব্য অমীমাংসিত, সিদ্ধান্তহীনতার মায়াজাল থেকে নিজেকে মুক্তি দিতে নিজের দ্বন্দ্ব এবং অমীমাংসিত পথ ছেড়ে দিলেন পাঠকের জন্য। গন্তব্যহীন সে যাত্রায় কোনো এক পাঠক গন্তব্যে পৌঁছানোর নেশায় ছটফট করতে করতে হয়তো লিখে বসলেন-

‘…কাকে সত্য বলা যায়? কাকে মিথ্যে? 

আকাশের ক্যানভাসে আঁকা নীল নাকি কালো মেঘ? 

বাষ্প হয়ে উড়ে যাওয়া অশ্রু নাকি শিশির বিন্দু? 

সবই তো জল,

সবই তো মেকি! কেন সৃষ্টি করে দ্বিধা?’

সব বিহ্বলতা, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব তিনি ঢেলে দিয়েছেন তার গল্পগুলোতে আর এই ক্যাথারসিসই যেন তাকে বিহ্বলতা থেকে ধীরে ধীরে মুক্তি দিতে থাকে। এর ধারাবাহিকতায় তিন বছর পর ১৯৯৯ সালে জীবনানন্দের জন্মশত বর্ষে প্রকাশ করেন তার দ্বিতীয় বই ‘পশ্চিমের মেঘে সোনার সিংহ।’ বইটির শুরুটি ছিল ১৮৯৯ শিরোনামে এক অণুগল্প দিয়ে, যা জীবনানন্দকে নিয়েই লেখা। 

চার

জীবনানন্দের প্রতি বিশেষ অনুরাগ কিংবা জীবনানন্দ যে শাহাদুজ্জামানের উপর ভর করেছিলেন- তা থেকে মুক্তি পেতেই ২০১৭ সালে তিনি প্রকাশ করেন জীবনানন্দের উপর লেখা বই ‘একজন কমলালেবু’। বইটির একটি অংশ প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৬ সালে প্রথম আলোর ঈদসংখ্যায়। এপার-ওপার দুই বাংলায় বহুল প্রশংসিত হয়েছে ‘একজন কমলালেবু’ বইটি। যেমন প্রশংসিত হয়েছে, ঠিক তেমনই অনেক জায়গায় সমালোচিতও হয়েছেন। তবে সবচেয়ে বেশি যে বিতর্কটা সৃষ্টি হয়েছিল, তা হলো বইটি জীবনী না উপন্যাস তা নিয়ে। যদিও বিতর্কটা নিরর্থক বলেই মনে হয়।

কারণ, ধারাকে ভেঙে ফেলার যে আকুতি তিনি নিজের মাঝে এখনো ধরে রাখেন, তা ২০১৭ সালে এসেও তিনি বুঝিয়েছেন ‘একজন কমলালেবু’র মধ্য দিয়ে। তিনি বলতে চেয়েছেন—

‘আমি কোনো উপন্যাস লিখতে আসিনি, আমি কোনো জীবনবৃত্তান্ত লিখতে আসিনি, চোখ দিয়ে কেবল দেখতে চেয়েছি আমার প্রিয় কবি জীবনানন্দকে, কেবল মনের গহীনে আঁকতে চেয়েছি তার প্রতিচ্ছবি, অক্ষরের মধ্য দিয়ে পেতে চেয়েছি তার সান্নিধ্য এবং কলমে সৃষ্ট করতে চেয়েছি কেবল একটা সাহিত্যকর্ম।”

একজন কমলালেবু বইয়ের প্রচ্ছদ; Source: Quora

ধারাকে যেমন ভাঙতে চেয়েছেন, সাথে আঙ্গিকের নিরীক্ষা করার যে অভ্যাস, সে অভ্যাসের পুনরায় দেখা মেলে ‘একজন কমলালেবু’র মধ্য দিয়ে, বইটি যে ফর্মে প্রকাশিত হয়েছে, তা ছাড়াও আরও দু’টি ভিন্ন ভিন্ন ফর্মের নিরীক্ষা তিনি করেছিলেন বইটি লেখার সময়। এই দুই অদ্ভুত তাড়না যেন হরহামেশাই শাহাদুজ্জামানের মাঝে ধ্রুব হয়ে রয়ে গেছে; এ ধ্রুবতাই যেন তাকে দিয়েছে এক অনন্য স্বকীয়তা। 

জীবনানন্দকে নিয়ে শাহাদুজ্জামানের ভাবনা ছিল অনেকটা এমন-

‘…তাঁর চোখটা বিশেষভাবে টানে আমাকে। চোখের দৃষ্টির ভেতর অদ্ভুত এক ব্যাপার আছে। মনে হয় তিনি যেন পথ ভুলে এই পৃথিবীতে এসেছেন। তাঁর অন্য কোথাও থাকার কথা ছিল, অন্য কোন সময়ে। আসলে জীবনানন্দ সময়ের অনেক আগেই যেন পৃথিবীতে এসেছিলেন। কিছু কিছু প্রাণী থাকে তাদের ঘ্রাণশক্তি বা দৃষ্টিশক্তি প্রখর। তারা অনেক দূরের ঘ্রাণ পায়, কিংবা দেখতে পায় বহুদূরের কোনো দৃশ্য। জীবনানন্দকে পড়ে আমার মনে হয়েছে, তিনি যে সময়ে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁর থেকে বহুদূরের পৃথিবীর ঘ্রাণ তিনি পেতেন, দৃশ্য তিনি দেখতে পেতেন…’ 

অদ্ভুত মায়াবী চোখ জোড়া, যে চোখ বিশেষভাবে টেনেছিল শাহাদুজ্জামানকে, সে চোখ জোড়া দিয়েই তিনি বাঁধিয়েছেন একজন কমলালেবুকে- বইয়ের প্রচ্ছদে। জীবনানন্দের সুদুরপ্রসারী সে চোখের দিকে তাকিয়েই শাহাদুজ্জামান দেখতে চেয়েছেন জীবনানন্দকে। কতটা নিবিড় পর্যবেক্ষণ করে শাহাদুজ্জামান কলমের কালিতে জীবনানন্দকে ধারণ করতে চেয়েছিলেন, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। 

জীবনানন্দের রেশ যে কেটে ওঠেননি, তা তার ব্যবহৃত অনেক শব্দের মাঝে বোঝা যায়। যে শব্দটি তিনি বহুল ব্যবহার করেন, তার নাম ‘বোধ’। যে বোধের কথা শাহাদুজ্জামান বারবার উল্লেখ করেন তার বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে, তা মূলত জীবনানন্দ হতেই সংক্রমিত। জীবনানন্দের ‘বোধ’ কবিতাটি লেখক তাকে এতটা আলোড়িত করেছে, যেন তিনি এখনো সেই বোধের সন্ধানেই জীবনের এক অতল সমুদ্রে ডুব দেন। কবিতাটি সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি লিখেছিলেন- 

”…বোধ কবিতার ভেতর দিয়ে জীবনানন্দ তখন পেয়ে গেছেন তাঁর এক পৃথিবীর খোঁজ, পেয়েছেন তাঁর কন্ঠস্বর। মূল স্রোতের বাইরে পেয়ে গেছেন তাঁর অজ্ঞাতবাসের ডেরা। এই অজ্ঞাতবাস থেকে পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে যেন তিনি নতুন করে চিনতে পারছেন সব। নিজের অস্তিত্বের সঙ্গে বাইরের পৃথিবীর অস্তিত্বের দ্বন্দ্বকে মোকাবিলার একটা পথ যেন পেয়েছেন তিনি…”

জীবনানন্দ যেমন তার ‘বোধ’ কবিতার মধ্য দিয়ে পেয়ে গেছেন পৃথিবীর খোঁজ, পথ পেয়েছেন নিজের ও পৃথিবীর অস্তিত্বের সাথে মোকাবিলা করার; লেখক শাহাদুজ্জামান কি সে বোধের সন্ধানেই লিখে যাচ্ছেন সহস্রকাল? নাকি জীবন জিজ্ঞাসার ভিন্ন ভিন্ন বোধের মাঝখানে তিনি খুঁজে পান তার কণ্ঠস্বর? তিনি কি বলতে চান, 

 ‘…মাথার ভিতরে 

স্বপ্ন নয়- প্রেম নয়- কোন এক বোধ কাজ করে

 আমি সব দেবতারে ছেড়ে

 আমার প্রাণের কাছে চ’লে আসি,

 বলি আমি এই হৃদয়ের :

সে কেন জলের মতো ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!’

পাঁচ

জীবনানন্দ ছাড়া শাহাদুজ্জামানের প্রিয় লেখক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। ‘কথা পরম্পরা’ বইটি তিনি উৎসর্গ করেছিলেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে। পছন্দের মানুষদের মাঝে শহীদুল জহির এবং হাসান আজিজুল হককে তিনি বহুবার স্মরণ করেছেন বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে। তিনি নিজেও সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এবং হাসান আজিজুল হকের। কোনো এক সাক্ষাৎকারে প্রশ্নকর্তা শাহাদুজ্জামানকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, এ সময়ে এসে তিনি কারও সাক্ষাৎকার নিতে চান কি না। উত্তরে শাহাদুজ্জামান ব্যক্ত করেছিলেন শহীদুল জহিরের একটি সাক্ষাৎকার নেওয়ার প্রবল ইচ্ছের কথা। কিন্তু শহীদুল জহিরের অকালমৃত্যু বাংলা সাহিত্যকে বঞ্চিত করল একটি গুরুত্বপূর্ণ কথোপকথন থেকেও। শহীদুল জহিরের লেখার বিষয়, ধরন, ভাষার নান্দনিকতা ব্যবহারের কথা অকুণ্ঠচিত্তে তিনি বহুবার উল্লেখ করেছেন এবং এক জায়গায় বলেছিলেন-

“শহীদুল জহিরকে আমি বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ লেখক মনে করি।”

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস; Source: Prothom Alo

ছয়

সব দেবতারে ছেড়ে জীবনানন্দের মতো শাহাদুজ্জামানও যেন প্রাণের কাছে চলে আসেন ‘মামলার সাক্ষী ময়না পাখি’ বইটিতে। কয়েকটি বিহ্বল গল্পের ‘অগল্প’ গল্পটিতে লেখক যেমন তার সর্তকতা, গল্প ভাঙার অভিনব জাদু দেখিয়েছেন; গল্পের নাটকীয়তা, অপ্রত্যাশিত সংবাদের বহুল ব্যবহার এবং গল্পের আঙ্গিক নিয়ে পাঠকদের সচেতন করতে চেয়েছেন, গল্প লেখার ভঙ্গিমার উপর জোর দিতে চেয়েছেন, বিহ্বলতাকে প্রকাশ করেছেন- তার অনেকটাই মেলেনি ‘মামলার সাক্ষী ময়না পাখি’তে। ‘কয়েকটি বিহ্বল গল্প’, ‘পশ্চিমের মেঘে সোনার সিংহ’, ‘কেশের আড়ে পাহাড়’- এই বইগুলোতে তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়েছিলেন সাহিত্যর খুব সূক্ষ্ম কাজের উপর, কিন্তু ‘মামলার সাক্ষী ময়না পাখি’ বইটিতে তিনি যেন এসবের উর্ধ্বে উঠে ছুঁতে চেয়েছেন কেবল জীবনের সত্যকে।

অদেখা, তবে ধ্রুব সব প্লট নিয়ে হাজির হলেন পাঠকের কাছে, জীবনের ধূসর আয়নার সামনে পাঠককে এনে দিয়ে বলতে চেয়েছেন হয়তো- “এবার তোমরা ভাবো”। সর্তকতা নয়, বরং স্বতস্ফূর্ততার সাথে যেন তিনি লিখলেন এ বইয়ের প্রতিটি গল্প। গল্পগুলোর মধ্যে নিঃসন্দেহে যে গল্পটি সবার মনে দাগ কাটার মতো, তা হলো ‘মৃত্যু সম্পর্কে আমার অবস্থান খুব পরিষ্কার’ গল্পটি। ‘পৃথিবীতে হয়তো বৃহস্পতিবার’ গল্পে তিনি শোনালেন অভিনব এক চুরির গল্প। বায়বীয় চুরি যে আমাদের জীবনে কতটা সাধারণ এবং নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার, তারই এক চিত্র আঁকলেন রিকশার পর্দায়। পার্থিব সব ভাবনাকে পেছনে ফেলে খুব কাছ থেকে দেখতে চাইলেন জীবনের বাস্তবতাকে, রোজ যে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের ভেতর দিয়ে মানুষ তার জীবনকে যাপন করে, তার সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণের দেখা মেলে বইটিতে। 

তবে ‘মামলার সাক্ষী ময়না পাখি’ বইটিতে লেখক একেবারে নতুন রূপে নিজেকে উপস্থাপন করেছেন, এমন চর্চা বহু জায়গায় দেখা গেলেও এটি পুরোপুরি সঠিক নয়। পার্থিব সব ভাবনাকে পেছনে ফেলে তিনি এবার নিত্য-নৈমিত্তিক সব দ্বিধা-দ্বন্ধ দ্বারা তাড়িত করতে চেয়েছেন পাঠকদের। ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত ‘কতিপয় ভাবুক’ গল্পটি যেমন পাঠককে গভীর ভাবনায় মজিয়েছে, ঠিক তেমনই ২৩ বছর পরের গল্প ‘অপস্রিয়মাণ তীর’ পাঠককে নিয়ে গেছে গন্তব্যহীন এক ভ্রমণে।

দুই গল্পের পার্থক্য করা যায় হয়তো কেবল জীবনের দূরত্ব দিয়ে। বলা যায়, একটি গল্প জীবনের খুব কাছের আরেকটি জীবন থেকে খানিকটা দূরের, নৈতিকতার কোটরে যাকে স্থান দেওয়া যায়। এছাড়াও ‘কয়েকটি বিহ্বল গল্প’ বইয়ের শেষ গল্প মারাত্মক নিরুপম আনন্দ এবং ২০১৯ সালের প্রকাশ পাওয়া ‘মামলার সাক্ষী ময়না পাখি’ বইয়ের শেষ গল্প নাজুক মানুষরে সংলাপ যেন একই সুতোয় গাঁথা। শাহাদুজ্জামান যে তার স্বকীয়তা ধ্রুবক হিসেবে এখনো বহাল রেখেছেন নিজের মাঝে, তা-ই কি তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন ‘মামলার সাক্ষী ময়না পাখি’র পাণ্ডুলিপির এক অনন্য আয়োজন দিয়ে, নাকি জীবনের ৬১তম বছরে পা রেখে জীবনানন্দের মতো বলতে চান?—

‘হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,

সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে

অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে

সেখানে ছিলাম আমি, আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে….’

This article is in Bangla. It is about a prolific Bengali author named Shaduz Zaman.

References: 

1. Interview- https://youtu.be/Of10VOCvS8g 

2. Book: কয়েকটি বিহ্বল গল্প

3. Interview (2019)- http://www.teerandaz.com/

4. Book: একজন কমলালেবু

5.Interview of Shahaduz Zaman published in Jibonanondo Potrika, 2018.  

6. Interview of Shahaduz Zaman published in Bonik Barta, 2019. 

Featured Image: event.quantummethod.org.bd 

Related Articles