এক
কোনো এক ভোরবেলা, রাত্রিশেষে শুভ শুক্রবারে
মৃত্যুর ফেরেস্তা এসে যদি দেয় যাওয়ার তাকিদ
অপ্রস্তুত এলোমেলো এ গৃহের আলো অন্ধকারে
ভালোমন্দ যা ঘটুক, মেনে নেব এ আমার ঈদ৷
১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ তারিখ রাতে কবি আল মাহমুদ মারা গিয়েছেন৷ উপরের পঙক্তিগুলো তাঁরই লেখা স্মৃতির মেঘলাভোর কবিতার অংশ৷
দীর্ঘদিন বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে ভুগেছেন৷ নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে শরীর বেশি খারাপ যাওয়ার ফলে কিছুদিন আগে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়৷ রাত দশটার দিকে লাইফ সাপোর্ট দেয়া হয়েছিল তাকে, কিন্তু শেষমেষ ইবনে সিনা হাসপাতালে, গতকাল রাত এগারোটা পাঁচ মিনিটে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে ওপারে পাড়ি জমিয়েছেন কবি আল মাহমুদ৷
দুই
আল মাহমুদের নামটা মাথায় আক্ষরিক অর্থেই গেঁথে যাওয়ার কথা শিশু-কিশোরদের৷ ক্লাস থ্রিতে তার লেখা একুশের কবিতা নামে একটা কবিতা ছিল বাংলা বইতে৷ সেই কবিতার শেষ চার লাইন এখানে তুলে দিচ্ছি,
প্রভাতফেরী, প্রভাতফেরী
আমায় নেবে সঙ্গে,
বাংলা আমার বচন, আমি
জন্মেছি এই বঙ্গে৷
এই কবিতার প্রত্যেকটা লাইন, প্রতিটা অক্ষর থেকে বিষাদ ঠিকরে পড়ে৷ যেন দূর পরবাসে কিংবা নির্বাসন থেকে কেউ একজন তার সমস্তটুকু দিয়ে নিজের অধিকার বুঝে পেতে চাইছে৷ বলতে চাইছে, বাংলা আমার ভাষা, আমার অধিকার৷
একুশের চেতনা যে কী, সেটা তখন থেকেই কিছুটা বুঝতে শিখে যাওয়ার কথা শিশুদের৷ আবার, পাখির মতো কবিতাটিও আল মাহমুদের লেখা।
তোমরা যখন শিখছ পড়া
মানুষ হওয়ার জন্য,
আমি নাহয় পাখিই হবো,
পাখির মতো বন্য৷
ছোটবেলায় এই কবিতাটা মনে মনে বিড়বিড় করে আবৃত্তি করেনি, এমন মানুষ সহজে খুঁজে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। শেকল, সমাজ-সংসারের বাধা- এসব কিছু ভুলে নিজের ইচ্ছেমতো কিছু করার কথা বলেছেন তিনি। এই এক কবিতা দিয়ে আল মাহমুদ শিশুদের মাথার মধ্যে সমস্ত বাঁধ যেভাবে ভেঙে দিতে চেয়েছেন, সেটা খুব সহজ কাজ নয়৷ এই মানুষটির অনেক কবিতাই দারুণভাবে বাঁধ ভেঙে, বৃত্ত ভেঙে বেরিয়ে যাওয়ার কথা বলে৷ মানুষটি নিজেও তো সেটাই করেছেন৷ নিজের মতো জীবন যাপন করেছেন৷ কারো কথায় কর্ণপাত করেননি৷
যত যা-ই হোক, যে যা-ই বলুক, বাংলা ভাষায় আল মাহমুদ নামে একজন কবি ছিলেন, এ কথা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না৷
তিন
একজন কবিকে স্মরণ করতে হয় তার কবিতায়৷ আল মাহমুদ উপন্যাস লিখেছেন, ছোট গল্প, প্রবন্ধ, নিবন্ধ- এসবও লিখেছেন৷ কিন্তু তিনি ছিলেন পুরোদস্তুর কবি৷ সেজন্য এই লেখার মূল আলোচনা তার কবিতা, তার কবি জীবন৷
তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ লোক লোকান্তর৷ বইটার ‘নাম কবিতা’টি উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ানো হয়৷ কবিতাটা সবাই পড়েছে৷ তারপরেও শ্রদ্ধা জানানোর জন্য কয়েকটা লাইন একটু তুলে দেয়া যাক৷
যখনি উজ্জ্বল হয় আমার এ চেতনার মণি,
মনে হয় কেটে যাবে, ছিঁড়ে যাবে সমস্ত বাঁধুনি
সংসার সমাজ ধর্ম তুচ্ছ হয়ে যাবে লোকালয়৷
লোক থেকে লোকান্তরে আমি যেন স্তব্দ হয়ে শুনি
আহত কবির গান৷ কবিতার আসন্ন বিজয়৷
এই আহত কবি কে? আল মাহমুদ নিজেই কি?
আগেই বলেছি, তার লেখা কবিতায় বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে এসব বাধা থেকে বেরোনোর গল্প৷ তবে, যারা দেখেও দেখে না, চোখ বন্ধ করে থাকে- কবিতায় তাদের ব্যাপারে তার ক্ষোভ টের পাওয়া যায়৷ মাতৃছায়া কবিতায় তিনি লিখেছেন,
পোকায় ধরেছে আজ এ দেশের ললিত বিবেক
মগজ বিকিয়ে দিয়ে পরিতৃপ্ত পন্ডিত সমাজ৷
ভদ্রতার আবরণে কতদিন রাখা যায় ঢেকে
যখন আত্মায় কাঁদে কোনো দ্রোহী কবিতার তাজ?
আর, আমাদের চোখ বুজে বই গেলার নিরানন্দ জীবন নিয়ে তাঁর ভীষণ রাগ টের পাওয়া যায় হায়রে মানুষ কবিতায়৷
তারপরে যে কী হলো, এক দৈত্য এসে কবে
পাখনা দুটো ভেঙ্গে বলে মানুষ হতে হবে৷
মানুষ হওয়ার জন্য কত পার হয়েছি সিঁড়ি
গাধার মতো বই গিলেছি স্বাদ যে কি বিচ্ছিরি৷জ্ঞানের গেলাস পান করে আজ চুল হয়েছে শণ
কেশের বাহার বিরল হয়ে উজাড় হলো বন৷
মানুষ মানুষ করে যারা মানুষ তারা কে?
অফিস বাড়ির মধ্যে রোবট কলম ধরেছে৷
এই যে ভয়াবহ ‘মানুষ’, এমন মানুষ হওয়ার ইচ্ছে তার কোনোদিনই ছিল না৷ ছড়ায় যেমন বলেছেন আগেও, তেমনি এই কবিতার শেষে এসেও তিনি বলেন,
‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস’- গান শোননি ভাই?
মানুষ হওয়ার ইচ্ছে আমার এক্কেবারে নাই৷
ব্যক্তির স্বাধিকার এমন করে বারবার খুব বেশি মানুষের কলমে কি বের হতে দেখা গেছে এই বাংলায়?
চার
১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মোড়াইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আল মাহমুদ৷ পুরো নাম, মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ৷ কুমিল্লার দাউদকান্দিতে সাধনা হাইস্কুলে পড়েছেন কিছুদিন৷ পরে চট্টগামের সীতাকুণ্ড হাইস্কুলে পড়াশোনা করেছেন৷ ছাত্রাবস্থাতেই কবিতা লেখা শুরু করেছিলেন৷ তার কবিতায় জীবনের প্রায় প্রতিটি দিকই উঠে এসেছে৷ প্রধান উপজীব্য ছিল বাংলা জীবন, চিরন্তন প্রেম-বিরহ, মৃত্যু ইত্যাদি৷ মৃত্যু নিয়ে লেখা সোনালি কাবিন তার সবচেয়ে বিখ্যাত সৃষ্টি৷
একাত্তরের পরে দৈনিক গণকণ্ঠে যোগ দিয়েছিলেন সম্পাদক হিসেবে৷ সরকারবিরোধী লেখা লিখে বছরখানেকের জন্য গিয়েছেন কারাগারেও৷ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাকে শিল্পকলা একাডেমির গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগের সহপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব দেন৷ দীর্ঘদিন এই দায়িত্ব পালন করে পরবর্তীতে বিভাগটির পরিচালক হয়েছিলেন তিনি৷ অবসর নিয়েছেন তিরানব্বইতে৷ বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, একুশে পদক, জীবনানন্দ স্মৃতি পুরস্কারসহ বেশ কিছু পুরস্কার পেয়েছেন তিনি৷
ব্যক্তিজীবনে আল মাহমুদের যে সংগ্রাম, তা কিন্তু এখান থেকে বোঝা যায় না৷ ধর্মপ্রাণ মানুষ ছিলেন৷ কিন্তু সেজন্য তার কবিতাকে অস্বীকার করা, তাকে জোর করে অবহেলার যে চেষ্টা, সেটা খুব দুঃখজনক৷ প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল তার সাক্ষাৎকার৷ নিয়েছিলেন নাসির আলী মামুন৷ সেই সাক্ষাৎকারের শিরোনাম ছিল: বইহীন পৃথিবী আমি কল্পনা করতে পারি না ৷ সেই সাক্ষাৎকারে মামুন প্রশ্ন করেছিলেন,
“ওপার বাংলায় আপনার আদর্শ এবং লেখা নিয়ে লেখক-সাহিত্যিকদের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জানেন কিছু?” কবি বেশ দীর্ঘ একটি উত্তর দিয়েছেন৷ শেষ করেছেন এই বলে,
কলকাতায় তো আমাকে কেউ মৌলবাদী বলে না!
মামুন জিজ্ঞাসা করেছিলেন, যারা বিভিন্নভাবে রবীন্দ্রনাথকে বাতিল করে দিতে চায়, সেটা কতটুকু ঠিক? আল মাহমুদ উত্তরে বলেছেন,
তাকে অস্বীকার করা যায় না৷ তিনি অনেক বড় লেখক৷ যারা করে, তারা বোকামি করে৷ আধুনিক বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠাতা রবীন্দ্রনাথ৷
যে মানুষটির প্রথম কবিতা প্রকাশ করে দিয়েছিলেন বুদ্ধদেব বসু, সেই মানুষটি যে কবিতার আকাশের রত্ন হবেন, তা তো বোঝাই যায়৷ এই বুদ্ধদেবের হাত ধরেই প্রকাশিত হয়েছে জীবনানন্দের কবিতাও৷ অগ্রজদের থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে কী পেয়েছেন, এই প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, পাঠ করার অভ্যাস৷
সত্যি বলতে, আরেকটি জিনিস পেয়েছিলেন আল মাহমুদ৷ কবিতা বুঝতে শিখেছিলেন তিনি৷ বুঝেছিলেন, দর্শন বা দৃষ্টিভঙ্গি না মিললে কবিদেরকে অস্বীকার বা অবহেলা করা যায় না৷ অথচ সেই মানুষটিকে কী অবলীলায় অবহেলা করেছি আমরা দিনের পর দিন!
আফসোস করে আল মাহমুদ যখন বলেন, অনেক কিছু লিখতে চেয়েছিলেন তিনি৷ পারেননি৷ বিরাট সংসারের বোঝা কাঁধে টেনেছেন৷ ভালো চাকরি দেয়নি তাকে কেউ৷ শ্রম দিয়েছেন প্রচণ্ড, অথচ উপেক্ষিত হয়েছেন বারবার৷
সাক্ষাৎকারের এই অংশটা আরেকটা প্রশ্ন এবং উত্তর দিয়ে শেষ করি৷
মামুন: আপনার সম্পর্কে শহীদ কাদরীর ভাষ্য, টায়ার কাটা স্যান্ডেল, গোলাপ ফুল আঁকা টিনের বাক্স নিয়ে ঢাকায় এসেছিলেন আপনি- এমনই তো জানি আমরা৷
মাহমুদ: সে আমাকে ঠাট্টা করত এবং বলত৷ সেই বাক্সের মধ্যে প্রকৃতপক্ষে সারা বাংলাদেশ ছিল৷ শহীদ এখন ঢাকায় থাকলে আমি দেখা করতাম৷ সে তো কবি৷
একজন মানুষ একটা দেশকে বুকের ভেতরে এরচেয়ে ভালো আর কীভাবে ধারণ করতে পারেন?
আল মাহমুদের বিখ্যাত সোনালী কাবিনের কিছু লাইন বলে শেষ করি:
প্রেম কবে নিয়েছিল ধর্ম কিংবা সংঘের শরণ
মরণের পরে শুধু ফিরে আসে কবরের ঘাস
যতক্ষণ ধরো এই তাম্রবর্ণ অঙ্গের গড়ন
তারপর কিছু নেই, তারপর হাসে ইতিহাস৷
মৃত্যুর পরের জীবনে বিশ্বাস করতেন কবি৷ প্রিয় কবি, আপনার ওপারের জীবন ছন্দ মধুর কাব্য হাতে নিয়েই কাটুক- এটুকুই চাওয়া৷