সারা পৃথিবীর মানুষ যেসব গ্রন্থাগারকে একনামে চেনে, ‘দ্য লাইব্রেরি অব কংগ্রেস’ সেগুলোর মধ্যে অন্যতম। এই গ্রন্থাগারে প্রায় ৪৭০ ভাষার ১৬৪ মিলিয়নের অধিক বই, জার্নাল ও সংবাদপত্রসহ নানা নথিপত্র সংরক্ষিত রয়েছে, বিশ্বের মধ্যে যা বৃহত্তম এবং অনন্য।
বিভিন্ন বিষয়ের বই থরে থরে সাজানো, যার যে বই দরকার, কম্পিউটারের সাহায্যে মুহূর্তে এনে হাজির করে দেয়ার ব্যবস্থা আছে এখানে। এই গ্রন্থাগারের সংগ্রহশালার তাকগুলো পাশাপাশি সাজালে তা প্রায় ৫৩২ মাইল দীর্ঘ হবে, এমনই বিশাল এই গ্রন্থাগার। এর আর্কিটেকচারাল ডিজাইনও এককথায় অসাধারণ। প্লেটো, নিউটন, শেক্সপিয়রের মতো প্রতিভাধরদের লেখা বই-ই শুধু নয়, তাদের পূর্ণ অবয়বের মূর্তি এই গ্রন্থাগারের বিভিন্ন তলায় সাজিয়ে রাখা আছে।
অবস্থান
গ্রন্থাগারটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডি.সি.-তে অবস্থিত। এখানকার ‘ক্যাপিটল’ প্রাসাদের কাছাকাছি একটি পাড়া জুড়ে তিন-তিনটি বিশালাকার বাড়িতে চলছে এই গ্রন্থাগারের বিস্ময়কর কর্মযজ্ঞ। ওয়াশিংটন ডি.সি.র কেন্দ্রস্থল ক্যাপিটল প্রাসাদ, আমেরিকার কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধান কর্মকেন্দ্র। তারই খুব কাছে সদা চঞ্চল ইনডিপেন্ডেন্স অ্যাভিনিউ ও তার পেছনের সেকেন্ড স্ট্রিট পর্যন্ত জায়গা জুড়ে বিশাল টমাস জেফারসন বিল্ডিং। পাশাপাশি ইনডিপেন্ডেন্স অ্যাভিনিউয়ের অন্য ফুটপাতে ম্যাডিসন মেমোরিয়াল বিল্ডিং। আর জেফারসন বিল্ডিংয়ের পেছনে, সেকেন্ড স্ট্রিটের অন্যদিকের ফুটপাতে জন অ্যাডামস বিল্ডিং।
এই পাশাপাশি তিনটি বাড়িতে উপরের রাস্তা দিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু অবিরাম চলতে থাকা বাস ও গাড়ির স্রোত এবং নিরন্তর পথচলতি মানুষের ভিড় এড়ানোর জন্য এই তিনটি বাড়িতে যাওয়ার সুবিধার্থে রাস্তার তলা দিয়েও সুড়ঙ্গ নির্মাণ করা হয়েছে। সেই সুড়ঙ্গপথে দিন-রাত সবসময় আলো জ্বলছে, পড়ুয়ারা এ-বাড়ি থেকে ও-বাড়িতে যাচ্ছেন। শুধু তা-ই নয়, বই ভর্তি ছোট আকারের মোটর ট্রাকও এ-বাড়ি থেকে ও-বাড়িতে যাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে।
যেভাবে গড়ে উঠলো এই লাইব্রেরি
আজকের এই বৃহৎ প্রতিষ্ঠান ‘দ্য লাইব্রেরি অব কংগ্রেস’ একদিনে গড়ে ওঠেনি। এর বয়স বলতে গেলে প্রায় ২১৮ বছর। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকান রাষ্ট্রপতি জন অ্যাডামস যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকারের কার্যক্রম ফিলাডেলফিয়া থেকে ওয়াশিংটন ডিসিতে সরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে কংগ্রেস থেকে অনুমোদন নেন। ওয়াংশিংটন ডিসি হয়ে ওঠে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন রাজধানী।
এই সময় ওয়াশিংটন ডিসিতে কংগ্রেসম্যানদের নানা ধরনের তথ্য সংগ্রহ ও বইপত্র ব্যবহারের জন্য কোনো উপযুক্ত গ্রন্থাগার ছিল না। ফলে রাষ্ট্রপতি অ্যাডামস কেবল কংগ্রেস সদস্যদের ব্যবহারের জন্য মাত্র ৫ হাজার ডলার ব্যয়ে একটি ছোট লাইব্রেরি স্থাপনের জন্য কংগ্রেস থেকে অনুমোদন নেন। তার পরবর্তী প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসন হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভ থেকে দুজন সদস্যকে এই লাইব্রেরি পরিচালনার জন্য নিয়োগের বিধান অনুমোদন করান।
এরপর অনুমোদিত অর্থে ইংল্যান্ড থেকে ১১ ট্রাঙ্ক ভর্তি বই আর ১ ট্রাঙ্ক ম্যাপ এনে ক্যাপিটল প্রাসাদের যেটুকু অংশ তখন তৈরি হয়েছিল তারই একপাশে ছোট আকারের লাইব্রেরিটি স্থাপিত হয়। প্রথমে শুধু কংগ্রেসের লোকদের ব্যবহারের জন্যই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এটি, নামও রাখা হয়েছিল ‘দ্য লাইব্রেরি অব কংগ্রেস’। কালক্রমে এর আকৃতি ও সংগ্রহের বিশালত্বের সাথে সাথে লাইব্রেরির দরজা খুলে দেয়া হয়েছে সর্বসাধারণের জন্য।
১৮১৪ সালে ইংরেজ সৈন্যরা তাদের মার্কিন উপনিবেশ রক্ষার চেষ্টায় ওয়াশিংটনে এসে ক্যাপিটল প্রাসাদে কেন্দ্রীয় সরকারের মূল দফতরটি অধিকার করে নেয় এবং লাইব্রেরি অব কংগ্রেস সম্পূর্ণ পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর আবার সেই পুড়ে যাওয়া লাইব্রেরি নতুন করে গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়।
যেভাবে পরিধি বাড়তে লাগলো
ব্রিটিশ সৈন্যরা লাইব্রেরি অব কংগ্রেস পুড়িয়ে দেয়ার পর গ্রন্থাগারটি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত কোনো বই সে সময় রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে যুদ্ধ শেষ হলে লাইব্রেরিটি নতুন করে গড়ে তোলার জন্য কংগ্রেস থেকে পুনরায় ব্যবস্থা নেয়া হয়।
লাইব্রেরির জন্য প্রথম তৈরি হয় জেফারসন বিল্ডিং
১৮৯৭ সালে জেফারসন বিল্ডিংয়ের নির্মাণ কাজ শেষ হয়। ৫০ জন সুনির্বাচিত স্থপতি, ভাস্কর ও চিত্রকর লাইব্রেরি বাড়িটি নিখুঁত ও শিল্পমন্ডিত করে গড়ে তোলেন। অন্য বাড়ি পরে তৈরি হয়। এই তিনটি বাড়ির মধ্যে জেফারসন বিল্ডিং বয়সে সবচেয়ে পুরনো। তারপরও বাড়িটি অতি সুন্দরভাবে সাজানো। ইতালীয় স্থাপত্যরীতিতে তৈরি এই জেফারসন বিল্ডিংয়ের সবচেয়ে বড় পড়ার ঘরটি তিন তলায়।
বাড়িটির মেঝে থেকে পাথরের স্তম্ভগুলো ১৬০ ফুট উঁচু। শুধু এই একটি হলেই ৪৫,০০০ হাজারেরও অধিক রেফারেন্স বই আছে। ২১২ জন পাঠক একসাথে বসে পড়তে পারেন এই একটি হলঘরে। এটি ছাড়া আরও পড়ার ঘর আছে। প্রতিটি ডেস্কে পৃথক আলো, আরামদায়ক চেয়ারের ব্যবস্থা আছে। এত পাঠকের ভিড়, কিন্তু গোটা হলঘর নিস্তব্ধ, নিরিবিলি পরিবেশ। কেউ কাউকে বিরক্ত করছে না। যে যার মতো করে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। পাশেই কম্পিউটার ক্যাটালগ সেন্টার। সেখানে দলে-দলে লোক কম্পিউটার টার্মিনালে তার প্রয়োজনীয় বিষয়টি জেনে নিচ্ছেন।
জন অ্যাডামস বিল্ডিং
জেফারসন বিল্ডিংয়ে লাইব্রেরির স্থান সঙ্কুলান না হওয়ায় এই বাড়ির পেছনে, রাস্তার অন্য পারে তৈরি হয় জন অ্যাডামস বিল্ডিং, ১৯৩৯ সালে। সেটি জেফারসন বিল্ডিংয়ের মতো অত জাঁকজমকপূর্ণ না হলেও বাড়ির সামনের দিক সুন্দর মার্বেল পাথরে মোড়া আর তার প্রধান প্রবেশপথে ব্রোঞ্জের বিরাট দরজা। তাতে শোভা পাচ্ছে বারোটি মনুষ্য-মূর্তি। এই চমৎকার মূর্তিগুলো সেসব ঐতিহাসিক পুরুষদের, যারা পৃথিবীর নানা দেশে লেখার হরফ আবিষ্কার করেছিলেন।
বাড়ি জেমস ম্যাডিসন মেমোরিয়াল বিল্ডিং
জন অ্যাডামস বিল্ডিংয়েও যখন লাইব্রেরির স্থান সঙ্কুলান হলো না, তখন তৈরি করতে হয় আরও একটি বাড়ি। জেফারসন বিল্ডিংয়ের পাশাপাশি ইনডিপেন্ডেন্স অ্যাভিনিউয়ের অন্য দিকে সেই নতুন বাড়ি জেমস ম্যাডিসন মেমোরিয়াল বিল্ডিং, নির্মিত হয় ১৯৮০ সালে। ফলে গোটা লাইব্রেরি অব কংগ্রেসের স্থান-পরিধি দ্বিগুন হয়ে যায়। এই তিনটি বৃহৎ বাড়ি ছাড়াও অন্যত্র এই লাইব্রেরির কর্মকেন্দ্র আছে। এই তিন বিল্ডিং মিলে সাধারণ পাঠকদের জন্য ২১টি পড়ার রুম রয়েছে।
যেভাবে সংগৃহিত হলো দুষ্প্রাপ্য বই ও ম্যাপের এক আশ্চর্য সংগ্রহশালা
প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেফারসন তখন মনটিচেলোতে অবসর দিনযাপন করছেন। তিনি যখন ফ্রান্সে মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে ছিলেন, তখন সেখানকার দোকানে ঘুরে ঘুরে আমেরিকা সম্পর্কে বহু দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ সংগ্রহ করে এনে নিজের লাইব্রেরিতে রেখেছিলেন। ১৮১৪ সালের পর যখন লাইব্রেরি অব কংগ্রেস নতুন করে গড়ে তোলার কার্যক্রম শুরু হলো, তখন তিনি কংগ্রেসকে জানালেন, তার বইগুলো তিনি এই লাইব্রেরিতে দিতে ইচ্ছুক। তারা যে দাম দিতে পারবেন তাতেই তিনি সেই অমূল্য বইগুলো লাইব্রেরিকে দিয়ে দেবেন। কংগ্রেস মাত্র ২৩,৯৫০ ডলারে ৬,৪৮৭টি বাছাই করা বই জেফারসনের কাছ থেকে লাইব্রেরির জন্য কিনে নেয়। এভাবেই শুরু লাইব্রেরির জন্য বই সংগ্রহের কার্যক্রম।
ধীরে ধীরে বাড়তে লাগলো লাইব্রেরির সংগ্রহশালা। লাইব্রেরিতে প্রায় ৪৭০টি ভাষার বই সংরক্ষিত রয়েছে। এখানে ২.৯ মিলিয়নের মতো আইনের বই, প্রায় ৭ লক্ষের মতো উত্তর আমেরিকান অঞ্চলের বই, সাড়ে সাত লক্ষের মতো ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন ভাষার বই সংরক্ষিত আছে। আফ্রিকা ও মধ্য এশিয়া বিভাগে রয়েছে ৬ লক্ষের অধিক বই। এশিয়ান বিভাগের রয়েছে প্রায় ৩ লক্ষের মতো বই। শুধু তা-ই নয়, প্রায় দেড় কোটির ওপর বই ও পুস্তিকা আছে, আছে সাড়ে তিন কোটির ওপর পান্ডুলিপি ও পুঁথি, যার মধ্যে আমেরিকার রাষ্ট্রপতিদের কাগজপত্র, বিখ্যাত লেখক ও শিল্পীদের পান্ডুলিপি ও চিত্রও রয়েছে। এমনকি বিজ্ঞানীদের আবিষ্কারের খসড়াও এতে আছে।
এছাড়াও এখানে আছে চল্লিশ লক্ষের ওপর ম্যাপ, যা খ্রিস্টীয় চতুর্দশ শতাব্দী থেকে একেবারে হাল আমল পর্যন্ত। আর আছে ষাট লক্ষ গানের স্বরলিপি, চিঠিপত্র, বাদ্যযন্ত্র, রেকর্ড, টেপ, ক্যাসেট ইত্যাদি। আছে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকা এক কোটির মতো নানা দুষ্প্রাপ্য ছবি ও ফটোগ্রাফ এবং বারোশ খবরের কাগজের নিয়মিত সংখ্যার ফাইল। প্রায় আড়াই লক্ষের ওপর চলচ্চিত্র ও ডকুমেন্টরি ফিল্ম এখানে আছে। এই সবকিছুই নিয়মিতভাবে প্রদর্শিত হয়ে থাকে। এছাড়া স্থায়ীভাবে দেখানো হয় লাইব্রেরির অমূল্য সংগ্রহ দুটি বাইবেল- গুটেনবার্গের ছাপা বাইবেল আর মেইনজের হাতে আঁকা ছবিসহ বিরাট আকারের বাইবেল।
লাইব্রেরি অব কংগ্রেসের উপর দায়িত্ব রয়েছে সারা আমেরিকার যেখানে যত বই প্রকাশিত হয় তার গ্রন্থস্বত্ব অনুমোদন করার। এই লাইব্রেরি থেকেই সমস্ত নতুন বইয়ের ক্যাটালগ প্রকাশিত হয় এবং দেশের অন্যান্য লাইব্রেরিতে তা সরবরাহ করা হয়। লাইব্রেরিটিকে ডিজিটাল করার জন্য ২০০৭ সালে লাইব্রেরি অব কংগ্রেস কর্তৃপক্ষের সাথে ইউনেস্কোর এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
এই সংগ্রহ থেমে নেই। প্রতি মিনিটে গড়ে ১০-১৫টি বিষয়ের বই, কাগজপত্র প্রভৃতি সংগ্রহ করা হচ্ছে সেখানে, অর্থাৎ এই গ্রন্থাগারে দৈনিক গড়ে বারো হাজারেরও বেশি নানা আইটেম সংগৃহীত হচ্ছে।
বড়দিন ও ১ জানুয়ারির ছুটি ছাড়া বছরের আর সব দিনই এই লাইব্রেরি খোলা থাকে। পড়বার ঘর, প্রদর্শনী, ফিল্ম শো, এমনকি সারা লাইব্রেরি ঘুরিয়ে দেখাবার ব্যবস্থাও রয়েছে। লাইব্রেরি থেকে প্রতিদিনই ‘Calendar of Events’ নামে ছাপা বিবরণী প্রকাশিত হয়। লাইব্রেরির মধ্যেই বিশ্রাম করার ঘর বা খাওয়া-দাওয়া করার জন্য ক্যাফেটেরিয়া পর্যন্ত রয়েছে।
বই পড়বার সময় না পেলে শুধু জেফারসন বিল্ডিংয়ের সিড়ি, গ্যালারি, প্রদর্শনী, চিত্রশালা- এসব খুঁটিয়ে দেখলেও বহু তথ্য জানা যায়। লাইব্রেরির নিজস্ব বিক্রয় বিভাগ থেকে কেনা যায় বিভিন্ন বিষয়ের প্রয়োজনীয় সব বই। কোনো বইয়ের তথ্য জানার জন্য কম্পিউটারের সাহায্য নেয়া যায়। এই লাইব্রেরিতে নিয়মিতভাবে নানা ডকুমেন্টরি ফিল্ম দেখানো হয়, গান-বাজনা শোনানোর ব্যবস্থা রয়েছে। যার যেদিকে আগ্রহ সে যেন সেই দিকের সুবিধাগুলো ভোগ করতে পারে সেই ব্যবস্থা রাখা হয়েছে এই গ্রন্থাগারে। আর তাই লাইব্রেরি অব কংগ্রেস তার নিজস্ব স্বকীয়তা নিয়ে এগিয়ে চলছে বছরের পর বছর।
ফিচার ইমেজ- slate.com