“দোহাই তোদের, একটুকু চুপ কর
ভালোবাসিবারে দে মোরে অবসর।”
মনে পড়ে লাইন দু’টো? ‘শেষের কবিতা’ পড়তে গিয়ে সাহিত্যপ্রেমীদের মনে বারবার ঢেউ তুলবেই এই লাইন দু’টি। নান্দনিক এই পংক্তিটি রবি ঠাকুর অনুবাদ করেছিলেন এক মোহনীয়, অন্তর্ভেদী ইংরেজি কবিতা ‘The Canonization’ থেকে। মূল লাইনটি হলো-
“For God’s sake hold your tongue and let me love…”
সেই মূল কবিতার লেখক জন ডানের কথাই বলছি। ‘শেষের কবিতা’য় রবীন্দ্রনাথ একাধিকবার তার নাম নিয়েছেন। যে ক’জন বিদেশী কবি দ্বারা কবিগুরু প্রভাবিত ছিলেন, তাদের মধ্যে একেবারে প্রথমদিকে থাকবে জন ডানের নাম। বলার অপেক্ষা রাখে না, জন ডান ইংরেজি সাহিত্যের অতি গুরুত্বপূর্ণ একজন কবি। ইংরেজি সাহিত্যে আধিবিদ্যামূলক কবিতা তথা ‘Metaphysical Poem’ এর জনক বলা হয় তাকে। ধারাটির নাম কঠিন হলেও বস্তুটি বড়ই মধুর। আর ডানের মধুতে যে একবার মজেছে, তার নেশা আজীবন কাটানো অসম্ভব। চলুন এই কালজয়ী কবির জীবন ও কর্ম নিয়ে কিছু কথা জেনে নেয়া যাক।
জন ডানের জন্ম ১৫৭২ সালের ২২ জানুয়ারি, লন্ডনে। ইংল্যান্ড জুড়ে সেই সময় ভয়ানক ক্যাথলিক-বিদ্বেষ চলছে। এমন এক সময়ে এক ক্যাথলিক পরিবারেই জন্ম নেন ডান। জন ডানের বাবার নামও ছিল জন ডান; আর তার মা এলিজাবেথ হেইউড ছিলেন আরেক বিখ্যাত ইংরেজ নাট্যকার ও সাহিত্যিক জন হেইউডের মেয়ে। “All is well that ends well”, “Beggars should not be choosers”, “Rome was not built in a day”, “Out of sight out of mind” -প্রভৃতি বিখ্যাত ইংরেজি সব প্রবাদ জন হেইউডের কাছ থেকেই পাওয়া। ধর্মবিশ্বাসের কারণে নিপীড়িত সম্প্রদায়ে জন্ম হবার কারণেই হয়তো ঈশ্বর ও আধ্যাত্মবাদের সাথে গভীর এক বন্ধন গড়ে উঠেছিল জন ডানের। তার সৃষ্টিকর্মে সে আধ্যাত্মিকতার উপস্থিতি প্রকট। যেমন-
“…But am betrothed unto your enemy;
Divorce me, untie or break that knot again,
Take me to you, imprison me, for I,
Except you enthrall me, never shall be free,
Nor ever chaste, except you ravish me.”
‘Batter My Heart’ নামের এই সনেটে কবি ঈশ্বরকে ডেকে বলছেন,
“আমি তোমার শত্রুর (শয়তান) বাগদত্তা হয়ে গেছি, তার সাথে আমার বন্ধন ছিন্ন করো,। আমায় বন্দী করো, কারণ তুমি আমায় দাসত্বে না জড়ালে আমার মুক্তি হবে না। তুমি আমায় ভোগ না করলে (আত্মার দখল না নিলে) আমি সতী (শুদ্ধ) হবো না।
এমনই অনন্য সব প্রহেলিকাময় উপমা ও রূপকে নিজের আধ্যাত্মবাদ ও প্রেমময়তা জাহির করেছেন জন ডান।
ডানের বয়স যখন চার বছর, তখন তার বাবা সিনিয়র ডান মারা যান। তার মা পরে এক বিত্তবান বিপত্নীককে বিয়ে করেন। শিক্ষাজীবনে জন ডান অক্সফোর্ড ও ক্যামব্রিজে পড়াশোনা করেছেন; কিন্তু দু’টির কোনোটি থেকেই কোনো ডিগ্রী পাননি। কারণ, ক্যাথলিক হবার কারণে প্রোটেস্ট্যান্ট রানী এলিজাবেথের প্রতি বিশ্বস্ততার শপথ তিনি পাঠ করতে পারেননি। পড়াশোনার নিমিত্তে ডান স্পেন ও ইতালিও ঘুরে আসেন। ২০ বছর বয়সে তিনি লন্ডনের লিঙ্কন’স ইন-এ আইন পড়তে শুরু করেন। ১৪২২ সালে স্থাপিত লিঙ্কন’স ইন পৃথিবীর অন্যতম বিখ্যাত আইনজীবীদের সমাবেশ তথা আইনবিদ্যায় পারদর্শিতা অর্জনের স্বর্গভূমি বলা যায়। ১৫৯৬ সালে লিঙ্কন’স ইন থেকে বেরিয়ে ডান স্যার থমাস ইগারটনের সহকারী হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন। ইগারটন পরিবার তৎকালীন ইংল্যান্ডের অন্যতম বনেদী পরিবারগুলোর একটি এবং স্যার থমাস ইগারটন ছিলেন একজন বিশিষ্ট অভিজাত, প্রখ্যাত রাজনৈতিক নেতা এবং আদালতের বিচারক। তিনি ২১ বছর ধরে ব্রিটিশ রাজসভার ‘লর্ড কিপার’ এবং ‘লর্ড চ্যান্সেলর’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। লর্ড কিপার এর অধিকারে থাকতো ব্রিটেনের রাজকীয় সীল। আর লর্ড চ্যান্সেলর হলো রাজসভার রাজকর্মকর্তাদের মধ্যে সর্বোচ্চ পদ। অর্থাৎ প্রশাসনের সর্বোচ্চ ক্ষমতাটি ছিল তার পদাধিকারে। এমন বিশিষ্ট ব্যক্তির ছত্রছায়ায় ডানের পেশাগত জীবন ভালোই চলছিল। কিন্তু এর মাঝেই ঘটে যায় আরেক অনিবার্য ঘটনা। ১৬০১ সাল, জন ডান তখন পার্লামেন্টের সদস্যও নির্বাচিত হয়ে গেছেন। এ সময় গুরু ইগারটনের ষোড়শী ভাইঝি অ্যানি মুরের প্রেমে পড়েন ডান। অ্যানি মুর ছিলেন মূলত ইগারটনের দ্বিতীয় স্ত্রীর ভাই জর্জ মুরের মেয়ে। জর্জ মুর ছিলেন তখনকার ‘চ্যান্সেলর অব দ্যা গার্টার’। এই পদটি ছিল ইংল্যান্ডের নাইটদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণকারী ও তাদের বিভিন্ন কমিশন ও ম্যান্ডেটে সীল প্রদানের ক্ষমতা ধারণকারী একটি উচ্চমানের পদ। ডান জানতেন, কন্যার পিতা তার সাথে কন্যার পরিণয়ে কখনোই আশীর্বাদ করবেন না। বামন হয়ে চাঁদে হাত যে পৌঁছাবে না, তা তিনি জানতেন। কিন্তু প্রণয়পীড়িত মন তা মানতে নারাজ ছিল। আর তাই গোপনেই চাঁদকে ছুঁয়ে দেন ডান। ১৬০১ এর ডিসেম্বরে ডান অ্যানিকে বিয়ে করেন বলে ধারণা করা হয়। বলা বাহুল্য, এই ধৃষ্টতার কারণে সরকারি সম্মানসূচক চাকরিতে ক্যারিয়ার গড়ার ডানের সকল সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায়। কিছুদিন জেলবন্দী হয়ে শাস্তিও পেতে হয় তাকে। ভুল, ধৃষ্টতা কিংবা দুঃসাহস যা-ই বলা হোক না কেন, এই কাজের মাশুল ডানকে আসলে ভালোভাবেই গুনতে হয়েছিল। মাত্র ৩০ বছর বয়সে ডান পড়েছিলেন অথৈ জলে। ছিলো না কর্মসংস্থান, রাজসভার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সাথে কোন্দলে জড়িয়ে কোথাও কাজে ঢোকার উপায়ও তেমন ছিল না, হাতে যথেষ্ট পয়সাও ছিল না। এদিকে ঘরে ছিলেন সদ্যপরিণীতা স্ত্রী।
পরবর্তী ১০টি বছর ডান তীব্র দারিদ্র্য আর পরনির্ভরশীলতায় দিন কাটিয়েছেন। এদিকে পরিবারও বড় হচ্ছিল। অ্যানির গর্ভে দেখতে দেখতে ১২টি সন্তানের জন্ম হয়। এর মধ্যে ৫ জন প্রাপ্তবয়স্ক হবার আগেই মারা যায়। চরম দুরবস্থার মধ্যেও ডান লেখা এবং পড়া দুটোই চালিয়ে যান। তিনি ধর্মতত্ত্ব, যাজকীয় অনুশাসন ও ক্যাথলিকবিরোধীদের সমালোচনামূলক বিভিন্ন প্রবন্ধ লিখেন, লিখেন ধর্মীয় কবিতা এবং প্রেমের কবিতা। হৃদয়ছোঁয়া প্রেমের কবিতাগুলোর জন্য তিনি পেয়েছেন ‘Poet of Love’ উপাধি।
ডানের অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো কবিতায় ‘Metaphysical Conceit’ এর ব্যবহার। ‘Meta’ অর্থ ‘ঊর্ধ্বে’। Physical বা শারীরবৃত্তীয় তথা প্রাকৃত বা বস্তুগত পৃথিবীর ঊর্ধ্বে (beyond) বোঝাতে, অথবা আরও সহজ ভাষায় ‘অতিপ্রাকৃত’ বা ‘আধ্যাত্মিক’ ব্যপারটি বোঝাতে Metaphysical শব্দটি ব্যবহার করা হয়। আর ‘Conceit’ বলতে বোঝায় সুদূরবিস্তৃত কাল্পনিক তুলনা। কাজেই, ‘Metaphysical Conceit’ কথাটির অর্থ করা যায় ‘অতিপ্রাকৃত তুলনা’। এর শত শত উদাহরণ আছে ডানের বিভিন্ন কবিতা জুড়ে। যেমন ‘The Flea’ কবিতায় কবি তার প্রিয়তমাকে নিষেধ করছেন Flea (একধরনের রক্তপায়ী, রোগসৃষ্টিকারী পতঙ্গ)-কে মারতে। এই পতঙ্গটি তার ও তার প্রেমিকা উভয়ের রক্ত পান করেছে। কবির যুক্তি হলো, এই পতঙ্গটির দেহ একটি পবিত্র মন্দিরের মতো, যেখানে তাদের উভয়ের রক্তের মিলন হয়েছে। এ যেন বিবাহের চাইতেও বড় এক বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন তারা।
“This flea is you and I, and this
Our marriage bed, and marriage temple is…”
একটা পতঙ্গের দেহকে ফুলশয্যার সাথে তুলনা…এমন অভাবনীয় কিন্তু নান্দনিক কল্পনা ডানের দ্বারাই সম্ভব ছিল।
যে কবিতার লাইন দিয়ে লেখাটি শুরু করেছিলাম, সেই ‘The Canonization’ কবিতায় ডান বলেছেন,
“হায়, আমার ভালোবাসা কার ক্ষতি করেছে? কোন সওদাগরের জাহাজ ডুবিয়েছে আমার দীর্ঘশ্বাস? কে বলেছে যে আমার অশ্রু তার উঠান ডুবিয়ে দিয়েছে?”
“What merchant’s ships have my sighs drowned?
Who says my tears have overflowed his ground?”
ডানের মিনতি হলো, সবাই নিজের মতো কাজ করো আর আমাকে আমার মতো ভালোবাসতে দাও। ভালোবাসবার এ চির আকুতি তিনি নিজের মধ্যে প্রবলভাবে ধারণ করতেন।
‘The Sun Rising’ কবিতায় কবি তার ও তার প্রেয়সীর শয়নকক্ষকে অভিহিত করেছেন পৃথিবীর কেন্দ্র হিসেবে। তিনি সূর্যকে ডেকে বলছেন,
“তোমার কাজ যখন পৃথিবীকে ঊষ্ণতা দেয়া, তো আমাদের (কবি ও তার প্রেমিকা) ঊষ্ণতা দেয়াতেই সে কাজ তোমার পূর্ণ হয়ে গেছে। কারণ পুরো পৃথিবীটাই আমাদের মাঝে সংকুচিত হয়ে রয়েছে। আমাদের আলো দিলেই তোমার সর্বত্র আলো দেয়া হবে। আমাদের এই বিছানা তোমার কেন্দ্র, আর ঘরের দেয়ালগুলো হলো তোমার অক্ষরেখা।”
“Shine to us, and thou art everywhere;
These beds thy center is, these walls, thy sphere.”
এমন বিমূর্ত সব ধারণাকে সুনিপুণ কৌশলে জীবন্ত করে পাঠকের সামনে আনতে পেরেছিলেন বলেই ইংরেজি সাহিত্যে ডানকে বলা হয় ‘Master of Metaphysical Conceit’।
রাজসভায় কাজ পেতে জন ডান পরবর্তীতে অনেক চেষ্টা করেন। কিন্তু রাজা প্রথম জেমস পীড়াপীড়িতে ১৬১৫ সালে তার জায়গা হয় রাজগীর্জায়। পরে তিনি সেখানে রাজযাজক নিযুক্ত হন। রাজার আদেশবলে তিনি ক্যামব্রিজ থেকে ‘ডক্টর অব ডিভাইনিটি’ ডিগ্রীও পান। এর দু’বছর পরে, মাত্র ৩৩ বছর বয়সে ডানের দ্বাদশ সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে তার স্ত্রী অ্যানি মারা যান। দুঃখভারাক্রান্ত ডান বাকি জীবনটা একাই কাটানোর সিদ্ধান্ত নেন। ১৬২১ সালে দান সেইন্ট পল ক্যাথেড্রালের ডিন নিযুক্ত হন। এর পরবর্তী সময়ে লেখা তার কবিতাগুলোয় তার মৃত্যুচিন্তার উপস্থিতি লক্ষণীয়।
ষোড়শ শতকের প্রচলিত কাব্যরীতি থেকে ডানের কাব্যের ধরন ছিল আলাদা। তার জীবনের প্রথমদিকে লেখা গদ্যসাহিত্যগুলো ক্ল্যাসিকাল ল্যাটিন মডেল থেকে উদ্ভূত হলেও এগুলোর রীতি, গঠন ও বাক্যালঙ্কারে তার নিজস্ব পরীক্ষণের পরিচয় রয়েছে। তার বাক্য গঠন ও অতিপ্রাকৃত তুলনা পাঠককে নিমেষেই এক আলাদা আবেগমথিত জগতের দরজায় নিয়ে দাঁড় করিয়ে দেয়। আর এই দরজা ঠেলে সে আলাদা জগতে ঢুকতে সাহায্য করে তার সুদক্ষ সুচারু ছন্দবিন্যাস।
ডানের প্রথম দু’টি কবিতা সংকলন প্রকাশিত হয় তার মৃত্যুর পরে ১৬৩৩ ও ১৬৩৫ সালে। পরবর্তী ৯০ বছরে ৮ বার পুনর্মুদ্রিত হয় সেগুলো। ইংরেজি সাহিত্যের পরবর্তী যুগগুলোতে অ্যালেক্সান্ডার পোপ, রবার্ট ব্রাউনিং, টি এস এলিয়ট, ডব্লিউ বি ইটস প্রমুখ কবি-সাহিত্যিকদের ডানের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতে এবং ডান কর্তৃক গভীরভাবে প্রভাবিত হতে দেখা যায়। ৩১ মার্চ, ১৬৩১, জন ডান ইহলোক ত্যাগ করেন। তবে তিনি অমর থাকবেন চিরকাল নিজের তৈরী ছন্দে, অসীম সুন্দর কল্পনায়, প্রেম ও অনুভূতির সুগভীর আবেশে।