
ইতিহাস অনেক কিছুর নীরব সাক্ষী হয়ে প্রতিনিয়ত আমাদের সামনে উপস্থিত হয়। প্রজন্মের পর প্রজন্ম সেই ইতিহাস পৌঁছে দেওয়ার নীরব সাক্ষী একমাত্র বই। বিশ্বের বড় বড় ঘটনার পেছনে সত্যিই কি কোনো ষড়যন্ত্র রয়েছে? ঘটনাগুলো কি আদৌ ঘটেছিল?
দেশ-বিদেশের ঘটে যাওয়া নানা ষড়যন্ত্র নিয়ে রচিত হয়েছে কতশত বই। এসব বই লেখার পেছনে রয়েছে যেমন নানা অনুসন্ধান, তেমনি কিছু বই নিতান্তই বাজারের কাটতির জন্য রচিত হয়েছে। ইতিহাস সমৃদ্ধ, নানা অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদনে সমৃদ্ধ এসব ষড়যন্ত্রমূলক ঘটনা নিয়ে লেখা বই সাধারণ মানুষের মনের কৌতুহল নিবারণ করার ক্ষমতা রাখে। এসব বইয়ের পাতায় পাতায় খুলে যাবে যেকোনো আপাতসাধারণ ঘটনার পেছনের নানা দিক। ইতিহাসে ঘটে যাওয়া এমনই নানা ষড়যন্ত্র নিয়ে রচিত বইয়ের সন্ধান দেবো আজ আপনাদের।
১) হিস্ট্রি ডিকোডেড: দ্য টেন গ্রেটেস্ট কনস্পিরেসিস অফ অল টাইম – ব্র্যাড মেল্টজার
ষড়যন্ত্রের বেস্টসেলার ক্যাটাগরিতে সবার প্রথম নাম আসে ব্র্যাড মেল্টজারের লেখা এই বইয়ের। আব্রাহাম লিঙ্কনের হত্যারহস্য থেকে শুরু করে হোয়াইট হাউজের অন্দরের কাহিনী, সবই রয়েছে এর আলোচ্য তালিকায়। ‘দ্য ভিঞ্চি কোর্ড’-এর মাধ্যমে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি আসলে কেন সত্য গোপন করেছিলেন?

এরিয়া ৫১-এর ঘেরাটোপে আসলে কী সত্য লুকিয়ে থাকতে পারে? কেনেডির হত্যার পিছনের রহস্য কোনদিকে ইঙ্গিত করে? বইটিতে রয়েছে সবকিছু নিয়ে সবিস্তারে তথ্য। তুলামূলক আলোচনা করা হয়েছে কনস্পিরেসির নানা থিওরি নিয়ে। এসব বইয়ের পাতায়-পাতায় রয়েছে নানা রহস্যভেদী তথ্য-প্রমাণ, যেমন, ‘ভার্টিকান সিটি’র আসল ম্যাপ, জন এফ কেনেডির ডেথ সার্টিফিকেট ইত্যাদি।
২) কনস্পিরেসিস অ্যান্ড সিক্রেট সোসাইটি: দ্য কমপ্লিট দোসিয়ের – ব্র্যাড স্টেইগার
এনসাইক্লোপিডিয়া অফ কনস্পিরেসি বলতে যা বোঝায়, এই বইটি তা-ই। খুনের রহস্য, হারিয়ে যাওয়া প্রধান সাক্ষী, নানা বড় বড় ঘটনার পেছনের তথ্য-প্রমাণ, পৃথিবীর নানা গুরুতর রহস্যের পিছনে লুকিয়ে থাকা নানা অজানা ব্যাপার বিস্মৃতির অন্ধকার থেকে তুলে আনা হয়েছে এই বইয়ে। ‘ওয়ার্ল্ড পাওয়ার’ আমেরিকার নানা চেনা-অচেনা সংস্থা, বিশ্ব ব্যাংকের ভিতরের খবর, দ্য ইলুমিনাটি, সিক্রেট সোসাইটির ইত্যাদির নানা ব্যাপার খুব সহজভাবেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে এই বইয়ে।

৩) দ্য প্রিন্সেস ডায়ানা কনস্পিরেসি – অ্যালেন পাওয়ার
১৯৯৭ সালের ৩১ আগস্ট মধ্যরাতে দুর্ঘটনার কবলে পড়লো বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুন্দরী যুবরানী ডায়ানার গাড়ি। তখন তার সঙ্গী ছিলে দোদি আল ফায়েদ। ফায়েদের বাবার হোটেল ‘রিটজ’ থেকে বেরিয়ে গাড়ি ছুটছিল দোদির ফ্ল্যাটের দিকে। দোদির দুজন স্টাফও ছিলেন সেই গাড়িতে। দুর্ঘটনাগ্রস্থ হওয়ার পর দোদি এবং তার গাড়ির ড্রাইভার হেনরি সাথে সাথেই মারা যান। আহত হয়েও বেঁচে যান দোদির দুই স্টাফ। আর ডায়ানা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন দুর্ঘটনার তিন ঘন্টা পর।

এই মর্মান্তিক ঘটনাকে স্রেফ দুর্ঘটনা হিসেবে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু এই দুর্ঘটনায় এমন কিছু বিষয় উঠে আসে যা জোরালো ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত দেয়। এসব অজানা ষড়যন্ত্র নানা তথ্য-প্রমাণ সহকারে তুলে ধরতে চেয়েছেন লেখক অ্যালেন পাওয়ার তার ‘দ্য প্রিন্সেস ডায়ানা কনস্পিরেসি’ বইটিতে।
ডায়নার গাড়িটি যে জায়গায় বিধ্বস্ত হয় সে জায়গার ১৪টি সিসিটিভি ক্যামেরা থাকা সত্ত্বেও কেন দুর্ঘটনার ঠিকঠাক কোনো ফুটেজ উদ্ধার করা যায়নি, সাবধানী ডায়ানা সবসময় সিটবেল্ট আটকালেও কেন সেদিন সিল্টবেল্ট আটকাননি- এ ধরনের অসংখ্য যুক্তি দিয়ে লেখক প্রমাণ করতে চেয়েছেন, গাড়ি দুর্ঘটনায় ডায়ানা ও দোদির মৃত্যু নিছক কোনো দুর্ঘটনা নয়, এর পেছনে রয়েছে বহুদিনের সাজানো এক পরিকল্পনা।
৪) দ্য ম্যামথ বুক অফ কভারআপ্স : জন ই লুইস
লেখক বইটিতে এ পর্যন্ত বিশ্বে ঘটে যাওয়া ১০০টি সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রের নানা কাহিনী তুলে এনেছেন। বিভিন্ন সরকার এবং সংস্থার অন্দরের ষড়যন্ত্র তো রয়েছেই, কিন্তু এছাড়াও এমন অনেক ঘটনা রয়েছে যার চারপাশে কোনো রহস্যের গন্ধ না থাকলেও ব্যাপারগুলো আদ্যেপান্ত রহস্যজনক এবং রহস্যের শিকড় গিয়েছে কোনো ষড়যন্ত্রের গভীরের রাস্তা দিয়ে। প্রিন্সেস ডায়ানার মৃত্যু রহস্য থেকে শুরু করে ‘লকারবি বম্বিং’ পর্যন্ত ইতিহাসের প্রায় ১০০টি ষড়যন্ত্রের রোমহর্ষক কাহিনীর সাথে জড়িত সম্ভাব্য সত্যের সূত্র নিয়ে নানা আলোচনা উঠে এসেছে এই বইয়ে।

৫) হু আর দ্য ইলুমিনাটি? – লেন্ডসে পোর্টার
সপ্তদশ শতকের সবচেয়ে সাড়া জাগানো এক গুপ্তসঙ্ঘের নাম ইলুমিনাটি। ১৭৭৬ সালে প্রফেসর অ্যাডাম উইশল্ট এ দলটি তৈরি করেন। বিভিন্ন বিপ্লবই শুধু নয়, নাৎসি বাহিনীর উত্থানের পেছনেও নাকি ছিল এই দলের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা।

ইহুদি উচ্চবিত্তদের পাশাপাশি সোভিয়েত সাম্যবাদীদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মদত দিয়ে ইলুমিনাটি গ্রুপ বিশ্বকে ভাঙতে নাকি সক্ষম হয়েছিল। সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা এবং আমেরিকা বিরোধী উগ্রপন্থী- এই দুই তরফকেই মদত দেয় এই সিক্রেট সোসাইটি। এসব নানা বিষয় উঠে এসেছে লেন্ডসে পোর্টার রচিত ‘হু আর দ্য ইলুমিনাটি?’ নামক অনুসন্ধানমূলক বইটিতে।
৬) দ্য ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন
যদিও একেবারে সত্য ঘটনা অবলম্বনে নয়, তবু কনস্পিরেসি থিওরির প্রসঙ্গে ড্যান ব্রাউনের লেখা এই উপন্যাসের কথা উঠেই আসে। মেরি ম্যাগডালেন এবং হোলি ব্লাড-হোলি গ্রেইলের আসল রহস্যটা কী? এবং খ্রিস্টধর্মের ইতিহাসে মেরি মাগডালেন গুরুত্বপূর্ণ কেন? মেরি এবং যিশু খ্রিস্টের বংশধররাই কি পরবর্তীকালে মেরোভিঞ্জিয়া রাজবংশ সূচনা করেন? এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয়েছে এই বইয়ে।

প্লটটি কাল্পনিক হলেও এর মধ্যে যে অনেক ষড়যন্ত্রের পেছনের ঘটনার ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ এ ধরনের ব্যাখ্যা রয়েছে তা এই ‘কনস্পিরেসি ফিকশন’টি পড়লেই বোঝা যায়।
৭) মিডনাইট ওয়াচ – ডেভিড ডায়ার
১৯১২ সালে ডুবতে বসা জাহাজ টাইটানিক থেকে মাত্র কয়েক মাইল দূরত্বেই নাকি ছিল আরেকটি জাহাজ এসএস ক্যালিফোর্নিয়ান। টাইটানিক জাহাজ থেকে পাঠানো বিপদ সঙ্কেত দেখেও কোনো রকম ব্যবস্থা না নিয়ে স্রেফ উপেক্ষা করে গিয়েছিল তারা।

কেন বিপদসঙ্কেত পাওয়ার পরেও এসএস ক্যালিফোর্নিয়ানের ক্যাপ্টেন তা উপেক্ষা করে জাহাজটিকে নিয়ে এগিয়ে গেলেন– তা অনুসন্ধানে নামেন এক বোস্টন রিপোর্টার। টাইটানিকের বিয়োগান্তক ঘটনা এবং সংবাদের পেছনের নানা ঘটনার অনুসন্ধানের চেষ্টা নিয়ে রচিত ডেভিড ডায়ারের এক অসমান্য উপন্যাস ‘মিডনাইট ওয়াচ’।
৮) লিবরা – ডন ডিলিলো
বিশ্বের সবচেয়ে বড় ধরনের ষড়যন্ত্র ঘটেছে আমেরিকার ৩৫তম রাষ্ট্রপতি জন এফ কেনেডির হত্যা নিয়ে। ১৯৬৩ সালের ২২ নভেম্বর কেনেডিকে ডালাসের ইলেকশন ক্যাম্পেইনে গুলিবিদ্ধ করে লি অসওয়াল্ড নামক এক ব্যক্তি। কেনেডি হত্যার অল্প কিছু পরেই ধরা পড়ে সেই ব্যক্তি। আসলে কি এই মৃত্যুর জন্য অসওয়াল্ডই দায়ী? তার খুনের উদ্দেশ্যই বা কী? তা নিয়ে রহস্য রয়েই গেছে। কারণ অসওয়াল্ড ধরা পড়ার দুদিন পর কোর্টে যাওয়ার পথে এক নাইটক্লাব মালিকের হাতে খুন হন অসওয়াল্ড। আর তাই কেনেডির হত্যা নিয়ে তৈরি হয়েছে নানা রোমাঞ্চকর কনস্পিরেসি থিওরি।

অসওয়াল্ড ভাড়াটে খুনি হলেও তার পেছনে মাথা কে বা কারা, তা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন লেখক ডন ডিলিলো তার ফিকশনধর্মী উপন্যাস ‘লিবরো’তে। এই উপন্যাসের মধ্য দিয়ে কেনেডি হত্যায় সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির সক্রিয় ভূমিকার তথ্য উঠে আসে। সিআইএ-কে ভাগ করে দেওয়ার পরিকল্পনাতেই কেনেডিকে তাদের রোষদৃষ্টিতে পড়তে হয়। শুধু তা-ই নয়, সিআইএর রোষানলে পড়ার আরেকটি কারণও ছিল। তাছাড়া মাফিয়ারাও এই হত্যার একটি অংশের সাথে জড়িত রয়েছে বলে বইটিতে লেখক তুলে ধরতে চেয়েছেন।
ফিচার ইমেজ- collegeloanfreedom.com