লেখক বলুন আর কবিই বলুন, তারা যখন দেশ বিদেশে ঘুরতে বের হন এবং লেখনীর মাধ্যমে সেই ভ্রমণকাহিনী পাঠকদের সামনে তুলে ধরেন, তা পাঠকদের কাছে রোমাঞ্চকর হয়ে ওঠে। তাদের অসাধারণ লেখনী, সাহিত্যিক ভঙ্গিমা, কাব্যিক দৃষ্টিকোণ এবং চমৎকার শব্দচয়ন পাঠকদের মনে এক দৃশ্যপটের সৃষ্টি করে, যা লেখক তার ভ্রমণ অভিজ্ঞতা থেকে তুলে ধরেছেন। অভিজ্ঞতা এবং সেই সাথে দৃশ্যের পেছনের ছোট ছোট এক একটি ইতিহাস বর্ণনা করার যোগ্যতা যেন সমগ্র বইটিকে জীবন্ত করে তোলে। এমনই একজন লেখক হচ্ছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, যিনি পাঠকদের কাছে এমনই একটি জীবন্ত বই রেখে গিয়েছেন- ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’।
১৯৯১ সালের কলকাতার আনন্দ পাবলিশার্স থেকে এই গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। বইটির ধরন হলো ভ্রমণকাহিনী। এই ভ্রমণ কাহিনীর যাত্রা শুরু হয়েছে আমেরিকা থেকে। আমেরিকা থেকে ফ্রান্স, তারপর ইতালি, রাশিয়া, ইংল্যান্ড, মিশর অর্থাৎ ইউরোপের প্রায় অনেক অংশ জুড়েই বিস্তৃত এই ভ্রমণকাহিনী।
বইটির মূল কাহিনীবিন্দুতে যদি যাই, তাহলে বলতেই হবে এই বইয়ের একটি প্রধান অংশ জুড়ে রয়েছে ফরাসি দেশে ভ্রমণ কাহিনী ও স্মৃতিচারণ। এছাড়াও দেখানো হয়েছে কবির প্রথম আমেরিকা যাবার ঘটনা এবং তার পড়ালেখার সূচনা। এই ভ্রমণকাহিনীতে যুক্ত হয় একজন নতুন কেন্দ্রীয় নারী চরিত্র যার নাম মার্গারেট, কবির মনের সবচেয়ে কাছের বান্ধবী এবং আপনজন। এই কাহিনীতে আছে আমেরিকাতে বসে তাদের পরিচিত হবার ঘটনা, উভয় মানুষদের একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বার ঘটনা, ফরাসি দেশে কবির নিজের অস্তিত্বকে শিল্পের মাধ্যমে কীভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হলেন তার দীর্ঘ ব্যাখ্যা ইত্যাদি। ঘটনাটি তবে শুরু করা যাক কবি মুখ হতেই,
আমি দেশের বাইরে গিয়ে জীবনে প্রথম যে বিদেশের মাটিতে পা রাখি, সেটা ফরাসি-দেশ। সে অনেককাল আগের কথা। আমার তখন অল্প বয়স,বেশ গড়া পেটা শরীর স্বাস্থ্য ঝুঁকিবহুল জীবন কাটাতে ভালোবাসি। হঠাৎ হঠাৎ বন্ধুদের সঙ্গে বনে পাহাড়ে চলে যাই, কিংবা সিমলা হায়দ্রাবাদের মতন বড় শহর দর্শন করতে গিয়ে পয়সার অভাবে এক আধদিন না খেয়ে কাটিয়ে দেই। কিংবা মধ্যরাত্রের কলকাতা শহরে অকারণে অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে মারামারি বাধিয়ে পুলিশের গুঁতো খাই, গারদে চোর-পকেটমারদের সঙ্গে রাত কাটাই। তবুও কিছুই গায়ে লাগে না, সবই যেন মজা। স্বেচ্ছাচারী জীবনযাপনের মধ্যে জীবনকে খুড়ে খুড়ে দেখার চেষ্টা করি।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় শুরুই করেছেন কলকাতা শহর এবং এই শহরের বুকে নিজের গড়ে উঠার ইতিহাসকে দিয়ে। কবি বরাবরই কলকাতা নগরী এবং এর আশেপাশের সকল কিছুর প্রতি দুর্বল। বইয়ের সূচনাতে পাওয়া যায় রাতের কলকাতা নগরী, তার পাশের কফি হাউজ আর কলেজ স্ট্রীট। যেখানে কবির এক দুর্দান্ত সময় কেটেছে আর তার সাথে এই নস্টালজিকতায় প্রকাশ পায় কলেজ স্ট্রীটে তার তরুণ বয়সে আড্ডা দেবার গল্প।
কবি শুরু করলেন তার জীবনের প্রথম মোড় ঘোরানো স্মৃতিকে দিয়েই। ঠিক সেই পঞ্চাশের দশকের ঘটনা, কলকাতার বঙ্গ সংস্কৃতির মাঠে কবি ও তার বন্ধুবান্ধবদের একটি আলোচনা এবং আড্ডা-মেলা বসতো। পল্লীগীতি, উপন্যাস, সাহিত্য, কবিতা, ইতিহাস নিয়ে আলোচনাই এই দলের মূল উদ্দেশ্য। এই দলটিই হলো সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সৃষ্টি করা “কৃত্তিবাস” পত্রিকা ও প্রকাশনীর প্রতিষ্ঠাতা এবং এই পত্রের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন ।
এই আড্ডার মাঠে সেদিন এক সুঠাম যুবক, বিদেশী সাদা জাতি এসে উপস্থিত হলো নাম পল এঙ্গেলস। এই পল এঙ্গেলস হলেন আমেরিকার বিখ্যাত কবি এবং লেখক। তিনি উপস্থিত হলেন কৃত্তিবাস সংঘের মাঝে হঠাৎই। সেখানেই সুনীলের সাথে পরিচয়। আরো তিন চারদিন এঙ্গেলস কলকাতা ছিলেন এবং বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছিলেন সুনীলের সাথেই। পরেই এঙ্গেলস চলে যান জাপানে এবং যাবার পূর্বমুহূর্তে তিনি সুনীলের লেখালেখি ও কবিতা দেখে অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, তার দ্বারাই সম্ভব।
এঙ্গেলস জাপানের উদ্দেশ্যে চলে যান এবং বেশ কয়েকদিন বাদেই সুনীলের কাছে একটি বিশাল খামে করে চিঠি আসে পল এঙ্গেলসের থেকে এই মর্মে যে, সুনীলকে আমেরিকার আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রিয়েটিভ রাইটিং ওয়ার্কশপের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে এবং এর জন্য প্লেন ভাড়া ও থাকা খাবার খরচ তারাই বহন করবে। ভাগ্য পরিবর্তনের হাওয়া এখান থেকেই বদলানো শুরু করে সুনীলের। যাত্রা করেন নিউ ইয়র্কের উদ্দেশ্যে অনেক অস্বাভাবিক এবং অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাবলীকে পেরিয়ে।
নিউ ইয়র্ক থেকে একটু পরে শিকাগো, সেখানে এক হোটেলে রাত্রিবাস। সেও নিদারুণ অভিজ্ঞতা… এরই মধ্যে দুটি পিকচার পোস্টকার্ড কিনে পঞ্চাশ সেন্ট খরচ করে ফেলেছি,আমার আর সম্বল মাত্র সাড়ে সাত ডলার।
তবুও অনেক কষ্ট এবং অনাকাঙ্ক্ষিত ফলাফলকে উতরে গিয়ে আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমালেন। এই অবস্থায় তাকে থাকতে হবে আমেরিকাতে কিছু বছর। তার পড়ালেখার উদ্দেশ্যে। সেখানে পৌঁছোবার পরপরই তার জন্য নির্ধারণ করে দেওয়া হয় একটি ফ্ল্যাটের। সেখানে কবি তার ভাষায় বলছেন,
মাস দুএকের মধ্যেই টেলিফোন-ফ্রিজ-বাথটাব ইত্যাদি আর গ্রাহ্যের মধ্যেই আসে না। ওদেশের জীবন যাত্রাই ওসব সাধারণ সামগ্রী এমনকি টিভি,যা কলকাতায় তখন তো ছিলই না ,ভারতের কোথাও এসেছে কি না সন্দেহ।
মূলত কবির আমেরিকা পৌছনোর পরবর্তীকালীন সময়ে টাকা পয়সার অভাববোধ করেননি যেটা তিনি কলকাতা থাকাকালীন করেছেন। সেখানে অনেক কষ্ট হতো লেখালেখি করে জীবন চালাতে। এখানে এসে টাকা রোজগারও হচ্ছে, বৃত্তির একটি অংশ বাড়িতে পাঠাতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন এবং পড়ালেখাও চলছে।
এমনই একটি সময় তার এই বিশ্ববিদ্যালয়েই পরিচয় ঘটে মার্গারিটের সাথে। কবির ভাষায় তিনি ছিলেন দীর্ঘাঙ্গিনী তরুণী, মাথাভর্তি অলোকলতার মতন এলোমেলো সোনালী চুল, গায়ে একটা সূর্যের মতন লাল রঙের সোয়েটার, সারা মুখে সুস্বাস্থ্যের ঝলমলানি উপস্থিতি নিয়ে তার সামনে প্রথম হাজির। তিনি ছিলেন ফরাসি, এদেশে এসেছেন সাহিত্যের উপর পিএইচডি ডিগ্রী অর্জনের জন্য। সুনীলের সাথে তার ভালো সম্পর্ক হয় সেই তখন থেকে যখন মার্গারিট সুনীলের কাছে জানতে চায় শকুন্তলার ইতিহাস ও ঘটনা নিয়ে। তখন সুনীল তার বাসায় আমন্ত্রণ জানালেন এবং দুজনেই এ বিষয় নিয়ে বিস্তারিত অনেক ঘটনাও শুনলেন, সুনীলের মুখ থেকে ভারতবর্ষের শকুন্তলার ইতিহাস শুনে মুগ্ধ হয়ে গেলেন এবং আবেগ আপ্লুত হয়ে উঠলেন।
একদিনের ঘটনা, মার্গারিটের সাথে সুনীলের ভালো পরিচয় গড়ে উঠার পরে মার্গারিট সুনীলের বাসায় গিয়ে দেখলেন সুনীল বাসা সাজাবার উদ্দেশ্যে কোনো ফুল রাখেন না। মার্গারিট সেদিন ফিরে আসেন এবং পরদিন এই ভদ্রমহিলা গাছ থেকে সদ্য তুলে আনা ফুল সুনীলকে উপহার দেন। সুনীল বিষয়টিকে মেনেই নিতে পারেননি। কবি মানুষ স্বভাবতই প্রকৃতিবাদী হন। সেই সূত্রপাতেই সুনীলও গাছ থেকে বাড়িতে সাজাবার উদ্দেশ্যে কোনো ফুল তুলে আনাকে অযৌক্তিক মনে করলেন। অযৌক্তিক হওয়া সত্ত্বেও মার্গারিটের ছেলেপনা আচরণে যেন সুনীল তার প্রতি আরো দুর্বল হয়ে পড়লেন একজন বন্ধু হিসেবে, একজন ভালোবাসার মানুষ হিসেবে।
সুনীলের আমেরিকাতে আসার পর তার একাকীত্বের ছাপ মুছে দিতে সহায়তা করেন মার্গারিট; কেননা সে কবিতাকে ভালোবাসে আর সুনীলও একজন লেখক হিসেবে কবিতা উপন্যাসকে আজীবন ভালোবেসে গিয়েছেন। এ কারণেই তাদের মিল আরো দৃঢ় হয়। এই কবিতার ভালোবাসার কারণে তারা দুজন একসময় একই বাসায় থাকতে শুরু করেন, সারাদিনের ব্যস্ততা শেষে মার্গারিট ঘরে ফেরেন এবং সুনীল তার লেখালেখির কাজ কর্ম শেষে দুজনই রাতভর আড্ডায় মেতে ওঠেন, ফরাসি কবিতার আড্ডায় মার্গারিট একেবারেই অদ্বিতীয়।
সুনীল প্রায়শই তার কবিতার দিকে মুগ্ধভাবে চেয়ে থাকতেন ও শুনতেন আর মার্গারিট তার মনের মাধুরী মিশিয়ে পাঠ করতেন আপোলিনিয়নেয়ার, মোপাসা, শার্ল বদলেয়ার, ভিক্টর হুগোসহ প্রখ্যাত কবি সাহিত্যিকদের কবিতা ও রচনা। মূলত মার্গারিট ছিলেন ধার্মিক, ক্যাথোলিক মতবাদে বিশ্বাসী। গোঁড়ামিটা তার মধ্যে শূন্য। কারণ সুনীল বলছেন যে কবিতাকে ভালোবাসে সে যেন অসাধারণ প্রকৃতির মানুষ হন। তবুও সুনীল তার ধার্মিকতা জেনেও অবাক ছিলেন। তিনি ভাবতেন, কোভাবে একজন ক্যাথোলিক মতবাদে বিশ্বাসী নারী সন্ন্যাসিনী বা পাদ্রী না হয়ে কবিতাকে ভালোবেসে যাচ্ছে এবং পড়ালেখাও করছে।
নিজেদের মধ্যে রসিকতার সম্পর্কও ছিল অসাধারণ। সুনীলের মুখ থেকে একদিন তো চন্দননগরের নাম শুনেই মার্গারিট বেশ তুমুল উত্তেজিত আর হাসিতে ফেটে উঠলো। সুনীল এই উত্তেজনার কারণ জানতে চাইলে সে জানালো, যদি দুশো বছর আগে ফরাসিরা যদি বুদ্ধি করে ইন্ডিয়াটা জিতে নিতো ইংরেজদের কাছ থেকে তাহলে কী ভালোই না হতো! এভাবেই রাতবিরাতে কখনো কবি এবং তার কবিতা ও জীবন কাহিনী, আবার কখনো বা ফরাসি বিপ্লব, রাশিয়া বিপ্লব, জার্মান-ফ্রান্স আক্রমণের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা হতো।
হঠাৎই একদিন মার্গারিট চলে গেল সুনীলকে ছেড়ে, দোষ ছিল সুনীল মার্গারিটকে ভালোবেসে ফেলেছে এবং মার্গারিট মেনে নিতে পারেনি এই জন্য যে তার পরিবার গোঁড়া ধর্মান্ধ, তারা কখনই মেনে নিবে না এবং দ্বিতীয়ত মার্গারিট নিজেও ধর্মের জায়গায় কিছুটা অনড়। এই কষ্টে সে তাকে ছেড়ে পাড়ি জমায় ফরাসি দেশে। সে ঘরে মার্গারিটের বেশ কিছু জিনিসপত্র রেখে যায় যাবার কালে। সেখানেই একটি কবিতার পাঠ যেন সমগ্র চৈতন্যে একাকীত্বের জন্ম দেয় এবং তা পাঠক সহজেই উপলব্ধি করতে পারবেন-
“বিদায় বিষাদ
স্বাগত বিষাদ
তুমি আঁকা আছো আমার ভালোবাসার চোখে
তুমি নও সম্পূর্ণ দুঃখ
কেননা দরিদ্রতম ওষ্ঠও তোমাকে
ফিরিয়ে দেয়
এক টুকরো হাসিতে…”
আমেরিকাতে বসে বন্ধুহীন, পথিকহীন, একাকী সুনীল যেন আরো বিষাদের মুখে পড়ে গেল। সারাদিন তার স্মরণেই দিন-রাত পার হতে থাকে, কোথাও ঘুরতে গেলেও মার্গারিটের সব জায়গায় জ্ঞান বাটোয়ারা করার স্বভাবটি যেন ভুলতেই পারে না। যখন যেখানেই দুজন যেত মার্গারিট অনেক ইতিহাস ঐতিহ্য তুলে ধরতো সুনীলের সামনে। গল্পে আড্ডায়, কবিতায়, নদীর ধার দিয়ে বেড়াতে বেড়াতে এমনকি এক সঙ্গে রান্না করতে করতেও সে ফরাসি কবি ও শিল্পীদের সম্পর্কে এমনভাবে সব কথা বলতো, যা সুনীল কোথাও পড়েননি। এভাবে কয়েক মাস পেরুতে থাকে তাকে ছাড়াই। সুনীলের সে সময় মনে পড়ে তার অতীত একটি স্মৃতির কথা-
একদিন সুনীল ও মার্গারিট হেটে বেড়াচ্ছিল রাস্তার ধারে,পথিমধ্যে মার্গারিটের নজরে পড়লো মরা চড়ুই পাখি। সে দৌড়ে সেই পাখিগুলোকে তুলে ধরে খুব ধীর সুরে কী যেন কবিতা পড়তে লাগলো-
“ওরিওল পাখি ছুঁয়েছে ঊষার রাজধানী
তার সঙ্গীত তলোয়ার, এসে বন্ধ করেছে দুঃখ শয্যা
সব কিছু আজ চিরজীবনের শেষ…”
মার্গারিট যেন মনে-প্রাণে খুব প্রকৃতিপ্রেমী এবং খুব আবেগী। কিন্তু সুনীল পুরোপুরিই তার উল্টো। এই কাণ্ড দেখে সুনীল আরো ভাবলো, এ যেন বাচ্চামো এবং ছোট বেলার অতিরঞ্জনমূলক কর্মকাণ্ড। তবুও সুনীলের যেন একটা মায়া কাজ করেছে মার্গারিটের জন্যে।
মার্গারিট হারিয়ে যাবার পরেও সুনীল চলে যায় নিউ ইয়র্কে। পৃথিবীর আরেক বিখ্যাত কবি এলেন গীন্সবার্গের বাড়িতে। তাকে চিঠিপত্র দিয়ে বার বার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে তার বাড়িতে আসবার জন্যে। সেখানে এলেনের সাথে সুনীলের কবিতার সাথে সংযোগ যেন আরো বৃদ্ধি পায় এবং তার সাথেও একটি বিশাল সময় পার করে আড্ডা গল্পে।
সুনীল সব ছেড়ে কল্পনা করলেন মার্গারিটের মতো অসাধারণ বন্ধুর কথা, সে কোনোভাবেই তাকে ছাড়া থাকতে পারছে না বলে একদিন গীন্সবার্গের ফ্ল্যাট থেকে যাত্রা করেন সুদূর আটলান্টিক মহাসাগরের অপর প্রান্তে ফ্রান্সের উদ্দেশ্যে। সেখানে আবারও দেখা হয়ে যায় মার্গারিটের সাথে পুনরায় দীর্ঘ বছর পর। মার্গারিট তার বান্ধবীসহ একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে নেন এ সময়ে। তারপর সুনীলকে নিয়ে মার্গারিট বের হয় পুরো ফ্রান্সের শহরকে আবিষ্কার করবার জন্য।
অনেক সময় বলা হয় কবিদের থাকে দুটি দেশ- একটি তার নিজ জন্মভূমি এবং আরেকটি হলো ফ্রান্স। ফ্রান্স সম্পর্কে সুনীল বলছেন, প্যারিস এমন একটি শহর যা বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানদের দ্বারা এমনকি বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্র দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। কারণ এ এমন একটি শহর যা শিল্পগুণের বিচারে এবং শিল্প কাঠামোর দিক থেকে খুব শক্তিশালী এবং অপূর্ব নগরী। শিল্পের জায়গা থেকে স্বতন্ত্র বলেই অন্যান্য রাষ্ট্র যুদ্ধ মানসিকতার হওয়া সত্ত্বেও তারা এই শিল্পের কদর করতো। প্যারিস হলো সেই রাত জাগা শহর যার বুকে একটি ছোট নদী বয়ে চলেছে আলো আঁধারে নৃত্য, মেলা জমে উঠেছে তরুণ-তরুণীদের নাচে ও গানে। সমগ্র শহরে শিল্পকলা যেন জীবন্ত হয়ে বেঁচে আছে চারিদিকে।
এই সফরে সে মার্গারিটের সাথে ঘুরতে যায় ল্যুভর মিউজিয়ামে। বেশ কয়েকটি আর্টের দর্শন ও ইতিহাস নিয়ে ব্যাখ্যা প্রদান করে সুনীলকে। রাতের বেলা ফরাসি রেস্তোরাঁয় বসে ফরাসি খাবার উপভোগ করা, ফরাসি দেশের ভাষাকে রপ্ত করাও ছিল সুনীলের জীবনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য সেই সময়কালে। পুরো ফ্রান্স ভ্রমণকালে একদা মার্গারিটের পরিবারের লোকজনদের অসুস্থতার কথা জানতে পেরে চরম হতাশায় ভোগে। এ সময় সুনীলের উপদেশ মোতাবেক তাকে আবার আমেরিকায় ফেরত যেতে বলা হয় যেন সেখান থেকে পড়ালেখাটাও শেষ করে আসে পাশাপাশি টাকা রোজগার করেও যেন তার পরিবারকে সাহায্য সহযোগিতা করতে পারে।
মার্গারিট তবুও যেন যেতে চায় না, কেন যেন আটকে গিয়েছে সুনীলের পৃথিবীতে। তবুও সকল আবেগকে ফেলে সে পুনরায় চলে গিয়েছে আমেরিকায়। সুনীলের ভয় সবসময় ছিল তাকে নিয়ে একটা বিষয় আর তা হলো এই মেয়েটি অপরিচিত যেকোনো মানুষকে সাহায্য করে বসে এবং তাদের কথায় বিশ্বাসও করে বসে। এই ফ্রান্স থেকেই এই দুজন পাড়ি দেয় একজন আমেরিকায় এবং একজন ভারতের দিকে।
ভুলবো না আমি ফ্রান্সের সেই প্রিয় উদ্যানগুলি
ওরা যেন বহু প্রাচীন কালের ভোরে প্রার্থনা গান
নৈশব্দের ধাঁধা সন্ধ্যার যাতনা কেমনে ভুলি
ছিল আমাদের যাত্রার পথে গোলাপ যে অফুরান
এভাবেই সুনীলের প্রায় তিন বছর কেটে গেল, মার্গারিটের খোঁজখবর নেই। কোনো চিঠির উত্তর নেই, নেই কোনো নির্দেশনা তার সম্পর্কে। সুনীলও যেন আস্তে আস্তে তাকে ভুলতে বসেছে। কিন্তু কোনোদিন মার্গারিটের কথা মনে পড়লেই বিষাদে আত্মহারা হয়ে পড়ে। কলকাতায় এসে পৌঁছান সেসময়কার বিখ্যাত কবি পল এঙ্গেলস। সদ্য বিবাহিত নতুন স্ত্রীকে সঙ্গে করে এনেছেন। তার থেকে সুনীল জানতে পারে গভীর মর্মবেদনামূলক ঘটনা। মার্গারিট আমেরিকার রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় তাকে অপরিচিত কয়েকজন ব্যক্তি গাড়িতে করে তুলে নিয়ে যায়। তারপর থেকে আর কোনো খোঁজ নেই তার। এই খবর যেন সুনীলকে বারেবারে পীড়া দিতো। সুনীলও সদ্য বিবাহিত, স্ত্রীকে নিয়ে সংসার করছে খুব ভালোই।
সুনীল তাই এই সুযোগে তার স্ত্রীকে নিয়ে ঘুরে এলো ফের ফরাসি দেশে। এবারের গন্তব্য তার পরিচিত এক বন্ধু অসীমের বাসায়। স্বভাবে অসীম বেশ রগচটা মনে হলেও মেপে মেপে চলার মানুষ। আর এদিকে লন্ডনবাসী ভাস্করও আসতো ফরাসি দেশে যতবারই সুনীল এসেছে। মূলত তাদের উদ্দেশ্যে ফ্রান্সের বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাফেরা করবে।
প্যারিস থেকে বেরিয়ে তাদের যাত্রা সুদূর দক্ষিণের দিকে। বেশ রোমাঞ্চকর পরিস্থিতির মধ্যেও সুনীল যেন বরাবরই একটু চুপচাপ স্বভাবের আর ভাস্কর দাদা-গিরি দেখাতে ওস্তাদ। সুনীল তাকেই ভরসা করে চলতো গোটা ফরাসি ট্রিপে, যদিও সেই দেশে অসীম অনেক বছরই রয়েছে। একপর্যায়ে যাত্রার সময়ে তাদের গন্তব্যস্থান যখন লুদা নামক গ্রামে এসে পড়ে, তখন যেন আবার স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ে সুনীল। এখানেই মার্গারিটের গ্রাম এবং তার মন যেন ছটফট করে একটাবার কাউকে জিজ্ঞাসা করুক মার্গারিট কোথায় এটা জানার জন্যে। কিন্তু সময়ের স্রোত দ্রুত গড়িয়ে যাবার কারণে তা-ও আর হয়ে উঠলো না। মন খারাপের নেশা নিয়ে তাদের গাড়ি যেন আরো দক্ষিণের দিকে চললো।
সুনীল যাত্রার এই সময়টায় দাবী করেছেন পৃথিবীতে যতগুলো সমুদ্র আছে তার মধ্যে ভূমধ্যসাগর সবচেয়ে শ্রেয় ও সর্বশ্রেষ্ঠ। এখানেই এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপের মাঝখানের এই সমুদ্রের ওপর দিয়েই মানব সভ্যতা অনেকবার পারাপার করেছে। যখন তারা সেই সমুদ্রতীরে পৌঁছে তখন থেকে সারাদিন স্নানের পর বালিতে পা ঝেড়ে বসে থাকতেন এবং কল্পনা করতেন বিভিন্ন দেশে তার ভ্রমণে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলীর কথা। বেশ স্মরণ করেছেন সুইডেনের কথা, অসংখ্য ছোট ছোট দ্বীপ নিয়ে গঠিত এবং সমুদ্রের তীরে তারা বসে থাকে দিন-রাত ধরে। এমনকি সেই সময় সমুদ্রের তীরে বসে সুনীল যেন ঝিনুকের স্বাদ চেখেও দেখেছেন, খাবারের ক্ষেত্রে মোটেও সুনীলের কার্পণ্য নেই। সব ধরনের খাবারের স্বাদ গ্রহণ করা ছিল যেন তার কাছে নতুনত্বের আরেক সংজ্ঞায়ন। আর সমুদ্রের তীরবর্তী ঝিনুক ও লেবুর রস যেন তাকে চাঙা করে দিয়েছে বারে বারে।
ফরাসি দেশ ভ্রমণের সময় সুনীলের আরেক অভিজ্ঞতার দ্বার খুলে দেয় নর্মান্ডি অঞ্চলটি। যেখানে যাবার পথিমধ্যে অসংখ্য পুরাতন বসত ভিটে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সৃষ্ট বাঙ্কার আর গুহা যেন দেখেই প্রশান্তি তার মধ্যে। সেখানে ইতিহাস বলছিলেন সুনীল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যদি জার্মানরা ভুল না করতো তাহলে নর্মান্ডি হয়ে যেত হিটলারের। মূল সমস্যা হয়েছিল প্যানজার বিমান বাহিনী পাঠাতে হিটলারের দ্বিধা। আর নর্মান্ডি ছিল ফ্রান্সের প্রাণ ও বন্দরনগরী। আর সেই সময় এই অঞ্চল সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে ছিল গুরুত্বপূর্ণ। আমেরিকা ও ফ্রান্সের যৌথ আক্রমণের ফলে এই অঞ্চল হাতছাড়া হয়ে পড়ে জার্মানদের। ফলে পরাজয়ে তাদের ঘরে দ্রুত পৌঁছায়। এভাবে চলতে চলতে তার চোখে দেখা দেয় আরেক বহু প্রাচীনকালের একটি গির্জা। নাম মঁ-সাঁ-মিঁশেল। সুনীল বলছেন, এ যেন প্রাচীন ভারতের মন্দিরের ন্যায়। এখানেও ইতিহাস বলেছেন সুনীল, একে দুই-একবার দুর্গ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। রাজশক্তির সঙ্গে যাজকদের লড়াইয়ের সময় কোনো রাজাও এটা কেড়ে নেবার চেষ্টাও করতে পারেননি। এর প্রতি ধাপেই রঙিন চিত্রিত কাচের দেয়াল, যিশু ও কুমারী মেরীর অনেক রকমের মূর্তি।
সুনীল হঠাৎ স্মরণে করছিলেন আইওয়াতে থাকাকালীন নদীর ধারে প্রচুর হাঁটতে যেতেন। মূলত তিনি ভালোবাসেন খুব নদীকে। আর ফরাসি নদীগুলোর প্রতি যেন আলাদা একটি তৃষ্ণা কাজ করতো। একদিনের ঘটনা তিনি উল্লেখ করে বলেন, একদা বিজ্ঞানী ভূপেন দাশের বাড়িতে দাওয়াত পেলেন। সেখানে বেশ সুন্দর ছোট্ট নদী রয়েছে নাম ইভেৎ। সেই অঞ্চলে গেলেই সুনীল যেন একবার হলেও নদীটিকে দেখে আসেন। তিনি আবার দাবী করছেন, ফ্রান্সের সবচেয়ে বিখ্যাত নদীটি হলো লোয়ার নদী।
লোভ সামলাতে না পেরে যে দেশেই ইউরোপে যেতেন না কেন টপ করে একবার হলেও ফরাসি দেশকে ছুঁয়ে আসতে ভোলেন না এবং এই নদীকে দেখার সৌভাগ্যও হারান না। লোয়ার নদীসহ প্যারিসের বুকে অন্যান্য নদীগুলো চারধারে যেমন অসাধারণ সভ্যতার বিকাশ ঘটেছে ঠিক তেমনি এর উপরে অবকাঠামোগত উন্নয়ন যেন তার চোখে পড়ার মতো। রাত্রি বেলায় ভাস্কর, অসীম,সুনীল যেন এই স্থানের আশেপাশের কাফে বা রেস্তোরাঁয় আড্ডা দিতে যেন ভুলে যান না। তখন ইতিহাসের পাতায় চোখ ফিরিয়ে বললেন চায়না, চেকোস্লোভাকিয়া, রাশিয়া ও সুইডেনের অন্যান্য নদীর ইতিহাসের কথা।
সুনীলের ফরাসি দেশ ভ্রমণ যেকোনো পাঠককে একটি রোমাঞ্চকর পরিস্থিতির দিকে ঠেলে নিয়ে যেতে বাধ্য। তার দৃষ্টিকোণ, তার চোখে ফুটে ওঠা প্রতিটি ইঞ্চি ইঞ্চি দৃশ্য, এমনকি এর পেছনের ইতিহাসগুলোও তুলে ধরা হয়েছে পদে পদে। শেষের দিকে এসে সুনীলের ভ্রমণ ঠেকেছে ফরাসি দেশের বিখ্যাত ও পুরনো যুগের ক্যাসেলের দিকে, রাজারা বসে যেখানে শাসন-শোষণ চালিয়েছেন।
এগুলোর মধ্যে অপেক্ষাকৃত ছোট দুর্গের নাম “শাতো”। এখানেও স্মৃতিচারণ দিয়ে উল্লেখ করেছে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির ঘটনা। ভিঞ্চির জীবনের শেষ সময়গুলো অতিবাহিত করেছেন ফরাসি দেশে। তিনি ছিলেন নদী বিশেষজ্ঞ, বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পী, কবি, লেখক, ডিজাইনার আরো কত কী! এ দেশে গড়ে গিয়েছেন রাজাদের জন্য বিলাসী বাড়িঘর ও দুর্গ। রেখে দিয়ে গিয়েছেন অনেক স্থাপত্যশিল্প এর নমুনা যার দ্বারা ফরাসি জগতে নতুন আধুনিকতার দ্বার খুলে যায়। এখানেই অনেক রাজাদের মন জয় করে নিয়েছিলেন লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি। এই শাতোগুলোতে ভাস্কর আর সুনীল যেন দিন-রাত ঘুরে ফিরেছে আর যেন এক অমায়িক আনন্দের মুখোমুখি হয়েছেন।
এই বইটিতে শুধুমাত্র এই কয়েকটি ঘটনাতেই সীমাবদ্ধ নয়, শত শত ঘটনাবলী, ইতিহাস, ঐতিহ্য নিয়ে গঠিত এই সমগ্র বইটি। পাঠকদের উদ্দেশ্যে একটিই বলার বিষয় আছে, আর সেটি হলো- এই বইটি একটি বার পড়া শুরু করলে আপনি পুরো ইতিহাস, সংস্কৃতি আর ভ্রমণের নেশায় হারিয়ে যেতে বাধ্য হবেন, এমনকি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের চোখ দিয়ে দেখতে পারবেন সমগ্র আবেগ অনুভূতিগুলোকে।
অনেকবার ফরাসি দেশে এসেও যখন সুনীলকে যতবারই শেষের বিদায় নিতে হয়, তখন যেন একবার হলেও স্মৃতিতে গিয়ে মার্গারিটের নামটি এসে পড়ে, আর বোধ হয় যেন তাকে একটা বার না দেখেই ফিরে যাচ্ছি আবার ভারত দেশে। মার্গারিটের কাছ থেকে কতই না দূরে সরে যাচ্ছেন, বারে বারে এ দেশ ছেড়ে এলে স্মরণ করেন মার্গারিটের সাতাশ বছর বয়সের ঈষৎ লাল বর্ণের চুল, গোলাপি রঙের স্কার্ট আর অসম্ভব রকমের ছটফটানি নিয়ে সুনীলের সামনে এসে যেন হেসে হেসে বলছে, “কী সুনীল, মন খারাপ? তুমি না প্রজাপতি হতে চাও! প্রজাপতি হবে না!”