Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বলা হয় প্রেমের কবি। তার জীবনকালে রচনা করে গিয়েছেন অসংখ্য কবিতা। যেগুলোর প্রতিটি শব্দের পরতে পরতে লুকিয়ে ছিল প্রেম, বিরহ, ব্যাকুলতা আর নিঃসঙ্গতার এক মহা উপাখ্যান। কখনো একা নীরবে-নিভৃতে বসে যদি তার কোনো কবিতা পড়েও থাকেন, সেগুলো আপনার মনে কীভাবে জায়গা করে নেয়? কবিতার অনুভূতি কি আপনাকেও নাড়িয়ে দেয়?
শুধু কি কবিতা? তার যে রয়েছে অসংখ্য গানের ভান্ডার! যেগুলো আমরা উৎসবে-পার্বনে কিংবা বদ্ধ দরজার ওপারে জানালা দিয়ে শূন্য চোখে চেয়ে থেকে শুনি, সেগুলোও বা কম আবেদনের কীসে! প্রতিটি শব্দ যেন আমার-আপনার কথাই বলে, পাওয়া না পাওয়ার গোলমেলে হিসাব স্মৃতি হাতড়ে বেড়ায়। গানের আধুনিকায়ন ঘটেছে বহু আগে, বদলেছে গানের যন্ত্রপাতির ব্যবহারও। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গানগুলো আজও টিকে আছে স্বমহিমায়।
ভালোবেসে, সখী, নিভৃতে যতনে আমার নামটি লিখো– তোমার মনের মন্দিরে। আমার পরানে যে গান বাজিছে তাহার তালটি শিখো– তোমার চরণমঞ্জীরে॥
সবার মতো করে রবীন্দ্রনাথও কিশোর বয়স পার করেছেন। আর দশজন যেমন করে প্রথম প্রেমের হাওয়া গায়ে লাগিয়ে মাতাল হয়ে পড়ে, রবীন্দ্রনাথকেও সেই হাওয়া দোলা দিয়ে গিয়েছিল। যার প্রভাব তার জীবনে পড়েছিল এবং সেটা খুব ভালো করেই। কিশোর রবীন্দ্রনাথের মনে প্রথম প্রেমের জোয়ার এনে দিয়েছিল বোম্বের এক মেয়ে, নাম তার নলিনী; নলিনী মানে প্রচুর পদ্ম জন্মে যেখানে। না, নলিনী তার আসল নাম নয়, সেটা রবীন্দ্রনাথেরই দেয়া। তার আসল নাম কী তবে? রবীন্দ্রনাথের সাথে তার দেখাই বা হলো কী করে, যে নারীকে তিনি অমর করে রেখেছেন অনেকগুলো সাহিত্যকর্মে? অসম প্রেমের এই গল্প নিয়েই আজকের লেখাটি।
কিশোর রবীন্দ্রনাথ ও নলিনী
রবীন্দ্রনাথ যখন নলিনীর দেখা পান তখন তিনি সবে সতের বছর বয়সে পা দেয়া এক কিশোর। নলিনীর আসল নাম আর না লুকাই, তার আসল নাম ছিল অন্নপূর্ণা তর্খদ। বোম্বেতে থাকলেও সে একজন মারাঠি। তার বাবা ছিলেন আত্নারাম তর্খদ, পেশায় একজন ডাক্তার। সমাজের উচ্চশ্রেণীর পরিবারে জন্মেছিলেন তিনি। তার সুবাদে উঁচু শ্রেণীর লোকজনের সাথেই তার মেলামেশা হতো। পরে তিনি ‘প্রার্থনা সমাজ’ নামে আলাদা একটি শ্রেণী তৈরি করেন। তৎকালীন ভারতবর্ষের বহু অভিজাত পরিবারের লোকজন এই সমাজে যোগ দেয়।
রবীন্দ্রনাথের বড় ভাই সতীন্দ্রনাথ ঠাকুরও এই সমাজে যোগ দিয়েছিলেন, যিনি ভারতীয়দের ভেতর সর্বপ্রথম সিভিল সার্ভিসে যোগদান করেন, যার সূত্র ধরে পরবর্তীতে আত্নারামের সাথে তার সখ্য গড়ে ওঠে।
অন্নপূর্ণা কেবল ব্রিটেন থেকে পড়ালেখা শেষ করে দেশে ফিরেছেন। এদিকে কিশোর রবীন্দ্রনাথকেও পড়ালেখার জন্য ব্রিটেনে পাঠানোর কথা ভাবছিল তার পরিবার। সতীন্দ্রনাথ তাই ভাবলেন অন্নপূর্ণার সাথে থাকলে রবীন্দ্রনাথ ইংরেজিতে দক্ষ হয়ে উঠবেন। ব্রিটেনে গিয়ে সেখানকার ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারবেন সহজেই। আত্নারামের সঙ্গে কথা বলার পর তিনিও কিশোর রবীন্দ্রনাথকে রাখতে রাজি হয়ে যান। সতের বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথ তাই ১৮৭৮ সালে পরিবার ছেড়ে চলে এলেন বোম্বেতে। অন্নপূর্ণা ছিলেন বয়সে রবীন্দ্রনাথ থেকে তিন বছরের বড়। রবীন্দ্রনাথ অন্নপূর্ণার কাছে ইংরেজি শিখতে শুরু করেন। তিনি প্রায় দু’মাস এখানে ছিলেন। এই স্বল্প সময়ের মেলামেশাতেই তাদের দুজনের ভেতর সখ্য গড়ে ওঠে। কৃষ্ণ কৃপালানি তার বই ‘ঠাকুরঃ একটি জীবন’-এ উল্লেখ করেন,
“রবীন্দ্রনাথ এবং অন্নপূর্ণা দুজনেই একে অপরের প্রতি ভালোবাসা দেখাতে শুরু করেন। কিশোর রবীন্দ্রনাথের মনে এর প্রভাব পড়েছিল বেশ ভালোভাবেই। তিনি সেই সময় অন্নপূর্ণাকে নিয়ে বেশকিছু কবিতা লেখেন। কিন্তু তাদের ভেতর চলমান অসম প্রেমের এই গল্প বেশিদূর যেতে পারেনি। তাদের নিয়তি ছিল ভিন্ন, বয়স কম হওয়ার কারণে তাদের কেউই সেটা বুঝতে পারেননি।”
তাদের মেলামেশার গভীরতার কারণে আত্নারাম এবং সতীন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন তাদের বিয়ে দিয়ে দেবেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের বাবা এই বিয়েতে মোটেই রাজি ছিলেন না। কারণ, রবীন্দ্রনাথের তখন বয়স কম এবং তিনি পড়াশোনা করবেন আরও।
নলিনী ছিলেন রবীন্দ্রনাথের চেয়ে বড়; Image Source: dailyasianage.com
তাছাড়া অন্নপূর্ণা তার থেকে বয়সে বড় হওয়াটাও একটি সমস্যা ছিল রবীন্দ্রনাথের বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে। তাই সকল পরিকল্পনার সমাপ্তি ঘটে এখানেই। ব্যথিত রবীন্দ্রনাথ নলিনী আর তার অল্প সময়ের স্মৃতি বিজড়িত বোম্বে ফেলে লন্ডনের উদ্দেশ্যে জাহাজে চড়ে বসেন।‘দ্য মিরিয়েড মাইন্ডেড ম্যান’ বইতে কৃষ্ণ দত্ত ও এন্ড্রু রবিনসন উল্লেখ করেন,
“রবীন্দ্রনাথ ইংল্যান্ড থাকাকালে ১৮৭৯ সালে আত্নারাম ও অন্নপূর্ণা কলকাতার বিখ্যাত জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে আসেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু তাদের ভেতর কী কথা হয়েছিল, তার বিস্তারিত জানা যায়নি। ধারণা করা হয়, বিয়ের প্রস্তাব নিয়েই এসেছিলেন আত্নারাম এবং দেবেন্দ্রনাথ প্রস্তাবে রাজি হননি।”
রবীন্দ্রনাথ ইংল্যান্ড গমনের দুই বছর পর ১১ নভেম্বর ১৮৮০ সালে অন্নপূর্ণার বিয়ে হয়ে যায় হ্যারল্ড লিটলডেল নামের একজন স্কটিশের সঙ্গে। বিয়ের পর অন্নপূর্ণা স্বামীর সঙ্গে ইংল্যান্ড চলে আসেন। এখানে তারা এডিনবার্গে বসবাস শুরু করেন। ১৮৯১ সালে অন্নপূর্ণা মাত্র ৩৩ বছর বয়সে মারা যান।
প্রেম যখন অমর
রবীন্দ্রনাথ আর নলিনীর প্রেমের সম্পর্ক যে শুধু সাময়িক আকর্ষণ ছিল না- সেটা বোঝা যায় রবীন্দ্রনাথের রচিত বিভিন্ন সাহিত্যকর্মে। তাকে নিয়ে রচিত সবগুলো কবিতাতেই নলিনীকে রূপায়িত করেছেন অত্যন্ত সযত্নে। ফুটিয়ে তুলেছেন তাদের ভালোবাসা আর বিরহের নীরব গল্প। ১৮৮৪ সালে রবীন্দ্রনাথ একটি গদ্য নাটক রচনা করেন যার নাম ছিল ‘নলিনী’। কিন্তু নাটকের উৎসর্গ পাতায় তিনি কিছুই লেখেননি। নলীনির প্রতি তার ভালোবাসা অন্তরেই রয়েছে, এটা বোঝাতেই হয়তো তিনি কিছু লেখেননি। নলিনীও এই অসম প্রেমকে স্মরণীয় করে রাখতে চেয়েছিলেন, যার কারণে নলিনীর অনুরোধে তার ভাইপোর নাম রাখা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ।
তাদের প্রেমের অনুভূতি ছিল জীবনভর; Image Source: stories.flipkart.com
নলিনীর কাছে ইংরেজির দীক্ষা ঠিক কতটুকু নিতে পেরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, সেটা নিয়ে সবার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে! কিন্তু দুজনের মনের লেনাদেনার হিসাব ঠিকই করে নিয়েছিলেন তারা। পড়ার টেবিলে যতটুকু না পড়ালেখা হয়েছে, তার চেয়ে ঢের বেশি প্রেমের বিনিময় হয়েছিল! নলিনীকে নিয়ে লেখা রবীন্দ্রনাথের গান শুনে নলিনী বলেছিলেন,
“রবীন্দ্রনাথ; তোমার গান শুনে মনে হচ্ছে, আমার মৃত্যুশয্যার পাশে এই গান শোনানো হলে আমি আবার জীবন ফিরে পাব।”
প্রেমের বেলায় নলিনী রবীন্দ্রনাথের চেয়ে একটু এগিয়েই ছিলেন। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ আকারে-ইঙ্গিতে ভালোবাসার কথা বললেও, মূলত তিনি বেশিরভাগ সময় লজ্জার কারণেই কিছু বলতে পারেননি। নলিনী যখন কিশোর রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধার করতে এগিয়ে এলেন, তখনই তিনি হালে পানি পেলেন!
লীলাময়ী নলিনী, চপলিনী নলিনী, শুধালে আদর করে ভালো সে কি বাসে মোরে, কচি দুটি হাত দিয়ে ধরে গলা জড়াইয়ে, হেসে হেসে একেবারে ঢলে পড়ে পাগলিনী!
জীবনের শেষ সময়ে এসে রবীন্দ্রনাথ আবার নলিনীকেই স্মরণ করেছেন। তিনি একবার রবীন্দ্রনাথকে বলেছিলেন, “তুমি তোমার মুখে কখনো দাড়ি রেখো না।” ৮০ বছর বয়সে বুড়ো রবীন্দ্রনাথ লিখেন,
“সবাই জানে, আমি তার কথা রাখিনি। কিন্তু তার কথা যে রাখা হয়নি, এটা দেখার জন্য সে আর বেঁচে নেই।”