“একটি ডকুমেন্টারি দেখছিলাম, টুইন টাওয়ারে আটকে পড়া মানুষগুলোর মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে করা শেষ মোবাইল কল এবং টেক্সট মেসেজগুলো নিয়ে। মানুষ ধোঁয়া আর আগুনের হলকার মধ্যে দাঁড়িয়ে হাতে যে কয়েক মুহূর্ত পেয়েছে, তাতে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে তার প্রিয়জনের সঙ্গে। মা, স্ত্রী, স্বামী, ভাইকে একটা কি দুটো বাক্য বলতে পেরেছে তারা। আমি লক্ষ্য করছিলাম, প্রায় সবাই একটি বাক্য অবধারিতভাবে বলছে, “আমি তোমাকে ভালোবাসি”। মনে পড়ছিল, সম্প্রতি আমাদের দেশের বিডিআরের ঘটনার সময়েও এমনি কয়েকজন অফিসার মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রিয়জনকে ফোন করেছিলেন। তাঁদের আত্মীয়দের সাক্ষাত্কারে লক্ষ্য করেছি, অনেকের ক্ষেত্রেই শেষ বাক্যটি ছিল- “আমাকে মাফ করে দিও।” আমি ভিন্ন দুই দেশে মানুষের অন্তিম বয়ানের এই সাংস্কৃতিক ভিন্নতার ভাবনায় তাড়িত হই। কেন এক দেশের মানুষ মৃত্যুর আগে প্রিয়জনকে তার ভালোবাসাটি নিশ্চিত করবার ব্যাপারে এতটা উদগ্রীব, আর আরেকটি দেশে মানুষ তার প্রিয়জনের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী?”
এমনই আরো হাজারো ভাবনায় তাড়িত হন শাহাদুজ্জামান। ভাবনার সেই জগতে তিনি পশ্চিমের মেঘে সোনার সিংহ আবিষ্কার করেন, তার কয়েকটি বিহবল গল্পে ঘোরগ্রস্থ হয়ে থাকে বাংলা সাহিত্যের ছোটগল্পের পাঠকেরা, অন্য এক গল্পকারের গল্প নিয়ে তিনি গল্প লেখেন, এক কাঁঠাল পাতা আর মাটির ঢেলার মিতালীর গল্প শোনাতে তিনি ভূমিকা করেন কাব্যিক ঢঙে, বিসর্গতে দুঃখ অনুভব করেন, কখনো বা ক্রাচে ভর করা কোনো এক কর্নেলের গল্প বলেন নিবিড়ভাবে, আবার নিভৃতচারী কবি জীবনানন্দ দাশকে আখ্যা দেন একজন কমলালেবু, চ্যাপলিনের চলচ্চিত্রের বর্তমান সময়ের চমৎকার প্রাসঙ্গিকতা তুলে ধরেন, একজন চিকিৎসক হয়ে কয়েকটি ভাঙা হাড়ের দরদে তিনি হাসপাতালের ব্যবচ্ছেদ করেন, একান্ত আলাপচারিতা কথা পরম্পরায় তিনি হাজির করেন সত্যিকারের কিছু মানুষ।
আল বেরুনীর মতো দীর্ঘ নয়, বিস্তৃত জীবনের আকাঙ্ক্ষী শাহাদুজ্জামান। বর্তমান সময়ে বাংলা কথাসাহিত্যের যারা প্রতিনিধি, তাদের মধ্যে অগ্রণী। কথাসাহিত্যে এ বছরই পেয়েছেন বাংলা একাডেমী পুরষ্কার।
শাহাদুজ্জামানের জন্ম ১৯৬০ সালে, ঢাকায়। মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যামিক- উভয়ই মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ থেকে। তারপর এম.বি.বি.এস করেছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে। চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেছেন ব্রাকের গ্রামীণ স্বাস্থ্য বিভাগে, পরে অধ্যাপনা করেছেন ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘স্কুল অফ পাবলিক হেলথ’-এ। পিএইচডি করেছেন নেদারল্যান্ডের অ্যামস্টারডাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, নৃবিজ্ঞানে। বর্তমানে যুক্তরাজ্যের গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা এবং গবেষণার সাথে যুক্ত।
বাংলা সাহিত্য বিষয়ে শাহাদুজ্জামানের প্রথম পাঠ পরিবারে। শাহাদুজ্জামানের ভাষায় পেটুক পাঠক ছিলেন তার বাবা। মা ছিলেন সাহিত্যের ছাত্রী এবং পরবর্তীতে শিক্ষিকা। তাই শৈশবেই অক্ষরের মধ্য দিয়ে জীবনকে আবিষ্কার করার প্রক্রিয়া শুরু। সাহিত্যের এক ধরনের ঘোরের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠা শাহাদুজ্জামানের। সেই ঘোরের মাঝে তখনও তিনি জানতেন না, হয়তো একদিন লেখক হয়ে উঠবেন তিনি। তবু আজন্ম অক্ষর আর শব্দের সাথে যে সখ্যতা, তাই-ই নির্মাণ করেছে আজকের শাহাদুজ্জামান। কৈশোরের দিনগুলোতে সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ সাহিত্যিক হয়ে উঠবার পথে প্রস্তুতি বলে মনে করেন তিনি।
শাহাদুজ্জামানের লেখালেখির শুরু আশির দশকের মাঝামাঝিতে। ক্যাডেট কলেজের পাঠ চুকানোর পর মুক্ত জীবনের প্রথম স্রোত অনুভব করেন বাম রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়ে। মানব জীবনের মৌলিক প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি হতে শুরু করেন তখন। তারপর সেই প্রশ্নগুলোর জবাব খুঁজতে হাতিয়ার হিসেবে বেছে নেন সাহিত্যকে। মৌলিক প্রশ্নের সাথে সাহিত্যের মোকাবেলা হয়ে ওঠে শাহাদুজ্জামানের সাহিত্যচর্চার প্রধান কারণ।
প্রথম বইগুলোতে তিনি খুঁজে ফেরেন রাজনীতির সাথে শিল্প সাহিত্যের সম্পর্ক। অনুবাদ করতে থাকেন এ বিষয়ে বিভিন্ন মানুষের ভাবনা। তারপর নিজের ভাবনাগুলো সবার সাথে ভাগাভাগি করতে তার প্রথম মৌলিক গ্রন্থ প্রকাশ পায় ১৯৯৬ সালে, ছোটগল্পগ্রন্থ ‘কয়েকটি বিহবল গল্প’। অনেকের মতে শাহাদুজ্জামানের সেরা কিছু কাজের প্রামাণ্য রূপ বইটি। ‘একটি কাঁঠাল পাতা এবং মাটির ঢেলা’ গল্পের কাব্যিক ঢঙে শুরু সাহিত্যের বিভিন্ন শাখার অন্তর্গত প্রাচীর উপেক্ষা করার শাহাদুজ্জামানের ইচ্ছের বহিঃপ্রকাশ। আরো সব বিহবল গল্পের ঘোরগ্রস্থতায় তার প্রথম মৌলিক বইটি জিতে নেয় মাওলা ব্রাদার্স কথাসাহিত্য পুরষ্কার ১৯৯৬।
সাহিত্যের বিভিন্ন শাখার মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক দেখতে পান শাহাদুজ্জামান। তাই তো তার বইগুলোকে সঙ্গায়িত করা সাহিত্য বোদ্ধাদের জন্য দুরুহ হয়ে দাঁড়ায়। তার উপন্যাসের আঙ্গিক সমসাময়িক উপন্যাসের সংজ্ঞায় ঠিক মেলে না, আবার তা অস্বীকার করা খানিকটা গোড়ামি হয়ে যায়। ফিকশন-নন ফিকশন, পদ্য-কথাসাহিত্য, সবকিছুর মিশেলে অনেকে ‘ডকু ফিকশান’, আবার অনেকে ‘মেটাফিকশান’ বলে রায় দেন। এ নিয়ে অবশ্য শাহাদুজ্জামানের কোনো মাথাব্যথা নেই। তার ভাবনার জগতে যে যুদ্ধ চলে অবিরাম, তা কাগজ হয়ে, বই হয়ে পৌঁছে যাচ্ছে অগণিত পাঠকে কাছে। পাঠক তা পড়ছে, আলোচনা করছে, তাদের সাথে লেখকের ভাবের মিলন আর বিরোধ হচ্ছে- এটাই শাহাদুজ্জামানের কাছে বড় পাওয়া।
শাহাদুজ্জামানের প্রথম বড় কাজ বলা যায় ক্রাচের কর্নেল। বড় কাজ উপন্যাস অর্থে, পাঠকপ্রিয়তার অর্থে। বাংলাদেশের ইতিহাসের নাটকীয় সময় ১৯৬৯ থেকে ১৯৭৫। আর সে সময়কার বাংলাদেশের একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ কর্নেল তাহেরকে মূল উপজীব্য করে লেখা ক্রাচের কর্নেল।
কোনো এক বাংলাদেশী তরুণের বেশে তিনি হাজির হয়েছিলেন কিউবার সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রোর কাছে। ডকু ফিকশান আঙ্গিকে তাদের কথোপকথনে তুলে আনেন কিউবার আন্দোলন, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ আর ব্যক্তি ফিদেল ক্যাস্ট্রোকে। তারপরও পাঠকমনে কিছুটা খচখচানি থেকে যায় বইটি পড়ে। তারা ভাবে, সমাজতন্ত্রের সহজ পাঠ হয়তো তারা পেতে থাকবে ধীরে ধীরে। কিংবা কিউবার মোকাবিলা করা সমস্যাগুলো কিভাবে তারা কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলো তা জানা যাবে বিশদভাবে, যা বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে সমস্যাগুলোর সমাধানে দিকনির্দেশনা হয়ে থাকতে পারে। শাহাদুজ্জামানের অন্যান্য কাজ থেকে এ কাজটিকে কখনও কখনও তুলনামূলক দূর্বল মনে হয়।
লেখালেখির একপর্যায়ে এসে শাহাদুজ্জামান অনুভব করেন কবি জীবনানন্দ দাশ এক প্রকার আছর করেছে তাকে। আমরাও তার কাজগুলোতে তেমনটিই দেখতে পাই। পশ্চিমের মেঘে সোনার সিংহ প্রথম উচ্চারিত হয় জীবনানন্দ দাশের কন্ঠে, অন্য এক গল্পকারের গল্প নিয়ে গল্পতে অন্য গল্পকার হলেন জীবনানন্দ দাশ। গল্পটিতে জীবনানন্দ দাশের একটি গল্পকে ব্যবচ্ছেদ করেন শাহাদুজ্জামান। তার অনুভব, জীবনানন্দ দাশের সত্ত্বা তার সাথে মিশে রয়েছে লেখক জীবনের একদম শুরু থেকেই। তাই সেই আছর থেকে মুক্তি পেতে শাহাদুজ্জামান আরো নিবিড়ভাবে অধ্যয়ন করেন ব্যক্তি জীবনানন্দ দাশকে।
এ বছর প্রথমা প্রকাশনের ব্যানারে বইমেলায় প্রকাশ পাওয়া ‘একজন কমলালেবু’ সেই নিবিড় অধ্যয়নের ফসল। বইটি জীবনীগ্রন্থ নয়, আবার ঠিক উপন্যাসও নয়। সাহিত্যবোদ্ধাদের সমালোচনায় তা মেটাফিকশান বা ডকুফিকশানের মধ্যে ঘোরাফেরা করলেও শাহাদুজ্জামান তা বিবেচনার ভার ছেড়ে দেন পাঠক সমাজের উপর।
কিন্তু একটা প্রশ্ন থেকে যায়। সাদা চোখে ব্যক্তিজীবনে একজন সফল মানুষ শাহাদুজ্জামান। শুধুমাত্র লেখকসত্ত্বা নয়, পেশাদার জীবনে তিনি একজন সফল চিকিৎসক, গবেষক এবং অধ্যাপক। তার ক্ষেত্রে কতটুকুই বা বোঝা সম্ভব একজন বেকার, ব্যর্থ মানুষ, হাহাকারের কবি জীবনানন্দ দাশকে? যার শেষ জীবনটি কেটেছে দুর্দশার চূড়ান্তে। শেষমেশ হয়তো পৃথিবীর প্রতি অভিমানে যিনি আত্মহত্যা করে বসেছিলেন ধীরগতির ট্রামের নিচে!
এ বছর বইমেলাতে প্রকাশিত শাহাদুজ্জামানের আরেকটি বই ‘কথা চলচ্চিত্রের’, প্রকাশক চৈতন্য। বইটি মূলত চলচ্চিত্র এবং বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালকদের বিভিন্ন কাজ সম্পর্কিত বিভিন্ন নিবন্ধের সংকলন। এছাড়াও আছে আন্দ্রেই তারকোভস্কির ডায়েরি ও তার বইয়ের কিছু অংশের অনুবাদ, আর্নেস্ট লিন্ডগ্রেন-এর একটি রচনার অনুবাদ এবং একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্রনাট্য।
সব মিলিয়ে শাহাদুজ্জামানের প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ২৫। সংখ্যা হিসেবে খুব বেশি না হলেও তার লেখার গভীরতা এবং বিষয়ের বিস্তৃতি তাকে বাংলা সাহিত্যের এ সময়কার একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ করে তুলেছে। ক্যাডেটের নিয়মতান্ত্রিক জীবন নিয়ে লেখেন ‘খাকি চত্বরের খোয়ারি’, চলচ্চিত্র বিষয়ে মুক যুগের কিংবদন্তী অভিনেতা চার্লি চ্যাপলিনকে নিয়ে লেখেন ‘চ্যাপলিন, আজো চমৎকার’।
একাডেমিক জীবনে থিসিসের বিষয় ছিলো নৃবিজ্ঞান সম্পর্কিত। সেই থিসিস পেপারটি পাঠকের সামনে উন্মক্ত হয় ‘একটি হাসপাতাল, একজন নৃবিজ্ঞানী, কয়েকটি ভাঙ্গা হাড়’ নামে। বইটি বর্তমানে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচির অন্তর্গত। রাইটার্স ব্লকের দিনগুলোতে গল্প লেখবার স্পৃহা থেকে অনুবাদ করেন বিদেশী ভাষার কিংবদন্তী সাহিত্যিকদের কিছু গল্প, সেগুলো একত্রে প্রকাশিত হয় ‘ক্যাঙ্গারু দেখার শ্রেষ্ঠ দিন এবং অন্যান্য অনুবাদ গল্প’ শিরোনামে।
শাহাদুজ্জামান এক বিস্তৃত জীবনের অধিকারী। বলা ভালো, শাহাদুজ্জামান কয়েকটি বিস্তৃত জীবনের অধিকারী। সাহিত্যের পাশাপাশি তার অপার আগ্রহ চিত্রকলা, সঙ্গীত, চলচ্চিত্র, রাজনীতি ইত্যাদি বিষয়ে। একসময় রেডিওতে গান করতেন, টেলিভিশনে চলচ্চিত্র বিষয়ক অনুষ্ঠান করতেন। সিনেমাবোদ্ধা হিসেবেও বিশেষ খ্যাতি আছে তার। থিয়েটার করতেন, পেইন্টার গ্রুপের সাথে যুক্ত ছিলেন। বহুমাত্রিক মাধ্যমের সাথে যুক্ত থাকার প্রতিফলন আমরা পাই তার সাহিত্যচর্চায়। পেশাগত জীবনে তার সার্থকতার বয়ান আমরা আগেই করেছি। আরেকটি তথ্য জানিয়ে রাখি, তার গবেষণাপত্রের সংখ্যা ৩৫!
তার এবং তার কাজের প্রতি আমরা শুভকামনা জানাই, অভিনন্দন জানাই বাংলা একাডেমি পুরষ্কার প্রাপ্তিতে। আর পাঠক হিসেবে আমাদের আশা, আরো অনেক অনেক বিহবল গল্প কিংবা অগল্প উপহার দিক বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের।