আজকের তরুণদের কাছে প্রচন্ড পরিচিত একটি নাম, ‘চে’…সত্যিই কি তাই? স্টাইলিশ টি-শার্টের সামনে পেছনে আজ ‘চে’ সত্যিই উজ্জ্বল! কিন্তু বুকপকেটের নিচের ঐ মনটাতে, ক্রমেই আধুনিকতার দাবি করতে থাকা আজকের এই তরুণদের চেতনাতে… চে গেভারা/ গুয়েভারা, প্রকৃতপক্ষে ‘আর্নেস্তো গেভারা দে লা সেরনা’ নামের ব্যক্তির পরিচয় ক্রমশই হচ্ছে বিলুপ্ত। ‘চে’ নামের খুব জনপ্রিয় ‘ব্র্যান্ড’টি অস্পষ্ট করে দিচ্ছে ব্যক্তি চে’কে।
‘চে’ তার প্রকৃত নাম নয়, যদিও এটিই সবচেয়ে বেশি পরিচিত তার ক্ষেত্রে। স্প্যানিশ ভাষায় ‘চে’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘প্রিয়’; কিউবায় সফল বিপ্লবের পর সেখানকার অধিবাসীগণ তার নাম দিয়ে দেয়-‘চে’। তিনি এই নামটিকে এত বেশি ভালোবেসে ফেলেছিলেন যে ১৯৬০ থেকে ১৯৬৭ সাল, অর্থাৎ তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি তার স্বাক্ষর হিসেবে ব্যবহার করতেন শুধুই এই শব্দটি-‘চে’।
১৯২৮ সালের ১৪ই জুন আর্জেন্টিনার রোসারিও গ্রামে বিপ্লবের জন্ম নেন এই প্রবাদপুরুষ; পিতা আর্নেস্তো গেভারা লিনচ ও মাতা সিলিয়া দে সেরনা। আইরিশ পিতা ও স্প্যানিশ মাতার পাঁচ সন্তানের মধ্যে চে’ই ছিলেন সবার বড়। তাদের পরিবারে বইত সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির ধারা, যা ভবিষ্যত জীবনে বিপ্লবী চে’কে গড়ে তুলতে শেকড়ের ভূমিকা পালন করেছে। চে’র পিতা ছিলেন গৃহযুদ্ধের সময় রিপাবলিকানদের গোঁড়া সমর্থক, চে’র ছোটবেলাতেই তিনি অনুভব করেন যে তার পুত্রের মধ্যেও আইরিশ বিদ্রোহের রক্ত প্রভাব ফেলছে।
খেলাধুলা যেমন পছন্দ করতেন, তেমনি পারদর্শীও ছিলেন চে…তা সাঁতার, গলফ, ফুটবল, শুটিং, সাইক্লিং, রাগবি যাই হোক না কেন! এককথায় একজন খেলুড়ে ব্যক্তি ছিলেন তিনি। রাগবি খেলায় প্রচন্ড ক্ষিপ্রতা কাজ করতো তার মধ্যে, রাগবি ইউনিয়নের নিয়মিত সদস্যও ছিলেন. বারকয়েক বুয়েন্স এয়ারস বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে খেলেছেনও। সাইক্লিংয়ে কখনোই ক্লান্ত হতেন না চে, যখনই সময় পেতেন ঘন্টার পর ঘন্টা সাইক্লিং করতেন। ১২ বছর বয়সে পিতার কাছে দাবা খেলা শেখার পর থেকে প্রায়ই বুদ্ধি শানিয়ে নিতেন দাবার ছকে, স্থানীয় প্রতিযোগিতায়ও অংশ নিয়েছিলেন। ঘোড়সওয়ারিও শিখেছিলেন শখ করে, কিছুই বোধহয় বাদ দিতে চাননি চে…হয়তো জীবনের কোন স্বাদই!
“চে কী ছিলেন?”-এই প্রশ্ন না করে বোধহয় প্রশ্ন করা উচিত, “চে কী ছিলেন না?”; একাধারে মার্ক্সবাদী, বিপ্লবী, চিকিৎসক, লেখক, বুদ্ধিজীবী, গেরিলা নেতা, কূটনীতিবিদ, সামরিক তত্ত্ববিদ এবং অবশ্যই যে পরিচয়টি চে’কে ‘চে’ করে তোলার পেছনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করেছে- তিনি ছিলেন কিউবা বিপ্লবের প্রধান ব্যক্তিত্ব। তার মৃত্যুর পর তার শৈল্পিক মুখচিত্রটি এর নির্দিষ্ট গন্ডি অতিক্রম করে হয়ে ওঠে একটি সর্বজনীন প্রতিসাংস্কৃতিক প্রতীক এবং এক জনপ্রিয় সাংস্কৃতিক বিশ্বপ্রতীক। ‘চে’ নামটি শুনলেই মনে ভেসে ওঠে এই ছবিটিই…
প্রবল ধরনের ভ্রমণপিয়াসু মন ছিল চে’র, সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়তেন বেড়াতে। তরুণ চে যখন সবেমাত্র ডাক্তারির পড়াশোনা করছেন সে সময় সমগ্র লাতিন আমেরিকা ভ্রমণের ঝোঁক চাপে তার, যেই ভাবা সেই বেরিয়ে পড়লেন আর কি! ঐ ভ্রমণটি তার জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভ্রমণ ছিল, কারণ তখনই তার চোখে ভালো করে ধরা পড়ে লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর সার্বিক অসহায়ত্ব। চারপাশে মূর্তমান দারিদ্রের কশাঘাত চে’র তরুণ মনে গভীর রেখাপাত করে। তিনি চোখ মেলে দেখতে পান তার চেনা জগতের সাথে সমান্তরালে বয়ে চলা এক অচেনা জগত, শোষিত মানুষের জগত। এই ভ্রমণ থেকে অর্জিত অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে চে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, এই অঞ্চলে বদ্ধমূল অর্থনৈতিক বৈষম্যের স্বাভাবিক কারণ হলো একচেটিয়া পুঁজিবাদ, নব্য ঔপনিবেশিকতাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ। চে অনুভব করেন, পরিবর্তন অনিবার্য; আর এই পরিবর্তনের জন্য আরো বেশি অনিবার্য একটি সশস্ত্র বিপ্লব। তিনি বিশ্বাস করতেন বিপ্লব কেউ কাউকে প্রদান করে না, বিপ্লব ছিনিয়ে আনতে হয়, বিপ্লব ঘটাতে হয়; কেউ কাউকে শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে দেয় না, মুক্ত নিজেদেরকেই হতে হয়।
এই ভ্রমণের ফলস্বরূপই চে গুয়েতামালার সামাজিক সংস্কার আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন এবং ধীরে ধীরে তার বৈপ্লবিক চেতনার ধারণা বদ্ধমূল হতে থাকে। ঘটনাক্রমে মেক্সিকো সিটিতে ফিদেল ক্যাস্ট্রো ও রাউল ক্যাস্ট্রোর সঙ্গে পরিচয় হবার পর তিনি প্রভাবান্বিত হয়ে তাদের আন্দোলনে যোগদান করেন এবং তারা কিউবার তৎকালীন একনায়ক বাতিস্তাকে উৎখাত করার লক্ষ্যে আন্দোলন পরিচালনা করেন। দুই বছরব্যাপী তাদের আন্দোলনটি সফল হয় এবং চে কিউবার জনগণের কাছে আপনজন হিসেবে আদৃত হন, বিপ্লবী হিসেবে হন বিশ্বপরিচিত।
বিপ্লব শুধু আগুনের ফুলিঙ্গই নয়, বিপ্লব ক্ষতস্থানে অষুধেরও ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে, চে এও দেখিয়েছেন তার মানবদরদী চরিত্রে। চে’র ‘মোটরসাইকেল ডায়েরীস’ থেকে পাওয়া যায় তার মোটরসাইকেল অভিযানটির কথা যেটি তিনি ও তার এক বন্ধু আলবার্টো গ্রানাডো করেছিলেন। অভিযানটির উদ্দেশ্য ছিল মূলত পেরুর সান পেবলোর লেপার কলোনিতে (কুষ্ঠ রোগীদের জন্য বিশেষ কলোনি) স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ কয়েক সপ্তাহ কাজ করা। এবং তিনি এই কাজটি করেছিলেন তার ডাক্তারি শিক্ষাজীবনের এক বছর বিরতি দিয়ে, নিঃসন্দেহে একটি প্রশংসনীয় ত্যাগ যা খুব কম মানুষই করতে পারবে এবং অবশ্যই চে অনেকের মধ্যে অনন্য ছিলেন; তিনি তার বিপ্লব শুধু একটি গন্ডিতে সীমাবদ্ধ না রেখে ঘটাতে চেয়েছিলেন বিপ্লবের বহুমাত্রিক প্রকাশ। এই ভ্রমণের দিনলিপি অর্থাৎ ‘মোটরসাইকেল ডায়েরীস’ থেকে পরবর্তী সময়ে চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়।
চে ভালবাসতেন কবিতা, কবিতা পড়তে…আবৃত্তি করতে কখনো তার ক্লান্তি হতো না। বয়ঃসন্ধিকাল থেকেই কবিতাসক্ত ছিলেন তিনি, খুব ভালো কবিতা আবৃত্তিও করতেন। বলা যায়, অনিশ্চিত জীবনের ফাঁকে কবিতায় চে খুঁজতেন এক পশলা স্বস্তি। রুডিয়ার্ড কিপলিং এর ‘if’ ও জোসে হার্নান্দেজ এর ‘martin fierro’ কবিতা দু’টি তিনি সবচেয়ে বেশি আবৃত্তি করতেন, প্রিয়ের তালিকায় এরা ছিল প্রথম। দু’টি কবিতার মতই তার জীবনে এসেছিলেন দু’জন নারী, তার দুই স্ত্রী। সবমিলিয়ে চে পাঁচ সন্তানের পিতা ছিলেন এবং সংসার জীবনে অত্যন্ত সন্তানবৎসল পিতা ছিলেন এই বিপ্লবী। জানা যায়, শেষবিদায়ের সময় স্ত্রী-সন্তানকে চিঠি দিয়ে গিয়েছিলেন চে।
চে ছিলেন এক বিশিষ্ট লেখক ও ডায়েরি-লেখক। গেরিলা যুদ্ধের ওপর তিনি একটি ম্যানুয়েল রচনা করেন।
চে গেভারা কিউবান ভাষায় লিখেছেন প্রায় ৭০টি নিবন্ধ, ধারণা করা হয় ছদ্মনামে কিংবা নামহীন অবস্থায় লিখেছেন ২৫টি। এছাড়া তিনি লিখে দিয়েছেন পাঁচটি বইয়ের ভূমিকা। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৫ পর্যন্ত ভাষণ আর সাক্ষাৎকার দিয়েছেন প্রায় ২৫০-এর কাছাকাছি। বিভিন্ন ব্যক্তিত্বকে লেখা তার অসংখ্য চিঠির মধ্যে সংগৃহিত আছে ৭০টির মতো। তার লেখালেখি নিয়ে এখন পর্যন্ত বের হয়েছে নয় খণ্ড রচনাবলি।
প্রতিদিনকার ঘটনাবলী লিখে রাখার অভ্যাস ছিল তার, গেরিলা যুদ্ধকালীন যখন সবাই বিশ্রাম নিত তখন অন্যদের অবাক করে দিয়ে চে তার নোটবই বের করে ডাক্তারদের হস্তাক্ষরের মতো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রায় অস্পষ্ট অক্ষরে লিখে চলতেন ডায়েরী। এই ডায়েরীটি তার বলিভিয়ার ডায়েরী বলে খ্যাত। এই ডায়েরীতে গেরিলা প্রধান হিসেবে তার দৃঢ়চরিত্রের বারংবার প্রমাণ মেলে।
চে’র কিছু উক্তি ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে, যা তার উপলব্ধিকে আরো স্পষ্ট করে তোলে।
**“বিপ্লব তো আর গাছে ধরা আপেল নয় যে পাকবে আর পড়বে, বিপ্লব অর্জন করতে হয়।”
**“নিষ্ঠুর নেতাদের পতন এবং প্রতিস্থাপন চাইলে নতুন নেতৃত্বকেই নিষ্ঠুর হতে হবে।”
**“নীরবতা একধরনের যুক্তি যা গভীর তথ্য বহন করে”
**”শিক্ষা ব্যবস্থা তৃনমূল পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে, যেখানে গরীব থেকে ধনী একই শিক্ষায় শিক্ষিত হবে, এমন নয় যাদের টাকা আছে শুধু তারাই শিক্ষিত হবে”
**”আমরা কিসের জন্য বাঁচব সেটা আমরা নিশ্চিত হতে পারি না যতক্ষণ না আমরা তার জন্য মরতে প্রস্তুত থাকি”
**“সবাই প্রত্যেকদিন চুলে চিরুনি চালায় যাতে চুল সুন্দর পরিপাটি থাকে, কেউ কেনো হৃদয় সুন্দর পরিপাটি রাখে না?”
**“বাস্তববাদী হও,’অসম্ভব’কে দাবী কর”
**“আমি কোনো মুক্তিযোদ্ধা নই, মুক্তিযোদ্ধা বাস্তবে কখনো হয় না যতক্ষণ মানুষ নিজে মুক্তিকামী হয়”
**“এবং কিছু ব্যাপার পরিষ্কার, আমরা চমৎকারভাবে শিখেছি একজন সাধারণ মানুষের জীবন পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ব্যক্তির সম্পদের চেয়েও লক্ষগুণ বেশি দামী”
**“নতজানু হয়ে সারা জীবন বাঁচার চেয়ে আমি এখনই মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত” “
**“বিপ্লবী হতে চাও? বিল্পবের প্রথম শর্ত, শিক্ষিত হও”
মৃত্যুর পূর্ব মুহুর্তে চে গেভারা সৈনিকদের বলেছিলেন,
“আমাকে গুলি করো না, আমি চে গেভারা, আমাকে মেরে ফেলার পরিবর্তে বাঁচিয়ে রাখলে তোমাদের বেশি লাভ হবে।“
কিন্তু তাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়নি। ১৯৬৭ সালের ৯ই অক্টোবর সারারাত বলিভিয়ার লা হিগুয়েরা গ্রামের একটি স্কুলঘরে আটকে রেখে তাকে হত্যা করা হয়। তার হত্যাকারী ছিলেন বলিভিয়া সেনাবাহিনীর মদ্যপ সার্জেন্ট মারিও তেরান। চে-কে ধরা ও হত্যা করার পেছনে কাজ করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ। মৃত্যুর পরপরই তিনি বিশ্বজুড়ে বিপ্লবীদের কাছে নায়ক হয়ে ওঠেন। তাকে হত্যার পেছনে লাতিন আমেরিকার একনায়ক শাসক আলফ্রেদো ট্রয়েসনারের হাত ছিল বলে তথ্য দিয়েছেন প্যারাগুয়ের গবেষক মার্টিন আলমাদা। কারণ‘ চে‘ তার বিরুদ্ধেও গেরিলা যুদ্ধ শুরু করতে পারেন বলে তার ভয় ছিল।
চে’কে সমাহিত করা হয় কিউবার সান্তা ক্লারায়, তার ভালবাসার স্থানে।
তার মৃত্যুর পর নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছিল, “একজন মানুষের সঙ্গে সঙ্গে একটি রূপকথাও চিরতরে বিশ্রামে চলে গেল।‘ টাইম পত্রিকা বিংশ শতাব্দীর সর্বাপেক্ষা প্রভাবশালী ১০০ জন ব্যক্তির যে তালিকা করেছে সেখানে তার নামও রয়েছে।”
বিপ্লব কখনো বিপ্লবীর মৃত্যুর সাথে শেষ হয়ে যায় না, চে’ও তাই বেঁচে থাকবেন আজকের ও আগামীর বিপ্লবীদের মাঝে…তাই তার ব্যক্তিত্ব যেন অস্পষ্ট না হয়ে যায়…।