স্বর্ণ মন্দির! যে মন্দিরের নিচের গোপন ভল্টে লুকানো আছে অকল্পনীয় এক ধন সম্পদের বিশাল ভাণ্ডার! ভারতের কেরালা রাজ্যের থিরুভানানথাপুরাম শহরে অবস্থিত শ্রী পদ্মনাভস্বামী মন্দিরকে বলা হয় পৃথিবীর ইতিহাসে এখনও পর্যন্ত যত ধরণের প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছে তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সম্পদশালী প্রতিষ্ঠান, সবচেয়ে ধনী ধর্মীয় উপাসনালয় তো বটেই।
এই মন্দিরের নিচের ভূগর্ভস্থ ৮ টি ভল্টের মধ্যে রয়েছে অজস্র রকমের ধন সম্পদের সমাহার। এর মধ্যে ৩ টি ভল্ট খোলা হয়নি, তাই সেগুলোতে কী আছে তার সঠিক তালিকা নেই। অন্য পাঁচটিতে রয়েছে স্বর্ণ, হীরা, রুবি, পান্না, নীলা সহ অমূল্য সব দুর্লভ রত্ন পাথর, এসব মূল্যবান ধাতু থেকে থেকে নির্মিত রত্ন খচিত মূর্তি, অলংকার, তৈজসপত্র সহ নানা রকম দ্রব্যাদি, প্রাচীন মুদ্রা ইত্যাদি অসংখ্য রকমের মূল্যবান সম্পদরাশি। আর এই ৫টি ভল্টের সম্পদের মিলিত আর্থিক মূল্য হিসেবে করলে সেটি দাঁড়ায় ২,২০০ কোটি মার্কিন ডলার! ঐতিহাসিক বিবেচনায় যেগুলো অমূল্য। যে ভল্টগুলো খোলা হয়নি তাদের মধ্যে একটি ভল্টের সম্পদের পরিমাণের একটি ধারণা পাওয়া যায় ইতিহাসের কিছু বর্ণনা ও রেকর্ড থেকে। সেটা এখন বললে লেখার শুরুতেই মাথা ঘুরতে পারে। সেই তথ্যটি জানবেন এই লেখার একেবারে শেষে।
আঠারো এবং উনিশ শতকে কেরালার মধ্য ও দক্ষিণ অংশ নিয়ে গঠিত ট্রাভাঙ্কোর রাজ্যের শ্রী পদ্মনাভস্বামী মন্দিরটি ষোল শতকে স্থাপিত হয়েছিল বলে অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন। তবে এর আগে থেকেই এখানে মন্দির থাকার অনেক বর্ণনা পাওয়া যায় ইতিহাসে, সে অনুসারে এর স্থাপনকাল সঠিকভাবে জানা যায় না। ট্রাভাঙ্কোর রাজ্য সৃষ্টির অনেক অনেক আগে খ্রিস্টপূর্ব ২০০ সালের মুদ্রাও রক্ষিত আছে মন্দিরের ভল্টের ভেতরে, যদিও তা পরবর্তী সময়ে নৈবদ্য হিসেবে আসতে পারে এমন ধারণাও রয়েছে। ব্রাহ্ম, মাৎস্য, বরাহ, স্কন্দ, পদ্ম, বায়ু, ও ভগবত এই পুরাণগুলোতে এবং মহাভারতে এই স্থানের মন্দিরের উল্লেখ রয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ সাল থেকে খ্রিস্টের জন্মের ৩০০ সালের মধ্যে রচিত প্রাচীন তামিল সাহিত্যের সঙ্গম আমল নামক সময়কালের রচনায় এই মন্দিরকে ‘স্বর্ণমন্দির’ রূপে আখ্যায়িত করা হয়েছে এর বিপুল সম্পদের কারণে। মন্দিরের নির্মাণ সংক্রান্ত রেকর্ডে উল্লেখ আছে, কলিযুগ শুরু হবার পর দিবাকর মুনি এই মন্দিরটির নির্মাণকাজ শুরু করেন এবং এটি তৈরি হতে সময় লেগেছিল প্রায় ৯৬৪ দিন।
অনেক ইতিহাসবিদের মতে এই মন্দিরের নাম স্বর্ণ মন্দির হবার কারণ, নির্মাণের সময় থেকেই এটি বিপুল পরিমাণে সম্পদশালী ছিল। অনেক প্রাচীন তামিল সাহিত্য রচনায় এমনকি খ্রিস্টীয় নবম শতকের ভারতীয় কবিতায় এই মন্দির ও এর শহরের দেয়াল স্বর্ণনির্মিত এমন আখ্যা দেয়া হয়েছে। কোন কোন রচনায় এই মন্দিরকে অভিহিত করা হয়েছে স্বর্গ হিসেবে।
আঠারো শতকের মাঝামাঝিতে ট্রাভাঙ্কোরের রাজা হন আনিঝাম থুরিনাম যিনি পরিচিত মার্তণ্ড ভার্মা হিসেবে। মার্তণ্ড ভার্মা ১৭৫০ সালে ট্রাভাঙ্কোর রাজ্যটি দেবতা পদ্মনাভস্বামীর পদচরণে সমর্পণের ঘোষণা দেন। তার পরবর্তী বংশধর ‘পদ্মনাভ দাস’ হিসেবে ট্রাভাঙ্কোর শাসন করবে, দেবতার নিকট এমন প্রতিশ্রুতির ঘোষণাও দেন তিনি। সেই থেকে ট্রাভাঙ্কোরের রাজ পরিবারের পুরুষ সদস্য ও রাজারা নামের আগে শ্রী পদ্মনাভ দাস উপাধি এবং নারী সদস্যরা শ্রী পদ্মনাভ সেবিনী উপাধি ধারণ করে আসছেন।
২০১১ সালে মন্দিরের এই অসাধারণ রত্নখনির আবিস্কার ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে, কারণ পৃথিবীর ইতিহাসে এক জায়গা থেকেই এত পরিমাণ স্বর্ণনির্মিত দ্রব্য ও রত্ন পাথরের সংগ্রহ আর কখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। দেবতা পদ্মনাভস্বামী এই মন্দিরের সমস্ত সম্পদের মালিক, এমনটাই বিশ্বাস করা হয়। মন্দিরটি পরিচালিত হয় একটি ট্রাস্টের মাধ্যমে যে ট্রাস্টের প্রধান ছিল ট্রাভাঙ্কোরের রাজ পরিবার। আইনজীবী টি পি সুন্দররাজন মন্দিরের অব্যবস্থাপনা নিয়ে একটি মামলা করেন। ২০১১ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট সেই মামলার শুনানিতে নির্দেশ দেয় এই মন্দিরের ভূগর্ভস্থ ভল্টগুলোর সম্পদের তালিকা তৈরির। আর তার পর সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে শ্রী পদ্মনাভস্বামী মন্দির হয়ে উঠে এক মহা বিস্ময়ের নাম।
মন্দির পরিচালনা কমিটি ছয়টি ভল্টের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানত। মন্দিরের পশ্চিম দিকে এর ‘গর্ভগৃহ’ অর্থ্যাৎ মন্দিরের পবিত্রতম স্থান বিবেচনা করা হয় যাকে সেই দেবমূর্তি রাখার স্থানটির খুব কাছেই মাটির নিচে এই ভল্টগুলো ছিল। তথ্য সংরক্ষণের জন্য ভল্টগুলোকে ‘এ’, ‘বি’, ‘সি’, ‘ডি’, ‘ই’ এবং ‘এফ’ দিয়ে চিহ্নিত করা হয়। পরবর্তীতে তালিকা তৈরি করতে গিয়ে আরও দুটো ভল্ট আবিস্কৃত হয় যাদেরকে ‘জি’ এবং ‘এইচ’ দিয়ে চিহ্নিত করা হয়।
চারটি ভল্ট, যেগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে সি, ডি, ই এবং এফ দিয়ে, সেগুলো ছিল মন্দিরের পুরোহিতদের দায়িত্বে। প্রতি বছর অন্তত আটবার সেই ভল্টগুলো খোলা হত। ভল্টের বিভিন্ন জিনিস মন্দিরের উৎসব ও বিশেষ আয়োজনের সময় ব্যবহার করা হত। কাজ শেষে সেগুলো আবার রেখে দেয়া হত এই চারটি ভল্টে।
ভারতের সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী গঠিত কমিটির সদস্যরা ২০১১ সালের ৩০ জুন মন্দিরের নিচের ভল্টগুলো খুলতে যান। সেখানে ভল্টগুলোর প্রধান প্রবেশদ্বার খুলে প্রথমে তারা ভল্ট ‘এ’ তে প্রবেশ করার সিদ্ধান্ত নেন। ভল্ট এ এর প্রবেশমুখেই তারা একটি লোহার গ্রিল দেখতে পান, সেটি খোলা হয়। এরপর আসে একটি ভারী কাঠের দরজা, সেটিও খোলা হয়। এরপর দরজাটি পেরিয়ে তারা যে স্থানে প্রবেশ করেন সেখানে মেঝেতে একটি গ্রানাইট স্ল্যাব মানে জমাটবাঁধা পাথরের স্ল্যাব দেখতে পান। সেটি সরিয়ে পাওয়া যায় পাঁচ বা ছয় ধাপের একটি সিঁড়ি। সিঁড়িটি পেরিয়ে নামার পর একটি ছোট অন্ধকার রুমে আসেন তারা। এখানেই রক্ষিত ছিল ‘এ’ ভল্টের অমূল্য সব ধন সম্পদ। সেগুলো গোটা রুম জুড়ে ছড়ানো অবস্থায় দেখেন তারা। কোনো কিছু সুন্দর করে গোছানো অবস্থায় ছিল না। ঝুড়ি, মাটি ও তামার পাত্র ভর্তি করে রাখা ছিল দামী দামী সব জিনিস। এক এক করে ভল্ট থেকে সমস্ত সম্পদ বাইরে নিয়ে এসে তালিকা প্রস্তুত করতে সময় লেগেছিল একটানা ১২ দিন!
বিশ্বাস করা হয়, ‘বি’ চিহ্নিত ভল্টের মূল দরজাটি কয়েক শত বছর ধরে বন্ধই আছে। কমিটির সদস্যরা ২০১১ সালের জুলাইয়ে ভল্ট ‘বি’ তে প্রবেশের চেষ্টা করেন। প্রথমে তারা এর প্রবেশমুখে লোহার গ্রিল দেয়া দরজাটি খুলে ভেতরে ঢুকেন। এরপর দেখা যায় অত্যন্ত মজবুত ও ভারী কাঠের একটি দরজা। সেটিও খোলা হয়। এরপর আসে একটি লোহার দরজা। লোহার দরজায় গোখরো সাপের ছবি খোদাই করা আছে। ট্রাভাঙ্কোরের রাজপরিবার জানিয়েছিল, গোখরো সাপের ছবি খোদাই করা সেই দরজাটি খুললে একটি ভয়ঙ্কর ভবিষ্যৎবাণী ফলে যাবে। বিশ্বাস করা হয়, এই দরজাটি খুললে তা সারা পৃথিবীর উপর অত্যন্ত ভয়াবহ দুর্যোগ সৃষ্টি করবে। ৪ জুলাই তারিখে সাত সদস্যের কমিটি এখনই দরজাটি না খুলে এর আগে আরও কিছু বিশেষজ্ঞের সাথে আলাপ করার সিদ্ধান্ত নেন। ধর্মীয় রীতিতে দেবতা যাতে রুষ্ট না হন সেজন্য দরজাটি খোলার আগে ‘অষ্টমঙ্গল দেবপ্রশ্নম’ পালনের সিদ্ধান্ত নেন তারা। কিন্তু সেটি আর খোলা হয়ে উঠে নি। যার করা মামলার কারণে এই মন্দিরের বিষয়টি আদালতে এসেছিল কাকতালীয় ভাবে সেই আইনজীবী পি টি সুন্দররাজন মারা যান সেই মাসে। আর এই ঘটনার কারণে যারা এই দরজা খোলার বিপক্ষে ছিলেন তারা আরও শক্তভাবে বলতে লাগলেন যাতে দরজা খোলা না হয়। এরই মধ্যে ট্রাভাঙ্কোরের রাজ পরিবারের আপিলের কারণে সুপ্রিম কোর্ট আবার বি ভল্টের দরজা খোলার সিদ্ধান্তকে স্থগিত করে দেয়।
২০১২ সালের মধ্যে এ, সি, ডি, ই এবং এফ ভল্টের দ্রব্যসামগ্রীর তালিকাকরণের কাজ শেষ হয়। ভল্ট বি, জি এবং এইচ এরপর আর খোলা হয়নি। ভল্ট বি এর মত জি এবং এইচ চিহ্নিত ভল্ট দুটিও এভাবে শত শত বছর ধরে খোলা হয়নি বলে বিশ্বাস করা হয়।
মন্দিরের যে ভল্টগুলো খোলা হয়েছে সেগুলোতে রক্ষিত সম্পদের একটি তালিকা তৈরি করা হয়। তবে এই তালিকার সম্পূর্ণ বিবরণী প্রকাশ করা হয়নি। পত্রিকার রিপোর্ট থেকে কী কী সম্পদ সেখানে ছিল তার একটি ধারণা পাওয়া যায়। ভল্ট ‘সি’ তে রয়েছে ১৪৬৯ ধরণের এবং ভল্ট ‘ডি’ তে রয়েছে ৬১৭ ধরণের দ্রব্যসামগ্রী। ভল্ট ‘ই’ এবং ভল্ট ‘এফ’ এ রয়েছে ৪০ ধরণের দ্রব্যসামগ্রী। আর কেবলমাত্র ভল্ট ‘এ’ তেই রয়েছে ১ লক্ষ ২ হাজার ধরণের দ্রব্যসামগ্রী!
আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী এই পাঁচটি ভল্টের সম্পদের সম্পূর্ণ তালিকা প্রকাশ না করা হলেও, কমিটির সদস্য ও অন্যান্য সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী করা পত্রিকার রিপোর্ট থেকে সেখানে বিদ্যমান অজস্র ধন দৌলতের মধ্যে কিছু কিছু সম্পদের বর্ণনা জানা যায়। এই ভল্টের সম্পদের মধ্যে আছে,
সাড়ে ৩ ফুট দীর্ঘ একটি স্বর্ণের বিষ্ণুমূর্তি যাতে খচিত আছে হীরা ও রুবিসহ মূল্যবান রত্ন পাথর।
স্বর্ণের তৈরি একটি সিংহাসন যাতে অন্তত সাড়ে ৫ মিটার দীর্ঘ একটি মূর্তি স্থাপন করা যায়। সিংহসনের গায়ে খচিত আছে শত শত হীরা ও অন্যান্য রত্ন পাথর।
সাড়ে ৫ মিটার লম্বা একটি স্বর্ণের চেইন।
৫০০ কেজি ওজনের একটি স্বর্ণের স্তুপ।
৩৬ কেজি ওজনের একটি পর্দার মত আবরণী।
রত্নখচিত স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে বানানো ১,২০০ টি চেইন।
স্বর্ণের জিনিসপত্র, নেকলেস, মুকুট, হীরা, রুবি, নীলকান্তমণি, পান্না, রত্ন পাথর ও মূল্যবান ধাতব দ্রব্যাদি ভর্তি কয়েকটি বস্তা।
দেবমূর্তির শরীর আচ্ছাদনের জন্য প্রায় ৩০ কেজি ওজনের স্বর্ণের আবরণ।
স্বর্ণ নির্মিত নারকেলের মালা যাতে খচিত আছে রুবি ও পান্না।
১৮ শতকের নেপোলিয়নের আমলের মুদ্রা।
রোমান সাম্রাজ্যের কয়েক হাজার মুদ্রা।
খ্রিস্টপূর্ব ২০০ সালের ১,৯৫০০০ টি স্বর্ণমুদ্রা যেগুলোর ওজন সব মিলিয়ে ৮০০ কেজি।
অন্তত ৩টি (বিভিন্ন রিপোর্টে বিভিন্ন সংখ্যার উল্লেখ আছে) সম্পূর্ণ স্বর্ণ নির্মিত আর হীরা ও অন্যান্য রত্ন খচিত রাজমুকুট।
কয়েকশ স্বর্ণের চেইন।
কয়েক হাজার স্বর্ণের পট ও জার।
সম্পূর্ণ বিবরণী প্রকাশ করা হয়নি তাতেই এই অবস্থা, প্রকাশিত হলে আরও কী কী পাওয়া যেতে পারে তার পুরোটা অনুমান করা হয়ত কোনো মানুষের পক্ষেও সম্ভব নয়। শ্রী পদ্মনাভস্বামী মন্দিরের এই বিপুল পরিমাণ ধন সম্পত্তি কোথা থেকে এল এমন প্রশ্ন তো আছেই। বিশ্বাস করা হয়, হাজার হাজার বছর ধরে মন্দিরের দেবতার উদ্দেশ্যে দান করা সম্পদগুলোই জমা হয়ে আছে ভূগর্ভস্থ ভল্টে। ভারতের বিভিন্ন সময়ের শাসনকারী রাজপরিবারগুলো এখানে দান করেছে। মেসোপটেমিয়া, গ্রিস, রোম, জেরুজালেম হতে শাসকবৃন্দ ও বণিকেরাও ভারতবর্ষে এসে মন্দিরে দান করেছে। এরপর ঔপনিবেশিক শাসনের সময়েও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে এসেছে দানের সামগ্রী।
অনেক গবেষকও মতামত দিয়েছেন, এই সম্পদ হাজার বছরের অর্জন। দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে স্বর্ণের খনি ছিল। সুমেরীয় আমলে মালাবার অঞ্চলে ছিল ব্যবসা বাণিজ্যের কয়েকটি কেন্দ্র। সেই সূত্রে স্বর্ণ ও সম্পদ মন্দিরের কাছাকাছি স্থানেই ছিল যেখান থেকে তা মন্দিরে অর্পিত হতে পারে দেবতার নৈবদ্য হিসেবে। ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে টিপু সুলতান সহ অনেকের আক্রমণের মুখে পালিয়ে এসে এই মন্দিরে আশ্রিতদের ধন সম্পদও এখানে লুকিয়ে রাখা হত নিরাপদ জায়গা হিসেবে। প্রখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ ও ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র নাগাস্বামী এ ব্যাপারে জানান, কেরালার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এই মন্দিরের দেবতার উদ্দেশ্যে নৈবদ্য হিসেবে ধন সম্পদ দেয়ার রেকর্ড পাওয়া যায় ইতিহাসের বিভিন্ন দলিল থেকে। মহারাণী গৌরী লক্ষ্মী বাঈ এর শাসনামলে কেরালার কয়েকশ মন্দিরের অব্যবস্থাপনার কারণে এগুলোকে সরকারের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা হয়। এসব মন্দির থেকে অনেক স্বর্ণালংকার সরিয়ে নিয়ে রাখা হয় শ্রী পদ্মনাভস্বামী মন্দিরে। ১৭৭৬ থেকে ১৭৯২ সাল পর্যন্ত ট্রাভাঙ্কোর রাজ্যে আশ্রয় নেয় প্রায় বারো জনের মত হিন্দু রাজা যারা টিপু সুলতানের বাহিনীর কাছে পরাজিত হওয়ার ভয়ে পালিয়েছিলেন। পালানোর সময় তারা যত পারেন ধন সম্পদ নিয়ে এসেছিলেন এবং দান করেছিলেন পদ্মনাভস্বামী মন্দিরে। ব্রিটিশদের নিকট টিপু সুলতানের পরাজয়ের পর এই রাজারা তাদের এলাকায় ফিরে যাবার পরেও তারা এবং তাদের বংশধরেরা এই মন্দিরে দান করেছিলেন। এছাড়া মন্দিরের ভক্ত ধনী ব্যবসায়ী ও জমিদারদের দান তো ছিলই।
প্রাচীন মালায়লাম ও তামিল ইতিহাসের এক বিশাল ভাণ্ডার হল ‘কজনপত্র’ বা তালপাতায় লিখিত ইতিহাস। এমন ৩,০০০ টি বান্ডেল আর্কাইভে সংরক্ষিত রয়েছে, যার প্রতিটি বান্ডেলে রয়েছে কয়েক হাজার তালপাতা। সেখানে লিখিত আছে হাজার বছর ধরে শ্রী পদ্মনাভস্বামী মন্দিরে স্বর্ণ ও মূল্যবান দ্রব্যাদি নৈবদ্য প্রদান করার তথ্য। এর মাত্র অল্প কিছু পাতা এখনো গবেষণা করা হয়েছে। বাকিগুলো থেকে তথ্য উদ্ধার করা গেলে হয়ত জানা যাবে মন্দিরের বিপুল ধনভাণ্ডারের উৎসের ইতিহাস।
১৯৩৩ সালে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত এমিলি গিলিক্রিস্ট হ্যাচ নামক একজন লেখিকার ‘Travancore: A Guide Book for the Visitor’ বইয়ে উল্লেখ আছে, ১৯৩১ সালে রাজা চিথিরা থিরুনাল বলরাম ভার্মার আদেশে ‘বি’ ভল্টের একেবারে বাইরের অংশটির দরজা একবার খোলা হয়েছিল। তিনি আরও লিখেন, এর দুই যুগ আগে ১৯০৮ সালে রাজ্যের অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন দেখা দেওয়ায় এই ভল্টটি খুলে সেখানকার সম্পদ কাজে লাগানোর কথা চিন্তা করা হয়েছিল। একদল লোক আলো হাতে ভল্টে প্রবেশের চেষ্টা করে। এরপর কোবরা বা গোখরো সাপের আক্রমণে পড়ে প্রাণ বাঁচানোর জন্য তারা সেখান থেকে পালিয়ে আসে।
যাই হোক, আদালতের নিযুক্ত ‘এমিকাস কিউরি’ বা ‘আদালতের বন্ধু’ হিসেবে আইনজীবী গোপাল সুব্রামানিয়াম ২০১৪ সালে তার প্রদত্ত রিপোর্টে যথাযথ ধর্মীয় রীতি পালনের পর এই ‘বি’ ভল্টটি আবার খোলার পরামর্শ দেন।
উপরে যে ধনসম্পদের একাংশের কিছু বর্ণনা দেয়া হয়েছে সেগুলো ছিল তালিকাকৃত পাঁচটি ভল্টের সম্পদের অংশ। এই পাঁচটি ভল্টের মোট সম্পদের যেগুলোর আর্থিক মূল্য প্রায় ২,২০০ কোটি মার্কিন ডলার। ‘বি’ ভল্টে কী এমন আছে যার জন্য এত দুর্ভেদ্য সেই ভল্ট? ট্রাভাঙ্কোরের রাজ পরিবারের ১৮৮০ সালের ইতিহাস থেকে একটি নির্ভরযোগ্য তথ্য জানা যায় ‘বি’ ভল্টের সম্পদের ব্যাপারে। সে তথ্য অনুসারে, সেই আমলে এই ভল্ট এর সম্পদের আর্থিক মূল্য ছিল ১২ হাজার কোটি রুপি। বর্তমানে স্বর্ণের দাম এবং মুদ্রাস্ফীতি হিসেব করে সেই মূল্য কততে দাঁড়িয়েছে জানতে চান? ৫০ ট্রিলিয়ন বা ৫০ লক্ষ কোটি রুপি, আর আন্তর্জাতিক হিসেবে, ১ ট্রিলিয়ন বা ১ লক্ষ কোটি মার্কিন ডলার! বাংলাদেশের টাকায় কত হয় সেটা আপনিই হিসেব করুন। আর এসব সম্পদের সাংস্কৃতিক-ঐতিহাসিক মূল্য তো মানুষের হিসেবের বাইরে।
ইতিহাসের কিছু সম্পদের হিসেব দিলে হয়ত এই মন্দিরের পৃথিবীর সবচেয়ে সম্পদশালী প্রতিষ্ঠানের খেতাবটা বোঝা যাবে। সম্রাট আকবর, জাহাঙ্গীর ও শাহজাহানের আমলের মুঘল রাজকোষের সবচেয়ে রমরমা সময়ে সেখানে ছিল সাত টন স্বর্ণ, প্রায় ৩৭ কেজি অপরিশোধিত হীরা, প্রায় ৪৫ কেজি রুবি ও ৪৫ কেজি পান্না আর প্রায় ২৭২ কেজি মুক্তা! আজকের যুগের হিসেব অনুসারে, মুঘল আমলের জিডিপি সবচেয়ে বেশি ছিল সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে, প্রায় ৯ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। ভাবুন তাহলে, সেটাও এই মন্দিরের সম্পদের তুলনায় কিছুই ছিল না, বিখ্যাত ব্রিটিশ ক্রাউন জুয়েলের মূল্যের হিসেব তো বাদই দিলাম। আজ পর্যন্ত পৃথিবীর ইতিহাসের কোনো সময়ের কোনো ধনভাণ্ডারের আর্থিক মূল্য শ্রী পদ্মনাভস্বামী মন্দিরের সম্পদভাণ্ডারকে ছাড়িয়ে যেতে পারে নি।
এই বিশাল সম্পদের বিবরণী লোকচক্ষুর সামনে চলে আসার পর এই মন্দিরের ধন সম্পদের মালিকানা কার তা নিয়ে যখন তুমুল আলোচনা চলছে সারা ভারত জুড়ে তখন ভারতের প্রায় ৪৫ কোটি মানুষ দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত। ঠিক সে সময় কেরালা রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী উমেন চাণ্ডি বলেন, “এই স্বর্ণ দেয়া হয়েছে দেবতার নৈবদ্য হিসেবে। এর মালিকানা মন্দিরের। সরকার মন্দিরের সম্পদের নিরাপত্তা রক্ষা করবে ট্রাভাঙ্কোরের রাজ পরিবার, মন্দির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ও মন্দিরের পুরোহিতদের সাথে আলোচনা করে।” এই সম্পদ মন্দিরের মালিকানার কিনা সেই বিতর্কের এক পর্যায়ে প্রখ্যাত আইনজ্ঞ ভি আর কৃষ্ণ আয়ার বলেন, “দেবতার সম্পদের মালিকানা জনগণের, রাজার নয়। হিন্দু কিংবা কোনো নির্দিষ্ট ধর্মীয় গোষ্ঠীর এই সম্পদের মালিক এমন বলাটা অর্থহীন। ধনীরা নয় বরং দরিদ্র এবং যাদের অর্থের প্রয়োজন আছে তারা যাতে এই সম্পদ থেকে উপকৃত হয় তেমন ব্যবস্থা করা দরকার।”
ইতিহাসের কত চড়াই উৎরাই সময়ে হয়ত কোন বিপদ থেকে রক্ষা পাবার উদ্দেশ্যে কত বিশ্বাসী মানুষ দেবতার চরণে সম্পদ অর্পণ করেছিলেন। কেউবা হয়ত তার সমৃদ্ধি আরও স্থায়ী করার জন্য, কেউবা কেবলই ঈশ্বরকে সন্তুষ্ট করতে তাদের সম্পদ দিয়েছিলেন মন্দিরের ভাণ্ডারে। সেই সমস্ত সম্পদ নিয়ে আজকের এই বিপুল ধনরাশি। কিন্তু এই সম্পদ যদি মানুষের কাজে না লাগে তাহলে তার এত এত আর্থিক মূল্যের সত্যিকারের ‘মূল্য’টাই বা কী? মানুষের সমাজে অমানবিক জীবন বজায় রেখে কি উপাসনালয়ের ধনভাণ্ডারের নিরাপত্তা বিধান চলতে পারে? সাম্যবাদী কবিতায় বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম উচ্চারণ করেছিলেন, “মিথ্যা শুনিনি ভাই, এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নাই।” মন্দির হোক, কিংবা মসজিদ, মানুষের হৃদয়ের দাবি শোনার জন্যই তো ধর্ম!