মৃত্যুর ফলে প্রিয়জন হারানোর বেদনা কখনো ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। তবে জীবনের গতির সাথে তাল মেলাতে গিয়ে ধীরে ধীরে আমরা আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠি, হাসি ফুটে ওঠে ঠোঁটের কোণে। আবার এমন কিছু মানুষও আছেন যারা প্রিয়জন হারানোর এ বেদনাকে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেন না। তাই শেষ পর্যন্ত মৃতদেহকে কবর থেকে তুলে এনেছেন কেউ কেউ। কেউবা আবার মৃতব্যক্তির শেষকৃত্যানুষ্ঠান সম্পন্ন না করে বরং নিজের কাছেই রেখে দিয়েছেন তাকে! সাম্প্রতিককালে মৃতদেহের সাথে মানুষের বসবাসের এমনই কিছু অদ্ভুত ঘটনা নিয়ে সাজানো হয়েছে আজকের লেখাটি।
১
প্রায় ২০ বছর আগের কথা। ব্রুকলিনে রিটা ওলফেন্সন নামে এক মহিলার ছেলে হঠাৎ করেই নিখোঁজ হয়ে যান, যার বয়স ছিলো তখন ৩০ বছর। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে অবশেষে পাওয়া যায় ছেলেটির সন্ধান। তবে জীবিত নয়, মৃত। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয় হলো- ছেলেটি আসলে কখনোই নিখোঁজ হয় নি, বরং সবসময় বাড়িতেই ছিলো। বাড়ির তিন তলার গুদামঘরে ছেলেটির কঙ্কাল খুঁজে পান তার ফুপু। তখনও তার পরনে শার্ট, জিন্সের প্যান্ট ও স্নিকার ছিলো। পাতলা একটি তোষকে হেলান দেয়া অবস্থায় ছিলো সেই কঙ্কালটি। স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধারণানুযায়ী, তার ছেলে লুইস ওলফেন্সন যে নিজ বাসাতেই মারা গিয়েছে, রিটা সম্ভবত সেটা জানতেই পারেন নি। তিনি ভেবেছিলেন তার ছেলে বোধহয় কোনো কারণে তার উপর অভিমান করে বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছে এবং সকল প্রকার যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে।
এ ভুল ধারণার জন্য রিটা আসলে গত ২০ বছর ধরে তার ছেলের মৃতদেহের সাথেই বসবাস করে এসেছেন, তবে নিজেরই অগোচরে!
২
২০১৪ সালের ৩ মে আমেরিকার ইন্ডিয়ানা অঙ্গরাজ্যের লাফায়েত শহরের পুলিশ নিজ বাড়ির মেঝের নিচ থেকে ৮৮ বছর বয়সী জেরাল্ড গাভানের মৃতদেহ উদ্ধার করেন। তার স্ত্রী প্রথমে জানান যে, তার স্বামী পাঁচ দিন আগে মারা গেছেন। কিন্তু ময়নাতদন্ত থেকে জানা যায় যে, গাভান কমপক্ষে নয় মাস আগে মারা গেছেন!
প্রায় এক বছর আগে থেকেই পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধবেরা গাভানকে দেখতে না পেয়ে তার স্ত্রী সলোমনের কাছে গাভান কোথায় গেছে জানতে চাইতেন। কখনো গলফ খেলতে যাওয়া কিংবা কখনো গ্র্যান্ড ক্যানিয়নে ঘুরতে যাওয়ার কথা বলেই সবসময় পার করে দিতেন সলোমন। এক পর্যায়ে তাদের সন্দেহের উদ্রেক হলে তারা পুলিশে খবর দেন। তারপরই উদ্ধার হয় গাভানের মৃতদেহ।
চুরি ও মৃতদেহের ব্যাপারে পুলিশকে রিপোর্ট না করার অভিযোগে গাভানকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এরপরই বেরিয়ে আসে অদ্ভুত এক তথ্য। গাভান আসলে চেয়েছিলেন যে, তার মৃতদেহটি যেন ‘আকাশ-সমাহীতকরণ’ পদ্ধতিতে সমাহীত করা হয়। এ প্রথাটির চর্চা করা হয় তিব্বতে। তিব্বতী ভাষায় এ প্রথাটির নাম ‘ঝাটর’, যার অর্থ পাখিদের খাদ্য দেয়া। সাদা কাপড়ে মুড়িয়ে মৃতদেহটিকে প্রথমে পাহাড়ের উপরে দেহ সৎকারের স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে থাকা সন্নাসীরা এরপর কাপড় সরিয়ে কুড়াল দিয়ে দেহটিকে টুকরো টুকরো করে ফেলেন! তারপর সেখানে উড়ে আসে শকুনের মতো মাংশাসী পাখিরা। তারা এসে মৃতদেহটিকে সাবাড় করে দিয়ে যায়। শকুনেরা তো শুধু মাংস খেয়েই উড়ে যায়, থেকে যায় মৃতদেহের হাড়গুলো। সেগুলোকে এরপর হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে গুড়ো গুড়ো করে ফেলা হয়। হাড়ের চূর্ণকে এরপর ময়দার সাথে মিশিয়ে অন্যান্য ছোট পাখিদের খাওয়ানো হয়। আকাশ থেকে উড়ে আসা প্রাণীদের সাহায্যে এ সৎকারের কাজ করা হয় বলেই এর এরুপ নামকরণ।
সলোমনের মতে, গাভান তাকে বলেছিলেন দরজা খুলে রাখতে। তাহলে পাখিরা এসে দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকে তার দেহটি খেয়ে যাবে। কিন্তু এটা করে আসলে কোনো লাভই হয় নি। তাই তিনি মৃতদেহটি মেঝের নিচে রেখে দিয়েছিলেন!
৩
২০১৩ সালের মার্চ মাসে কানাডার অন্টারিওর বাসিন্দা পিটার ওয়াল্ড ডায়াবেটিসজনিত অসুস্থতায় মৃত্যুবরণ করেন। প্রচলিত কোনো চিকিৎসা গ্রহণে তিনি রাজি ছিলেন না। কারণ পিটার বিশ্বাস করতেন যে, ঈশ্বর তাকে সুস্থতা দান করবেন। স্বামীর মৃত্যুর পর শুরু হলো স্ত্রীর অদ্ভুত কাজকারবার। পিটারের স্ত্রী কালিং ওয়াল্ড এরপর স্বামীর দেহটি কম্বল দিয়ে মুড়ে দিলেন, ঘরের দরজায় তালা লাগিয়ে দরজা-জানালায় ডাক্ট টেপ আটকে দিলেন।
একই বছরের সেপ্টেম্বরে এক শেরিফ আসলেন তাদের বাসায়। ওয়াল্ড দম্পতির কোনো একটি জিনিস বন্ধকের ব্যাপারে কথা বলতেই তিনি আসেন। এসেই তো তার আক্কেল গুড়ুম হবার দশা হয়ে যায়। কম্বলে মোড়ানো পিটারের দেহটি এতটাই পচে গিয়েছিলো যে তা আর চিনবার কোনো উপায় ছিলো না।
এই ছয় মাস কালিং ওয়াল্ড কেবলই স্বামীর পুনর্জন্মের জন্য প্রার্থনা করে গেছেন। আফসোস! পুনর্জন্ম হয় নি পিটারের। শুধু পিটারের গলা-পচা দেহটি খেতে ভিড় জমিয়েছিলো ইঁদুরের দল।
৪
ব্রুস ও শ্রেল হপকিন্স দম্পতি বাস করতেন স্পেনের জিরোনাতে। তারা ছিলেন আমেরিকার নাগরিক। ২০১৫ সালের শেষের দিকে তাদের সাত বছর বয়সী ছেলে ক্যালেব অ্যাজমায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। ছেলের মৃত্যুর পর তারা ঠিক বুঝতে পারছিলেন না কী করবেন। কারণ তাদের ছেলে যে আর তাদের মাঝে নেই- এ সত্যটিই তারা মেনে নিতে পারছিলেন না। তাই মৃতদেহটি তারা বাড়িতেই রেখে দিয়েছিলেন!
২০১৬ সালের জানুয়ারিতে তাদের বাড়িওয়ালা অপরিশোধিত ভাড়া নিতে আসলে বিষয়টি ধরা পড়ে। সাথে সাথেই পুলিশে খবর দেন তিনি। ময়নাতদন্ত শেষে জানা যায় যে, ক্যালেব কম করে হলেও দুই মাস আগে মারা গিয়েছিলো। হপকিন্স দম্পতিকে অযত্নে নিজেদের ছেলেকে মেরে ফেলার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। কারণ অনুসন্ধানে জানা গিয়েছিলো যে, প্রচলিত ওষুধে বিশ্বাস না থাকায় তারা ক্যালেবকে কোনো হাসপাতালেই নিয়ে যান নি। অবশ্য ক্যালেব যে আসলে কবে মারা গিয়েছিলো সেই তথ্যটি উদ্ধার করা যায় নি। তাকে ২০১৫ সালের ১৫ নভেম্বর সর্বশেষ এক জন্মদিনের অনুষ্ঠানে দেখা গিয়েছিলো।
৫
২০১৪ সালের জুলাইয়ে ব্রুকলিনে চাভা স্টার্ন নামে এক মহিলার সন্ধান পাওয়া যায় যিনি তার মায়ের মৃতদেহের সাথে দু’বছর কাটিয়ে দিয়েছেন। স্টার্ন যে ফ্ল্যাটটিতে থাকতেন, সেটার সুপারিন্টেন্ডেন্ট বাসায় একটি ছিদ্র ঠিক করা নিয়ে তার সাথে দেখা করতে যান। কিন্তু তিনি তাকে ঢুকতে না দিলে তার সন্দেহ হয়। তখন দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে বিচিত্র এ জিনিসটি দেখতে পান তারা।
রান্নাঘরে ময়লা-আবর্জনার কিছু ব্যাগের উপর মায়ের কঙ্কালটি বসিয়ে রেখেছিলেন স্টার্ন। এর পাশেই ঘুমোতেন তিনি। আবার খাওয়াদাওয়ার সময় হলে কঙ্কালকে পাশেই বসিয়ে রাখতেন। মায়ের কঙ্কাল এবং নিজে একইরকম জামা-কাপড়ও পরতেন!
৬
পেনসিলভানিয়ার নাগরিক জিন স্টিভেন্সের স্বামী জেমস স্টিভেন্স মারা যান ১৯৯৯ সালে। জুন নামে জিনের এক যমজ বোন ছিলেন যিনি মারা যান ২০০৯ সালে। এত কাছের দুজনের মানুষের মৃত্যু একেবারেই মেনে নিতে পারেন নি জিন। তাই স্বামী ও বোন দুজনের মৃত্যুর পরই সবার অগোচরে কবর খুঁড়ে তাদের মৃতদেহ বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন তিনি।
স্বামীর কঙ্কালকে গ্যারেজে একটি কাউচে বসিয়ে রেখেছিলেন জিন। শুধু তাই নয়। জেমসের কঙ্কালকে কালো স্যুট, সাদা শার্ট ও নীল রঙের একটি টাইও পরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি! বোনের মৃতদেহকে মেক-আপ করে সবচেয়ে সুন্দর কোটটা পরিয়ে দিতেন তিনি, চোখে লাগিয়ে দিতেন চশমা!
কাছের মানুষদের সাথে এভাবে কাছাকাছি থাকতে, টুকটাক কথাবার্তা বলতেই ভালো লাগতো জিনের। ২০১০ সালে অবশেষে বিষয়টি জানতে পারে কর্তৃপক্ষ।