“মেঘ দেখে ভাল্লুক মনে হয়,
নাকি তুমি দেখনি
তোমার হাতের ছায়া দিয়ে দেয়ালে একটা হরিণ নিয়ে খেলোনি…”
অঞ্জন দত্তের এই গানের পঙক্তিগুলোর মধ্যে মনের বেখেয়ালে ছেলেবেলায় আকাশের মেঘ দেখে বিভিন্ন জন্তু জানোয়ারের অবয়ব তৈরি করা, আবার রাতের আকাশে হাজারো তারার মাঝে আঁকি-বুকি করার কথা মনে পড়ে যায়। এ যেন অন্য এক জগত যেখানে আছে শুধু কল্পনা আর বাস্তবের মিলনমেলা। পুরো জগতটাই যেন নিজের। অন্য কারও হস্তক্ষেপ করার অধিকার নেই সেখানে।
জীবজগতের মধ্যে চিন্তাভাবনায় বা কল্পনায় মানুষের তুলনা সে নিজেই। কল্পনার জগতে বিচরণ করার চারণভূমিই হলো সৃজনশীলতা। আর সেই সৃজনশীলতার রূপকার একমাত্র মানুষই।
আমরা সকলেই জন্মগতভাবে কিছুটা সৃজনশীল, কৌতুহলী এবং নতুনকে জানার আকাঙ্ক্ষায় সর্বদা বিভোর। ছোটবেলা থেকেই খেলার ছলে আমাদের শেখার শুরু। সৃজনশীলতা সবচেয়ে বেশি ধরা পড়ে শিশুদের মাঝেই। এই যেমন বাচ্চারা বা ছোট্ট ছোট্ট সোনামণিরা আকাশে যখন বিদ্যুৎ চমকায়, তখন মেঘের ঘনঘটা বা অলক মেঘের ছুটোছুটির আদলে তারা দেখতে পায় কুমীর বা ডাইনোসররুপী মেঘদলের ছুটোছুটি। মাঝে মাঝে তো আকাশকেই বাড়ি বানিয়ে বসে থাকে- এমনও অসম্ভব নয় কিন্তু তাদের চিন্তা রাজ্যে!
তারপর জীবনের অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে জীবন আমাদের প্রকৃত জ্ঞান বিলায়। জীবনের প্রতিটি বাঁক আমাদের নতুন অনেক কিছু শেখার রসদ যোগায়। কিন্তু একটা সময় এক ধরনের ধূসরতা নেমে আসে আমাদের জীবনে। ছোটবেলার খেলনা পাশে সরিয়ে রেখে নেমে পড়ি চাকরির খোঁজে। তারপর যথারীতি আর সকলের মতো বিয়ে, সন্তান, সংসার। ধীরে ধীরে আমরা অভিজ্ঞ সংসারী হয়ে উঠি যা জীবনের একটু বাড়তি সময়ে পর্যন্ত ঐ সংসার নিয়েই ভাবতে বাধ্য করে। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমাদের চোখ তা মানবে কেন? আমাদের মন সবসময় আকুল হয়ে থাকে সেই সুন্দরকে কাছে টানার, মনে গেঁথে রাখার।
আমরা এমন এক সংসারে বাস করি যেখানে সৃজনশীলতা এক ধরনের বিলাসিতা মাত্র। অর্থ-কড়ি যতক্ষণ পর্যন্ত না সৃজনশীলতার সাথী হচ্ছে সে অবধি সকল কাজই ধোঁয়ায় অসার হওয়ার সামিল। পৃথিবীর সর্বত্র সৃজনশীলতা মাপার এক অন্যতম কাঠি হয়ে গেছে অর্থ উপার্জন। ‘শৌখিনতা’ শব্দটি আজকাল খুব ব্যঙ্গভরে উদ্ধৃত করা হয়। অথচ আশির দশকের আগ পর্যন্ত একজন শিক্ষিত মানুষের পেশা যাই হোক না কেন, শখের বশে বাদ্যযন্ত্র বাজানো, আঁকাআঁকি শেখা বা আনন্দের জন্য লেখালেখি করা খুব সাধারণ ব্যাপার ছিল। এ ধরনের শখের কার্যক্রম শুধুমাত্র জীবনে সফল হয়ে ওঠার জন্য ছিল তা নয়, বরং মানবিক উৎকর্ষ সাধনই ছিল এর মুখ্য উদ্দেশ্য। এতে অর্থাকাঙ্ক্ষার চাইতে আত্মতৃপ্তি ছিল বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
জীবন সম্পর্কে ভিন্নভাবে ভাবার উপাদান গড়ে দেয়ায় ছিল এমনতর শখের পরম প্রাপ্তি। বিখ্যাত ভিক্টোরিয়ান সমালোচক জন রাসকিনকে প্রশ্ন করা হয়েছিল যে, কেন তিনি কারখানার শ্রমিকদের আঁকাআঁকি করতে পরামর্শ দেন। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, “I’m not teaching to draw, I’m teaching them to see ”।
‘Amateur’ শব্দটি এসেছে লাতিন ‘Amatory’ শব্দ হতে যার অর্থ প্রেম উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী। প্রকৃতপক্ষে, এমেচার বা অপেশাদারিত্বের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে প্রকৃতির সৃষ্টিশীলতার সকল রসায়ন, একজন মানুষের চিন্তাশক্তির গভীরতা। লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি যখন তার আকাঁআঁকি শুরু করেন, তখনও তিনি ভাবেননি তিনি একজন বড় মাপের চিত্রশিল্পী হবেন। তিনি তার সৃজনশীলতাকে তার মানসপটে ধারণ করতে পারতেন যা তিনি ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলতেন।
ইতিহাসের পাতা খুললেই এমন হাজারো গুণীজনের দেখা মিলবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। চার্লস ডারউইনের হবার কথা ছিল ছিল যাজক। কিন্তু প্রকৃতির সৃষ্টিশীল বিষয়ের প্রতি ছিল তার অগাধ ভালবাসা। আর তার এই সুপ্ত সৃজনশীলতা থেকে সমৃদ্ধ হল বিবর্তনবাদ তত্ত্ব। জোহানেস ক্যাপলার একজন গণিতবিদ হয়েও জ্যোতির্বিদ্যার নানা গবেষণার প্রতি তার ঝোঁক ছিল বেশি। ঠিক তেমনি ওয়ালেস স্টিভেন্স একজন ব্যাংক কর্মকর্তা হয়েও তার কাব্য প্রতিভাকে কেউ অস্বীকার করতে পারেননি।
সৃজনশীলতাকে সবসময় যে অর্থ উপার্জনের মাধ্যম করেই তুলতে হবে তা কিন্তু নয়। এমন অনেক লোক আছেন যারা নিজ নিজ পেশায় সফল হয়েও বেশ সাফল্যের সাথেই তার শৌখিন মনোবৃত্তি পালন করে চলেছেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের কথাও যদি বলা হয়, লেখালেখির জন্য তিনি তার জমিদারী পরিচালনার কোথাও নমনীয় ছিলেন তা কিন্তু নয়। পেশার সাথে সাথে নিজের মানবিক তৃষ্ণা মেটানোর উপলব্ধি মানুষের সর্বদা। সেই উপলব্ধির বাস্তব প্রতিফলনই শিল্প হয়ে ধরা দেয় সৃষ্টিকর্তার তুলির আঁচড়ে।
প্রতিভার উপলব্ধি শুধুমাত্র নিজের মধ্যে গুটিয়ে রাখার মধ্যে নিহিত নয়। নিজের চিন্তা-চেতনা, ভাব-বুদ্ধি, অনুরাগ-বিরাগ ইত্যাদি নিজের মতো করে বিশ্বের কাছে তুলে ধরার মধ্যেই প্রতিভার সঠিক প্রয়োগ ঘটে। সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টির মধ্যেই বাঁচে তার সৃষ্টি। প্রতিভা বলে যদি কিছু থেকেই থাকে তা শুধুমাত্র চেষ্টার মধ্যে নিহিত থাকে। চেষ্টা করে যেতে হবে, নিজের মনকে নিয়ে খেলতে হবে, যা মনে আছে তা প্রকাশ করার উপায় করে নিতে হবে। তবেই প্রতিভার সঠিক উত্তরণ করা সম্ভব।
সৃজনশীলতা এক ধরনের সহজাত গুণ। এই গুণ হলো অন্য সকলের মাঝে বিলিয়ে দেয়ার উপাদান, নয়তো এটির স্বত্বাধিকার জন্মায়। কিন্তু স্থূল চিন্তায় একজন স্রষ্টার তার সৃষ্টির প্রতি আরও বেশি উদার হতে হয়। আমরা যতই সৃষ্টির প্রতি উদার হবো, ততই আমাদের সৃষ্টির মনোভাব আরও বেশি প্রশস্ত হতে থাকবে। আমাদের কল্পনাশক্তি ও অবিরত কৌতূহল অন্যদের মাঝে বিলিয়ে দেয়ার ক্ষমতা উপহার হিসেবে সকলের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারি।
অনেকের ধারণা, অনুপ্রেরণা ছাড়া কোনো সৃষ্টি সম্ভব নয়। বিশেষ করে কেউ যদি নিজে থেকে ভাবতে না পারে যে তার মাঝে সৃজনশীলতার গুণ রয়েছে তবে তার দ্বারা কোনো সৃজনশীল কাজ করানো সম্ভব নয়। কিন্তু এই ধারণা বহুলাংশে অসত্য। কেননা শুধুমাত্র প্রেরণার উপর নির্ভর করলে জাগতিক চিন্তা ভাবনা সবকিছু ঠোঁটের কিনারায় এসে থমকে যাবে। তার আর বাস্তবিক রূপ দেয়া সম্ভব হবে না। সৃষ্টি তৈরির আগে কীভাবে সম্ভব তার সফলতা সম্পর্কে জানার? সৃষ্টিশীলতা এক ধরনের অভিযান যার যাত্রাপথে অনেক ধরনের অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয় এবং যা ধীরে ধীরে একজন সৃজনকর্তাকে তার নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে বয়ে নিয়ে যায়।
একজন স্রষ্টার তার নিজের সৃষ্টির মধ্যে বিশ্বাস থাকতে হবে। তিনি কী নিয়ে খেলছেন বা খেলার চেষ্টা করছেন তা বোঝাতে পারার সক্ষমতা স্রষ্টার নিজের। নিজের সৃষ্টির কাছে সত্যনিষ্ঠ থাকতে পারলে তা স্রষ্টার মনের মতো হতে বাধ্য। সফলতার কথা চিন্তা করে কখনও শিল্প সৃষ্টি হতে পারে না। জীবনের বিভিন্ন চড়াই উৎরাই পার করে তবেই না প্রকৃত সৃষ্টি। বিফলতাও কিন্তু সৃষ্টির পারস্পরিক সঙ্গী। শিল্প সৃষ্টির প্রচেষ্টায় যদি বিফলতাও আসে তবে সেই বিফলতাও শ্রেয়।
অনেকেই আবার ভেবে বসেন এমন যে, অনুপ্রেরণাবিহীন সৃজনশীলতার দেখা মেলা ভার। কিন্তু ৩০ বছর বয়সের একজন লেখক যদি অনুপ্রেরণার অজুহাতে সময় গুনতে থাকেন তবে তার সাদা পাতা আজীবন শব্দ বিহীন শুন্য মরুদ্যান থেকে যাবে সন্দেহ নেই।
বিখ্যাত লেখক শেলি বার্চ তার ক্রিয়েটিভিটি ওয়ার্ক শপের ‘দ্যা গিফট অফ দ্যা এমেচার’-এ খুব সুন্দর করে উপস্থাপন করেছেন এ বিষয়টি। তার মতে, সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটতে পারে কোনো অর্থপ্রাপ্তি বা হিসাবনিকাশের কথা চিন্তা না করে। সেটাই হবে যথার্থ সৃজনশীলতার চর্চা।
স্যামুয়েল বেকেট এর ভাষায় তাই বলতে হয়- ব্যর্থতার পরেই আপনার জীবনে আসবে সর্বোত্তম ব্যর্থতা যা আপনার সৃষ্টিশীল কর্মকে ধারণ করতে সহায়তা করবে।