তবে এরপর আর বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি তাকে, ১৯৫৮ সালে খ্যাতির তুঙ্গে পৌঁছেন বৈজয়ন্তীমালা। ‘সাধনা’ ও ‘মধুমতী’ এ দুইটি ছবি ব্যাপকভাবে আলোচনায় স্থান পায় ও বাণিজ্যিকভাবে সফলতা লাভ করে। এ দুটি চলচ্চিত্রই ফিল্মফেয়ার সেরা অভিনেত্রী পুরস্কার বিভাগের জন্য মনোনীত হয়েছিল। ফিল্মফেয়ার পায় ‘সাধনা’ সিনেমাটি।
বাবা আর ডি রমণ ও মা বসুন্ধরা দেবী। বড় হয়েছেন মাতুলালয়ে, দিদিমার কাছে । চল্লিশের দশকে বৈজয়ন্তীমালার মা-ও ছিলেন তামিল চলচ্চিত্রের উল্লেখযোগ্য একজন তারকা। তার অভিনীত ‘মাঙ্গামা সাবাথাম’ ১৯৪৩ সালে প্রথম তামিল চলচ্চিত্ররূপে বক্স অফিস হিট করে। মায়ের হাত ধরেই চলচ্চিত্র জগতে পা রাখেন বৈজয়ন্তীমালা। বৈজয়ন্তীমালার মা ছিলেন খুব অল্প বয়সের যখন তার জন্ম হয়। মায়ের ষোল বছর বয়সে মেয়ে কথা বলতে শেখেন আর তখন থেকেই মাকে ডাকতেন নাম ধরে! বোধ হয় খেলার সাথীই ভেবে বসতেন!
তামিল পরিবারে জন্ম, তামিল সিনেমা দিয়েই চলচ্চিত্র জীবনের শুরু। তামিল সিনেমার জগত কাঁপিয়েছেন তিনি তার নৃত্য ও অভিনয় দিয়ে। ১৯৪৯ সালে ‘বাঁজখাই’ নামক তামিল সিনেমা দিয়ে তিনি অভিনয় শুরু করেন, যখন বয়স ছিলো মাত্র ১৩! চাইলে থেকে যেতে পারতেন তামিল চলচ্চিত্রের সম্রাজ্ঞী হয়েই। তবে কেন বলিউডের পর্দায়ও তার প্রবেশ? বৈজয়ন্তীমালাই প্রথম দক্ষিণ ভারতীয় অভিনেত্রী যিনি জাতীয়ভাবে স্বীকৃত, প্রতিষ্ঠিত এবং পুরষ্কৃত হয়েছেন। এটি তার বলিউডে আসার সিদ্ধান্তকেই জয়যুক্ত করে বটে! হয়তো সাফল্যের হাতছানিই তাকে টেনে এনেছে বলিউড জগতে। ‘বাহার’ ও ‘নাগিন’ এর মতো সিনেমার মধ্য দিয়ে হিন্দি সিনেমা জগতে সফলতার শুরু হয় তার। ‘বাহার’ ছবিটি তার প্রথম অভিনীত ‘বাঁজখাই’ এরই হিন্দি রিমেক ছিলো।
দীলিপ কুমারের সাথে তার জুটি বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে ‘নয়া দৌড়’ সিনেমার মাধ্যমে। আর ‘দেবদাস’-এ তাদের রসায়নের জের ধরেই অন্যান্য ছবিতেও তাদের বেশ তালমিল দেখা যায়। ১৯৮০ সালে একটি নিবন্ধে তিনি তার সবচেয়ে প্রিয় নায়কের কথা বলতে গিয়ে দীলিপ কুমারের নাম নেন। দীলিপ কুমার ও বৈজয়ন্তীমালার যৌথ ঝুলিতে মোট ৭টি ব্লকবাস্টার হিট সিনেমা রয়েছে। সিনেমহলে বেশ মাতামাতি হয় এই জুটিকে নিয়ে; বলা হয় ‘গঙ্গা-যমুনা’ ছবিটি করার সময় প্রতিটি দৃশ্যে বৈজয়ন্তীমালার শাড়ি বেছে দিতেন দীলিপ কুমার!
১৯৫৭ সালে কিশোর কুমারের সাথে জুটি হয়ে বৈজয়ন্তীমালার কমেডির দিকটিও সামনে আসে সবার, সিনেমহলে আর দর্শকদের কাছে এবার নির্মল হাস্যরস পৌঁছে দিলেন বৈজয়ন্তীমালা। কিশোর কুমারের সাথে তার প্রথম ছবি ‘আশা’।
ষাটের দশকে আরেকবার দীলিপ কুমারের সাথে করা হলো ‘গঙ্গা-যমুনা’। সবাইকে তাক লাগিয়ে দিলেন এক দক্ষিণ ভারতীয় অভিনেত্রী ভোজপুরি ভাষায় কথা বলে, শুধু কথাই বা বলছি কেন- বলা যাক ভোজপুরি তরুণীর চরিত্রে নির্দ্বিধায় অভিনয় করে! এবার বৈজয়ন্তী হলেন ‘গঙ্গা-যমুনা’র ধান্নো! এ থেকেই বোঝা যায়, বিভিন্ন ভাষা শিখতে কী পরিমাণ পারদর্শী তিনি। অভিনয়ের ক্ষেত্রে ভাষার সীমাবদ্ধতা কখনোই তার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি, কারণ নতুন নতুন ভাষা শিখতে অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ ছিলেন বৈজয়ন্তীমালা। হিন্দিও শিখেছিলেন তিনি শুধুমাত্র নিজের ডায়ালগগুলো নিজেই বলতে পারার জন্য।
এরপর নবাগত অভিনেতা মনোজ কুমারের সাথে কাজ করলেন ‘ড. বিদ্যা’ সিনেমায়, কিন্তু তা বক্স অফিসে সাড়া ফেললেও এরপরের কিছু সিনেমা তেমন সফল হয়নি। কিন্ত এরপরই এলো তার অভিনয় জীবনের প্রচন্ড সফল সিনেমা ‘সঙ্গম’। রাজেন্দ্র কুমার-বৈজয়ন্তীমালা-রাজ কাপুর, ত্রিভুজ প্রেমের গল্প যা বক্স অফিসে, দর্শকদের কাছে সব জায়গাতেই অনেক বেশি প্রশংসা কুড়ালো। এর গান, অভিনয়, পরিচালনা, সবকিছুই একাধারে জনপ্রিয়তা পেলো। এই সিনেমার শ্যুটিং চলাকালীন রাজ কাপুরের সাথে তার প্রেমের গুজব শুনা যায়, গুজব বলছি কারণ অনেক বছর পর বৈজয়ন্তীমালার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘Bonding… A memoir’ এ এর সত্যতা অস্বীকার করা হয়। তার এই আত্মজীবনী ইতি টেনে দেয় বহুদিন থেকে জেনে আসা রঙ্গিন সে গল্পের।
‘সঙ্গম’ করার পর কিছুদিন কেটে গেলো। বৈজয়ন্তীমালা ড. বালীকে বিয়ে করে হলেন বৈজয়ন্তীমালা বালী। ড. বালী পূর্বে বিবাহিত ছিলেন এবং প্রথম স্ত্রীর সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ করে তিনি বৈজয়ন্তীমালাকে পত্নীরূপে গ্রহণ করেন। মজার ব্যাপার হলো এই ড. বালী রাজ কাপুরেরই চিকিৎসক ছিলেন!
‘আম্রপালি’ সিনেমাতে তার স্বতস্ফূর্ত চরিত্র দেখি বৈশালীর মধ্য দিয়ে। এক নৃত্যশিল্পীরই জীবনের উপর ভিত্তি করে করা এই সিনেমাটিতে তার অভিনয় খানিকটা নিজেকেই তুলে ধরার মতন ছিলো। এই নিখুঁত কাজটি করার পরপরই তিনি চলচ্চিত্রজগত থেকে অব্যাহতি নিয়ে নেন। এখন মনে প্রশ্ন জাগে, এক সময়ের পর্দা কাঁপানো এই হাস্যোজ্জ্বল মুখ কি এরপর একেবারেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলেন অভিনয়ে?
বলিউডের জনপ্রিয় পরিচালক যশ চোপড়া তাকে এসময় একটি সিনেমায় অভিনয়ের প্রস্তাব দেন। এতে তার পুত্রের ভূমিকায় অভিনয় করার কথা ছিলো অমিতাভ বচ্চন ও শশী কাপুরের, কিন্তু বৈজয়ন্তীমালা তা ফিরিয়ে দেন। মূলত একটিই কারণ, নায়িকা ছাড়া অন্য কোনো ভূমিকায় নিজেকে তিনি দেখতে চাননি কখনোই। সেই শুরুর দিকে দেবদাস থেকে অভিনয় জীবনের শেষ পর্যন্ত নায়িকা হবার প্রতি তার প্রচন্ড আকর্ষণ দেখি। অন্য কোনো চরিত্র যতই আবেদনময় হোক না কেন, বৈজয়ন্তীমালার জন্য নায়িকার চরিত্রটিই ছিলো সবসময় সবচেয়ে বেশি আবেদনের।
অভিনয় ছাড়ার পরও আলোচনা থেকে দূরে থাকেননি তিনি। আমরা তাকে দেখতে পাই একজন সফল রাজনীতিবিদ হিসেবে, একজন নিয়মিত সংসদ সদস্য হিসেবে। আশির দশকের দিকে এসে তিনি রাজনীতিতে পুরোপুরি সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন, প্রথমে লোকসভার সদস্যপদ প্রাপ্তি এবং ১৯৯৩ সালে রাজ্যসভার সদস্য হিসেবেও মনোনয়ন পান বৈজয়ন্তীমালা।
বৈজয়ন্তীমালা নাচতে-গাইতে-অভিনয় সবই করতে পারতেন, পারেন। তবে সবকিছুর মধ্যে নৃত্যই তার মনের সবচেয়ে কাছের কলা। আজও নৃত্য নিয়ে কথা বলতে গেলে তার চোখে অদ্ভুত জ্যোতি খেলা করে! নৃত্যকলা সবসম্যই বৈজয়ন্তীমালার প্রথম প্রেম, যাকে কখনোই ছাড়তে পারেননি তিনি। এমনকি অভিনয় ছাড়ার পরও, রাজনীতিতে সক্রিয় হবার পরও যখনই সুযোগ পেয়েছেন, তিনি তার নৃত্যকলাকে ঝালিয়ে নিয়েছেন। নাচের জন্য বহু দেশ-বিদেশ সফর করেছেন বৈজয়ন্তীমালা। এই নৃত্য নিয়ে, ভারতের নৃত্যশিল্পের বিভিন্ন দিক যেমন কত্থক-ভরতনাট্যম-মনিপুরী ইত্যাদি নিয়ে তার গর্বের অন্ত নেই। ১৯৬৯ সালে যুক্তরাজ্যে নারীবর্ষ উদযাপনের জন্য যে নৃত্য তিনি পরিবেশন করেছিলেন তাই তার কাছে শ্রেষ্ঠ বলে মনে হয়, একটি সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়। তার মতে সেখানে তিনি বিশ্বসমক্ষে তার দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন এবং এটি তার জন্য বেশ সৌভাগ্যের বিষয়ও ছিল বলে তিনি মনে করেন।
বৈজয়ন্তীমালাকে বলা হয় প্রথম নারী সুপারস্টার, যিনি ১৩ বছর বয়সে অভিনয় শুরু করেন। তিনি একাধারে ভরতনাট্যম নৃত্যশিল্পী ও কার্ণাটক সঙ্গীতশিল্পী, আর অভিনয়ের জন্য তো বহুভাবে স্বীকৃত। বৈজয়ন্তীমালা একজন সম্পূর্ণ শিল্পী, তার মাত্রা শুধু একটি নয়। তার স্বীকৃতির মুকুটে একের পর এক যুক্ত হয়েছে পালক- অপ্সরা ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড, আক্কিনেনি অ্যাওয়ার্ড, মরণোত্তর, তামিল নাড়ু স্টেট ফিল্ম, কলাকার নামে বহু পুরষ্কার। এর মধ্যে বেশ কিছু মরণোত্তর পুরষ্কারও আছে।
১৯৩৬ সালের ১৩ই আগস্ট জন্ম নেয়া বৈজয়ন্তীমালা অভিনয়জগত ছাড়বার পরও আজ তাকে দেখা যাইয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যেখানে ক্যামেরায় ধরে পড়ে যান এই সুপারস্টার, বৈজয়ন্তীমালা বালী। তার আগের চেহারা এখনের চেহারায় রয়েছে হাজার ফারাক, বয়সের বলিরেখা খুবই স্পষ্ট। কিন্তু নাচ-গান ও অভিনয়ে নিবেদিতপ্রাণ স্বতস্ফূর্ত সে বৈজয়ন্তী যেন আজও এই বৈজয়ন্তীর চোখের তারায় সত্য হয়ে ধরা দেয়। না, ক্যামেরায় নয়, যারা তাকে জেনেছেন কখনো জানতে চেয়েছেন তাদের কাছে ধরা পড়ে তার চোখের সেই কখনো না দমে যাওয়া জ্যোতি!