Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

জলদস্যুদের অজানা জীবনকাহিনী

এক চোখে তাপ্পি, কালো ছেঁড়া পোশাক, মুখে ক্রুর হাসি, ইয়া বড় মোটা মোটা গোঁফ, রক্তিমাভ চোখের চাহনী, হাতে উদ্যত তলোয়ার। নাটক বা সিনেমার আদলে চিন্তা করলে জলদস্যু বলতে আমাদের দৃষ্টিতে এমন এক ছবিই ফুটে ওঠে। কিন্তু জলদস্যু মানেই কিন্তু শুধু লুটতরাজ বা নির্মমতা নয়, বীরত্ব এবং অ্যাডভেঞ্চারও বটে। জলদস্যুরা যতই খারাপ বা নির্মম হোক না কেন, একটা বিষয়ে তাদের তারিফ করতেই হয়, আর সেটা হলো তাদের হুঙ্কার করা সাহসিকতার দম্ভ। দৃঢ় সাহসিক মনোবল যেন একমাত্র জলদস্যুদেরই হতে পারে। জলদস্যুদের নিয়ে হাজারো কল্প কাহিনীর মোটেও কিন্তু ঘাটতি পাবেন না। আসুন, কিছুক্ষণ গল্পের রাজ্যে ভেসে বেড়াই…

একটা কর্কট কণ্ঠস্বর ঘুরে ফিরে আসতো জিম হকিন্সের দুঃস্বপ্নে! ঘুমের ঘোরে সে শুনতে পেতো কে যেনো বলছে, “পিসেজ অফ এইট, পিসেজ অফ এইট!” জিমের ঘুমটাও ভেঙ্গে যেতো ঠিক তক্ষুনি! এই দুঃস্বপ্নটা কি পরিচিত ঠেকছে? স্বাভাবিক! কারণ রবার্ট লুইস স্টিভেনসনের কালজয়ী উপন্যাস ‘দ্য ট্রেজার আইল্যান্ড’- এর এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়!

রবার্ট লুইস স্টিভেনসনের কালজয়ী উপন্যাস ‘দ্য ট্রেজার আইল্যান্ড’- এর প্রচ্ছদ

‘অ্যাডমিরাল বেনবো’ সরাইখানায় থাকা এক প্রাক্তন জলদস্যুর তোরঙ্গ থেকে উদ্ধার হয় একটি গুপ্তধনের ম্যাপ। তাই নিয়ে ধুন্দুমার বেঁধে যায় জলদস্যু ও কয়েকজন গুপ্তধন সন্ধানীর মধ্যে। গোটা উপন্যাসে প্রচুর চরিত্র থাকলেও কাহিনীর পুরোভাগে ছিল লং জন সিলভার। সেই এক পা ওয়ালা লোকটা। ডাক সাইটে জলদস্যু ছিল বটে লং জন সিলভার। আরেক জলদস্যু নেতার অদ্ভুত বাতিক, নাম তার ক্যাপ্টেন ফ্লিন্ট। নিজের পোষা টিয়া পাখিটির নাম রেখেছিল সিলভার। অদ্ভুত তার পোষা পাখিটিও বলতো, “পিসেজ অফ এইট, পিসেজ অফ এইট।

‘দ্য ট্রেজার আইল্যান্ড’- এর এক অনবদ্য চরিত্র লং জন সিলভার

তবে এ তো স্রেফ উপন্যাস মাত্র। জলদস্যুরা কিন্তু ঘোর বাস্তব, মোটেও কল্পনা নয়! আজ থেকে প্রায় ৫০০ বছর আগেও এদের দৌরাত্ম্য ছিল ভয়ঙ্কর। দাপিয়ে বেড়াতো বিশ্ব। তবে তাদের অস্তিত্ব কিন্তু একেবারেই কালের আবর্তে মুছে যায়নি। আগে জলদস্যু বলতেই যেমনটি অ্যাডভেঞ্চারের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যেতো, আজ আর তেমনটি নেই।

গতানুগতিক আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে একটি নির্দিষ্ট অপরাধের নাম জলদস্যুতা। জলদস্যুতার মতোই আরো একটি পরিভাষা হলো প্রাইভেটারিং। প্রাইভেটিয়াররা যুদ্ধকালীন সময়ে বা কৌশলগত কারণে রাষ্ট্র কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত হন। তাদের মূল কাজই হলো শুধুমাত্র শত্রু দেশের জাহাজ আক্রমণ ও লুট করা। কিছু মিল থাকা স্বত্ত্বেও জলদস্যুতা ও প্রাইভেটারিং পরিভাষা দুটি সম্পূর্ণ আলাদা।

যাত্রীবোঝাই জাহাজে জলদস্যুদের আক্রমণ

সাধারণত সমুদ্রে সংঘঠিত ডাকাতি বা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডকেই জলদস্যুতা বলে। এই রকম ডাকাতি অবশ্য স্থলপথ, আকাশপথ বা অন্য কোনো বড় জলবেষ্ঠিত অঞ্চলে বা সৈকতেও সংঘঠিত হতে পারে। আসুন এবার জেনে আসি জলদস্যুদের ইতিহাস।

কীভাবে এলো জলদস্যুরা?

বিভিন্ন ধরণের জলদস্যুদের মধ্যে বাকেনিয়ার, বোম্বেটে, হার্মাদ, প্রাইভেটিয়ার হলো ভিন্ন ভিন্ন। এদের মধ্যে তফাত রয়েছে যথেষ্ট। তবে যে যা-ই হোক না কেন, জলদস্যুদের সাহসের দৌরাত্ম্য নিয়ে মোটেও সন্দেহ নেই। জলদস্যুদের ইতিহাস অবশ্য বেশ পুরোনো। তবে ইতিহাস যা-ই হোক না কেন, জলদস্যুরা কিন্তু বিশেষভাবে পরিচিত তাদের অসম সাহসিকতার জন্যেই।

তৎকালীন সময়ে যেসব অঞ্চলে জলদস্যুদের প্রভাব ছিল

জলদস্যুদের ইতিহাস ঘেঁটে দেখতে গেলে প্রথমেই এসে যায় প্রাচীনকালের মিশরের এক ফারাও আমলের দুষ্প্রাপ্য নথি যেখানে জলদস্যুদের কথা উল্লিখিত ছিল। সেই নথি অনুযায়ী জানা যায় পূর্ব আফ্রিকা উপকূলে যাত্রীবাহী বা অন্যান্য জাহাজে জলদস্যুদের হামলার ঘটনা।

জলদস্যুদের প্রতীকি চিত্র

নথিটির সম্ভাব্য সময়কাল ১৩৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। সত্যিই কিন্তু জলদস্যুদের ইতিহাসটা অনেক অনেক পুরনো। জলদস্যুদের কথা মাথায় এলে পাশাপাশি ভাইকিংদের কথাও মনে আসে। কারণ তাদের মতো ডাকসাইটে সাহসী জলযোদ্ধা পৃথিবীর ইতিহাসে সত্যিই বিরল। তাদের গাঠনিক বর্ণনা দিতে গেলে যেটা চোখে ভাসবে সেটা হলো- বিশাল চেহারা, হাতে বর্শা, মাথায় শিরস্ত্রাণ! ঠিক একজন সাহসী যোদ্ধার চেয়ে কোনো দিকেই কমতি নেই। তাছাড়া অমন চেহারা দেখলেই যে কারো পিলে চমকানোটাই স্বাভাবিক।

ভাইকিংরা ছিল ডাকসাইটে সাহসী জলযোদ্ধা

১৬৫০ সাল থেকে ১৭২০ সালের মাঝামাঝি সাত দশককে বলা চলে জলদস্যুদের স্বর্ণযুগ। অষ্টম শতাব্দীর কথা। তখন গোটা ইউরোপ মহাদেশ ভাইকিংদের নাম শুনলেই আত্মারাম খাঁচা ছেড়ে উড়াল দিতো। তদের ভয়ে আধমরা হয়ে যেতো সমগ্র ইউরোপ অধিবাসীরা। জলদস্যুদের মূল বিচরণস্থল ছিল প্রধানত ক্যারিবিয়ান সাগর বা ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের আশেপাশেই। সেই এলাকায় জলদস্যুদের বলা হতো বাকেনিয়ার।

ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের ত্রাস ছিল বাকেনিয়াররা

সোনাদানা, মণি-মুক্তো বোঝায় করা ব্যবসায়ী জাহাজ থেকে শুরু করে যাত্রীবাহী জাহাজ পর্যন্ত সেই এলাকা তো দূর থাক, তার আশপাশ দিয়ে অব্দি যাওয়ার মতো সাহস রাখতো না। জলদস্যুদের দৌরাত্ম্যপনা তখন যেন পরিণত হয়েছিল এক অলিখিত নিয়মে। জাহাজ আক্রমণ করে সব মূল্যবান জিনিসপত্র কেড়ে নেওয়াটাই যেন হয়ে উঠেছিল এক সাধারণ রেওয়াজ।

কিন্তু কেউ কি জানতো যে জাহাজগুলোর উপরে কেন এমন দূর্যোগ নেমে আসতো? কারণ খুঁজে যা পাওয়া গেলো তার উত্তর তেমন অপরিচিত নয়। আসলে জাহাজে এতো এতো সোনাদানা, মণি-মুক্তো বোঝায় থাকতো যে তা নজরে পড়তেই লোভ সামলানো ভীষণ অসাধ্য। তাই শুরু হয় জলদস্যুদের আক্রমণ। প্রভূত ধন সম্পদ লুট করে তাড়াতাড়ি বড়লোক হওয়ার হাতছানিই যেন ডেকে নিতো জলদস্যুদের। তাই দস্যুপনা করতে গিয়ে আতঙ্কের ছাপ এঁকে যেতো সাধারণ মানুষদের মানসপটে।

পণ্যবোঝাই জাহাজ দখলের উদ্দেশ্যে জলদস্যুদের আক্রমণ

সেই সঙ্গে আলোচনার বিষয়বস্তু হওয়ার সুযোগ তো রয়েছেই। অ্যাডভেঞ্চার কথাটি ভুলে গেলে চলবে কী করে? বিজ্ঞানের আবিষ্কারের অবদানে আজ সব কিছুই হাতের মুঠোয় হলেও প্রায় ছয় কী সাত শতাব্দী আগেও সমুদ্র বলতেই ছিল অদ্ভুত এক আতঙ্কের জায়গা। মহাসাগরের শেষ বলতে কিছু আছে কিনা, অথবা অন্য পাড়ে কি আছে এসব বিষয় ছিল ধারণার অতলে। সেই সুযোগেই নতুন নতুন দেশ আবিষ্কারের নেশায় মত্ত নাবিকরা বেরিয়ে পড়তেন জীবন বাজি রেখে।

জাহাজের দখলের জন্য জাহাজের যাত্রীরা জলদস্যুদের নির্মমতার শিকার হতো

ইউরোপের অনেকেই তখন নতুন দেশ আবিষ্কার করে বিশ্বের মানচিত্রে যোগ করবেন আর সাথে ইতিহাসের পাতায় লিখাবেন তার নাম সে কথা ভেবেই এক অদ্ভুত নেশায় মেতে উঠেছিলেন। তাদের মাঝে অন্যতম ছিল পর্তুগিজ, ইংরেজ, ওলন্দাজ, ফরাসি, স্পেনীয়রাও। পর্তুগিজ জলদস্যুরা তো আমাদের বাংলাতেও পা দিয়েছিল।

নতুন দেশ আবিষ্কারের অ্যাডভেঞ্চার জলদস্যুদের দুর্গম পথে পাড়ি দিতে উদ্বুদ্ধ করতো

কথিত আছে, পর্তুগিজ জলদস্যুদের শক্ত ঘাঁটি ছিল ডায়মন্ড হারবার। দুর্জয়, উদ্দাম, সাহসী জলদস্যুদের কব্জা করা ছিল মারাত্মক কঠিন! তারা নৌযুদ্ধে ছিল অত্যন্ত পটু। শোনা যায়, মুঘল সম্রাটরা পর্যন্ত পর্তুগিজ জলদস্যুদের তেমন একটা ঘাঁটাতো না, কারণ তখনও মুঘলদের নৌবাহিনী জলদস্যুদের সাথে পেরে উঠার মতো পোক্ত ছিল না।

এবার চলুন জেনে নিই জলদস্যুদের প্রধান উপকরণ জাহাজ সম্পর্কে। তার আগেই বলি রাখি এমন দুটো উপকরণের কথা যা ছাড়া জলদস্যুতা চলবেই না। সেগুলো হলো- ১) জায়গা এবং ২) গতি।

জলদস্যু জাহাজের ধরণ

জলদস্যুরা ইয়া মস্ত বড় জাহাজ নিয়ে কিন্তু তাদের কাজ খতম হতো না কিন্তু। লুট করে পালানোর বিষয় আছে না? অনেক সময় দেখা যেতো লুটের জাহাজও দখল করে বসতো জলদস্যুরা।

জলদস্যুদের ব্যবহৃত সেসময়ের জাহাজ

তারপর বদলে দিতো তারচেহারা। পালের অবস্থান পাল্টে দিয়ে বন্দুক আর কামান বসিয়ে একেবারেই যাত্রীবাহী জাহাজকে গড়ে নিতো দস্যু জাহাজের রূপে। দেখে বোঝার উপায়া থাকতো না যে জাহাজখানা আগে যাত্রীবাহী ছিল। জলদস্যুবৃত্তির জন্যে জাহাজে রাখতে হতো পর্যাপ্ত জায়গা। তা না হলে এতো এতো মাঝিমাল্লা, দস্যু, সাথে আরও লোকবল থাকবে কোথায়? জলদস্যুদের জাহাজের মাঝে উল্লেখযোগ্য হলো স্কোয়ার রিগার, স্কুনার, বার্ক, ব্রাইগেন্টাইন।

জলদস্যুদের ব্যবহৃত ব্রাইগেন্টাইন জাহাজ

সবচেয়ে দ্রুতগতির এক মাস্তুল বিশিষ্ট জাহাজ হলো স্লুপ। স্কুনার জাহাজটিও কিছুটা স্লুপের মতন ছিল। বার্ক ছিল তিন পাল বিশিষ্ট। ব্রাইগেন্টাইনের দুটো মাস্তুল থাকলেও সেই জাহাজটিই ছিল অভিযানের জন্য সবচেয়ে উত্তম। এটি বাতাসের গতি প্রকৃতির সঙ্গে দিব্যি মানিয়ে যেতো।

জলদস্যুদের ব্যবহৃত স্লুপ জাহাজ

তাছাড়া স্কোয়ার রিগার জাহাজের কথা না বললেই নয়, দেখার মতোই ছিল এই জাহাজটি। তিন মাস্তুল আর চৌকো পালওয়ালা স্কোয়ার রিগার খুব দাপট নিয়েই সাগরের বুকে জল কেটে কেটে এগিয়ে যেতো।

জলদস্যুদের ব্যবহৃত স্কোয়ার রিগার জাহাজ

জলদস্যুদের নিয়ে জানার শেষ নেই। আরও নতুন নতুন মজার মজার তথ্য নিয়ে আসার প্রত্যয় রইলো যেসব কিনা না জানলেই মিস!

তথ্যসূত্র

১) brethrencoast.com/Pirate_Ships.html

২) owlcation.com/humanities/The-Life-of-a-Pirate-What-They-Ate-What-They-Did-For-Fun-and-More

৩) en.wikipedia.org/wiki/Piracy

৪)denofgeek.com/us/tv/black-sails/232782/black-sails-the-life-of-a-pirate

Related Articles