কল্পনা করুন, পেনসিলভানিয়ার এক নির্জন অরণ্যে, চারদিকে শুনশান নীরবতার মাঝে আপনি চোখ বুজে শুয়ে আছেন। নির্মল বাতাস বইছে, কানে বাজছে ঝর্ণার জলের কুলুকুলু শব্দ। অবারিত স্রোত বয়ে চলছে তার তলদেশে। চোখ মেললেই দেখা যায় প্রকৃতির অপরিমেয় সৌন্দর্য। যান্ত্রিক সভ্যতার সব কোলাহল ছেড়ে আপনি মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছেন সেই অরণ্যের মাঝে। সত্যিই কি মনে হবে না স্বর্গ এসে ধরা দিয়েছে এই ধরাধামে। ফ্র্যাংক লয়েড বোধহয় একেই উল্লেখ করেছেন তার অর্গানিক আর্কিটেকচার হিসেবে। যেখানে প্রকৃতি, মানুষ আর তার নির্মাণ- এই ত্রয়ী যুক্ত থাকবে এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কে।
ফ্র্যাংক লয়েড রাইট ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠ স্থপতি, নকশাকার ও লেখক। তিনি তার নিজস্ব স্টাইলের জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন, যার নাম দিয়েছেন অর্গানিক আর্কিটেকচার। বাংলায় বলা যায় আঙ্গিক স্থাপত্য। এমন নির্মাণ যা কি না তার আশেপাশের অঙ্গন ও পরিবেশকে ধারণ করে, প্রতিনিধিত্ব করে।
ফ্র্যাংক লয়েড রাইটের জন্ম ১৮৬৭ সালের ৮ জুন মধ্য-পশ্চিম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন রাজ্যে। তার পূর্বপুরুষদের বাস ছিল যুক্তরাজ্যের ওয়েলসে। মা ছিলেন শিক্ষিকা, বাবা ধর্ম প্রচারক ও সংগীতজ্ঞ। হাই স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যান স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনার জন্যে। এর মধ্যে বাবা-মায়ের বিবাহ বিচ্ছেদ তার জীবনেও প্রভাব ফেলে। আর্থিক বন্দোবস্তের জন্য কাজ করেন আমেরিকান স্থাপত্যের রাজধানী শিকাগোতে স্থপতি যোসেফ সিলসবির সাথে। এজন্য ১৮৮৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠে ইতি টানেন।
এরপর শিকাগোতে তার ঠিকানা হয় অ্যাডলার ও সুলিভানের স্থাপত্য প্রতিষ্ঠানে। লুই সুলিভান ছিলেন আমেরিকার অন্যতম সেরা স্থপতি। তিনি স্কাইস্ক্র্যাপারের জনক বলেও বিদিত। তিনি ফ্র্যাংক লয়েডের উপর বেশ প্রভাব বিস্তার করেন। বৈশ্বিক স্থাপত্যে ইউরোপিয়ান স্টাইলের যে আধিপত্য তা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা সুলিভান এবং লয়েড দুজনের মধ্যেই ছিল। আমেরিকান স্থাপত্যে নিজস্বতা নিয়ে আসার প্রয়াস থেকেই সৃষ্টি হয় প্রেইরি নামে এক নতুন স্থাপত্যরীতির।
২০-এ প্রণয়, ২২-এ পরিণয় ক্যাথেরিন টোবিনের সাথে, যিনি লয়েডের জীবনের প্রথম প্রেম। পেশাদার জীবনে নিজের জন্য শিকাগোর শহরতলীর ওক পার্কে তার নকশা করা প্রথম বাড়িটি তৈরি করেন। বাইরে থেকে মনে হবে বদ্ধ, বিচ্ছিন্ন এক ঘর, কিন্তু তার অভ্যন্তরে আবিষ্কার করবেন আলোর এক বিষ্ফোরণ। চমৎকৃত হবেন আপনি। এই সৃষ্টিই তাকে বেশ খানিকটা পরিচিত এনে দেয়।
এরপর অনেকগুলো নকশা করেন । তার হাতে তৈরি হয় রিভার ফরেস্টে অর্গানিক আর্কিটেকচার ধারার উইন্সলো হাউজ। খোলামেলা অভ্যন্তরীণ, আনুভূমিক, উল্লম্ব তলের মিশেলে স্বকীয় এটি। আছে প্রেইরি ধাঁচে তৈরি শিকাগোর রোবি হাউজ। ওক পার্কে তৈরি করেন ইউনিটি টেম্পল, যা সত্যিকারের আধুনিক স্থাপত্যের অন্যতম নির্মাণ। তার করা নির্মাণগুলোতে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বিশুদ্ধতা, স্থানীয় নির্মাণ উপকরণের ব্যবহার, সর্বোপরি আশেপাশের ল্যান্ডস্কেপের সাথে ওতপ্রোতভাবে মিশে যাওয়ার প্রবণতা যোগ করেন সফলভাবে।
শুধু গৃহ নির্মাণই নয়, পাশাপাশি ইন্টেরিয়র ডিজাইন ও এর সাথে মিল রেখে ফার্নিচার ডিজাইন, এমনকি গৃহকর্ত্রীর পোশাকের নকশাও করে দেয়ার নজির আছে। স্থপতি হওয়ার পাশাপাশি জাপানি শিল্পকর্মের একজন সংগ্রাহক এবং ডিলার ছিলেন তিনি। তার ইন্টেরিয়র ডিজাইনে এসব শিল্পকর্ম স্থান পেত ভালোভাবে।
১৯২০ এর দশকে তিনি টেক্সটাইল কনক্রিট ব্লক সিস্টেমের নকশা করেন। এই রিইনফোর্সড কনক্রিট ব্লকের মাধ্যমে তিনি ক্যালিফোর্নিয়ায় তৈরি করেন মিলার্ড হাউজ। আশেপাশের পরিবেশের সাথে চমৎকারভাবে মিশে আছে এই অসাধারণ বাড়িটি। হলিউডের অনেক বিখ্যাত মুভির শ্যুটিং হয়েছে এতে। টেক্সটাইল কনক্রিট ব্লক সিস্টেম অনুসরণ করে তিনি পরে আরো অনেকগুলো অট্টালিকা নির্মাণ করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে এর আরো আধুনিকায়ন হয়।
১৯০৯ সালে প্রথম স্ত্রীর সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায় লয়েডের। তারই এক ক্লায়েন্টের স্ত্রীর হাত ধরে পাড়ি জমান ইউরোপে। শেষতক ফিরে আসেন উইসকনসিনে তার বৈমাত্রেয় সম্পত্তিতে। সেখানকার প্রকৃতি, আশেপাশের পরিবেশ তাকে সবসময় বিমোহিত করতো এবং তার কাজেও এর প্রকাশ ঘটেছে বেশ। সেখানে নিজের জন্য তৈরি করেন বিখ্যাত তালিয়েসিন নামের বাড়িটি। এই বাড়িটি লয়েডের জীবনে একটি বিশেষ অধ্যায় জুড়ে ছিল। নানা উত্থান-পতনের স্বাক্ষী এই তালিয়েসিন। এখানেই তিনি কাটান জীবনের সবচেয়ে সেরা এবং আনন্দময় কিছু সময়।
কিন্তু এরপরেই তার জীবনে ঘটে যায় ভয়াবহ এক দুর্ঘটনা। লয়েড ছিলেন উদারপন্থী ইউনিটারিয়ান ধর্মীয় বিশ্বাসের মানুষ। নিজের গৃহভৃত্যদের তিনি নিজ পরিবারের মানুষের মতোই বিবেচনা করতেন। কিন্তু একদিন ঘর থেকে কাজে বেরিয়ে পড়ার পর তারই এক গৃহভৃত্য আচমকা তার ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়, হামলা করে ঘরে থাকা সদস্যদের উপর। সেই ঘটনায় দ্বিতীয় স্ত্রী মেমাহ বোরথউইক চেনেই-সহ ৭ জন নিহত হন। সেবার তালিয়েসিন পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। পরে তিনি তা পুনর্নিমাণ করেন। এই ঘটনার রেশ তার কর্মজীবনেও ছিল দীর্ঘদিন ধরে। এরপরে আবার তিনি ছন্দে ফিরে আসেন তার অন্যতম সেরা সৃষ্টির মাধ্যমে। তার পেশাদারী জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয় বিখ্যাত ফলিং-ওয়াটার বাড়িটি।
ফলিং-ওয়াটার নামক স্থাপনাটি বিশ্বে অর্গানিক আর্কিটেকচারের অন্যতম সেরা উদাহরণ। এই প্রবন্ধের শুরুতে মূলত এই স্থাপনার দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছিল। মজার ব্যাপার হলো, এর নকশা তিনি কয়েক ঘন্টার মধ্যেই করেছিলেন। এটি তাকে স্থাপত্যাঙ্গনে বিশেষ স্থানে আসীন করে দেয়। এদিকে তালিয়েসিন বাড়িটিকে শীতকালে বেশ প্রতিকূল পরিবেশের মুখোমুখি হতে হতো। তাই তিনি শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচতে অ্যারিজোনাতে তৈরি করেন আরেকটি বাড়ি, যার নাম দেন তালিয়েসিন ওয়েস্ট। এটি বর্তমানে আর্কিটেকচার স্কুল হিসেবেই ব্যবহৃত হয়।
ফ্র্যাংক লয়েডের সেরা আরেকটি স্থাপনা ছিল সলোমন আর. গগেনহেইম মিউজিয়াম। নিউ ইয়র্কে অবস্থিত এই স্থাপনা নির্মাণ করতে সময় লাগে দীর্ঘ ১৬ বছর। স্কাইস্ক্র্যাপারের মধ্যে আছে ওকলাহামায় অবস্থিত ১৯ তলাবিশিষ্ট প্রাইস টাওয়ার। এস. সি জনসন ওয়াক্স রিসার্চ টাওয়ার তার আরেক মাস্টারপিস। এর অভ্যন্তরীণ নকশা তিনি তৈরি করেন অত্যন্ত চমৎকারভাবে। তার এই নির্মাণকে বলা হয় স্থাপত্য জগতের অন্যতম অনবদ্য সৃষ্টি হিসেবে। এটি তার প্রবল প্রকৌশল জ্ঞানেরও প্রমাণ দেয়। টোকিওর ইমপেরিয়াল হোটেলের নকশাকার হিসেবেও তিনি বিখ্যাত হয়ে আছেন।
ফ্র্যাংক লয়েডের কাজে সমতল ছাদ আর উন্মুক্ত ফ্লোরপ্ল্যান যেমন মর্ডানিজমকে প্রতিফলিত করে, একইভাবে নিচু ছাদ, দীর্ঘ আনুভূমিক লাইন, সহজ-সরল বাহুল্যবর্জিত নকশা, পারিপার্শ্বিকের প্রাসঙ্গিকতা প্রকাশ করে তার প্রিয়েরি আর ইউসোনিয়ান স্টাইলকে। একটি বৃক্ষ যেমন নিজে নিজে বেড়ে ওঠে, তেমনই তার নির্মাণগুলোও প্রকৃতিকে অনুসরণ করে তার রূপ ধারণ করে, যাকে তিনি বলেছেন অর্গানিক আর্কিটেকচার।
জীবদ্দশায় পেয়েছেন রয়্যাল ইন্সটিটিউট অব ব্রিটিশ আর্কিটেক্টস গোল্ড মেডেল ও আমেরিকান ইন্সটিটিউট অব আর্কিটেক্টস গোল্ড মেডেল, যথাক্রমে ১৯৪১ ও ’৪৯ সালে। লিখে গেছেন অসংখ্য বই।
১৯৫৯ সালের ৯ এপ্রিল ৯১ বছর বয়সে অ্যারিজোনাতে পরলোকগমন করেন ফ্র্যাংক লয়েড। বার্ধক্য যে মানুষের প্রতিভা বা ক্ষমতাকে কোনোভাবেই অবদমিত করতে পারে না তার অনন্য নজির রেখে গেছেন তিনি। কারণ ৭০ বছরের ক্যারিয়ারে তিনি যে ১,১০০ এর মতো ঘরবাড়ি, অট্টালিকার নকশা করেছেন, তার প্রায় এক-তৃতীয়াংশই করেন জীবনের শেষ দশকে। তার কিছু কাজ মনোনীত হয়েছে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবেও।
ফ্র্যাংক লয়েড রাইট বিবেচিত হন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠ স্থপতি হিসেবে। গত শতাব্দীর তো বটেই, এযাবতকালের বিশ্বসেরা দশ স্থপতির তালিকায় আপনি খুঁজে পাবেন তাকে। আমেরিকার নিজস্ব স্থাপত্যরীতির প্রচলনে তার অবদান উল্লেখযোগ্য। সৃষ্টিকর্মগুলোতে পরিবেশ, মানবিকবোধের সংমিশ্রণ করেছেন সবসময়। জয় করেছেন কালের খেয়া।