
গুপ্তঘাতক বা অ্যাসাসিন, শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে কালো কাপড়ে চোখ মুখ বেধে শরীরের নিচে একগাদা অস্ত্র লুকিয়ে মিশরের পথে পথে নিজের পরিচয় আত্মগোপন করে ঘুরে বেড়ানো একদল যোদ্ধা। প্রিন্স অফ পারসিয়া চলচ্চিত্র বা অ্যাসাসিন্স ক্রিড গেম অ্যাসাসিন শব্দটির সাথে মনের মাঝে মিশরের ছবিগুলো আরো স্পষ্ট করে ভাসায়। তবে অ্যাসাসিনদের শুরু কিন্তু মিশর থেকে না। মিশর থেকে ৩,৬২১ কিলোমিটার দূরে সমরখন্দ নামক শহরে হাসান-ই-সাব্বাহ নামে এক ব্যক্তির হাত ধরে জন্ম হয় ইতিহাসে আতঙ্ক সৃষ্টিকারী এ গোষ্ঠীর।
হাসান সাব্বাহ ১০৫৬ খ্রিস্টাব্দে পারস্যের কোম শহরে বারো ইমামে বিশ্বাসী এক শিয়া পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার শৈশবে তার পরিবার ইরানের অন্যতম এক প্রাচীন শহর ‘রে’ তে স্থানান্তরিত হয়। সেখানেই হাসান তার পারিবারিক ঐতিহ্য অনুসারে তার প্রাথমিক শিক্ষাদীক্ষা লাভ করেন। রে শহর ছিল ইসমাইলি ধর্মমত প্রচারের অন্যতম কেন্দ্র। ইসমাইলিদের মতবাদ সম্পর্কে হাসান আমির যারাব নামক ইসমাইলি মতবাদ দীক্ষাদানকারীর কাছে জ্ঞানলাভ করেন। পরবর্তীতে তিনি আবু নাসের সরজ এবং রে শহরের অন্যান্য ইসমাইলি মতবাদ প্রচারকারীর কাছে এ বিষয়ে আরো শিক্ষালাভ করেন। ফলস্বরূপ তিনি ইসমাইলি মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সতের বছর বয়সে তৎকালীন ইসমাইলি ইমাম ফাতিমিদ খলিফা আল-মুনতাসির এর আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করেন।
হাসান তার পড়াশোনা চালিয়ে যেতে থাকেন। ইসমাইলি সমাজে তিনি তার জ্ঞান ও প্রজ্ঞার জন্য শ্রদ্ধা অর্জন করেন। তাকে ডেপুটি মিশনারি হিসেবে নিযুক্ত করা হয়, এবং পরামর্শ দেয়া হয় যেন তিনি খলিফার সভায় নিজেকে উপস্থিত করেন।
তবে তিনি আরো অনেক বছর নিজেকে খলিফার কাছে যাওয়া থেকে বিরত রাখেন। পরবর্তীতে তিনি নানা জায়গায় ঘুরে মিশরে খলিফার কাছে উপস্থিত হন। মিশরে তার শিক্ষাগ্রহণ ও ধর্মপ্রচারকালীন সময়ে তিনি উজির বদর আল জামালির বিরাগভাজন হন। খলিফা সেখানকার শাসক হলেও রাজনৈতিকভাবে দুর্বল হওয়ায় কার্যত উজিরই সেখানকার শাসক ছিলেন। বদর আল জামালি তার পুত্র আল-আফদালকে উজির মনোনীত করেন। খলিফা আল মুনতাসির মারা যাবার পর তার বড়পুত্র নিজারের ইমাম হবার কথা থাকলেও আল-আফদাল দাবি করেন মৃত্যুর পূর্বে খলিফা তার মনোনীত উত্তরাধিকার পরিবর্তন করে কাসিম আহমদকে তার সিংহাসনের উত্তরাধিকার হিসেবে মনোনীত করে গিয়েছেন। কাসিম আহমদ সিংহাসনে বসলে নিজার সেখান থেকে আলেক্সান্দ্রিয়ায় পালিয়ে যান এবং সেখানে নিজেকে ইমাম হিসেবে প্রচারিত করেন। ১৯০৫ সালে উজির তাকে পরাজিত করে কায়রোতে বন্দী হিসেবে নিয়ে আসেন। সেখানে তার শিরশ্ছেদ করা হয়। হাসানকে বদর আল-জামালি কারাবন্দী করেন। কারাগারের একটি মিনার ধ্বসে পড়লে সেটিকে হাসানের শুভলক্ষণ হিসেবে দেখা হয় এবং তাকে জেল থেকে মুক্তি দেয়া হয়। তবে মুক্তি দিলেও তাকে উত্তর আফ্রিকার জাহাজে করে দ্বীপান্তরিত করা হয়। তবে তিনি যে জাহাজে করে যাত্রা করছিলেন তা পথিমধ্যে বিধ্বস্ত হয়। তাকে সেখান থেকে উদ্ধার করে সিরিয়া নিয়ে যাওয়া হয়।
এ সময় হাসান পুরোপুরি ধর্ম প্রচারণার দিকে মনোযোগী হন। তিনি ইরানের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলে ঘোরেন। তিনি উত্তর ইরান ও কাস্পিয়ান সাগরের উপকূলের পাহাড়ি এলাকায় তার মনোযোগ নিবদ্ধ করেন। এ অঞ্চলে তিনি প্রধান ধর্মপ্রচারকারীর দায়িত্ব নেন এবং বাকি অঞ্চলগুলোতে তার ব্যক্তিগতভাবে প্রশিক্ষিত ধর্মপ্রচারকারীদের পাঠান। তার এ কর্মকান্ড নিজাম-উল-মুলকের কানে গেলে তিনি হাসানকে বন্দী করতে সৈন্যবাহিনী পাঠান। হাসান তাদেরকে কৌশলে এড়িয়ে গিয়ে আরো গভীর পাহাড়ি অঞ্চলে প্রবেশ করেন।
এ সময় হাসান তার জন্য এমন এক জায়গার খোঁজ করতে থাকেন যেখানে তিনি তার কার্যক্রম আরো ভালোভাবে পরিচালনা করতে পারবেন। খোঁজ করতে করতে তিনি ১০৮৮ সালে আলামুট শহরের দেখা পান। এখানে হাসান তৎকালীন ফাতিমীয় খলিফার ইমাম হবার দাবি অস্বীকার করেন। তিনি নিজারের সমর্থক ছিলেন। এখানেই তিনি তার স্থায়ী কেন্দ্র গড়ে তুলে প্রকৃত ইমাম হিসেবে নিজারের উত্তরাধিকারকে সমর্থন প্রদান করতে আগ্রহী ছিলেন। আলামুটে একটি দুর্গ ছিল যা প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার লম্বা এবং পাঁচ কিলোমিটার চওড়া একটি উপত্যকার প্রতিরক্ষা হিসেবে দাঁড়িয়ে ছিল। কিংবদন্তী আছে যে, এক রাজা এখানে শিকার করার সময় এক ঈগলকে দেখে সেটিকে অনুসরণ করেন। কিছুক্ষণ পর সেটিকে উড়ে গিয়ে পাহাড়ের চূড়ায় এক পাথরের ওপর বসতে দেখলে রাজা এটিকে এক শুভলক্ষণ হিসেবে নেন। এ জায়গার কৌশলগত প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে সে রাজা এখানে এক দুর্গ নির্মাণ করে সে দুর্গের নামকরণ করেন ‘আলামুট’ বা ‘ঈগলের বাসা’।
প্রায় দু’বছর সেখানে অবস্থান ও ইসমাইলি মতবাদ প্রচারের মাধ্যমে তিনি ১০৯০ খ্রিস্টাব্দে শান্তিপূর্ণভাবে দুর্গের দখল নিতে সমর্থ হন। লোকমুখে প্রচলিত কথা অনুসারে হাসান দুর্গের মালিককে ৩০,০০০ স্বর্ণের দিনারের বিনিময়ে দুর্গ বিক্রি করে দেয়ার প্রস্তাব দেন। দুর্গের মালিক রাজি হলে হাসান যুদ্ধ শুরু করেন এবং দুর্গের মালিককে পরাজিত করে দুর্গের দখল করেন। তিনি দুর্গের মালিককে এক ধনী জমিদারের নাম ও ঠিকানা লিখে একটি চিঠি দেন এবং তার কাছ থেকে তিনি তার পাওনা টাকা নিতে বলেন। কিংবদন্তী আরো বলে যখন সে জমিদার হাসানের সই সহ সে চিঠি দেখেছিলেন তিনি দুর্গের মালিককে বিস্মিত করে বিনাবাক্য ব্যয়ে তার পাওনা টাকা পরিশোধ করে দেন।
আলামুট দুর্গ দখল করার বছরই হাসান অ্যাসাসিন বা গুপ্তঘাতকদের এ সংঘটি প্রতিষ্ঠা করেন। অ্যাসাসিনরা ছিলো শিয়া মুসলিমদের বিচ্ছিন্ন একটি অংশ। তিনি পাহাড়ি অঞ্চলের উপরের অংশের দখল পাওয়ামাত্র তিনি যুদ্ধ ও গুপ্তহত্যার মাধ্যমে তার রাজনৈতিক ক্ষমতার বিস্তৃতি ঘটানো শুরু করেন।
হাসান এবং তার অনুসারীরা তার দুর্গে লড়াই করার মেধাসম্পন্ন বালকদের জড়ো করতেন। প্রচলিত আছে যে হাসান সাব্বাহ হাশিশ নামক এক ধরনের মাদক দিয়ে আচ্ছন্ন করে তাদেরকে তার বাগানে নিয়ে যেতেন। উল্লেখ্য যে, অ্যাসাসিন শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে ‘হাশাশিন’ থেকে। হাশিশ পানকারীদের হাশাশিন বলে উল্লেখ করা হতো। সে বাগানে তাদের চারদিকে সুন্দরী নারীদের রেখে তাদেরকে বিশ্বাস করানো হতো তারা স্বর্গে আছে। হাসান যখন সে বাগানে ভ্রমণ করতে যেতেন তখন তাকে একজন পবিত্র বার্তাবাহক হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়া হতো। পরে তাদেরকে আবারও মাদকের আচ্ছন্নতার বাইরে ফিরিয়ে এনে এক অন্ধকূপে নিক্ষিপ্ত করা হতো এবং বলা হতো তারা যদি পুনরায় সে স্বর্গে ফিরে যেতে চায় তবে তাদেরকে হাসানের প্রদানকৃত আদেশসমূহ মানতে হবে। স্বর্গে ফেরার জন্য তাদের মৃত্যুবরণ করার ইচ্ছা তাদেরকে ভয়ের জগতের বাইরে নিয়ে যেতো। এ সময়ে তাদেরকে অ্যাসাসিনেশনের জন্য প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল। এভাবেই উৎপত্তি হয়েছিলো গুপ্তঘাতকদের সর্বপ্রথম ও সবচেয়ে ভয়ানক সংগঠনের।
গুপ্তহত্যার সর্বপ্রথম শিকার ছিলেন আল-মুলক। ১০৯২ সালের অক্টোবরের ১৪ তারিখ তাকে হত্যা করা হয়েছিলো। এছাড়াও বায়হাকি শহরকর্তা, কারামাইয়া উপদলের প্রধানসহ আরো অনেকে ১১০১-০৩ সালের মধ্যে গুপ্তহত্যার শিকার হয়।
এর পরবর্তী সময়ে হাসান স্বেচ্ছায় লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান। তবে তিনি তার কার্যক্রম যথাযথভাবে চালিয়ে যেতে থাকেন। দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছর তিনি আর আলামুট থেকে অন্য কোথাও যাননি। এ দীর্ঘসময় তিনি তার দুর্গে পড়াশোনা, ধর্মীয় কাজকর্ম করেছেন ও শাসনকার্য চালিয়েছেন। তিনি তার শাসনকার্জে ধর্মীয় রীতিনীতি মানার ক্ষেত্রে খুবই কঠোর ছিলেন। শোনা যায়, বাঁশি বাজানোর অপরাধে তিনি রাজ্য থেকে একজনকে নির্বাসিত এবং খুনের অভিযোগে এক পুত্র এবং মদ্যপানের অভিযোগে অন্য পুত্রের মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রদান এবং তা কার্যকর করেছিলেন। ইতিহাসবিদগণ বলেন, হাসান পরবর্তী বছরগুলোতে কখনোই তার দুর্গের বাইরে আসেননি।
হাসান সাব্বাহ যখন তার মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এসেছে বলে অনুভব করছিলেন তখন তিনি তার সহকারী বুজুর্গ-উমিদকে তার উত্তরাধিকার হিসেবে মনোনীত করে যান। তিনি আরো তিনিজনকে তার সহকারী হিসেবে মনোনীত করে যান। কিছুদিন অসুস্থতায় ভোগার পর হাসান ১১২৪ খ্রিস্টাব্দে মারা যান। তাকে আলামুটের অদূরে দাফন করা হয়।
হাসান সাব্বাহর শুরু করা কাজ অ্যাসাসিনরা আরো দেড় শতকেরও বেশি সময় ধরে সফলভাবে পরিচালনা করতে সক্ষম হয়। হাসানকে ইসমাইলিদের ত্রাণকর্তা বলে অভিহিত করা যায়। তার সমাধিতে প্রতি বছর অসংখ্য নিজারি ইসমাইলি জিয়ারত করতে যেত। মঙ্গোলরা ১২৫৬ খ্রিস্টাব্দে তার সমাধি ধ্বংস করে দেয়।
ফিচার ইমেজ: wall.alphacoders.com