দাবার জগতে এক অতি পরিচিত নাম ববি ফিশার। অনেক কম বয়সে দাবা খেলায় নিজের অসামান্য প্রতিভার ঝলক দেখিয়ে তিনি পুরো বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। আবার নিজের অহংকারী মানসিকতা ও গণমাধ্যমে নানা কটূক্তির কারণে প্রচুর সমালোচনারও শিকার হয়েছেন এই কিংবদন্তী দাবাড়ু। একই সাথে প্রতিভা ও বিতর্কিত আচরণের সম্মীলনে তিনি যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিনই নিজেকে আলোচনায় রেখেছেন। এমনকি তার মৃত্যুর পরও মনোরোগ বিশেষজ্ঞগণ তার উদ্ধত আচরণ ও জীবনযাপন নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেছেন। চলুন তবে জেনে নেওয়া যাক এই কিংবদন্তী সম্পর্কে।
জন্ম ও শৈশবকাল
রবার্ট জেমস ফিশার ওরফে ববি ফিশার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোতে ১৯৪৩ সালের ৯ই মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা হান্স-গেরহার্ড ফিশার এবং মা রেজিনা ওয়েন্ডার ফিশার। কাগজে-কলমে হান্স ফিশারকে ববি ফিশারের বাবা হিসেবে উল্লেখ করা হলেও পরবর্তীতে নানা অনুসন্ধান চালিয়ে জানা যায় যে, তার সত্যিকার জন্মদাতা হলেন পল নেমেন্য়ি। তিনি ছিলেন একজন হাঙ্গেরিয়ান গণিতবিদ ও পদার্থবিজ্ঞানী। ১৯৩৯ সালের দিকে হান্স ফিশার ও রেজিনা ওয়েন্ডার আলাদা হয়ে গেলেও ১৯৪৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে। নানা প্রতিবেদন মোতাবেক এই সময়ের মাঝেই রেজিনার সাথে পলের সাক্ষাৎ হয়।
ববির মা রেজিনা স্বামীর থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার পর নিজের মেয়ে জোয়ান ফিশার ও সদ্য জন্ম নেওয়া ববি ফিশারকে নিয়ে এককভাবে জীবনযাপন করতে থাকেন। এসময় তিনি কাজের উদ্দেশ্যে বহুবার শহর বদল করেছেন। এভাবে প্রায় দশবার বিভিন্ন শহরে ঘুরাঘুরি করার পর অবশেষে ১৯৫০ সালে তিনি দুই সন্তান নিয়ে ব্রুকলিনে এসে থিতু হন। কথিত আছে, ববির আসল বাবা পল সরাসরি নিজের সন্তানের জীবনে না আসলেও ঠিকই তার ভরণপোষণের জন্য রেজিনাকে অর্থ সরবরাহ করতেন। আর এ দায়িত্ব তিনি মৃত্যুর আগপর্যন্ত পালন করে গেছেন।
মাত্র নয় বছর বয়সেই প্রথম দাবা টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ
বংশগত দিক বিবেচনা করলে ববি ফিশার যে অনেক বুদ্ধিমান হবেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তার মা রেজিনা ফিশার মেডিসিনে পিএইচডি ডিগ্রিধারী একজন চিকিৎসক এবং একইসাথে ছয়টি ভাষায় পারদর্শী। তার বাবা একজন গণিতবিদ ও পদার্থবিজ্ঞানী, যিনি আইনস্টাইনের পুত্র হান্স-অ্যালবারট আইনস্টাইনের সাথে তার হাইড্রোলজি ল্যাবে কাজ করেছিলেন।
ছয় বছর বয়সে ববি ফিশারের প্রথম দাবা খেলায় হাতেখড়ি হয়। প্রথমে সে আর তার বোন জোয়ান ফিশার একসাথে এই খেলা শিখে। এরপর বোনের দাবায় আগ্রহ কমে যাওয়ায় ও মা রেজিনার সময় বের করতে না পারার জন্য ববি নিজেই নিজের সাথে দাবা খেলা চালিয়ে যেতে থাকে।
ব্রুকলিনে শহরে বেড়ে ওঠা মাত্র ৬ বছর বয়সী এই কিশোর ধীরে ধীরে দাবায় আসক্ত হয়ে পড়ে। তার সহজাত বুদ্ধিমত্তা ও তীক্ষ্ণ মনোযোগের দরুন মাত্র ৯ বছর বয়সেই সে প্রথম কোনো দাবা টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করে। এরপর ১১ বছর বয়সে সে নিউ ইয়র্কের দাবা ক্লাবের সদস্য হয়।
মূলত দাবাই ছিল ববি ফিশারের জীবন। উঠতে-বসতে সে কেবল এক দাবা নিয়েই পড়ে থাকতো। ছোটবেলা থেকেই দাবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বপ্ন তাকে পেয়ে বসে। দাবায় ফিশারের তীব্র আসক্তি সম্পর্কে জানতে পারা যায় তার ছোটবেলার বন্ধু অ্যালেন কফম্যানের কাছ থেকে।
ববি প্রচণ্ড দাবা পাগল ছিল। সে একটা ঘরে প্রবেশ করতো যেখানে শুধু দাবা খেলোয়াড়রা থাকতো। এদিক ওদিক ঘুরাঘুরি করে দাবার কোনো বই বা ম্যাগাজিন পেলেই বসে পড়তো। সে বলতে গেলে এই বইগুলো একটার পর আরেকটা শুধু গিলতে থাকতো। আর সবকিছু মুখস্থ করে ফেলতো।
ববি ফিশার ধীরে ধীরে আমেরিকায় নিজের প্রতিভার ঝলক দেখাতে শুরু করেন। মাত্র ১৩ বছর বয়সেই তিনি আমেরিকার জুনিয়র দাবা চ্যাম্পিয়ন খেতাব লাভ করেন এবং নিজ দেশের বড় বড় গ্র্যান্ডমাস্টারদের সাথে খেলায় মুখোমুখি হন। ইন্টারন্যাশনাল মাস্টার রবার্ট বার্নকে এক শ্বাসরুদ্ধকর গেমে হারানোর পর তিনি প্রথম একজন বিখ্যাত দাবাড়ু হিসেবে আলোচনায় আসেন। বয়সের সাথে তার র্যাংকও বাড়তে থাকে।
তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের দাবায় বলতে গেলে একক আধিপত্য ছিল। প্রায় অর্ধশত বছর ধরে রাখা শিরোপা যেন কেউ ছিনিয়েই আনতে পারছিল না। বুদ্ধির এই খেলায় সোভিয়েত ইউনিয়ন একরকম অপ্রতিরোধ্যই ছিল বটে। কিন্তু এই ধারা মাত্র ১৫ বছর বয়সের আমেরিকান কিশোর ববি ফিশার ভেঙে দেন। সেই সাথে সর্বকনিষ্ঠ দাবা গ্র্যান্ডমাস্টারের খেতাব অর্জন করেন এই দাবা প্রডিজি।
খ্যাতি ও অহংকার যেন পেয়ে বসে এই বুদ্ধিমান দাবাড়ুকে
বয়সের সাথে সাথে দাবার জগতে ববি ফিশারের নামডাক বৃদ্ধি পেতে থাকে। অনেক কাঠখড় পোড়ানোর পর অবশেষে সে টুর্নামেন্টের উদ্দেশ্যে সোভিয়েত যাত্রা করেন। মস্কো শহরে অনুষ্ঠিত দাবা প্রতিযোগিতাগুলোতে তিনি বেশ কয়েকজন অনূর্ধ্ব মাস্টারদের পরাজিত করেন। কিন্তু সমবয়সী দাবাড়ুদের হারিয়ে তিনি যেন খুব একটা শান্তি পাচ্ছিলেন না।
তার লক্ষ্য ছিল রাশিয়ার বড় বড় দাবাড়ুদের বিপক্ষে জয়ী হওয়া। এই উদ্দেশ্যে তিনি তৎকালীন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন মিখাইল বটভিনিকের বিপক্ষে খেলার জন্য চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন ফিশারের এই চ্যালেঞ্জ নাকচ করে দিয়েছিল। দাবী মেনে না নেওয়ায় এই প্রথমবারের মতো ফিশার জনসম্মুখে তার ক্রোধ প্রকাশ করেন। তিনি ঘোষণা দেন যে, “এই রাশিয়ান শুকরদের ওপর তিনি অতিষ্ঠ।” রাশিয়া থেকে আমেরিকায় পাঠানো নানা চিঠিতে তিনি রাশিয়ার মানুষ ও তাদের আতিথেয়তা নিয়ে নানা কটু কথা বলতে থাকেন। তার এসব উত্তপ্ত বাক্যের জন্য রাশিয়া তার ভিসা বাতিল করে দেয়।
নিজের মা, যে তাকে এতদিন দাবা খেলায় সমর্থন দিয়ে গেছেন, তার সাথেও ফিশারের বনিবনা হচ্ছিল না। রেজিনা ফিশার চাচ্ছিলেন, তার ছেলে অন্তত পড়াশোনা চালিয়ে একটা আসল চাকরি করুক আর সাথে দাবা খেলা চালিয়ে যাক। কিন্তু ফিশারের মনোযোগ ছিল সম্পূর্ণ দাবার দিকে। নিজের একরোখা ইচ্ছা ও জেদি মনোভাবের উপর ভর করে তিনি ১৬ বছর বয়সে হাই স্কুল ছেড়ে দেন। এবার তিনি পরিপূর্ণভাবে দাবায় মনোনিবেশ করেন। মতের ভিন্নতা ও অনধিকার চর্চার অভিযোগ এনে সে মা রেজিনা ফিশারের থেকেও আলাদা হয়ে যান এবং একাকী থাকতে শুরু করেন। তার মা পুনরায় মেডিকেল প্রশিক্ষণ শুরু করার উদ্দেশ্যে ওয়াশিংটন ডিসিতে পাড়ি জমান।
এদিকে সময়ের সাথে সাথে ববি ফিশারের দাবায় দক্ষতা যেমন বাড়তে থাকে, একই মাত্রায় তার মানসিক অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। বিভিন্ন ম্যাগাজিন ও পত্রিকায় দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি একের পর এক বিস্ফোরণ ঘটাতে থাকেন। ১৯৬২ সালে হার্পারস ম্যাগাজিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন যে, মাত্রাতিরিক্ত ইহুদী দাবা খেলায় প্রবেশ করছে। তারা নাকি দাবার জাত নিচের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। নারীদের দাবা খেলা নিয়ে কটাক্ষ করতেও তিনি পিছপা হননি। তার মতে, নারীদের দাবা খেলতে দেওয়াই উচিত নয়। তারা নাকি দাবার ক্লাবগুলোকে পাগলা গারদ বানিয়ে ফেলছে।
নারীরা আসলে অনেক দুর্বল। পুরুষদের তুলনায় তারা বেশ বেকুব। তাদের দাবা খেলা উচিত নয়। একেবারেই আনাড়ি তারা। পুরুষদের সাথে খেলা প্রত্যেকটা গেম তারা হেরে যায়।
এমন কটুবাক্য প্রকাশ করা সত্ত্বেও তার সাফল্যে কোনো ভাটা পড়েনি। ১৯৫৭-১৯৬৭ সাল, এই দশ বছরের সময়কালে তিনি টানা আটবার ইউএস চ্যাম্পিয়নশিপে জয়ী হয়েছিলেন। টানা ১১ বার জিতে তিনি যে ঐতিহাসিক রেকর্ড গড়েন তা আজও কেউ ভাঙতে পারেনি। এ কারণেই অনেকের দৃষ্টিতে তিনি সর্বকালের সেরা দাবাড়ু। তবে সাফল্যের সাথে সাথে এই আমেরিকান দাবাড়ুর অহংকারও যেন একই গতিতে বাড়তে থাকে।
তার সময়ে আন্তর্জাতিক দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে সোভিয়েত ইউনিয়নের একক আধিপত্য ছিল। তাছাড়া সোভিয়েত ও আমেরিকার মধ্যে চলমান স্নায়ুযুদ্ধের সেই সময়টাতে দাবাকে একরকম জাতির বুদ্ধিমত্তার পরিমাপ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। আর রাশিয়া এ ব্যাপারে বড়াই করতে কোনো অংশে কম ছিল না। তাই আমেরিকার তুরুপের তাস ছিল তাদের সেরা গ্র্যান্ডমাস্টার ববি ফিশার। ববি নিজেও রাশিয়ান দাবাড়ুদের বিপক্ষে খেলার জন্য উন্মুখ ছিলেন। তাদের খেলার সকল ধরন ও প্রক্রিয়া তিনি একেবারে আত্মস্থ করে ফেলেছিলেন।
১৯৬২ সালের ঘটনা। বিশ্ব দাবা চ্যাম্পিয়নশিপ অনুষ্ঠিত হয়েছিল রাশিয়ায়। তাতে নিজ দেশের পক্ষ থেকে অংশ নিতে গিয়েছিলেন ববি ফিশার। অনেক ভালো শুরু দিয়েই এগোচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু খেলার সময় অন্য টেবিলের দিকে খেয়াল করলে তিনি এক অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করেন। খেলার মাঝখান থেকেই তিনি পুরো চ্যাম্পিয়নশিপ বয়কট করে বের হয়ে যান।
বাইরে গিয়ে গণমাধ্যমের লোকজন জড়ো করে তিনি রাশিয়ান গ্র্যান্ডমাস্টারদের বিরুদ্ধে খেলা পাতানোর অভিযোগ করেন। স্পোর্টস ইলাস্ট্রেটেড নামক এক ম্যাগাজিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান যে, রাশিয়ান গ্র্যান্ডমাস্টাররা আগে থেকে পরিকল্পনা করে তাদের ম্যাচ ড্র করতো, যাতে ট্রফি তারা নিজ দেশেই রেখে দিতে পারে। তার এমন বিতর্কিত মন্তব্য রাশিয়া উড়িয়ে দিলেও পরবর্তীতে খতিয়ে দেখার পর ঠিকই এর সত্যতা প্রমাণিত হয়।
ববি ফিশার বনাম বোরিস স্প্যাসকি, দাবার ইতিহাসে এক বৈপ্লবিক দ্বৈরথ
রাশিয়ানদের উপর এক রকম ক্ষোভ ছিল বলেই রবার্ট ফিশার একের পর এক গ্র্যান্ডমাস্টারদের হারাতে শুরু করেন। বড় বড় রাশিয়ান গ্র্যান্ডমাস্টার তিগরান পেত্রোসিয়ান ও মার্ক তাইমানোভকে তিনি দাবার বোর্ডে বলতে গেলে হেনস্তা করে ছাড়েন। এই মাথা গরম আমেরিকানের কাছে রাশিয়া যেন তাদের দাবার গৌরব হারাতে বসেছিল। তবুও তাদের ভরসা ছিল নিজেদের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন বোরিস স্প্যাসকির উপর।
জার্মানিতে অনুষ্ঠিত ১৯তম দাবা অলিম্পিয়াডে ববি ফিশার বোরিস স্প্যাসকির মুখোমুখি হন। শ্বাসরুদ্ধকর সেই ম্যাচে বোরিসই শেষ হাসি হাসেন। এই একজন রাশিয়ানই ববির একটানা জয়ের ধারা ভেঙে দিয়েছিলেন। বোরিস স্প্যাসকির কাছে হারার পর ববির উন্মত্ততা যেন আরো বেড়ে যায়। খেলার সময় তিনি রাশিয়ানদের নানারকম শর্ত জুড়ে দিতে শুরু করেন। শব্দের প্রতি অনেক সংবেদনশীল ছিলেন এই দাবাড়ু। সামান্য শব্দ তার মনোযোগে অনেক ব্যাঘাত ঘটাত। একেবারে রেগে গিয়ে তিনি খেলার মাঝখানে পরিচালনাকারীদের সাথে তর্কে লিপ্ত হতেন। তাছাড়া তার সন্দেহ প্রবণতাও অনেক বেড়ে গিয়েছিল। তিনি মনে করতেন তার হোটেলে রাশিয়ানরা মাইক্রোফোন লুকিয়ে তার সব কথা শুনছেন। মাঝে মাঝে হোটেল রুম তছনছ করে ফেলতেন তিনি।
বোরিস স্প্যাসকির সাথে পরবর্তীতে মুখোমুখি হওয়ার সময় নানা রকম শর্ত জুড়ে দিতে থাকেন ববি ফিশার। এসব শর্ত পূরণ না করলে তিনি খেলবেন না তা সাফ জানিয়ে দেন। দাবায় আমেরিকার একমাত্র আশা ছিলেন বলে তার প্রতিনিধিদেরও এই শর্তগুলো উত্থাপনের জন্য ব্যবস্থা নেওয়া লাগতো। তিনি দর্শকদের প্রথম সারি ফাঁকা রাখার নির্দেশ দেন, নিজের জন্য আরামদায়ক চেয়ারের ব্যবস্থা করতে বলেন, প্রাইজমানি বাড়িয়ে দেওয়ার কথা বলেন, গণমাধ্যমকে দূরে থাকার পরামর্শ দেন। এছাড়া তিনি দাবার বোর্ডও পরিবর্তন করতে বলেন। কারণ যে বোর্ডে খেলা হয়, তাতে চাল দেওয়ার সময় তৈরি হওয়া শব্দ তাকে প্রচণ্ড বিরক্ত করতো।
বোরিসের বিপক্ষে খেলায় ১-০ তে পিছিয়ে পড়ার পর ববি নতুন অভিযোগ আনেন ক্যামেরা নিয়ে। টেলিভিশনে প্রচারের জন্য যে ক্যামেরা ব্যবহার করা হচ্ছিল তার শব্দে তিনি মনোযোগ ধরে রাখতে পারছিলেন না। ক্যামেরা সরানোর এই দাবী মেনে না নেওয়ায় তিনি তার দ্বিতীয় খেলায় উপস্থিত হননি। এতে বোরিস ২-০ তে এগিয়ে যান। তবে টুর্নামেন্টের আয়োজকরা ববির জেদের সাথে পেরে ওঠেননি। তাছাড়া বোরিসের সম্মতিতেও তারা ববির সকল শর্ত মেনে নেন। ববির ইচ্ছা অনুযায়ী তৃতীয় রাউন্ডের আয়োজন করা হয় একটা টেবিল টেনিস রুমে।
তৃতীয় গেম থেকে ববি ফিশার তার কারিশমা দেখাতে শুরু করেন। এর পরের প্রত্যেকটা রাউন্ডের একটিতে ড্র ও বাকি সবকটি জিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের মুকুট সোভিয়েত ইউনিয়নের মাথা থেকে ছিনিয়ে আনেন। খেলার এই আকস্মিক পরিবর্তন সোভিয়েতদের রীতিমতো ভয় পাইয়ে দেয়। তারা এই খেলার সাথে আমেরিকার সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি (সিআইএ) জড়িত ছিল কি না তা-ও সন্দেহ করতে শুরু করে। তারা আরো অনুসন্ধান চালায় যে, বোরিসের অরেঞ্জ জুসে কিছু মেশানো ছিল কি না। এমনকি খেলার ঘরের মধ্যে কোনো রশ্মি ব্যবহার করা হয়েছিল কি না তা-ও পরীক্ষা করা বাদ যায়নি।
শেষ জীবন
২৪ বছর ধরে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের ট্রফি ধরে রাখা সোভিয়েত ইউনিয়নের গৌরব ভেঙে দিতে আগমন ঘটেছিল ববি ফিশারের। কিন্তু বয়সের সাথে সাথে তার উন্মাদ হওয়ার মাত্রা যেন বাড়তেই থাকে। নানা গণমাধ্যমে তিনি ইহুদী ও রাশিয়ানদের প্রতি তার ঘৃণা প্রকাশ করতে থাকেন। নিজে একজন ইহুদী হওয়া সত্ত্বেও তার নানা চাঞ্চল্যকর মন্তব্য জনগণ মেনে নিতো না। সবার সাথে মেলামেশা বাদ দিয়ে তিনি নিজেকে একঘরে করে রাখতেন। এরপর টুকটাক দাবা খেললেও অনেকটা ভবঘুরে হয়ে যান তিনি। মা কমিউনিস্ট পার্টির একজন প্রকাশ্য সমর্থক ছিলেন বলে তার পেছনে গুপ্তচর রয়েছে বলে তিনি ধারণা করতেন।
৯/১১ এর ঘটনায় তিনি আরেক বিস্ফোরক মন্তব্য করে বসেন। তিনি বলেন, তিনি আমেরিকা ধ্বংস হয়ে যাওয়া দেখতে চান। তার এই মন্তব্যের পেছনে কারণ হলো অনুমতি ছাড়া বিদেশে একটি খেলায় অংশগ্রহণ করার জন্য তাকে গ্রেফতারের আদেশ করা হয়। ২০০৪ সালে জাপানে আমেরিকান পাসপোর্ট নিয়ে যাতায়াতের জন্য তাকে সরাসরি গ্রেফতার করা হয়। এরপর তিনি আইসল্যান্ডের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করলে তা মঞ্জুর করা হয় এবং তিনি পাকাপোক্তভাবে সেখানে শেষ জীবন কাটিয়ে দেন।
ছোটবেলা থেকেই ববি ফিশার মানসিক সমস্যায় ভুগতেন। তারা বাবার বংশেও মানসিক রোগের নমুনা পাওয়া গিয়েছিল। মৃত্যুর পরও মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা তার মানসিক অবস্থা ও পারিবারিক পরিবেশ নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। অনুসন্ধান করে জানা যায়, ছোটবেলায় তার মা রেজিনা ফিশার নানা বিশেষজ্ঞদের কাছে ববিকে নিয়ে যেতেন। তার দাবার প্রতি এই অবসেশন নিয়ে আলোচনা করতেন। বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞই আভাস দিয়েছিলেন, এর থেকেও অনেক খারাপ কিছুতে মানুষ আসক্ত হয়। সেই তুলনায় দাবা বরং ভালো জিনিস। আর এর থেকে বের হতে এর ভেতর দিয়েই যাওয়া উচিত।
বিশ্ববিখ্যাত দাবা গ্র্যান্ডমাস্টার ও মানসিক রোগের বিশেষজ্ঞ ডক্টর রুবেন ফাইন ববি ফিশারকে নিয়ে একটি বই লিখেছিলেন। সেই বইতে তিনি ছোটবেলায় ববির মানসিক অবস্থা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। ববির বয়স যখন ১৩ বছর তখন তিনি রেজিনার মাধ্যমে ববির সাথে পরিচিত হন।
তিনি (রেজিনা) আমার সাথে ছয়বার দেখা করেছিলেন। প্রত্যেকবার আমি আর ববি এক-দুই ঘণ্টার একটা ম্যাচ খেলতাম। তার সাথে একটা সম্পর্ক তৈরি করার জন্য আমার জেতা দরকার ছিল, যেটা আমি পারতাম। আমার পরিবারের মনে আছে, প্রত্যেক ম্যাচ হারার পর সে কেমন ক্ষিপ্র আচরণ করতো। সে বলতো যে আমার ভাগ্য ভালো ছিল। তার মন অন্যদিকে নেওয়ার জন্য আমি খেলার মাঝখানে তার সাথে নানা বিষয়ে আলোচনার চেষ্টা চালাতাম।
এমন এক আলোচনার সময় আমি তাকে তার স্কুল কেমন চলছে তা নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম। স্কুল শব্দটি শোনার পরই সে একেবারে ক্ষেপে ওঠে এবং চিৎকার করতে শুরু করে। ‘তুমি আমার সাথে চালাকি করছো’– এমন মন্তব্য করে সে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। এর বছরখানেক পর যখনই কোনো ক্লাবে বা টুর্নামেন্টে আমার সাথে তার দেখা হতো, সে দূর থেকে রাগান্বিত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতো। তার দৃষ্টি এমন ছিল যেন আমি তার খুব বড় কোনো ক্ষতি করার জন্য তার ঘনিষ্ঠ হতে চেয়েছিলাম।
ববি ফিশারকে নিয়ে অনেক প্রামাণ্যচিত্র তৈরি হয়েছে। ২০১৪ সালে হলিউডে তার জীবনকাহিনীর উপর ভিত্তি করে ‘পন স্যাক্রিফাইস’ চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায়। স্পাইডার ম্যান ট্রিলজিখ্যাত অভিনেতা টবি ম্যাগুইয়ার ববি ফিশারের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন।
জীবদ্দশায় ববি ফিশারের অ্যাস্পারগাস সিনড্রোম ছিল এমনটি বিশেষজ্ঞরা দাবী করেছিলেন। তার ঘনিষ্ঠরা তাকে কাউন্সেলিংয়ের পরামর্শ দিলেও তিনি তা এড়িয়ে যেতেন। ২০০৮ সালের জানুয়ারি মাসে কিডনির জটিলতার কারণে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর সময় তার বয়স ছিল ৬৪ বছর। কাকতালীয় ব্যাপার হলো, দাবার বোর্ডের মোট বর্গাকার ঘরের সংখ্যাও ৬৪।