মানুষ চিরকালই সৌন্দর্যের পূজারী। আর সেই সৌন্দর্যকে ফুটিয়ে তুলতে মানুষের চেষ্টাও কম নয়। বর্তমানে শুধু ভারতীয় উপমহাদেশ নয়, বরং গোটা বিশ্বজুড়েই, এমনকি আফ্রিকানদের মধ্যেও ফর্সা হওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। আর সময়ের দিকেও ভ্রূক্ষেপ না করে থাকা যাবে না। কেননা প্রথম মানবসভ্যতা মিশরীয়দের মধ্যেও ব্যাপকভাবে গায়ের রংকে হালকা করার প্রচলন ছিল। এর মানেটা পরিষ্কার, গোড়া থেকেই মানুষের মনে “ফর্সাই সৌন্দর্যের প্রতীক” ধারণাটি জেঁকে রয়েছে!
ঔপনিবেশিক আমলের সাদা চামড়ার ইউরোপিয়ানদের পুরো বিশ্ব শাসন এর উপর শুধুমাত্র আরেকটু প্রলেপ লাগিয়েছে। কারণটাও পরিষ্কার, কালো চামড়ার উপর সাদা চামড়ার কালো হৃদয়ের অত্যাচার আর বৈষম্যর অসংখ্য উদাহরণ পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে। ফলাফল বয়ে এনেছে সাদা চামড়াদের লোকদেরকে শ্রেয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার মতো ধারণা। নেলসন ম্যান্ডেলা, মার্টিন লুথার কিং কিংবা মহাত্মা গান্ধীও “ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি”-এর মতো পণ্য বিক্রির পরিমাণ খুব একটা কমাতে পারেনি। ব্রিটিশদের বুটের লাথি আর রুশদের গালির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। বরং তাদের মতো হওয়ার জন্য উল্টো ফর্সা হওয়ার হিড়িক পড়ে গেছে।
তো যাই হোক, মূল কথায় ফিরে আসি। অতীত পৃথিবীর অধিবাসীরা কিভাবে ফর্সা হওয়ার চেষ্টা করত সে গল্পগুলোই শোনা যাক।
প্রাচীন মিশর
পৃথিবীর সর্বপ্রথম মানবসভ্যতা প্রাচীন মিশরের লোকজন শারীরিক সৌন্দর্য্যকে কিছুটা আলাদা চোখেই দেখত। প্রাচীন সভ্যতাগুলোর মধ্যে সৌন্দর্য রক্ষার জন্য মিশরীয়রাই সবচেয়ে সচেতন ছিল। সৌন্দর্য লাভের জন্য মিশরীয়রা পূজা করতো মাতৃত্ব, সৌন্দর্য আর ভালোবাসার দেবী হাথোরের। মিশরীয় নারী বিশেষ করে রানীদের ব্যবহার করা পদ্ধতিগুলো সাত হাজার বছর পরেও আজও বিশ্বব্যাপী সমাদৃত।
পিরামিড অর্থাৎ মিশরীয় ফারাওদের সমাধিতেও প্রচুর প্রসাধনীর প্রমাণ মেলে। মিশরীয়রা বিশ্বাস করত এসব প্রসাধনীর সাহায্যে ফারাওরা মৃত্যুর পরেও নিজেদের সৌন্দর্য ধরে রাখবে। প্রাচীন মিশরে সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য উপাসনা করা খুবই সাধারণ ছিল এবং এর ফলে দেবতাদের সম্মান করা হয় ধারণা প্রচলিত ছিল। মিশরীয় মমিগুলোতেও ত্বক ফর্সা করার কেমিক্যাল ব্যবহার করার প্রমাণ মেলে। প্রায় ৩৫০০ বছর আগের এক মমির চেহারা নষ্ট হয়ে গিয়েছে শুধুমাত্র অতিরিক্ত রং ফর্সাকারী রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহারের জন্য!
ত্বকের কোমলতা আর রং হালকা করার জন্য মিশরীয়রা ব্যবহার করত ডেড সি-এর লবণাক্ত পানি! দুধ আর মধুর মিশ্রণও ব্যবহার করার ব্যাপক প্রচলন ছিল। তবে সবচেয়ে অদ্ভুত বিষয় হল, রানী ক্লিওপেট্রা কুমিরের বর্জ্য এবং গাধার দুধ ব্যবহার করতেন ফর্সা হওয়ার জন্য। অ্যাপেল-সিডারের সিরকাসহ বিভিন্ন রকম রাসায়নিক পদার্থও ব্যবহার করতেন মিশরের শেষ রানী। এছাড়াও মিশরীয়রা প্রায় ২৫ ধরণের ভেষজ তেল ব্যবহার করতো ত্বক ঠিক রাখার জন্য, নারী-পুরুষ উভয়েই এসকল ভেষজ তেল নিয়মিতভাবেই নিজেদের শরীরে প্রয়োগ করতেন। মিশরের আরেক রানী নেফারতিতিও বেশ কয়েক ধরণের ভেষজ পদার্থ ব্যবহার করতেন।
প্রাচীন গ্রিস
মিশরীয়দের মতো গ্রিকরাও শারীরিক সৌন্দর্যের পূজারী ছিল। প্রাচীন গ্রিসে ফর্সা ত্বককে সৌন্দর্য ও আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে ধরা হত। মিশরীয়দের মতো বয়সের ছাপ আড়াল করার চেষ্টা না করলেও সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য প্রসাধনী কম ব্যবহার হত না। প্রসাধনীর ইংরেজী “কসমেটিক্স”-ই তো এসেছে গ্রিক শব্দ “কসমেটিকোস” থেকে!
প্রাচীন গ্রিসে সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য জলপাইয়ের তেল ছিল সর্বজনবিদিত। রোদের হাত থেকে রক্ষার জন্য গ্রিক অ্যাথলেটরা জলপাইয়ের তেল প্রচুর পরিমাণে ব্যবহার করত। এছাড়াও জলপাই গাছের পাতা থেকে পেস্ট বানিয়ে তা মুখে প্রয়োগ করা হত। ফর্সা হওয়ার জন্য মিশরীয়দের মতো গ্রিকরাও মধু ব্যবহার করত, এছাড়া লেবু আর সিরকা ব্যবহারেরও উল্লেখ রয়েছে। ত্বক উজ্জ্বল করার জন্য গ্রিক নারীরা সমুদ্রশৈবাল আর শামুকের মিউকাসও ব্যবহার করত!
কিন্তু গ্রিসের সবাই তো আর ফর্সা হয়ে জন্ম নিত না, তাই বাধ্য হয়ে অনেকেই মুখে বিষাক্ত সাদা সীসা মেখে ঘুরে বেড়াত! এর ফলে মৃত্যুহার বেড়ে যাওয়ায় কিছুদিন পরেই সাদা সীসার বদলে সাদা চক ব্যবহার শুরু হয়। চক ব্যবহারের ফলে পরে খুব সহজেই ধুয়ে ফেলা সম্ভব হত আর একই সাথে সহজলভ্যও ছিল।
রোমান সাম্রাজ্য
প্রাচীন ইউরোপের কেন্দ্র রোমে প্রচুর বাথহাউজের সন্ধান পাওয়া যায়, সহজ ভাষায় যাকে বলা যায় হাম্মামখানা বা গোসল করার জায়গা। শরীর থেকে ময়লা দূর করার জন্য “স্ট্রিগিল” নামক এক প্রকার ধাতুর তৈরি বস্তু ব্যবহার করত রোমানরা। ফর্সা হওয়ার জন্য গ্রিকদের মতো রোমানরাও বিষাক্ত সীসা ব্যবহার করেছে অনেকদিন, এছাড়াও সাদা মার্ল এবং চকও ব্যবহার করেছে। সাদা ত্বকের উপর লাল লাল ছোপ ফেলার জন্য মার্লবেরি জুস, ওয়াইন, লালরঙা চক, ফুলের পাপড়িসহ বিভিন্ন জিনিস ব্যবহার হত। ক্লিওপেট্রার মতো রোমানরাও কুমিরের বর্জ্য ব্যবহার করত! আমন্ডের তেল এবং ময়দা আর মাখনের মিশ্রণের ব্যবহারও রোমে প্রচলিত ছিল।
মধ্যযুগীয় ইউরোপ
বর্তমানে ইউরোপিয়ানরা রোদে পোড়া চামড়ার দিকে ঝুকে পড়লেও কয়েক শতাব্দী আগেও ধারণা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। তখন রোদে পোড়া চামড়াকে ধরা হত বাইরে কাজ করার প্রমাণ আর ফর্সা রংকে ধরা হত আভিজাত্যের প্রতীক। এর ফলে মধ্যযুগের অভিজাত ইউরোপীয় নারীরা স্ট্রবেরি এবং ওয়াইনের প্রলেপ লাগিয়ে রং ফর্সা করার চেষ্টা করত। ভেনেশিয়ান সেরুস নামে পরিচিত সেই পুরোনো সাদা সীসা ব্যবহার করতেন স্বয়ং প্রথম এলিজাবেথ, তবে এ নিয়ে অনেকে দ্বিমতও পোষণ করেছেন। যদিও ইউরোপজুড়ে নারীদের কাছে সেরুসের প্রচুর চাহিদা ছিল।
সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ দিকে ইউরোপীয় নারীরা শিরার উপরের চামড়ায় নীল রং-এর পেন্সিল দিয়ে দাগিয়ে রাখতেন, যাতে তাদের চামড়া আরও সাদা দেখায়। এছাড়াও মুক্তার গুড়া এবং জিংক অক্সাইডও প্রচুর ব্যবহার হত। তবে উনবিংশ শতাব্দীতে অভিনেত্রী এবং দেহ ব্যবসায়ী ছাড়া কসমেটিক্স ব্যবহার করা সামাজিক অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হত।
আফ্রিকা ও আধুনিক বিশ্ব
বর্তমানে আফ্রিকাজুড়ে সাদা চামড়া বানানোর চেষ্টা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে, আর জিনিসগুলোও খুবই অদ্ভুত। পেট্রোল আর ডিজেল আপনার কাছে গাড়ির জ্বালানি হতে পারে, কিন্তু আফ্রিকানরা পেট্রোল-ডিজেল মেখে রোদে শুয়ে থাকে ত্বকের রং হালকা করার জন্য! ব্লিচিং পাউডার সাধারণ মানুষ ব্যবহার করে দাগ উঠানোর জন্য, উল্টোদিকে আফ্রিকায় এটি ব্যবহার হয় ফর্সাকারী পণ্য হিসেবে! কেরোসিন, বেকিং সোডা আর সিমেন্ট আপনি কি কাজে ব্যবহার করেন? আফ্রিকানরা এগুলো দিয়েও রং ফর্সা করার কাজে লাগায়! বিষাক্ত হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডও ব্যবহার হয় একই কাজে!
আধুনিক বিশ্বে চামড়া পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় অস্ত্র হলো প্লাস্টিক সার্জারি। শুধু ইউরোপ-আমেরিকার মাইকেল জ্যাকসনরা নয়, বরং চীন-কোরিয়া থেকে শুরু করে গোটা পূর্ব এশিয়ায় প্লাস্টিক সার্জারির সাহায্যে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে শরীরের নকল বহিরাবরণ!
প্রাচীন ভারত এবং উপনিবেশিক-পরবর্তী ভারত
“ফর্সা চামড়ার প্রতি আকর্ষণ”, এর ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা শুধুমাত্র প্রাচীন ভারতবর্ষে! প্রাচীনকালে হালকার চেয়ে গাঢ় রংকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হত। হিন্দু সংস্কৃতিতে, “কৃষ্ণ”-র শরীরের রং একেবারে কালো ছিল, বলাই বাহুল্য কৃষ্ণ মানেই হল কালো। রামকেও কালো হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। পর্তুগিজ পর্যটক মার্কো পোলোর ভাষ্যমতে, মধ্যযুগীয় ভারতেও সমাজে কালো চামড়ার লোকদের সমাজে উঁচু স্থানে রাখা হত।
কিন্তু উপনিবেশিক আমলে সবকিছু পরিবর্তন হয়ে যায়। ব্রিটিশদের কালো চামড়াদের উপর নাক সিটকানোর প্রভাব পড়ে ঔপনিবেশিক ভারতে। চাকরির ক্ষেত্রে আগে সুযোগ পেত কিছুটা হালকা রং-এর ভারতীয়, ব্রিটিশদের সুনজরও এদের উপর পড়া শুরু হয়। ব্রিটিশ এবং অন্যান্য ইউরোপীয়দের তৈরি স্কুলে বর্ণবাদের শিক্ষা দেওয়ার প্রভাবে পুরো ভারতজুড়ে “ফর্সাই শ্রেয়” ধারণাটি বিস্তার পাওয়া শুরু হয়। আর ব্রিটিশদের বর্ণবৈষম্য তো সবসময়ই ওঁত পেতে ছিল। এভাবেই ভারতবর্ষে তৈরি হয় গায়ের চামড়ার রং পরিবর্তনের প্রাদুর্ভাব।