Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ভোপালের দুঃস্বপ্ন: এক মৃত্যুরজনীর নির্মম কাহিনী

আজ থেকে প্রায় ৩৩ বছর আগে এক ভয়ানক বিভীষিকা নেমে এসেছিল ভারতের মধ্যপ্রদেশে। সুবিস্তৃত মালভূমির উপর, বিন্ধ্য পর্বতের পাদদেশে, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় অর্ধ কিলোমিটার উচ্চতায় অবস্থিত সহস্র বছরের পুরাতন নর্মদা নদীবিধৌত ভোপালে। সারাদিনের ব্যস্ততা শেষে ক্লান্তিসকাশে ঘুমাতে গিয়েছিল ভোপালবাসী। কিন্তু কুয়াশায় ঢাকা সেদিনের মধ্যরাত হাজার হাজার ঘুমন্ত মানুষের মৃত্যু পরোয়ানা নিয়ে হাজির হয়েছিল চুপিসারে। আর ভোরের আলো ফোটার আগেই সে নিয়ে যায় হাজার হাজার নিরীহ প্রাণ। আক্রান্ত করে দিয়ে যায় ভোপালের অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে। বিংশ শতাব্দীর ইতিহাসের পাতাগুলো যেসব করুণ, বেদনাবিধুর ঘটনায় সিক্ত হয়ে আছে, মধ্যপ্রদেশের ভোপাল গ্যাস ট্র্যাজেডি তার মধ্যে অন্যতম। পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম ভয়ানক শিল্প-দুর্ঘটনা নিয়েই আজকের লেখা। সময়ে ভর করে চলুন ফিরে যাই তিন দশক আগে, ১৯৮৪ সালের ২ ডিসেম্বর… মধ্যপ্রদেশের ভোপালে।

লেকের শহর ভোপাল; ছবিসূত্রঃ Prakhar Chaudhary

ভোপালকে বলা হয় লেকের শহর। ভারতের সতেরতম জনাকীর্ণ এই শহর মধ্য প্রদেশের রাজধানী। লোককাহিনী বলে যে, ধারানগরের রাজা ভুজা কর্তৃক একাদশ শতকে এই নগরী প্রতিষ্ঠিত। রাজার নামানুসারে ভোপাল পরিচিত ছিল ‘ভুজপাল’ হিসেবে। ধীরে ধীরে কালের বিবর্তনে তা হয়ে যায় ভোপাল। যদিও এটি লোককাহিনীর মত; সুনির্দিষ্ট কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ এর স্বপক্ষে পাওয়া যায়নি। তবে আধুনিক ভোপালের প্রতিষ্ঠাতা মোঘল সেনাবাহিনীর আফগান যোদ্ধা দাস্ত মোহাম্মদ খান (১৭০৭ – ১৭৪০)। তাঁকে বলা হয় ভোপালের প্রথম নবাব। ১৭০৮ সালে তিনি বেরাসিয়া এস্টেট লীজ নেন; সাথে আরো কতগুলো এলাকা যুক্ত করে প্রতিষ্ঠা করেন বর্তমানের তিলোত্তমা ভোপাল নগরীকে।

এখানেই শেষ নয় ভোপালের ইতিহাসের পাতা। বিগত শতাব্দীর শেষভাগে এসে ভোপালের ইতিহাস রচিত হয় এক করুণ গতানুশোচনায়। নিদ্রাচ্ছন্ন এক জনপদের সহস্র নিরীহ অধিবাসীকে মধ্যরাতের গহীন আঁধারে মেরে ফেলা হয় অবহেলা ও অজ্ঞতার বিষ দিয়ে। ৩ ডিসেম্বর (কোনো কোনো জায়গায় অবশ্য ২ ডিসেম্বরের উল্লেখও পাবেন, কারণ দুর্ঘটনার সূত্রপাত যে এই তারিখেই) মধ্যরাতের কিছু আগে ইউনিয়ন কার্বাইড ইন্ডিয়া লিমিটেডের কীটনাশক প্ল্যান্ট থেকে লিক হয়ে যায় ৪০ টনেরও বেশি বিষাক্ত মিথাইল আইসোসায়ানেট গ্যাস। হাজার হাজার প্রাণের বিনিময়ে রচনা করে পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে মারাত্মক ও হৃদয়বিদারক শিল্প দুর্ঘটনার।

৩ ডিসেম্বর, ১৯৮৪; ৭০ একর জমির উপর নির্মিত ইউনিয়ন কার্বাইড ইন্ডিয়া লিমিটেডে রাতের পালার কাজ শুরু হয়েছে। ভোপালের প্রায় নয় লক্ষ অধিবাসী তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। টিক টিক করে ঘড়ির কাঁটা সময়কে নিয়ে যাচ্ছে আঁধার রাতের গহীনে। ঠিক সেসময় একটা অদ্ভুত শব্দ কারখানার এক অপারেটরের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মিথাইল আইসোসায়ানেট ইউনিটের এক কীটনাশক প্ল্যান্টের (ট্যাঙ্ক নাম্বার ই৬১০) ভেতর চাপ বাড়তে থাকে। চাপ বাড়তে বাড়তে এক পর্যায়ে তা বিপদসীমার উপরে চলে যায়। অপারেটর জানতেন, অত্যধিক তাপ ও চাপে মিথাইল আইসোসায়ানেট তরল থেকে গ্যাসীয় অবস্থায় রূপান্তরিত হবে, আর তখন তা ট্যাঙ্ক থেকে বের হবার সম্ভাবনাও বহুগুণে বেড়ে যাবে। তিনি সাথে সাথে ঘটনাটি তার ঊর্ধ্বতনকে অবহিত করেন। সবাই ছুটে আসে ই৬১০-এর সামনে। কিন্তু পরিস্থিতি ততক্ষণে নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ট্যাঙ্কটি এতটাই গরম হয়ে ওঠে যে এর আশেপাশে কেউ ভিড়তে পারছিল না।

হতোদ্যম শ্রমিকেরা তাপ কমাতে প্ল্যান্টের গায়ে আরো পানি ছুঁড়ে মারে। কিন্তু এতে করে হিতে বিপরীত ঘটনা ঘটে। মিথাইল আইসোসায়ানেট পানির সাথে বিক্রিয়া করে আরো তাপ (প্রতি কিলোগ্রামে তিন হাজার ক্যালরির উপর!) উৎপন্ন করে। সাথে তৈরি হয় অত্যধিক মাত্রায় কার্বন ডাই-অক্সাইড। ¹ যদি কার্যকরী উপায়ে এই পানিকে দূরীভূত করা না যায়, বিক্রিয়ার হার অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাবে আর পরিণামে ফুটতে আরম্ভ করবে কীটনাশক কার্বারাইলের মূল উপাদান মিথাইল আইসোসায়ানেট। আর হয়ও তাই। ৩৯º সেলসিয়াস স্ফুটনাংকের এই বিষাক্ত পদার্থ মুহূর্তের মধ্যে ট্যাঙ্কের ২৫০ ডিগ্রীর পরিবেশে চলে আসে।

প্রচণ্ড চাপে গ্যাসে পরিণত হওয়া মিথাইল আইসোসায়ানেট সেফটি ভাল্ভ অতিক্রম করে ৭০ ফিটের এক লম্বা পাইপলাইনে ঢুকে পড়ে। এই পাইপলাইনের শেষ প্রান্তে যুক্ত ছিল গ্যাস স্ক্র্যাবার। এখানে মূলত কস্টিক সোডা দিয়ে মিথাইল আইসোসায়ানেটকে ক্ষতিকর নয় এমন পদার্থে রূপান্তরিত করা হয়। কিন্তু এদিন হয়তো মৃত্যু পরোয়ানা নিয়েই এসেছিল ইউনিয়ন কার্বাইড ইন্ডিয়া লিমিটেডের ট্যাঙ্ক ই৬১০। আর সে কারণেই গ্যাস স্ক্র্যাবারটিও সেই রাতে কাজ করেনি। সংস্কার করার জন্য এটিকে বন্ধ (Shut Down) রাখা হয়েছিল। শুধু তাই নয়, প্ল্যান্টের পাঁচটি নিরাপত্তা ব্যবস্থার সবকয়টি সেই রাতে অকেজো হয়ে পড়েছিল। ভুপালের কুয়াশামাখা বাতাসে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে প্রাণসংহারী বিষাক্ত গ্যাস। ঘন্টায় ১২ কিলোমিটার গতিতে বয়ে চলা বাতাসে ভর করে মৃত্যুদূতের ন্যায় হাজির হয় দক্ষিণ-দক্ষিণপূর্ব প্রান্তে বাস করা ঘুমন্ত ভোপালবাসীর ঘরে ঘরে। ²

এই সেই অভিশপ্ত ট্যাঙ্ক ই৬১০ যেখান থেকে বের হয়ে আসে বিষাক্ত মিথাইল আইসোসায়ানেট; ছবিসূত্রঃ Julian Nitzsche

ঘুমন্ত মানুষগুলো বিনা সতর্কতায় আক্রান্ত হয়ে পড়ে। একযোগে জেগে ওঠে তারা। প্রতিটি ঘর ধোঁয়াচ্ছন্ন। শিশুরা গলা চেপে ধরে অবিরাম কাশছে, অবর্ণনীয় যন্ত্রণায় চোখ, গলা, কণ্ঠনালী পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে। কেউবা পেট চেপে ধরে বসে পড়েছে ঘরের মেঝেতে। ভীতসন্ত্রস্ত মানুষ ঘরের বাইরে আসার আপ্রাণ চেষ্টায় রত। কেউ পারছে, তো কেউ চৌকাঠ পর্যন্ত যেতে না যেতেই লুটিয়ে পড়ছে মাটিতে। কাশির শব্দ আর ঠিকমতো শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে না পারার অজানা কষ্টে বিদীর্ণ হয়ে ওঠে মধ্যপ্রদেশের ভোপাল। কিছু কঠিন প্রাণের মানুষ কড়িকাঠ মাড়িয়ে বাইরে আসতে পেরেছিল। কিন্তু হতভাগ্য লোকদের চারপাশ তখন বিষাক্ত গ্যাসে আচ্ছন্ন। নিঃশ্বাস নেওয়ার মতো অক্সিজেনও ছিল না সে রাতের বাতাসে। রাস্তার ধারে পড়ে ছিল কাঁথা মুড়ি দেওয়া শত শত লাশ। চোখে ভয় আর মুখে ফেনা নিয়ে সবার আগে মারা যাওয়া এই গৃহহীনদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল ছিন্নমূল পথশিশু।

এ শুধু মানবের মৃত্যু নয়, এ মৃত্যু মানবতারও; source: Raghu Rai/Greenpeace

ঘিঞ্জি বস্তিগুলোতে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। মানুষ দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটতে থাকে অজানার দিকে। বাঁচতে হবে তাকে; কিন্তু সেই বাঁচার পথ কোথায়! দৌড়াতে দৌড়াতে হাঁপিয়ে ওঠা মা জানেন না, তার কোলে থাকা আদরের ধন অনেক আগেই মারা গেছে। কান্নাভেজা চোখে একরাশ বিদগ্ধ জ্বালা নিয়ে ছোট্ট শিশুটি মৃত্যুর প্রহর গুনছে পাশেই সদ্য লাশ হয়ে যাওয়া মা-বাবার পাশে। মায়ের কোল থেকে ছিটকে পড়ে পদদলিত হয়ে মারা যাওয়া শিশুটি ছিল সেই রাতের ‘ভাগ্যবান’ (!); কারণ গ্যাসের ভয়ানক বিষাক্ততা ছোঁয়ার আগেই সে চলে গেছে না ফেরার দেশে। ভোপাল রেলস্টেশনে (রাত ১.১০) হাজির হওয়া লক্ষ্ণৌ-মুম্বাই এক্সপ্রেস ট্রেনটি বিভীষিকার ঘন সাদা ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে ছিল। ‘ডমিনোস ইফেক্টের’ মতো সারি সারি লাশ পড়ছিল ভোপালের রাস্তায়, বাড়িতে, গাড়িতে, রেলস্টেশনে, সবখানে।

বিষাক্ত গ্যাসে আচ্ছন্ন লেকের শহর ভোপাল source: Chandu Mhatre

মিথাইল আইসোসায়ানেটের বিষাক্ত থাবা কতটা ভয়ানক ছিল সেটা চিন্তা করাও অনেকের কাছে দুরূহ ঠেকবে। যুক্তরাষ্ট্রের অকুপেশনাল সেফটি এন্ড হেলথ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের মতে, একটি আট কর্মঘণ্টার কারখানায় মিথাইল আইসোসায়ানেটের নিরাপদ মাত্রা ০.০২ পিপিএম(পার্টস পার মিলিয়ন)। ০.৪ পিপিএমের উপস্থিতিতেই যেখানে কফ, বুকে ব্যথা, অ্যাজমা, ত্বকের ক্ষতি থেকে শুরু করে চোখ, নাক আর গলা জ্বালা-পোড়া করতে পারে, সেখানে ভুপাল গ্যাস ট্র্যাজেডির মিথাইল আইসোসায়ানেটের পিপিএম ছিল ২৭! যা আদর্শ মানের (০.০২ পিপিএম) তুলনায় প্রায় ১, ৪০০ গুণ বেশি ছিল। ³

মৃত্যুর মিছিলে যোগ দেওয়া এক হতভাগ্য নারীর লাশ নিয়ে যাচ্ছে এক লোক; source: BEDI/AFP/Getty Images

এটা ছিল সেই মৃত্যুরজনীর পরের দিনের সকাল। বেঁচে যাওয়া এই আক্রান্ত মানুষদের ফুসফুস আর চোখ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়; source: Raghu Rai/Magnum Photos

ভোপালের সরকারি হামিদিয়া হাসপাতালে বস্তায় বস্তায় রাখা হয়েছিল মৃতদের মাথার খুলি আর হাড়গোড়। হয়তো কোনোদিন দেখাও হয়নি, হয়তো হয়নি কথা; কিন্তু দুর্ভাগ্যের ফেরে সেদিন তারাই পাশাপাশি থেকে রচনা করেছিল এক বিয়োগান্তক গাথা। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, বিষাক্ত গ্যাস মৃতদেহের মাথায় ভয়ানক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।

শত শত মৃত ‘প্রাণ’ আছে পাশে পাশে,
মানবতা মরে ভূত দানবসকাশে…
হামিদিয়া হাসপাতালে ভোপাল ট্র্যাজেডির এক মর্মান্তিক নিদর্শন source: Raghu Rai/Greenpeace

ভারত সহ সমগ্র বিশ্ব হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। ভোপালের বিভীষিকা ধীরে ধীরে সবার সামনে উন্মোচিত হতে শুরু করে। বোধে আসে না এমন অকথ্য কষ্টে নিমজ্জিত হয় সমগ্র মানবতা। সারি সারি শিশুর নিথর দেহ দেখে ডুকরে কেঁদে ওঠে পাথরের মতো কঠিন হৃদয়ও। সদ্য বিপত্নীক হওয়া লোকটি কোলে করে নিয়ে যায় তার প্রাণপ্রিয় স্ত্রীর নিথর লাশ। মৃত সন্তানের কপালে স্নেহের পরশ বুলিয়ে তাকে শেষ বিদায় দেন হতভাগ্য পিতামাতা। জীবন সায়াহ্নে সবাইকে হারিয়ে একদম একা হয়ে যান গরীব বৃদ্ধা। ভুপাল অনাথ করে দিয়ে যায় শত শত শিশুকে, সন্তানহারা মায়ের মর্মন্তুদ কান্নায় তৈরি হয় ইতিহাসের এক ধূসর অ্যালবাম। জীবনসঙ্গীকে হারিয়ে শোকে মুহ্যমান মানুষের অপলক দৃষ্টি সৃষ্টি করে এক অব্যক্ত বেদনা। ভুপালে ওঠে প্রিয়জন হারানোর মহামাতম।

মৃত স্ত্রীকে কাঁধে করে সৎকারের জন্য নিয়ে যাচ্ছে এক হতভাগ্য স্বামী; source: Raghu Rai/Magnum Photos

এই বৃদ্ধা তার আপনজন সবাইকে হারিয়েছে ভোপালের মর্মান্তিক বিভীষিকায়; source: Raghu Rai/Magnum Photos

পরিবেশ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংগঠন গ্রিনপিসের ভাষ্যমতে, ভোপালের ঘনবসতিপূর্ণ ৪০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়া এই গ্যাসে ২০ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা যায়। তিন হাজার তো মারা যায় সেই রাতের আদিভাগেই, যাদের জীবনে নতুন ঊষালগ্ন আর কখনোই আসেনি। প্রথম ৭২ ঘন্টায় অবর্ণনীয় যন্ত্রণা সহ্য করে প্রাণ হারায় ৮ হাজার নিরীহ মানুষ। অন্যদিকে আক্রান্তের সংখ্যা পাঁচ লক্ষাধিক, যার প্রায় দুই লক্ষই ছিল ছোট ছোট শিশু। অবশ্য তৎকালীন সরকারের গতানুগতিক চাটুকারিতা হিসেবে ভোপাল গ্যাস ট্র্যাজেডিতে মৃতের সংখ্যা ‘মাত্র’ ৫,২০০ জন!

ললাটের এই লিখনই কি ছিল চোলা কলোনির ছোট্ট লীলার ভাগ্যে! source: Raghu Rai/Magnum Photos

লাশের সৎকার করতে হিমশিম খেয়ে যায় বেঁচে থাকা স্বজন ও প্রশাসন। সাদা কাফনে মোড়ানো সারি সারি লাশগুলোকে বাধ্য হয়ে একসাথে কবর দেওয়া হয়। শ্মশানে একসাথে পোড়ানো হয় শত শত লাশ। অমর চাঁদ আজমেরার মতো সমাজসেবীদের দিনে প্রায় দু হাজারের মতো লাশের সৎকার করতে হয়েছিল। কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল শোকের জনপদ ভোপাল।

সাদায় মোড়ানো এক কালো অধ্যায়ের পরিণাম source: Sandro Tucci/Getty Images

আদরের সন্তানকে বাধ্য হয়ে এভাবেই কবর দিয়েছিল ভোপালের মা-বাবারা source: Raghu Rai/Magnum Photos

অমর চাঁদেরা এভাবেই শত শত লাশের সৎকার করতে বাধ্য হয়েছিল source: Raghu Rai/Magnum Photos

ইউনিয়ন কার্বাইড ইন্ডিয়া লিমিটেড: পশ্চিম ভার্জিনিয়া থেকে মধ্য ভারতে 

প্রথম মহাযুদ্ধের পর বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মহামন্দা ইউরোপ হয়ে সমগ্র পৃথিবীকে গ্রাস করে ফেলে। অর্থনৈতিক এই মহামন্দা যখন সর্বোচ্চ শিখরে, ঠিক তখনই ১৯৩৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এই ইউনিয়ন কার্বাইড ইন্ডিয়া লিমিটেড সংক্ষেপে- ইউসিআইএল। এটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইউনিয়ন কার্বাইড কর্পোরেশনের একটি সম্পূরক প্রতিস্থান। কোম্পানিটির সমগ্র ভারতজুড়ে ছিল ১৪টির মতো প্ল্যান্ট। ইউনিয়ন কার্বাইড ইন্ডিয়া লিমিটেড একটি যৌথ কোম্পানি যার ৫০.৯% শেয়ার ইউনিয়ন কার্বাইড কর্পোরেশনের এবং বাকি ৪৯.১% ভাগের বন্টন ছিল বিভিন্ন ভারতীয় বিনিয়োগকারীর মধ্যে। খোদ ভারত সরকারও (সরকার নিয়ন্ত্রিত ব্যাংকের মাধ্যমে) ছিল এই লঘিষ্ঠ ভাগের ভেতর। 4

ইউসিআইএল মূলত তৈরি করতো বিভিন্ন কীটনাশক, কার্বন পণ্য, প্লাস্টিক ও ওয়েল্ডিংয়ের যন্ত্রপাতি। ১৯৬৬ সালে ইউসিআইএল ও ভারত সরকারের মধ্যে একটা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সেই চুক্তি অনুযায়ী, ১৯৬৯ সালে তারা ভোপালে একটি কীটনাশক প্ল্যান্ট প্রতিষ্ঠা করে। ইউসিআইএল তৎকালে ব্যাপকহারে এশিয়া জুড়ে ব্যবহৃত কীটনাশক সেভিন (কার্বারাইলের বাণিজ্যিক ব্র্যান্ড) উৎপাদনের জন্য এই প্ল্যান্টটি বেছে নেয়। ভারত সরকার তাদেরকে বছরে ৫ হাজার টন সেভিন উৎপাদনের লাইসেন্স দেয়।

১৯৭৩ সালে প্রথমবারের মতো তারা যুক্তরাষ্ট্র থেকে মিথাইল আইসোসায়ানেট আমদানি করা শুরু করে। কিন্তু পুঁজিবাদী শিল্পব্যবস্থা কখনোই থেমে থাকে না। মানবতা, মূল্যবোধ, পরিবেশ, বাস্তুসংস্থান, সবকিছুকে কাঁচকলা দেখিয়ে তারা ঠিকই তৈরি করে নেয় তাদের অন্যায় অগ্রযাত্রার অবৈধ মহাসড়ক। খোদ নিজেদের নিয়োগ করা উপদেষ্টাদের কথা অগ্রাহ্য করে ১৯৭৯ সাল থেকে কর্তৃপক্ষ ভোপালে তাদের কীটনাশক প্ল্যান্টেই এই বিষাক্ত পদার্থ মিথাইল আইসোসায়ানেটের উৎপাদন ও সংরক্ষণ শুরু করে। কর্তৃপক্ষ এই বলে আশ্বস্ত করে যে, এই প্ল্যান্টটি একটা চকোলেট ফ্যাক্টরির মতোই ‘নিরীহ’ (!) টাইপ হবে; দুশ্চিন্তা করার কোনোই কারণ নেই! অথচ যে কালি গ্রাউন্ডে এই কীটনাশক প্ল্যান্ট বসানো হয়েছিল সেই জায়গাটি ছিল হালকা ধরনের শিল্পকারখানা আর সাধারণ বাণিজ্যিক কার্যক্রমের জন্য উপযোগী। এর আশেপাশে ছিল ওরিজা, জয়প্রকাশ নগর আর চোলার বস্তি। নগর কর্তৃপক্ষের বিধানেও স্পষ্টভাবে বলা ছিল, এমন স্থানে কোনো শিল্প-কারখানা বসানো যাবে না যেখান থেকে বাতাসে করে বিষাক্ত ধোঁয়া আশেপাশের ঘনবসতিপূর্ণ জনপদে চলে আসার সম্ভাবনা থাকে। অর্থাৎ কোনোভাবেই কীটনাশক প্ল্যান্টের মতো বিপজ্জনক শিল্পের জন্য আদর্শ ছিল না কারখানাটি। কিন্তু তারপরও সেটা হয়। এক জটিল, বিপজ্জনক প্রক্রিয়ার সূচনা ঘটলো ভোপালের মাটিতে। 5

ভোপালের বিভীষিকা ইউনিয়ন কার্বাইড ইন্ডিয়া লিমিটেড source: Raghu Rai

কিন্তু ঝামেলা বাঁধলো গিয়ে আশির দশকে ভারতজুড়ে শুরু হওয়া দুর্ভিক্ষ নিয়ে। একদিকে দুর্ভিক্ষ, অপরদিকে ফসল না হওয়া  ক্রমাগত বাড়তে থাকা ঋণের বোঝায় জর্জরিত কৃষকদের কীটনাশক ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করে তোলে। ফলে মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়ে কীটনাশক উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো। ১৯৮৪ সালে ইউসিআইএলের সেভিন উৎপাদন প্রায় ২৫ শতাংশে নেমে আসে। ফলে সে বছরের জুলাই মাসে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ইউসিআইএলের ভোপাল প্ল্যান্ট বিক্রি করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু কিনবে কে ক্ষতির মুখে থাকা কীটনাশক কারখানাটি? ফলে ইউসিআইএল কর্তৃপক্ষ কারখানাটি অন্য কোনো উন্নয়নশীল দেশে সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর থেকে কারখানাটির সেফটি ইকুপমেন্ট আর তার পরিচালনা পদ্ধতি পশ্চিম ভার্জিনিয়ার স্ট্যান্ডার্ড মান বজায় রাখতে ব্যর্থ হতে থাকে। এটা ইচ্ছাকৃতভাবেই করা হয় বলে অধিকাংশের ধারণা। অন্যদিকে স্থানীয় সরকার নিরাপত্তা মানদণ্ডের এই নিম্নগামিতার বিষয়টি জানার পরও উদাসীনতার পরিচয় দেয়। 6

পদে পদে ছিল অনিয়ম, শৈথিল্য আর কৃপণতা। ১৯৮০ থেকে ১৯৮৪ সাল- এই চার বছরের ভেতর প্ল্যান্টের কর্মী সংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে আনা হয়। মেইনটেন্যান্স সুপারভাইসরের পদটি অবলুপ্ত করে ফেলায় কারখানায় এই পদের কেউ ছিল না। কারখানার শ্রমিকদের নিরাপত্তা বিষয়ক প্রশিক্ষণ কর্মশালার সময় ৬ মাস থেকে কমিয়ে করা হয় মাত্র ১৫ দিন! খরচ কমাতে ১৯৮৩ সালে কারখানার ম্যানেজিং ডিরেক্টর জগন্নাথ মুকুন্দ ঊর্ধ্বতনের নির্দেশে দুইশ দক্ষ শ্রমিক ও টেকনিশিয়ানকে অবসরে পাঠান। চুরাশির ভোপাল গ্যাস দুর্ঘটনাই একমাত্র ছিল না। ১৯৮১ সালের ডিসেম্বরে কারখানার ফসজিন গ্যাস লিক হয়ে প্ল্যান্ট অপারেটর মোহাম্মদ আশরাফ মারা যান। ১৯৮২ সালের জানুয়ারিতে আরেকটি ফসজিন লিকে ২৮ জন শ্রমিক মারাত্মকভাবে আহত হয়। একই বছরের অক্টোবরে ভাঙা ভাল্ভ দিয়ে মিথাইল আইসোসায়ানেট বের হয়ে চারজন শ্রমিককে আহত করে। এতকিছুর পরও অন্ধ হয়ে ছিল সবাই- সরকার, কর্তৃপক্ষ, এমনকি জনগণও।

প্রতিক্রিয়া ও ফলাফল

সবাই সরব হয় এই ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের গ্রেফতার ও যথোপযুক্ত শাস্তির দাবিতে। ইউনিয়ন কার্বাইড কর্পোরেশনের তৎকালীন সিইও ওয়ারেন অ্যান্ডারসন ৭ ডিসেম্বর ভারতে আসলে গ্রেফতার করা হয় তাকে। কিন্তু গ্রেফতারের ঘন্টা ছয়েকের ভেতর মাত্র ২৫ হাজার রুপীর (সেই সময়, ১ ডলার = ১২ রুপী ছিল) বিনিময়ে জামিনে ছাড়াও পেয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ‘পালিয়ে’ যায় সে। ওয়ারেন আর কখনোই ভারতে ফিরে আসেনি। তাকে ভারতে এনে বিচারের মুখোমুখি করারও কোনো গ্রহণযোগ্য সদিচ্ছা লক্ষ্য করা যায়নি কোনো আমলের কোনো সরকারের মধ্যে! তবে ১৯৯২ সালের এপ্রিলে তাকে পলাতক আসামী ঘোষণা করে ভারতের আদালত।

মার্কিন সরকারও তাদের এই কুলাঙ্গার নাগরিকেরই পক্ষ নেয়। তাদের ভাষ্য, যেহেতু এই দুর্ঘটনা ভারতে হয়েছে, সেহেতু তারা কিছু করতে পারবে না! ১৯৮৯ সালে ইউনিয়ন কার্বাইড কর্পোরেশন ভারত সরকারকে ৪৭০ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি হয়। কিন্তু সেই অর্থের কতটুকুই বা কাজে লেগেছে সৎভাবে, সঠিকভাবে? ভুক্তভোগী প্রত্যেকে মাসিক ২০০ রুপী (প্রায় ৪ ডলারের মতো) করে পেতেন। কিন্তু এই যৎসামান্য অর্থ তাদের অসামান্য কষ্টকে লাঘব কারার জন্যে যথেষ্ট ছিল কি? ভোপাল গ্যাস ট্র্যাজেডির প্রায় ২৬ বছর পরে ২০১০ সালের জুন মাসে ভারতের আদালত চূড়ান্ত রায় দেন। আদালত দুর্ঘটনার সময় কর্মরত আটজন ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করে। এদের সবাই ছিল ভারতীয়। তাদের সবাইকে দু’বছর করে কারাদন্ড ও এক লাখ রুপী জরিমানা করা হয়। ততদিনে সত্তরের কোঠায় চলে যাওয়া এই আসামীরা জামিন নিয়ে বের হয়ে যায়। এই রায়ের সবচেয়ে আশ্চর্যের দিক ছিল ওয়ারেন অ্যান্ডারসনের বিরুদ্ধে কোনো চার্জশীট দায়ের না করা এবং তাকে কোনোপ্রকার শাস্তির আওতায় না আনা। অ্যান্ডারসন ২০১৪ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যে মারা যায়

শত সহস্র প্রাণের মৃত্যুর নেপথ্যে থাকা মূল হন্তারক ওয়ারেন অ্যান্ডারসন source: Yvonne Hemsey/Getty Images

তেত্রিশ বছর আগের সেই অমানিশা আজও কাটেনি ভোপালের ঘরে ঘরে, পথে-ঘাটে। মায়ের জঠর থেকেই শারীরিক ও মানসিক বিকলাঙ্গতা নিয়ে জন্ম নেয় অনেক শিশু। ক্যান্সারের মতো মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে অগণিত মানুষ। ভোপালের শহরতলীতে আছে স্বামীহারা মহিলাদের জন্য বিধবা কলোনি। শ্বাসকষ্ট, ক্ষুধামন্দা, জ্বরজারি আজ আলো-হাওয়ার মতোই ভোপালবাসীর নিত্যসঙ্গী। না ভারতের কোনো সরকার, না এই দুর্ঘটনার পুঁজিবাদী মূল হোতারা, না সমাজ, সভ্যতার ধারক বাহকেরা- কেউই পারেনি ভোপালবাসীদের সেই দুঃস্বপ্নের অমানিশা থেকে বের করে আনতে; তাদের সুস্থ স্বাভাবিক জীবনধারায় সম্পূর্ণরূপে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে। অপরিকল্পিত শিল্পায়নের করাল গ্রাসে পতিত হবার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ভোপাল গ্যাস ট্র্যাজেডি।

Pulmonary Fibrosis রোগে আক্রান্ত মোহাম্মদ আরিফ source: Raghu Rai/Magnum Photos

এই নারীদের সবাই তাদের স্বামীকে হারিয়েছে ভোপাল গ্যাস দুর্ঘটনায় source: Raghu Rai/Magnum Photos

ভোপাল গ্যাস ট্র্যাজেডির নির্মম পরিণাম; গর্ভপাত হওয়া ভ্রূণ গবেষণার স্বার্থে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে source: Raghu Rai/Magnum Photos

এই সেই হৃদয়বিদারক বিশ্বকাঁপানো ছবি যেটি ভারতের বিখ্যাত ফটোগ্রাফার রাঘু রাই তুলেছিলেন source: Raghu Rai/Magnum Photos

ফিচার ইমেজঃ Edited by writer

ফুটনোটঃ

  1. Castro, E. A., Moodie, R. B., & Sansom, P. J. (1985). The kinetics of hydrolysis of methyl and phenyl lsocyanates. Journal of the Chemical Society, Perkin Transactions 2, (5), p. 737-742.
  2. Mukherjee, S. (2002). Bhopal gas tragedy: the worst industrial disaster in human history, a book for young people. Tulika Books, ISBN 8186895841, p. 6-11.
  3. Dhara, V. R., & Dhara, R. (2002). The Union Carbide disaster in Bhopal: a review of health effects. Archives of Environmental Health: An International Journal, 57(5), p. 391-404.
  4. Cavusgil, S. T., Knight, G., Riesenberger, J. R., Rammal, H. G., & Rose, E. L. (2014). International business, Pearson Australia., ISBN 1486011381, Chapter 5, p. 140-142.
  5. Dutta, S. (2002). The Bhopal gas tragedy. ICFAI Center for Management Research, Hyderabad.
  6. Shrivastava, P. (1987). Bhopal: Anatomy of a crisis. Cambridge, MA: Ballinger.

Related Articles