গত ২০ মার্চ নয়াদিল্লির সংসদ ভবনে ভারতের বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ একটি মর্মান্তিক ঘোষণা করার পর থেকেই তুমুল শোরগোল পড়ে যায় দেশের অলিতে গলিতে। সুষমা জানান, বছর চারেক আগে পশ্চিম এশিয়ার দেশ ইরাকে নিখোঁজ হওয়া ৪০ জন ভারতীয় শ্রমিকের খোঁজ অবশেষে পাওয়া গেছে, কিন্তু আজ তাদের মাঝে ৩৯ জনই বেঁচে নেই। ইরাকের কুখ্যাত ইসলামিক স্টেট জঙ্গি সংগঠন তাদের অপহরণ করে খুন করে। শুধুমাত্র একজন নিজের ভারতীয় পরিচয় লুকিয়ে পালিয়ে বাঁচে।
সুষমার এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই সংসদে তুমুল হট্টগোল শুরু করে বিরোধীপক্ষ। পরিস্থিতি এমন বিশ্রী আকার ধারণ করে যে, সুষমা নিজের ঘোষণা শেষই করতে পারেননি। বিরোধীপক্ষের তরফ থেকে বলা হয়, মাঝের এই বছরগুলোতে ওই মৃত শ্রমিকদের পরিবার যতবার সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছে তাদের খোঁজ দেওয়ার জন্যে, ততবার কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে তাদের ফাঁকা আশ্বাস দেওয়া হয়। তাহলে কি সরকারের কোনো কিছুই জানা ছিল না? গত বছরও সুষমাকে সংসদে এই প্রশ্ন করা হলে তিনি জানিয়েছিলেন যে, যতক্ষণ না তিনি ওই শ্রমিকদের মৃত্যুর যথাযথ প্রমাণপত্র পাচ্ছেন, ততক্ষণ তার পক্ষে তাদের মৃত ঘোষণা করা সম্ভব ছিল না।
সুষমা সংসদকে জানান যে, মৃত ভারতীয় শ্রমিকদের দেহ কোনো গণকবরে নয়, পাওয়া যায় একটি স্তূপের তলায়। তিনি বলেন, ঠিক ৩৯টি দেহ পাওয়া যায় এবং তাতে লম্বা চুল এবং হাতে বালা থাকাতে সন্দেহ আরও দৃঢ় হয়। এরপরেই ডিএনএ পরীক্ষা করা হয় এবং তাতেই প্রমাণিত হয় যে, মৃতদেহগুলো ভারতীয় শ্রমিকদেরই। এই শ্রমিকদের বেশিরভাগই ছিলেন পাঞ্জাব প্রদেশের। বিদেশমন্ত্রকের রাষ্ট্রমন্ত্রী ভি কে সিং ইরাকে গিয়ে দেহগুলো ফেরত এনে পরিবারবর্গের হাতে তুলে দেবেন।
ইরাকের জঙ্গিদের হাতে নির্দোষ ভারতীয় শ্রমিকদের মৃত্যুর ঘটনাটি খুবই পীড়াদায়ক। একদিকে যেমন এই ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখায় ইরাকে ভারতের বিদেশনীতির সীমাবদ্ধতা, অন্যদিকে বিদেশমন্ত্রীকে সংসদে এ বিষয়ে বিশদে বলতে না দেওয়াও বিরোধীপক্ষের তরফে এক নিকৃষ্ট নিদর্শন। মৃত প্রাণগুলোকে আর ফিরিয়ে আনা যাবে না নিশ্চয়ই, কিন্তু ভবিষ্যতে যাতে এমন ঘটনা ফের না ঘটে তার ব্যবস্থা গ্রহণ করাও আশু জরুরি।
ভারত পশ্চিম এশিয়ার রাজনৈতিক এবং অন্যান্য ডামাডোল থেকে কূটনৈতিক দূরত্ব বজায় রেখেছে বরাবরই। কিন্তু পশ্চিম এশিয়ায় ভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ রয়েছে, আর তা হলো সেখানে কর্তব্যরত সত্তর লক্ষ ভারতীয় যারা সেখানে কাজের প্রয়োজনে থাকেন। এদের মধ্যে প্রায় বিশ হাজার মানুষ থাকেন শুধু ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ ইরাকেই। এদের সুরক্ষার বিষয়টি ভারতের বিদেশনীতির প্রণেতাদের অগ্রাধিকার দেওয়া বাঞ্ছনীয়।
২০১৪ সালে ভারতের বিদেশমন্ত্রকে অপহরণের কথা জানিয়েছিল
২০১৪ সালের জুন মাসে ভারতের বিদেশমন্ত্রকের মুখপাত্র সৈয়দ আকবরউদ্দিন ইরাকের মসুল শহরে ওই ৪০ জন ভারতীয় শ্রমিকের অপহরণের কথা জানিয়ে বলেছিলেন যে, ইরাকের যুদ্ধে ভারতীয়দের নিশানা করা হচ্ছে তা নয়। বরং দুই পক্ষের লড়াইতে মধ্যখানে আটকে পড়েছে সেখানকার ভারতীয়রা। এখন ঘটনা হলো, যুদ্ধক্ষেত্রে কোনো নিয়মই বিশেষ খাটে না। আর তাই ভারতীয়রা প্রত্যক্ষ নিশানা হোক বা না হোক, তাদের নিরাপত্তার কথা ভাবতেই হবে নয়াদিল্লিকে। সেই ৪০ জনের মধ্যে শেষপর্যন্ত ৩৯ জনকেই মেরে ফেলল ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিরা, অথচ ভারত জানতেও পারল না! এ এক চরম বিদেশনীতির ব্যর্থতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
ইরাকে ভারতীয় শ্রমিকদের মৃত্যুর পরে নয়াদিল্লি সেদেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা থেকে আর মুখ ঘুরিয়ে থাকতে পারবে না। কারণ, ইরাকের গৃহযুদ্ধে যদি ফের প্রাণ খোয়ান কোনো ভারতীয়, তাহলে তার খেসারত দিতে হবে এদেশের সরকারকেই। অতীতে ইরাক এবং ইয়েমেনের মতো বেশ কয়েকটি বিপজ্জনক পরিবেশ থেকে ভারতীয়দের সুরক্ষিত অবস্থায় ফিরিয়ে এনে সুনাম কিনেছিলেন নরেন্দ্র মোদী সরকার। কিন্তু এবারে আর তা হলো না। তাই প্রতিবারেই যাতে প্রাণগুলোকে বাঁচানো যায় তার জন্যে পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলোর জন্যে একটি স্থায়ী নীতি নিয়ে চলার প্রয়োজন রয়েছে ভারতের। কাজটি অবশ্য সহজ নয় কারণ, এই দেশগুলোর সরকার যথেষ্ঠ নড়বড়ে।
কিন্তু চেষ্টা তো করতে হবে সব পরিস্থিতিতেই। মধ্যপ্রাচ্যে ভারতীয় শ্রমিকদের আয় সমৃদ্ধ করে ভারতের কোষাগারকেই, আর তাই সেখানে যাওয়াতে বিধিনিষেধ আরোপ করাও কোনো সমাধান নয়। তাই নিরাপত্তাজনিত সুষ্ঠু নীতি প্রণয়ন করা ছাড়া আর বিশেষ উপায় ভারতের নেই।
যেখানে ইরাকে ইসলামিক স্টেটের প্রভাব ক্রমেই বাড়ছে, সেখানে ভারতের আরও সাবধান হওয়ার প্রয়োজন ছিল
ইরাকে ইসলামিক স্টেটের প্রভাব ক্রমাগত বাড়তে থাকায় ভারতের আগে থেকেই এই ব্যাপারে আরও সচেতন হওয়ার প্রয়োজন ছিল। ওই উগ্রপন্থী সংগঠনের প্রভাব বাড়ার অর্থ ইরাকের সরকারের দুর্বল অবস্থান। আর যেখানে দেশের কর্তৃপক্ষেরই বিশেষ ক্ষমতা নেই উগ্রপন্থাকে ঠেকানোর, সেখানে ভারতের সঙ্গে ইরাকের সুসম্পর্কের কথা বলে বিশেষ লাভ নেই।
নয়াদিল্লির এই ক্ষেত্রে প্রয়োজন অন্যান্য কোনো শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়ে ইরাকের নিরাপত্তা বাহিনীর হাত শক্ত করা। যাতে তা শেষ পর্যন্ত ভারতের নিজের নাগরিকদের সুরক্ষাকেই জোরদার করে। আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে ভারত যদি এরকম কিছু করে দেখাতে পারে তাহলে ইরাকে নয় কেন? হ্যাঁ, একথা ঠিক যে ইরাকে কোনোরকমে জড়িয়ে পড়লে তা নিয়ে শোরগোল তুলবে অনেক পক্ষই। কিন্তু সরাসরি কোনোরকম যুদ্ধ-বিবাদে না জড়িয়ে যদি ভারত নিজের প্রবাসী নাগরিকদের সুরক্ষা দেওয়ার কথা ভেবে কোনো পদক্ষেপ নেয়, তবে তাতে অসুবিধা কীসের?
ইরাকে ৩৯ জন ভারতীয়র হত্যাকাণ্ড নিয়ে দেশে যে যথেষ্ঠ অস্বস্তির মুখে পড়বে মোদী সরকার, তা নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। আর এই অস্বস্তি কাটাতে মোদীকে পেশ করতে হবে একটি কূটনৈতিক দৃষ্টিকোণ যাতে ঘরে ও বাইরে তার সরকার দেশবাসীর আস্থাভাজন হতে পারে।
Featured Image Source: w3livenews.com