ত্রিদেশীয় সিরিজে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রথম ইনিংসে ৭ উইকেটে ৩২০ রান তুলল বাংলাদেশ। মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামের প্রেসবক্সের ঠিক পাশেই কমেন্টেটরদের আস্তানা। নিচে নামতে কিংবা উঠতে একটাই লিফট ব্যবহার করতে হয় সবাইকে।
ইনিংস বিরতি চলছে। দীর্ঘদেহী, যেন মনে হয় নিয়মিত জিম করেন। গায়ের রং ফর্সা আর ট্রিম করা দাড়ির সঙ্গে কেতাদুরস্ত পোশাকে এককথায় আল্ট্রা স্মার্ট এক ব্যক্তি গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে লিফটে উঠলেন। খাস বাংলায় বলে উঠলেন, “কি মাইরটা মারল কউ পোলারা!” ইংরেজিতে বললেন, “জাস্ট আনবিলিভেবল!” হেসে উঠল সবাই। দিনের পর দিন পানির মতো ইংরেজি বলতে বলতে বাংলাটা ঠিক ভুল হয় না। বিশেষত, মন খুলে আঞ্চলিক টানে বলতে পারলেই যেন খুশি হন।
যে মানুষটিকে নিয়ে এত কথা, তিনি আর কেউ নন, আতহার আলী খান। বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ধারাভাষ্যকার। কথার লড়াইয়ে বাংলাদেশের সেরা প্রতিনিধি, সাবেক ক্রিকেটার, ক্রিকেট বোদ্ধা। তিনি ‘বাংলাওয়াশ’ এর জনক।
ও হ্যাঁ, তিনি একইসঙ্গে যোদ্ধাও বটে। বলা চলে গোঁয়ার যোদ্ধা। কারণ তিনি যে সময়ে ধারাভাষ্য শুরু করেন, তখনকার দিনে বিশ্ব ক্রিকেটে বাংলাদেশের সফলতা ছিল কালেভদ্রের মতো। কত গঞ্জনা, কত অপমান যে বুকে জমিয়ে আজকের বাংলাদেশ নিয়ে লড়তে পারছেন তা বোধ হয় তার চেয়ে কেউ বেশি জানে না। সাফল্যের পিরামিডে সেসব না বলা, না জানা ব্যাপারগুলো যেন অন্তরের কফিনে লুকানো আছে।
ক্রিকেটার আতহার
আশির দশকের কথা। তখনকার দিনে ঢাকা শহরে তথা সারা বাংলাদেশের খেলার পাগলামো ছিল ফুটবল নিয়ে। ক্রিকেট ছিল উচ্চবিত্তের খেলা। খুব স্মার্ট, পড়াশোনা জানা, এমন ছেলেরাই যেন ক্রিকেটে বেশি আসতেন। অন্তত পুরনো দিনের লোকমুখে তা-ই শোনা যায়। বিশেষ করে সেই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্রিকেটের বিশাল আগ্রহ জন্মে। আতহার আলী খান ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই পাগলাটে শিক্ষার্থীদের একজন। শুরু করেছিলেন শখের বসে। কিন্তু সেই ক্রিকেটই তার জীবিকা হয়ে গেল শেষপর্যন্ত। বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে টানা ১০ বছর খেলেছেন।
ডানহাতি পেস বোলিংয়ের সঙ্গে ওপেনিং ব্যাটসম্যান। দারুণ সব শটের জন্য পরিচিত ছিলেন ‘ক্লিন হিটার’ হিসেবে। বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রথম ওয়ানডে সিরিজটা আসতে পারতো তার ব্যাটেই। ১৯৯৭ এশিয়া বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে ৮২ রানের ইনিংস খেলে আউট হয়েছিলেন স্ট্যাম্পিংয়ে। থার্ড আম্পায়ার বেনিফিট অব ডাউট দিয়েছিল বোলারকে। মজার ব্যাপার হল, সেই আম্পায়ার ছিল বাংলাদেশি!
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নেওয়ার আগ পর্যন্ত দেশের হয়ে ১৯টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলেছিলেন। মোট রান ৫৩২। সর্বোচ্চ ওই ৮২ রানের ইনিংসটি। হাফ সেঞ্চুরি তিনটি। বল হাতে ৬ উইকেট আছে তার। ঘরোয়া ক্রিকেটে ওয়ানডে তথা লিস্ট ‘এ’ ম্যাচ খেলেছেন ২৯টি। প্রাপ্তি ৭০৮ রান সঙ্গে ৯ উইকেট। প্রথম শ্রেণীতে ৩টি ম্যাচ খেলেছেন। রান ৪৮, উইকেট ১টি । তার অধীনে ১৯৮৪-৮৫ মৌসুমে জাতীয় ক্রিকেটে শিরোপা জেতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
বাংলাদেশের প্রথম ওয়ানডে জয়ের সাক্ষী আতহার। শুধু তা-ই নয়, জয়ের অন্যতম নায়কও তিনি। ১৯৯৮ সালে কেনিয়ার বিপক্ষে মোহাম্মদ রফিকের সঙ্গে ১৩৭ রানের জুটি গড়েছিলেন। তার ব্যাটে ৪৭ রানের ইনিংস পেয়েছিল বাংলাদেশ। আতহারের অন্যতম ইনিংসের মধ্যে আরেকটি ছিল ইডেন গার্ডেনে। কলকাতায় শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে চোখ ধাঁধানো ৭৮ রানের অপরাজিত এক ইনিংস খেলেছিলেন তিনি।
ছোট্ট এই পরিসংখ্যান দেখে আতহারের ক্রিকেটীয় সাফল্যে বোঝার কোনো উপায় নেই। তবে যারা খুব কাছ থেকে দেখেছেন তারা জানেন আতহারদের লড়াইয়ের কারণেই বাংলাদেশের ক্রিকেট আজকের অবস্থানে। আজ যখন কোটি কোটি টাকার স্পন্সরশিপ ক্রিকেটে দিতে খাবি খাচ্ছে কর্পোরেট কোম্পানিগুলো, আতহারদের দিনগুলো ছিল ঠিক ততটাই সংগ্রামের। সেই স্মৃতি যেমন ভুলে যায়নি বাংলাদেশের প্রবীণ ক্রিকেটার, সংগঠক আর সমর্থকরা, তেমনই আতহারদের আন্তর্জাতিক প্রতিপক্ষরাও ভোলেনি। বরং সম্মানের সঙ্গে স্মরণ করেছে।
এই তো সেদিনেরই কথা। শ্রীলঙ্কায় নিদাহাস ট্রফিতে খেলছে স্বাগতিক শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ ও ভারত। সেখানেই এক সাক্ষাতকারে সাবেক লঙ্কান লেগ স্পিনার, মূলত বোলিং অলরাউন্ডার উপুল চন্দনা বাংলাদেশ ক্রিকেটের বর্তমান অবস্থা প্রসঙ্গে এই বলে মন্তব্য করেন যে, “বাংলাদেশ ক্রিকেট তাদের পূর্বসূরিদের শ্রমের বিনিময়ে ফলানো ফল খাচ্ছে।”
সেই শ্রমের ‘শ্রমিক’দের মধ্যে অন্যতম আতহার আলী খান। উপুল বলেছেন, “ওই সময়ে আতহার, আকরাম খান, বুলবুলরা কঠোর পরিশ্রম করে বাংলাদেশের ক্রিকেটকে আজকের এই অবস্থানে নিয়ে এসেছে। তারা অনেক কষ্ট করে ক্রিকেট খেলেছে যার ফল এখন পাওয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশ এখন ভালো একটা সিস্টেমের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, প্রতিনিয়ত আরও ভাল করছে।”
ধারাভাষ্যকার আতহার আলী খান
ক্রিকেট থেকে অবসরের পর ক্রিকেটের সঙ্গেই রইলেন। বনে গেলেন ধারাভাষ্যকার। বাংলাদেশি হয়েও তিনি প্রায় ইংরেজি ভাষী। সেই ইংরেজিটাকেই পুঁজি করলেন। সঙ্গে ছিল ক্রিকেট বিশ্লেষণ তথা কথার মারপ্যাঁচের ক্ষমতা। সেই থেকে শুরু, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার থেকে আন্তর্জাতিক ধারাভাষ্যকার।
কিন্তু এখানেও যে লড়াই! যে দেশের ক্রিকেটাররা ভালো খেলবে, সে দেশের ধারাভাষ্যকাররা ভালো অবস্থানে থাকবে এটাই তো স্বাভাবিক। আতহার আলী যখন শুরু করলেন তখন বাংলাদেশের অবস্থা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট অঙ্গনে এককথায় নাজুক ছিল। একের পর এক ম্যাচে হার, হোয়াইওয়াশের লজ্জার ভাগ ওই চার দেয়ালের ছোট ধারাভাষ্য কক্ষে বসেও নিতে হয়েছে আতহারকে। সহকর্মী ধারাভাষ্যকারদের কাছে খোঁচা, গঞ্জনা, অপমানের মালা পরতে হয়েছে বারবার।
তারপরও থেমে থাকেননি এই মানুষটি। ক্রিকেটারদের মতোই মাটি কামড়ে পড়ে থেকেছেন প্রতিবার। যখন জিতেছে বাংলাদেশ, তখন ধারাভাষ্য কক্ষেও জিতেছেন আতহার। যখন বাংলাদেশকে হেয় করা হচ্ছে, সমানে কথার লড়াই চালিয়ে গেছেন তিনি। এ নিয়ে অনেক ঘটনা আছে। কিন্তু আতহারের লড়াই করা ঘটনার মধ্যে অন্যতম হলো ২০০৩ সালের ঐতিহাসিক মুলতান টেস্ট।
সেই ম্যাচে অলক কাপালির তোলা এক ক্যাচ ডাইভ দিয়ে ধরেছিলেন তৎকালীন পাকিস্তানি উইকেট রক্ষক রশিদ লতিফ। কিন্তু ক্যাচটি মাটিতে পড়ে গিয়েছিল। আম্পায়ার খেয়াল করেননি। লুকিয়ে বলটি গ্লাভসে নিয়ে জোরালো আবেদন করলে আম্পায়ার আউট দিয়ে দেন। থার্ড আম্পায়ারের সাহায্যও চাওয়া হয়নি সেই আউটে।
এমন অবস্থায় ধারাভাষ্য কক্ষে বসে আতহার চেঁচিয়ে উঠলেন, “আমার মনে হয় না এটা পরিস্কার ক্যাচ ছিল”। উত্তরে পাশে বসা পাক ধারাভাষ্যকার রমিজ রাজা বললেন, “তুমি কি তাদেরকে (পাকিস্তানি ক্রিকেট দল) প্রতারক দাবি করছ?”। আতহার সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠেলেন, “না, আমি কেবল দেখতে চাইছি আউটের সিদ্ধান্তটা ঠিক ছিল কিনা”। রমিজ রাজা খোঁচা দিয়ে বললেন, “টিপিক্যাল বাংলাদেশি কমেন্ট”। আতহারের উত্তর, “অ্যান্ড ইটস টিপিক্যালি ডিসমিসিভ পাকিস্তানি কমেন্ট”। দুজনের করা ওই মন্তব্য ঝড় তুলেছিল গণমাধ্যমে। পরে শাস্তি হিসেবে রশিদ লতিফ পাঁচ ম্যাচের জন্য নিষিদ্ধ হন।
বাংলাদেশের জন্য লড়ে যান। ঘরের মাঠে তার অংশগ্রহণ নিশ্চিত। বিদেশ সফরে বাংলাদেশের খেলা থাকলে সেখানেও তার জায়গা হয়। কিন্তু আইসিসির বড় বড় সব টুর্নামেন্টে সবসময় সুযোগ পান না আতহার। সেগুলো তাকে কম কষ্ট দেয় না। তারপরও ঘরে বসে সমর্থক হিসেবে গলা ফাটিয়ে যান।
২০১৫ ওয়ানডে বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে যখন ‘অবিচার’ এর শিকার হয়ে কোয়ার্টার ফাইনাল হেরে ফিরল বাংলাদেশ, তখন দেশের সব সমর্থকরা পড়েছিল ভারতের বিপক্ষে। কিন্তু যারা অবিচারের শিকার হল, তাদের কৃতিত্ব নিয়ে যেন আলোচনা ঝিমিয়ে পড়েছিল। আতহার এমন সময় বললেন, “ফলাফল যেটাই হোক, তোমরা বিজয়ী। আমি লাল গোলাপ নিয়ে বিমানবন্দরে হাজির হব।”
সত্যি সত্যি বাংলাদেশ ঢাকায় ফেরার দিন বিমান বন্দরে হাজির হয়েছিলেন। হাতের একটি লাল গোলাপ নিয়ে মাশরাফি বিন মুর্তজাকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। প্রত্যেক ক্রিকেটারকে আলাদা করে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন সেদিন। পুরো বিমানবন্দর সেদিন দেখেছিল এক পাগলাটে সমর্থককে। বাংলাদেশ ক্রিকেটের সমর্থককে।
যে ‘বাংলাওয়াশ’ শব্দ এখন ক্রিকেট সমর্থকদের মুখে মুখে ফেরে, সেটার আবিষ্কারক এই আতহার আলী খান। ধারাভাষ্য কক্ষে বসেই হুট করে বানিয়ে ফেলেছিলেন এই শব্দ। এক সাক্ষাতকারে আতহার সেই ঘটনার বয়ান করেছিলেন এভাবে, “২০১০ সালের ঘটনা। অক্টোবর মাসের ১৭ তারিখ। মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে পাঁচ ম্যাচ ওয়ানডে সিরিজের শেষ ম্যাচে ব্ল্যাক ক্যাপদের শেষ সদস্য কাইল মিলস রুবেল হোসেনের বলে বোল্ড হলেন। বাংলাদেশ ৩ রানের জয় পেল। আমি তখন ধারাভাষ্য দিচ্ছি। পাশ থেকে নিউজিল্যান্ডের ড্যানি মরিসন বলে উঠলেন, “দিস ইজ হোয়াইটওয়াশ”। আমি বললাম, “দিস ইজ বাংলাওয়াশ”।”
আতহার জানান, ওই সময়ে মরিসন শব্দটি বুঝতে পারেননি। তারপর বুঝিয়ে বললাম। ওটাই প্রথম শব্দটি ব্যবহার করা। তিনি বলেন, “তখনও ভাবিনি বাংলাওয়াশ শব্দটা এত জনপ্রিয়তা পাবে। কোনকিছু চিন্তা করে বলিনি, মাথায় এলো বলে দিয়েছিলাম।”
সেই থেকে এখনও চলছে ‘বাংলাওয়াশ’। আতহারের খুব ইচ্ছে, এই টাইগাররা একদিন সব ক্রিকেট খেলুড়ে দেশের বিপক্ষে বাংলাওয়াশের স্বাদ নেবে। সেই অপেক্ষায় এখনও পড়ে আছেন। জীবিকার তাগিদে, দেশের তাগিদে, ক্রিকেট প্রেমের তাগিদে। এক যোদ্ধা হয়ে।
ফিচার ইমেজ- BCB