বর্ণবাদ নিন্দিত সর্বত্রই। তবে উদারবাদী গণতন্ত্র বা ভদ্রলোকদের দেশ বিলেতেও যখন তা দেখা যায়, তখন একইসাথে হতাশ ও বিস্মিতই হতে হয়। তার ওপর বস্তুনিষ্ঠতা ও পরিমিতিবোধ হারিয়ে গণমাধ্যম যদি বর্ণবাদিতা প্রদর্শন করে, তখন আস্থা হারাতে হয় তাদের নৈতিকতার ওপর। উগ্র রক্ষণশীলতা আর বর্ণবাদ কীভাবে ব্রিটিশ অভিজাততন্ত্রকে এখনো আচ্ছন্ন রেখেছে, তারই প্রতিফলন ঘটেছে দেশটির অনেক সংবাদপত্রের আচরণে। ব্রিটিশ রাজমুকুটের পঞ্চম উত্তরাধিকার প্রিন্স হ্যারির বাগদত্তা মেগান মার্কেলকে উগ্র রক্ষণশীলতা ও বর্ণবাদের শূলবিদ্ধ করে সমালোচিত হয়েছে ব্রিটিশ পত্র-পত্রিকাসমূহ। সেটি নিয়েই আজকের লেখা।
বধূ নয়, ‘উপপত্নী’ হবার যোগ্য মেগান!
১৮২৮ সাল থেকে প্রকাশিত হয়ে আসা ব্রিটিশ সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন ‘দ্য স্পেক্ট্যাটর’-এ বেশ কিছু লেখায় ব্রিটিশ কট্টর রক্ষণশীলতাকে মানদণ্ডে রেখে মেগান মার্কেলের সমালোচনা করা হয়েছে। মেগান মার্কেলের এর আগেও একবার বিয়ে হয়েছিলো, পাত্র ছিলেন মার্কিন চলচ্চিত্র প্রযোজক ট্রেভর এঙ্গেলসন। অন্যদিকে অ্যাংলিকান মূল্যবোধ অনুযায়ী প্রাক্তন স্বামী বা স্ত্রী জীবিতাবস্থায় দ্বিতীয় বিবাহকে নিরুৎসাহিত করা হয়। এই দুই মিলিয়ে দ্য স্পেক্ট্যাটরের সমালোচনার ‘বস্তু’ শুধু মেগানই নন, বরং আরো আছেন সাংবাদিক মিশাল হুসাইন। এই সাংবাদিকের ‘দোষটা’ হলো, হবু রাজদম্পতির বিবিসি সাক্ষাৎকারে তিনি কেন মেগানকে পূর্বতন স্বামীর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেননি! ম্যাগাজিনটিতে একটি লেখায় মেলানি ম্যাকডোনাফ তো বলেছেন আরো বিস্ফোরক সব কথা। লেখার শুরুতেই লেখক বলছেন,
“ব্যাপারটি হয়তো খানিকটা রুক্ষই হবে, যদি সম্প্রতিই বাগদান হওয়া যুগলটির প্রসঙ্গে নির্দয় সমালোচনা আনি, কিন্তু তা আবশ্যিক। কাউকে না কাউকে তা করতেই হবে।”
বর্ণের মিশ্রতা ও পূর্ববিবাহের ইতিহাস টেনে মেগানকে রাজবধূ হিসেবে ‘খারাপ পছন্দ’ এবং হ্যারি-মেগানের বিয়ের সংবাদকে পরোক্ষভাবে “সুসংবাদ নয়” বলেই ক্ষান্ত হননি লেখক। আলপটকা মুখে বলেই দিয়েছেন,
“সত্তর বছর আগে হলে ব্রিটিশ যুবরাজ হয়তো মেগানকে বধূ হিসেবে নয়, বরং উপপত্নী হিসেবে গ্রহণ করতো।”
ডেইলি মেইলের বর্ণবাদপ্রীতি
জনপ্রিয় ব্রিটিশ পত্রিকা ডেইলি মেইলের একটি প্রতিবেদন বিশেষভাবে সমালোচিত হয়েছিলো; কেননা তাতে মেগান-হ্যারির বাগদানকে ‘বিরাট অঘটন’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, ঘুরে ফিরে সেই প্রতিবেদনসহ আরো অনেক প্রতিবেদনেই মেগানকে একজন ‘আমেরিকান ডিভোর্সি’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, বারবার। ঐ প্রতিবেদনটিতে এমনও বলা হয়েছে যে, মেগানের জনপ্রিয়তার মূলেই রয়েছে তার পূর্বতন বিয়ে। আশ্চর্যের বিষয়, হ্যারি-মেগানের বাগদান সম্পর্কিত সেই প্রতিবেদনে একটি বড়সড় প্যারা রাখাই হয়েছে কেবল মেগানের প্রাক্তন বৈবাহিক জীবন অবতারণা করতে। মেগানকে ‘গ্ল্যামারাস’ বললেও সাথে ‘ব্রুনেট’ অর্থাৎ শ্যামবর্ণী শব্দটাও জুড়ে দিয়েছে ডেইলি মেইল।
ব্রিটিশ এ ট্যাবলয়েডটির অন্য আরেক প্রতিবেদন তো সমালোচিত হয়েছে আরো বিচিত্র উপায়ে। প্রতিবেদনটির শিরোনাম ছিলো ‘কারা কারা আমন্ত্রিত হতে পারেন বিয়েতে’। অথচ সেটির প্রথম প্যারা থেকেই অপ্রয়োজনে ও অপ্রাসঙ্গিকভাবে মেগান মার্কেলের মায়ের পরিবারের অর্থনৈতিক দুরবস্থা, সৎ ভাইবোনের অসততার তথ্যাদি ও নেতিবাচক মোড়ে ভরা কিছু ‘ফ্যামিলি ড্রামা’ তুলে ধরা হয়েছে।
সেই সাথে ‘আনকনভেনশনাল ফ্যামিলি’ অভিধা প্রদানপূর্বক সরাসরি শিরোনামে আরেকটি প্রতিবেদনেও দেওয়া হয়েছে মেগানের পরিবার সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য। প্রতিবেদনের শুরুটাই হয়েছে ‘ডিভোর্সড ফাদার’ এই শব্দটিকে দ্বিতীয় বাক্যে রেখে। সেখানে আবার কেট মিডলটনের সাথে তুলনা টানা হয়েছে মেগানের। তুলনার ফলাফল অবশ্য হতাশাব্যঞ্জক। কেননা সেখানে মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে যে কেটের পরিবার কোটিপতি অন্যদিকে মেগানের পরিবার বড্ড সাদামাটা! সেই প্রতিবেদনটি ডেইলি মেইলের টুইটার থেকে শেয়ার করা হয়েছিলো, ‘দাসত্ব থেকে রাজপদবী: মেগানের শেকড়ের ঊর্ধ্বমুখী যাত্রা’ ক্যাপশন দিয়ে।
সানের ইনিবিনিয়ে রক্ষণশীলতা ও বর্ণবাদ চর্চা
দ্য সান পত্রিকায় শিরোনাম করা হয়েছে “MEET THE IN-LAWS: The VERY un-royal Markle family now set to liven up Windsor family Christmases“। অর্থাৎ শুরুতেই ‘আন-রয়্যাল’ সম্বোধন করে মেগান গরিয়ান রাজপরিবারের আভিজাত্যের তুলনায় কতটা ‘জমকহীন’, পরোক্ষভাবে তারই ফিরিস্তি গাওয়া হয়েছে প্রতিবেদনটিতে।
- মেগানের মা আফ্রিকান-আমেরিকান ডোরিয়া র্যাডলানের সাথে যখন তার বাবা ডাচ-আইরিশ থমাস মার্কেলের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে, তখন মেগানের বয়স মাত্র ৬।
- বাবার সূত্রে ককেশীয় প্রভাবটাই মেগানের বাহ্যিকতায় প্রকট বলে মেগানের কৃষ্ণাঙ্গ মাকে নাকি অনেকেই তার ‘আসল মা’ বলে বিশ্বাস করতে চাইতো না।
- মেগানের বাবা টেলিভিশন আলোকসজ্জা পরিচালক থমাস মার্কেলের এমি অ্যাওয়ার্ড জয়ের তথ্যের সাথে প্রতিবেদনটিতে এটা জানাতে মোটেও ভুল করা হয়নি যে, তিনি একবার দেউলিয়াও ঘোষিত হয়েছিলেন!
- এটাও জানানো হয়েছে যে, মেগানের সৎ ভাই টম মার্কেল জুনিয়র গ্রেফতার হয়েছিলেন মাতাল অবস্থায় প্রেমিকার মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে, যদিওবা আদালতে গড়াবার আগেই তার মীমাংসা হয় এবং সেই প্রেমিকা নিয়েই ঘর করছেন টম।
- ওদিকে মেগানের সৎ বোন সামান্থার একটি বিতর্কিত ভাষ্যও উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনটিতে। সামান্থা বলেছিলেন, হলিউডে গিয়েই নাকি মেগান বদলে গিয়েছেন; সামাজিক প্রতিপত্তির মোহে প্রতিবন্ধী বোনটিকে ত্যাগ করেছিলেন ‘সোশাল ক্লাইম্বার’ মেগান! সেই সাথে সামান্থা আরো বলেন, “রাজবধু হবার অভিপ্রায় মেগানের পূর্বপ্রসূত।” সামান্থা পরবর্তীতে দাবি করেন তার বক্তব্য ভুলভাবে উদ্ধৃত করা হয়েছে এবং সামান্থার মা-ও মেগান সম্পর্কে সামান্থার বক্তব্যকে মিথ্যা অভিহিত করেন; এসবও বলা হয়েছে প্রতিবেদনটিতে।
বস্তুনিষ্ঠতার একটি ভারসাম্য আনার জন্য মেগানের পারিবারিক পটভূমি সম্পর্কিত প্রতিটি পরোক্ষ নেতিবাচক তথ্যের সাথে এভাবেই জুড়ে দেওয়া হয়েছে ইতিবাচক পাদটীকা। এ কারণে বর্ণবাদ প্রতিবেদনটিতে সরাসরি উঠে না এলেও স্বদেশী কন্যার অপকর্ষকে সূক্ষ্মভাবে দৃষ্টিগোচরে আনার একটি প্রয়াস হিসেবে মার্কিন গণমাধ্যম প্রতিবেদনটিকে বিবেচনা করছে। অন্যদিকে প্রতিবেদনটির কমেন্ট সেকশনে বর্ণবাদী মন্তব্যের আনাগোনা দেখে এটি মনে হওয়া খুবই সম্ভব যে, প্রতিবেদনটি অল্প হলেও বর্ণবাদীদের মুখ খোলার রসদ যুগিয়েছে।
ট্যাটলারের কুরুচিকর ব্যাখ্যা
অন্যদিকে ট্যাটলার নামক দক্ষিণপন্থী ম্যাগাজিনের এক প্রতিবেদনে আবার উত্তর খোঁজা হয়েছিলো, কেন ব্রিটিশ ‘মোস্ট ইলিজিবল’ ব্যাচেলররা আমেরিকান সুন্দরীদের প্রেমে পড়েন, পড়ছেন!
সেখানে উত্তরগুলো অভিজাত পরিবারগুলোর সদস্যদের কাছ থেকেই খোঁজা হয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে প্রায় সাড়ে তিনশ’ আমেরিকান নারী ব্রিটিশ অভিজাত ও রাজকীয় বংশের বধূ হয়েছেন। তাদের এই ‘ঢল’ কেন? কেউ কেউ বললেন, আমেরিকান মেয়েদের ধারণা, ইংরেজ পুরুষদের বিয়ে করলে নাকি সামাজিক প্রতিপত্তি বহুগুণে বেড়ে যায়! আর ছেলেরা কেন আমেরিকান মেয়েদের দিকে ঝুঁকছেন? রূপ-গুণ, শিক্ষা ইত্যাদি কারণের সাথে যৌনতা বিষয়ক একটি কারণ দাঁড় করিয়েছে ট্যাটলার। সঙ্গত কারণেই বিস্তারিত এ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা গেলো না (ট্যাটলারের প্রতিবেদনটি পড়ুন)। যৌনতা সম্পর্কিত সে ব্যাখ্যায় বর্ণবাদিতা এসেছে ভালোমতোই। আর এটিও কারো বুঝতে বাকি থাকে না যে, উক্ত বর্ণবাদী ব্যাখ্যা সম্বলিত প্রতিবেদনটি মেগান মার্কেলের রাজবধূ হবার সম্ভাব্যতার প্রসঙ্গেই লিখিত।
বর্ণবাদের প্রতিবাদে সবেধন নীলমনি ‘গার্ডিয়ান’
ব্রিটিশ গণমাধ্যম, বিশেষত নামোল্লেখপূর্বক ডেইলি মেইলের সমালোচনা করেছে বিখ্যাত ব্রিটিশ পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ান। সেখানে সাংবাদিক আফুয়া হার্শ বলেন,
“মেইল তার প্রতিবেদনে মেগান প্রসঙ্গে বারবার বলছে ‘গ্ল্যামারাস ব্রুনেট’, ‘হ্যারির অন্য প্রেমিকাদের মতো স্বর্ণকেশী নন, ‘হ্যারির জন্য গতানুগতিক ধারার বাইরে’ ইত্যাদি। এসব বাক্য/শব্দের দ্বারা অভিনয়শিল্পী, লাইফস্টাইল ব্লগার, উন্নয়নকর্মী মেগানের একটি পরিচয়কেই সামনে আনতে চাইছে মেইল; তা হলো, মেগান কালো।”
গায়ের রঙের বাইরে গিয়ে কেউ কেউ আবার ‘সেইফ’ খেলার জন্য সমালোচনা করছেন মেগানের পূর্ব বৈবাহিক সম্পর্কের, হ্যারির থেকে তিন বছরের বড় হওয়ার, মার্কিন টিভিতে ‘নিম্নমানের’ দৃশ্যে কাজ করার। তবে উগ্র-রক্ষণশীলতা বা বর্ণবাদের বলয়ের বাইরে নয় সেসব সমালোচনার কোনোটাই।
অন্যদিকে মিশ্রবর্ণের রক্ত ব্রিটিশ অভিজাত রক্তের সাথে মেশার বহু উদাহরণ রয়েছে। তাই মেগানই যে রাজরক্তধারার একমাত্র দূষক নন, তা প্রমাণে বেশ কিছু কথা বলেছেন সাংবাদিক আফুয়া। তবে ইতিহাস অনুসন্ধানে উঠে এসেছে যে, এসব ‘এরিস্টোব্ল্যাক’ বা রাজবংশের ‘কৃষ্ণকায় প্রতিনিধি’দের সবসময়ই বর্ণবাদী আচরণের শিকার হতে হয়েছে। আফুয়ার মতে হ্যারি-মেগানের এই বিয়ের দ্বারা ব্রিটিশ অভিজাততন্ত্রের বর্ণবাদী কাঠামোতে স্থায়ী ক্ষতি হতে চলেছে। এ বক্তব্যের সাথে আবার সাংবাদিক মিস আকপান, ব্রিঙ্কহার্সট-কাফ দ্বিমত পোষণ করে বলেছেন, এক বিয়েতেই ঐতিহাসিক কাঠামোর আমূল বদল সম্ভব নয়, কেননা বর্ণবাদ ব্রিটিশ কাঠামোর রন্ধ্রে রন্ধ্রে। লেখিকা রেনি এডো-লজের বক্তব্যও শেষোক্ত দুজনকে সমর্থন করে,
“মেগান ব্রিটেনের জন্য ‘ওবামা’ নন। কেননা ব্রিটিশ রাজপরিবারের এক উত্তরাধিকার কর্তৃক পছন্দ হওয়াটাই গণতন্ত্র নয়।”
ভব্যতাজ্ঞানে বিশ্ববিদিত ব্রিটিশ তথা তাদের অভিজাততন্ত্র বর্ণবাদের বলয় থেকে কখনোই পুরো বেরোতে পারেনি, এই ঐতিহাসিক সত্য বর্তমানে এসেও প্রতিষ্ঠিত হলো পুনরায়। আর এবারের উপলক্ষ মেগান মার্কেল।
ফিচার ইমেজ:thecut.com