ভারতে সদ্যসমাপ্ত কর্ণাটক বিধানসভা নির্বাচন নিয়ে নাটক যেন শেষ হতেই চাইছে না। ১২ মে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ভারতের শাসকদল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ২২২টি আসনের মধ্যে ১০৪টিতে জেতে আর রাজ্যের বিদায়ী শাসকদল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস জেতে ৭৮টিতে। তৃতীয় শক্তি জনতা দল (সেকুলার) বা জেডিএস জেতে ৩৮টিতে। কোনো দলই ১১২টি আসনের সংখ্যাগরিষ্ঠতা (২টি আসনে ভোট পিছিয়ে যায়) না পাওয়াতে ত্রিশংকু পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। কিন্তু বিজেপিকে ঠেকাতে কংগ্রেস এবং জেডিএস নির্বাচন পরবর্তী জোট করে সরকার গড়ার দাবি করে কারণ, একত্রে তাদের আসনের সংখ্যা ১১৬ যা সংখ্যাগরিষ্ঠতার বেশি।
কিন্তু বিরোধীদের অবাক করে কর্ণাটকের রাজ্যপাল ভাজুভাই ভালা, যিনি অতীতে গুজরাটের মন্ত্রী ছিলেন, প্রথমেই ডেকে বসেন বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী তথা কর্ণাটকের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বি এস ইয়েদ্দুরাপ্পাকে।
তাকে পক্ষপাতিত্ব করার অভিযোগে মধ্যরাতে সুপ্রিম কোর্টেরও কড়া নাড়ে কংগ্রেস, কিন্তু তাদের আবেদন খারিজ করে দেয় শীর্ষ আদালত। ১৫ মে নির্বাচনের ফল বেরোনোর পরে ১৭ মে কর্ণাটকের নতুন মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন ইয়েদুরাপ্পা। সুপ্রিম কোর্ট জানায় বিজেপি মুখ্যমন্ত্রীকে ১৯ মে বিধানসভায় তার সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ করতে হবে। ইতিমধ্যে রাজ্যপাল ভালার বিজেপি বিধায়ক কে জি বোপাইয়াকে ইয়েদুরাপ্পার সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণের ‘ফ্লোর টেস্ট’-এর পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়াটাও ক্ষুব্ধ কংগ্রেস-জেডিএস জুটি সুপ্রিম কোর্টে যায় ফের। তবে এব্যাপারে নতুন কিছু ঘটার আগেই ইয়েদুরাপ্পা জানিয়ে দেন যে তিনি এই সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণের পরীক্ষায় দাঁড়াতে রাজি নন; তার চেয়ে বরং তিনি মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ইস্তফা দিতেই বেশি পছন্দ করবেন।
এরপর আর উপায়ান্তর থাকে না কংগ্রেস-জেডিএস জোটকে সরকার গড়তে দেওয়ার আমন্ত্রণ জানানোর। আগামী ২৩ মে পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার কথা জেডিএস-এর নেতা এইচ ডি কুমারস্বামীর, যিনি এর আগেও কর্ণাটকে ঘোর ডামাডোলের মধ্যে মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন ২০০৬ সালে; যদিও ক্ষমতায় টেকেননি বেশিদিন।
ঘটনা হচ্ছে, বিজেপির তরফ থেকে এই নাটকের ইতি অনেক আগেই করা যেতে পারত। ১০৪টি আসন জিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং তার সেনাপতি বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ যদি নতমস্তকে মেনে নিতেন নৈতিক পরাজয় আর পথ করে দিতেন বিরোধী জোটকে, তাহলে জনমানসে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে যেত বহুগুণ।
কিন্তু বিজেপির কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য নেতৃত্ব তো তা করলেনই না, উল্টো সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে ইয়েদুরাপ্পাকে তার সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণের জন্য মাত্র দু’দিন সময় দিয়ে শীর্ষ আদালত এই বার্তাই দিল যে, সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণের প্রতিযোগিতায় যেন কোনোরকম ‘ঘোড়া কেনাবেচা’কে প্রশ্রয় দেওয়া না হয়। এই বার্তাও ঘুরিয়ে মোদী এবং তার বিজেপির দুর্নীতি-বিরোধী ভাবমূর্তিকে বিদ্ধ করে।
বিজেপির উচিত ছিল কংগ্রেস–জেডিএস–এর হাঁসজারু জোটকে আগে যেতে দেওয়ার
তাছাড়া, কর্ণাটকের নির্বাচনের পরে কংগ্রেস এবং জেডিএস-এর জোট নিয়েও অনেকেই সংশয় পোষণ করেছেন। অতীতেও এই দুই দলের মধ্যে জোট সাফল্যের মুখ দেখতে পায়নি আর এবারেও ক্ষমতায় এলেও যে তাদের জোট সফল প্রশাসন দিতে পারবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এই পরিস্থিতিতে যদি বিজেপি কংগ্রেস-জেডিএসকে প্রথম দান দিতে দিয়ে নিজেরা দূর থেকে মজা দেখত, তাহলেও রাজনীতির পাঞ্জা লড়াইয়ে একটি নৈতিক সুবিধা থাকত তাদেরই। কিন্তু বিজেপি তা না করে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস দেখায় ‘কংগ্রেস-মুক্ত ভারত’ এর প্রকল্পকে রাতারাতি রূপান্তরিত করার।
ইয়েদুরাপ্পার দুই দিনের মুখ্যমন্ত্রীত্ব বিজেপিকেই অপদস্থ করলো তো বটেই, জোরালো করল তাদের বিরুদ্ধে প্রভাব খাটানোর অভিযোগকেও। এর আগে মণিপুর বা গোয়ার মতো রাজ্যের নির্বাচনে কংগ্রেস বৃহত্তম দল হলেও তাদের সরকার গড়ার আমন্ত্রণই জানানো হয়নি। প্রত্যেক রাজ্যে কি তবে তাহলে আলাদা আলাদা নিয়ম মানা হবে, বিজেপির অবস্থার উপর নির্ভর করে?
মোদী ম্যাজিকেও বিজেপি উত্তীর্ণ হতে পারল না কর্ণাটকে
কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রীত্ব হাত থেকে পিছলে যাওয়া বিজেপির আরও একটি উদ্বেগকে প্রকট করে। এবারের নির্বাচনে ইয়েদুরাপ্পা বিজেপির মুখ হলেও প্রধানমন্ত্রী মোদী স্বয়ং দলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন; প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়ার সঙ্গে সম্মুখসমরে জড়িয়ে পড়েন; চ্যালেঞ্জ জানান কংগ্রেস অধ্যক্ষ রাহুল গান্ধীকেও।
সে রাজ্যে তার নির্বাচনের প্রচারের সংখ্যা ১৫ থেকে বাড়িয়ে ২১ করা হয়। কিন্তু এত কিছু সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত বিজেপি পাঁচ বছরের জন্যে ক্ষমতা জিততে ব্যর্থ হয়। এই নির্বাচনে তারা বৃহত্তম দল হিসেবে শেষ করলে বিজেপির অনেক সমর্থক এবং রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, মোদীর ম্যাজিক এবার দক্ষিণ ভারতেও ফল দিতে শুরু করল। কিন্তু শেষপর্যন্ত বিজেপির এই নাটকীয় ব্যর্থতা সেই আশাতে সম্পূর্ণ জল ঢেলে দিল; ক্ষুণ্ণ হলো ইয়েদুরাপ্পা-অমিত শাহ সহ মোদীর ভাবমূর্তিও।
এই বছরের শেষেই রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ এবং ছত্তীসগঢ়ে ভোট আর এই তিনটি রাজ্যেই শাসকদল হিসেবে বিজেপির উপর ভালো ফলের বাড়তি চাপ থাকবে, বিশেষ করে আগামী বছরের লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে। কর্ণাটকের নির্বাচনে সরাসরি জিতলে বলা যেতেই পারত যে, বিজেপি এবারে তৈরি লোকসভা নির্বাচনের জন্য। কিন্তু স্বয়ং মোদীও এযাত্রা বৈতরণী পার না করাতে পারায় পদ্মবাহিনীর প্রস্তুতি নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাবে। ২০১৫ সালে দিল্লি এবং বিহারের পর এই নিয়ে তৃতীয়বার মোদী ম্যাজিক বিজেপিকে নির্বাচনে জেতাতে বিফল হলো।
২০১৯–এর আগে দেখা যাচ্ছে এক আবছা মোদী–বিরোধী মঞ্চও
বিজেপির এই ব্যর্থতা চাঙ্গা করবে বিরোধীদেরও। ২০১৯-এর মহারণে মোদীর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই বলেই ধরে নিচ্ছিল বিশেষজ্ঞ মহল। কিন্তু কংগ্রেস-জেডিএস এর এই জোট (যদিও নির্বাচনের আগে কংগ্রেস জেডিএসকে বিজেপির ‘বি টিম’ বলেও আক্রমণ করে) এখন অনেক দলকেই উৎসাহিত করবে মিত্র-শত্রু সকলের সঙ্গেই হাত মিলিয়ে কাজ করার জন্যে, মোদীকে হারানোর লক্ষ্যে। জেডিএসকে এবারে সাহায্য করেছিল মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টি, যারা মাস কয়েক আগে উত্তরপ্রদেশের কয়েকটি উপনির্বাচনে ঘোর শত্রু সমাজবাদী পার্টির সঙ্গে জোট করে হারিয়েছিল বিজেপিকে।
আরেক মোদী-বিরোধী নেত্রী তৃণমূল কংগ্রেসের সুপ্রিম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও অভিনন্দন জানিয়েছেন কংগ্রেস-জেডিএস জোটকে। মমতাদেবীকে কুমারস্বামী ইতিমধ্যেই তার শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। আমন্ত্রিতদের মধ্যে রয়েছেন মায়াবতী, রাহুল গান্ধীও। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, কুমারস্বামীর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে তৈরি হচ্ছে একটি নতুন মোদী-বিকল্প সমীকরণ।
কংগ্রেসকেও বুঝতে হবে নিজের দুর্বলতা; জোটসঙ্গী আরও বাড়াতে হবে
বিজেপির এই ব্যর্থতার মধ্যে কংগ্রেসেরও শিক্ষা নেওয়ার আছে। কংগ্রেসের যদিও ভোট শতাংশ যথেষ্ঠ ভালো এখনও (কর্ণাটক নির্বাচনে তো তারা এ ব্যাপারে বিজেপিকেও পিছনে ফেলে দিয়েছে), তাদের সমস্যা হচ্ছে আসন নিয়ে। কারণ, সমর্থক সংখ্যাকে ভোটবাক্সে সফলভাবে রূপান্তরিত করতে তাদের নেতৃত্ব ও সংগঠন দুর্বল বলে প্রতিপন্ন হচ্ছে বারবার।
তাই কংগ্রেসকে এখন তাদের এই দিকটিকে মান্যতা দিয়ে আঞ্চলিক দলগুলোর সঙ্গে জোট করেই এগোতে হবে, আগামী দিনে যাতে তাদের নিজেদের ভোট শতাংশ এবং জোটসঙ্গীদের আসনের জোর মিলিয়ে মোদীর সঙ্গে টক্কর দেওয়া যায়। কাজটা সহজ নয় অবশ্যই, কিন্তু রাজনীতি কোনোদিনই সহজ ব্যাপার নয়, কঠিনকে সহজ করার ব্যাপার।
Featured Image Source: Twitter/@vijayrupanibjp