Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মহাকাশে সোভিয়েত কুকুর

বহু বছর ধরে মহাকাশ নিয়ে চলছে বিস্তর গবেষণা। সেসব গবেষণার অংশ হিসেবে বিজ্ঞানীরা মহাশূন্যে পাঠিয়েছেন বানর, কুকুর, শিম্পাঞ্জী, এমনকি ব্যাঙ পর্যন্ত। এর মধ্যে আলাদাভাবে কুকুরের উল্লেখ না করলেই নয়। বানর ও শিম্পাঞ্জী যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন হলেও তারা কুকুরদের মতো মানুষের পাশে থাকেনি। পোষা প্রাণী হিসেবে কুকুরের তাই একটু আলাদা গুরুত্ব আছে বলতেই হবে।

কুকুরদের মহাশূন্যে পাঠাবার কাজ প্রথম শুরু করে সোভিয়েতরা। গত শতাব্দীর পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে সোভিয়েত বিজ্ঞানীরা মোট ৫৭টি কুকুর মহাকাশে পাঠিয়েছেন। এদের মধ্যে কয়েকটি কুকুর একাধিকবার মহাকাশ ভ্রমণ করেছে। আমরা সবাই এই কুকুরদের মধ্যে অন্তত একটির কথা জানি- লাইকা। মস্কোর এই বেওয়ারিশ কুকুরটি মহাবিশ্বে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করা প্রথম জীবন্ত প্রাণী। তবে দুঃখের ব্যাপার হলো, লাইকাকে ফেরত আনবার কোনো পরিকল্পনা সোভিয়েতদের ছিল না। এটি ছাড়া যতগুলো কুকুর মহাকাশে পাঠানো হয়েছে, নেহাত দুর্ঘটনার বলি না হলে তাদের সবাইকে আবার জীবিত ফেরত নিয়ে এসেছেন সোভিয়েত বিজ্ঞানীরা।

লাইকা; Source: Time

কেমন কুকুর বাছাই করা হতো

অন্য প্রাণী থাকতেও কুকুর কেন পছন্দ করা হলো? এরা খুব দ্রুত মানুষের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নেয়, কথা শোনে এবং অনুগত। আর সোভিয়েত বিজ্ঞানীরা কুকুরদেরকে দীর্ঘসময় ধরে একস্থানে স্থির হয়ে বসে থাকবার মতো প্রশিক্ষণ দিতেন। কারণ মহাকাশের যাত্রাপথে দীর্ঘসময় ধরে ছোট্ট ক্যাপসুলে বন্দী হয়ে বসে থাকতে হয়। অন্যদিকে মার্কিন বিজ্ঞানীরা এক্ষেত্রে বানরকে বেশি উপযুক্ত মনে করতেন। কিন্তু সোভিয়েতরা বানরকে খামখেয়ালী ও অস্থিরচিত্তের বলে বাতিল করে দিয়েছিলেন। তাছাড়া সোভিয়েত বিজ্ঞানমহলে কুকুর নিয়ে এর আগে গবেষণাও হয়েছে বিস্তর। ইভান পাভলভ তো কিংবদন্তীই বনে গিয়েছেন কুকুরের ওপরে তার গবেষণার জন্য।

মহাকাশ অভিযানের প্রথম দিককার সময়গুলোতে মহাকাশ সম্বন্ধে মানুষ খুব কম তথ্যই জানত। মহাজাগতিক রশ্মি, ক্ষতিকর বিকিরণ, মাধ্যাকর্ষণজনিত পিছুটানসহ অন্যান্য জটিলতা রয়েছে সেখানে। তাই দরকার ছিল খুবই শক্তপোক্ত এবং সাহসী কোনো প্রাণী। সোভিয়েতরা অবশ্য কুকুর খুঁজতে বেশি হাঙ্গামা করেনি। বেওয়ারিশ কুকুরের জন্য মস্কো খুবই প্রসিদ্ধ। রাস্তা থেকে এইসব কুকুর বেছে নেওয়া হতো মহাকাশ গবেষণার কাজে। তাদেরকে নতুন নাম দেওয়া হতো, প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো, তৈরি করা হতো কঠিন অভিযানের জন্য। আর একদিন দেখা গেল রাস্তায় মারামারি আর কষ্টকর জীবন পার করে আসা এই কুকুরগুলোই দুঃসাহসী কিছু অভিযান সমাধা করে ফেলেছে।

মহাকাশচারী কুকুর বেলকা আর স্ত্রেলকা; source: theguardian.com

মজার কথা হচ্ছে, এদের মধ্যে কোনো পুরুষ কুকুর ছিল না। তাদের জন্য সোভিয়েতরা যে স্পেস স্যুট বানিয়েছিল, সেগুলো পুরুষ কুকুরের জন্য সুবিধাজনক ছিল না। তাছাড়া স্ত্রী কুকুর অপেক্ষাকৃত শান্ত ও ধৈর্য্যশীল হওয়ায় তাদেরকে নির্বাচন করা হতো। রকেটে স্থান কম। তাই ৬ কেজি ওজন এবং ঘাড় পর্যন্ত ১৪ ইঞ্চির বেশি উচ্চতার কোনো কুকুরকে নেয়া হতো না।

কুকুরদের প্রশিক্ষণপর্ব

অভিযানের অনেক আগে থেকেই কুকুরদের প্রশিক্ষণ পর্ব শুরু হয়ে যেত। একটি হাশিখুশি কুকুরকে পাকড়াও করে ছোট্ট একটি খাচাঁয় পুরে দিলে স্বভাবতই চিৎকার চেচামেচি শুরু করে দেবে। কুকুরদেরকে তাই ধীরে ধীরে, ক্রমশ ছোট থেকে আরো ছোট খাঁচায় থাকবার অভ্যাস করানো হতো। মাঝে মধ্যে দীর্ঘদিন একা রেখে দেওয়া হতো, কখনো কখনো একনাগাড়ে পনেরো-বিশ দিনও রাখা হতো। বিশেষ যন্ত্রের মাধ্যমে খাওয়ানো হত। পরিয়ে রাখা হতো বিশেষ স্পেসস্যুট। রকেটের গর্জনের সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য আগে থেকেই এমন বিকট শব্দের সাথে অভ্যাস করানো হতো।

সবচেয়ে কষ্টকর ছিল সম্ভবত প্রবল বেগে খাপ খাওয়ানোর বিষয়টি। রকেট উৎক্ষেপণের সময় তীব্র গতিবেগের সাথে মানিয়ে নেবার জন্য কুকুরগুলোকে প্রচণ্ড বেগে ঘুরতে থাকা একটি খাচার মধ্যে বেঁধে দেওয়া হতো। খাঁচায় পাক খেতো তারা। চেষ্টা করে যেত জ্ঞান ধরে রাখতে। সোভিয়েতরা কুকুরগুলোকে ভরশূন্য পরিবেশে থাকবার প্রশিক্ষণও দিয়েছিল। জেট বিমান যদি প্রচণ্ড বেগে ওপরে ওঠে আচমকা আবার নীচে নামে, তাহলে কয়েক মুহুর্তের জন্য বিমানের ভেতরে ভরশূন্য পরিবেশ সৃষ্টি হয়। কুকুরগুলোকে বিমানে চড়িয়ে এই অভিজ্ঞতারও স্বাদ দেওয়া হয়।

কুকুরদের নিয়ে আকাঁ কার্টুন; source: theguardian.com

এরা বিশেষভাবে বানানো জেলি জাতীয় একধরনের খাবার খেত। পুরো সময়টা জুড়ে, এদের ওপর থেকে বিজ্ঞানীরা এক মুহূর্তের জন্যও নজর সরাতেন না। প্রতিনিয়ত পর্যবেক্ষণ করা হতো তাদের হৃদস্পন্দন, আচার-আচরণ ও বিভিন্ন শারিরীক বিষয়াদি। এদেরকে দিয়ে চালানো বিভিন্ন অভিযানের ফলাফল হিসেবেই ১৯৬১ সালে প্রথম মানুষ হিসেবে ইউরি গ্যাগারিন মহাকাশে যান।

বিখ্যাত কয়েকজন নভোযাত্রী

সোভিয়েত নেতা নিকিতা খ্রুশ্চেভ অক্টোবর বিপ্লবের চল্লিশ বছর পূর্তি উপলক্ষে জমকালো একটা কিছু করে দেখাতে চাচ্ছিলেন। বিজ্ঞানীরা ঠিক করলেন স্পুটনিক-২ এ করে একটি কুকুরকে মহাকাশে পাঠানো হবে। বিজ্ঞানীরা লাইকাকে পছন্দ করলেন। ১৯৫৭ সালের তিন নভেম্বর, স্পুটনিক-২ এ চড়ে কাজাখস্থানের বাইকনুর কসমোড্রোম থেকে কুকুরটি যাত্রা শুরু করে। সে সময়ে সবাই জানতো লাইকাকে বাঁচিয়ে ফেরত আনা সম্ভব হবে না। কর্তারা অবশ্য এদিকটায় খুব একটা গুরুত্ব দেননি।

সোভিয়েত পোস্টার; source: theguardian.com

দীর্ঘদিন পর্যন্ত সবার ধারণা ছিল লাইকা ছয় দিনের মতো বেঁচে ছিল। পরে অক্সিজেন ফুরিয়ে যাওয়ায় দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগেই তাকে কৃত্রিমভাবে মেরে ফেলা হয়। অন্তত এটাই ছিল তখনকার সরকারি ভাষ্য। অনেকদিন পর, ২০০২ সালের গোপন নথি থেকে জানা যায়, লাইকা আসলে প্রচণ্ড তাপে পুড়ে মারা গিয়েছিল। উৎক্ষেপণের সাড়ে পাঁচ ঘন্টার মধ্যেই তার চেম্বারের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় এই অবস্থা হয়। লাইকার মৃত্যু সোভিয়েত ইউনিয়নের বাইরে ও দেশীয় বিজ্ঞানী মহলে ভীষণ আলোড়ন তোলে। ওলেগ গাজেঙ্কো আর ভ্লাদিমির ইয়াজদোভস্কি, যারা এই গবেষণার নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন, তারা পরে বহুবার অনুশোচনা ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন কুকুরটিকে এরকম জেনে-শুনে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়ার জন্য। তবে পরের যাত্রার কুকুরগুলোকে ফেরত আনার ব্যবস্থা নিয়ে এরপর থেকে কাজ শুরু করা হয়। এরপর বহাল তবিয়তে মহাকাশ থেকে ঘুরে আসে বেলকা আর স্ত্রেলকা, চেরনুশকা, ভিতেরোক, উগোলোকসহ আরো অনেকগুলো কুকুর। শেষের কুকুরটি আবার টানা ২২ দিন মহাশূন্যে থেকে রেকর্ড গড়েছে।

পরিশেষ

পঞ্চাশের দশকে এই কুকুরগুলোই ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্যতম তারকা। এসব অভিযাত্রী কুকুরদের ছবি বা কার্টুন পাওয়া যেত সর্বত্র; পোস্টার, স্ট্যাম্প, সিগারেটের প্যাকেট, ম্যাচ বাক্স থেকে শুরু করে বইয়ের পাতা পর্যন্ত। সায়েন্স ফিকশন যেমন টানতো মানুষকে, তার চেয়েও বেশি টানতো এই বাস্তবতা। শুধু সোভিয়েত ইউনিয়নই নয়, ইতালি ও জাপানে পর্যন্ত লাইকাকে নিয়ে কমিক লেখা হয়েছে, লেখা হয়েছে বই। রাশিয়া জুড়ে বহু জায়গায় লাইকার ভাস্কর্য বানানো হয়েছে। বেলকা আর স্ত্রেলকাকে নিয়ে ২০১০ সালে অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র বানানো হয়েছে। স্ত্রেলকার একটি বাচ্চা মার্কিন প্রেসিডেন্ট কেনেডিকে উপহার হিসেবে দেওয়া হয়েছিল।

কুকুরদের নিয়ে লেখা বইয়ের প্রচ্ছদ; source: theguardian.com

১৯৫৮ সালে স্পুটনিক-২ মহাশূন্যে ধ্বংস হয়ে যায়। লাইকার দেহাবশেষ সেখানেই রয়ে গিয়েছে।

ফিচার ইমেজ – Wikimedia Commons

Related Articles