১৯৯২ এর এপ্রিলে বসনিয়া-হার্জেগোভিনার যুগোশ্লাভ প্রজাতন্ত্রের সরকার যুগোশ্লাভিয়া থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। পরবর্তী কয়েক বছরে, সার্ব-আধিপত্যশীল যুগোশ্লাভ সেনাবাহিনীর মদদপুষ্ট বসনীয় সার্ব বাহিনীসমূহ বসনিয়াক (বসনিয়ান মুসলিম) ও ক্রোয়েশীয় বেসামরিক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে গণহত্যামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে। এর ফলে ১৯৯৫ সাল নাগাদ প্রায় ১ লক্ষ লোক মারা যায়, যাদের শতকরা ৮০ ভাগই ছিল বসনিয়াক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাজিদের হাতে ৬০ লাখ ইহুদির মৃত্যুর পর এটাই ছিল গণহত্যার নিকৃষ্টতম উদাহরণ।
বসনীয় গণহত্যা নিয়ে হিস্টরি চ্যানেলের ভুক্তি থেকে সংক্ষিপ্ত ইতিহাস তুলে ধরা হলো আজকের লেখায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বসনিয়া-হার্জেগোভিনা, সার্বিয়া, মন্টেনেগ্রো, ক্রোয়েশিয়া, স্লোভেনিয়া, ও মেসিডোনিয়ার মতো বলকান রাষ্ট্রগুলো যুগোশ্লাভিয়ার ফেডারেল গণপ্রজাতন্ত্রের অংশ হয়ে যায়। ১৯৮০তে যুগোশ্লাভিয়ার দীর্ঘসময়ের নেতা জোসিপ ব্রজ টিটোর মৃত্যুর পরে, যুগোশ্লাভিয়ার অন্তর্গত বিভিন্ন প্রজাতন্ত্রের মধ্যে বৃদ্ধি পেতে থাকা জাতীয়তাবাদ তাদের ইউনিয়নকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলার আশঙ্কা নিয়ে হাজির হয়।
মধ্য-’৮০ পরবর্তী সময়ে এই প্রক্রিয়া সার্ব নেতা স্লোবোদান মিলোসেভিচের উত্থানের মধ্য দিয়ে তীব্র হয়ে ওঠে। তিনি বসনিয়া-ক্রোয়েশিয়ায় থাকা সার্বদের সাথে তাদের ক্রোয়েশীয়, বসনিয়াক, এবং আলবানীয় প্রতিবেশীর বিরোধ তৈরি করেন। ১৯৯১-এ সার্বিয়া, ক্রোয়েশিয়া, ও মেসিডোনিয়া তাদের স্বাধীনতা ঘোষণা করে।
পরবর্তীতে যে ক্রোয়েশীয় যুদ্ধ হয়, তাতে সার্ব-আধিপত্যশীল যুগোশ্লাভ সেনাবাহিনীকে, ক্রোয়েশীয় বাহিনীসমূহের সাথে সার্ব বিচ্ছিন্নতাবাদীদের রক্তাক্ত সংঘর্ষগুলোতে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মদদ দিতে দেখা যায়।
বসনিয়ায় মুসলমানরা একক বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করত, সেটা ১৯৭১ সাল নাগাদ। পরবর্তী দুই দশকে, অসংখ্য সার্ব আর ক্রোয়াট বসনিয়ায় অভিবাসিত হন। এর ফলে ১৯৯১ এর এক আদমশুমারিতে দেখা যায়, বসনিয়ার ৪০ লাখ বাসিন্দার ৪৪ শতাংশ বসনিয়াক, ৩১ শতাংশ সার্ব, আর ১৭ শতাংশ ক্রোয়াট।
১৯৯০ এর শেষদিকে যে নির্বাচন হয়, তাতে তিন সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব আছে (মোটামুটিভাবে তাদের জন-অনুপাতের ভিত্তিতে) এমন পার্টিগুলোকে নিয়ে, একটি কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয়; যার নেতৃত্বে ছিলেন বসনিয়াক নেতা আলিয়া ইজেতবেগোভিচ।
দেশের ভেতরে বাইরে অস্থিরতা বৃদ্ধি পেতে থাকলে, বসনীয় সার্ব নেতা রাদোভান কারাদজিচ এবং তার সার্বীয় গণতন্ত্রী পার্টি সরকার থেকে নিজেদেরকে প্রত্যাহার করে নেয়, এবং নিজস্ব ‘সার্বীয় জাতীয় সংসদ’ প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৯২ এর ৩ মার্চ, একটি গণভোটের পরে (কারাদজিচের পার্টি যেটা সার্ব-অধ্যুষিত বিভিন্ন এলাকায় সম্পন্ন হতে বাধাপ্রদান করেছিল), রাষ্ট্রপতি ইজেতবেগোভিচ বসনিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
বসনিয়ার নিয়ন্ত্রণের জন্য লড়াই
বসনিয়ার এই স্বাধীনতা ঘোষণা সমর্থন করা দূরে থাক, বসনীয় সার্বরা চাইলেন বলকানে একটি আধিপত্যশীল সার্বীয় রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করতে, সেই ‘বৃহত্তর সার্বিয়া’ গঠন করতে- যার স্বপ্ন দীর্ঘকাল ধরে দেখে আসছিলেন সার্ব বিচ্ছিন্নতাবাদীরা।
১৯৯২ এর মে-তে, জাতিসংঘ এবং ইউরোপীয় কমিউনিটি (ইওরোপীয় ইউনিয়নের পূর্বসুরি) বসনিয়ার স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেওয়ার দু’দিন পর, বসনীয় সার্ব বাহিনীগুলো মিলোসেভিচ ও সার্ব-আধিপত্যশীল যুগোশ্লাভ সেনাবাহিনীর মদদে বসনিয়ার রাজধানী সারায়েভোতে বোমাবর্ষণ করার মাধ্যমে তাদের যুদ্ধাভিযান শুরু করল।
তারা পূর্ব বসনিয়ার ভোরনিক, ফোসা, ও ভিসেগার্দের মতো বসনিয়াক-অধ্যুষিত শহরগুলোতে আক্রমণ করল, অঞ্চলটি থেকে বসনিয়াক বেসামরিক ব্যক্তিদেরকে জোরপূর্বকভাবে বহিষ্কার করল এমন একটি প্রক্রিয়ায়, যা পরবর্তীতে ‘জাতিগত শুদ্ধি অভিযান’ হিসেবে চিহ্নিত হবে। প্রসঙ্গত, জাতিগত শুদ্ধি অভিযান গণহত্যার চেয়ে ভিন্ন এই অর্থে যে; গণহত্যার ক্ষেত্রে যেখানে শারীরিকভাবে নিশ্চিহ্ন করে ফেলাটাই উদ্দেশ্য, সেখানে জাতিগত শুদ্ধি অভিযানের ক্ষেত্রে একটা ভৌগলিক এলাকা থেকে একটি মানবগোষ্ঠীকে সরিয়ে দেওয়াটাই লক্ষ্য; যদিও খুন, ধর্ষণ, অত্যাচার, এবং জোরপূর্বক স্থানান্তরকরণের মতো একই পদ্ধতি ব্যবহৃত হতে পারে।
বসনীয় সরকারি বাহিনীগুলো যদিও আত্মরক্ষার চেষ্টা চালায়, কখনো কখনো ক্রোয়েশীয় সেনাবাহিনীর সাহায্য নিয়ে, ১৯৯৩ এর শেষ নাগাদ দেশটির তিন-চতুর্থাংশ বসনীয় সার্ব বাহিনীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। কারাদজিচের পার্টি পুবদিকে তাদের নিজস্ব স্রপস্কা প্রজাতন্ত্র গঠন করে। বসনীয় ক্রোয়াটদের অধিকাংশই এরই মাঝে দেশ ছেড়ে চলে গেছে, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বসনিয়াকরা স্রেফ অপেক্ষাকৃতভাবে ছোট শহরগুলোতে বাস করছে।
সার্বরা তাদের দখলকৃত ভূখণ্ডের কোনো অংশই ছাড়তে রাজি না হওয়ায় একটি ক্রোয়েশীয়-বসনীয় ফেডারেশন ও বসনীয় সার্বদের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার কয়েকটি প্রস্তাব ব্যর্থ হয়ে গেল। জাতিসংঘ বসনীয় সংঘাতে নাক গলাতে অস্বীকৃতি জানাল। তবে প্রতিষ্ঠানটির উদ্বাস্তু বিষয়ক হাই কমিশনারের চালানো এক প্রচারাভিযানের ফলে দেশটির বহু বাস্তুচ্যুত, অপুষ্ট, ও আহত ভিকটিম মানবিক ত্রাণ সাহায্য পেলেন।
স্রেব্রেনিচা হত্যাযজ্ঞ
১৯৯৫ এর গ্রীষ্মের সময়, পূর্ব বসনিয়ার তিনটি শহর – স্রেব্রেনিচা, জেপা, ও গোরাজদে – বসনীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে এলো। ১৯৯৩ এ জাতিসংঘ এই এলাকাগুলোকে ‘মুক্তাঞ্চল’ ঘোষণা করেছিল, যা নিরস্ত্রীকৃত ও রক্ষিত হওয়ার কথা ছিল আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী বাহিনীদের দ্বারা।
যা-ই হোক, ১৯৯৫ এর ১১ জুলাই, বসনীয় সার্ব সেনাবাহিনী স্রেব্রেনিচার দিকে আগুয়ান হতে লাগল। সেখানে অবস্থানরত ডাচ শান্তিরক্ষী বাহিনীগুলোর একটি ব্যাটেলিয়নের চোখের সামনে বসনিয়াক বেসামরিক ব্যক্তিদেরকে আলাদা করে ফেললো তারা। তারপর নারী ও কন্যা শিশুদেরকে বাসে তুলে বসনীয়-নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় পাঠিয়ে দিল।
এই নারীদের কেউ কেউ ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়ণের শিকার হন। পেছনে রয়ে গিয়েছিল যে পুরুষ ও ছেলে শিশুরা, তাদেরকে তাৎক্ষণিকভাবে মেরে ফেলা হয়, বা বাসে করে বধ্যভূমির দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। স্রেব্রেনিচাস্থ সার্ব বাহিনীগুলোর হাতে সেদিন ৭,০০০-৮,০০০ পুরুষ ও ছেলেশিশু খুন হয়।
সে মাসেই বসনীয় সার্ব বাহিনীগুলো জেপা দখল করে নিলে, এবং সারায়েভোর এক জনবহুল বাজারে একটি বোমা বিস্ফোরণ ঘটালে, চলমান সংঘাত এবং এর ফলে ক্রমেই বেড়ে চলা বেসামরিক মৃত্যুতে উদ্বিগ্ন হয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় অবশেষে সাড়া দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল।
১৯৯৫ এর আগস্টে, সার্বরা জাতিসংঘের দেওয়া একটি আলটিমেটামকে অগ্রাহ্য করলে, নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন (ন্যাটো) বসনীয় সার্বদের অবস্থানগুলোতে বোমাবর্ষণে ও একটি গ্রাউণ্ড অফেন্সিভে বসনীয় ও ক্রোয়েশীয় বাহিনীদের সাথে যোগ দেয়।
জাতিসংঘ সার্বিয়ার ওপর বাণিজ্য অবরোধ আরোপ করে, এতে সার্বীয় অর্থনীতি স্রেফ ভেঙে পড়ে। তিন বছর ধরে যুদ্ধ করার পরও সার্বদের সামরিক বাহিনীগুলোকে বসনিয়ায় সুবিধা করতে পারছিল না। এই পরিস্থিতিতে মিলোসেভিচ সমঝোতায় যেতে সম্মত হন। ১৯৯৫ সালে ডেয়টনের ওহায়ো রাজ্যে, মার্কিন-মদদে শান্তি আলোচনা শুরু হয়। এতে সার্বিয়ার পক্ষে মেলোসেভিচ, বসনিয়ার পক্ষে ইজেতবেগোভিচ, এবং ক্রোয়েশিয়ার পক্ষে ফ্রানজো তুজমান উপস্থিত ছিলেন। এই শান্তি আলোচনায় স্থির হয়, একটি ফেডারেলিকৃত বসনিয়া গঠন করা হবে, যা একটি ক্রোয়াট-বসনিয়াক ফেডারেশন ও একটি সার্ব প্রজাতন্ত্রের মধ্যে বিভক্ত থাকবে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
বসনিয়ার বসনিয়াক ও ক্রোয়াটদের বিরুদ্ধে যখন গণহত্যা পরিচালিত হচ্ছিল, তখন তা ঠেকাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ভূমিকা রেখেছিল সামান্যই। কিন্তু, পরবর্তীতে, গণহত্যাকারীদেরকে বিচারের আওতায় আনতে তারা সক্রিয় ভূমিকা পালন করল।
১৯৯৩ এর মে-তে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ নেদারল্যান্ডসের হেগ শহরে সাবেক যুগোশ্লাভিয়ার জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিটিওয়াই) পত্তন ঘটাল। ১৯৪৫-৪৬ এর নুরেমবার্গ আদালতের পরে এটাই ছিল প্রথম আন্তর্জাতিক আদালত, অপরাপর যুদ্ধাপরাধের মধ্যে গণহত্যার বিচার করার ক্ষেত্রেও এটাই প্রথম।
আইসিটিওয়াই যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করার দায়ে যাদের অভিযুক্ত করেছিল, তাদের ভেতরে ছিল রাদোভান কারাদজিচ, ও বসনীয় সার্ব সামরিক কমাণ্ডার জেনারেল রাতকো ম্লাদিচ।
সাবেক যুগোশ্লাভিয়ায় সংঘাত চলাকালীন বিভিন্ন ধরনের অপরাধ সংঘটিত করার দায়ে আইসিটিওয়াই পর্যায়ক্রমে ১৪১ জনকে অভিযুক্ত করে। গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ, ও যুদ্ধাপরাধের দায়ে মেলোসেভিচকে আদালতে হাজির করা হয় ২০০২ এ। তিনি নিজেই নিজের ডিফেন্স ল-ইয়ারের ভূমিকা পালন করেন। তার রুগ্ন স্বাস্থ্যের কারণে বিচার বিলম্বিত হতে থাকে। ২০০৬ সালে তাকে তার কারাকক্ষে মৃত পাওয়া যায়।
বসনিয়ার কসাই
২০০৭ সালে আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালত সার্বিয়ার বিরুদ্ধে বসনিয়ার আনা এক ঐতিহাসিক সিভিল ল-সুইটের রায় ঘোষনা করে। যদিও আদালত রায়ে স্রেব্রেনিচা হত্যাযজ্ঞকে গণহত্যা অভিহিত করে, এবং বলে যে সার্বিয়া এই গণহত্যা ঠেকাতে এবং এর জন্য দায়ীদেরকে বিচারের মুখোমুখি করতে ‘পারতো ও তা-ই করা উচিত ছিল’, তবে তারা খোদ সার্বিয়াকেই এই গণহত্যার জন্য অপরাধী ঘোষণা করা থেকে বিরত থাকেন।
প্রায় ৬০০ প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য নেওয়ার ও চার বছর ধরে বিচার চালানোর পর, আইসিটিওয়াই ২০১৭ সালের নভেম্বরে ‘বসনিয়ার কসাই’ খ্যাত রাদকো ম্লাদিচকে গণহত্যা ও অপরাপর মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে। আদালত ৭৪ বছর বয়সী সাবেক এই জেনারেলকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করে। এর আগের বছরেই যুদ্ধাপরাধের জন্য কারাদজিচকে দোষী সাব্যস্ত করার পর, ম্লাদিচের দীর্ঘ-বিলম্বিত দোষী সাব্যস্তকরণটিই ছিল আইসিটিওয়াইএর প্রদান করা শেষ কোনো বড় আকারের রায়।
ফিচার ইমেজ: dailysabah.com (স্রেব্রেনিচার কাছে পটচারিতে একটি সমাধিক্ষেত্রের মাঝ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন এক বসনীয় নারী)