আঙ্গুলের ছাপ থেকে আসামী ধরা হয় সেটা আমরা সবাই জানি। পুলিশ, সিআইডির লোকেরা কোনো ক্রাইম স্পটে আগে দেখে যে সেখানে কোনো আঙ্গুলের ছাপ পাওয়া যায় কিনা। এরপর সেখান থেকে আস্তে আস্তে সামনে এগিয়ে তথ্য-প্রমাণসহ আসামী ধরে ফেলে। কিন্তু আঙ্গুলের ছাপ দিয়ে যে শুধু আসামী শনাক্ত করা যায় তা কিন্তু নয়। এই ছাপ দিয়ে আরও অনেক কিছু সেখান থেকে বোঝা যায়। একজন মানুষের ফিঙ্গারপ্রিন্ট বা আঙ্গুলের ছাপ থেকে বিভিন্ন আণবিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে তার জীবনযাত্রা সম্পর্কে, তার বসবাসরত পরিবেশ সম্পর্কে, তার কাজ, খাওয়ার অভ্যাস এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সমস্যা থাকলে সেগুলোও জানতে পারা যায়।
কোনো কিছুর উপর আঙ্গুলের ছাপ তখনই পড়ে যখন সেখানে মানুষের কোনো আঙুল স্পর্শ করে। এর ফলে সেই জায়গায় ঘাম কিংবা অন্যান্য ক্ষুদ্র পদার্থ লেগে যায়। আঙুলের তলাতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খাঁজের প্যাটার্ন দেখা যায়। একটু খেয়াল করলে সেটা খালি চোখে দেখা যায়। কোনো কিছু যদি আঙুলে লেগে থাকে এবং সেই আঙুল দিয়ে অন্য কিছু স্পর্শ করলে সেই একই প্যাটার্নের ছাপ সেই জায়গাতে পড়ে যায়।
কোনো কিছুর উপর খালি চোখে এই আঙুলের ছাপ দেখা যায় না। সেটা দেখার জন্য অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থের আশ্রয় নিতে হয়। প্রযুক্তির দ্রুত উৎকর্ষের যুগে এই কাজটি আরও নিখুঁত হয়ে গিয়েছে এবং আঙুলের ছাপ শনাক্তকরণের পাশাপাশি আরও তথ্য এই ছাপ থেকে এখন পাওয়া যাচ্ছে। তার কিছু উদাহরণ আগেই ব্যক্ত করা হয়েছে। কিছুদিন আগে গবেষকগণ জানিয়েছেন, কোনো মানুষ কী ধরনের ওষুধ ব্যবহার করছে অথবা কোনো ধরনের বিস্ফোরকের সংস্পর্শে আছে কিনা সেটা আঙুলের ছাপ থেকে নির্ণয় করা যায়।
ফরেনসিকের দিক দিয়ে যদি আমরা চিন্তা করি তাহলে আঙুলের ছাপ আরও অনেক কাজে ব্যবহার করা যাবে। যেমন- এখন চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন টেস্ট বা পরীক্ষা করাতে হয় (রক্ত পরীক্ষা, ইউরিন পরীক্ষা ইত্যাদি)। গবেষকদের মাথায় এখন নতুন ভাবনা এসেছে- আঙুলের ছাপ থেকে কি এসব পরীক্ষার কিছু কাজ শনাক্তকরণে ব্যবহার করা যায় না? কারণ আঙুলের ছাপ পদ্ধতি ব্যবহার করে এই শনাক্তকরণ অনেক সহজ এবং এতে সময়ও লাগে কম।
কোথাও স্পর্শ করলেই যে শুধু আঙুলের ছাপ পাওয়া যাবে তা কিন্তু নয়। অনেক সময় আঙুলের তলা বা Finger tip থেকেও কিছু পদার্থ নিঃসরিত হয়। ইক্রাইন বলে একধরনের গ্রন্থি আছে যেটা আঙুলে অবস্থিত এবং যা দিয়ে ঘাম বের হয়। এই ঘামকে বিজ্ঞানীরা এখন গবেষণার উৎসে পরিণত করেছেন। ঘাম যেহেতু শরীরের ভিতর থেকে বের হয় তাই এর সাথে আরও বিভিন্ন পদার্থ ট্রেস হিসেবে থাকতে পারে। Clinical Chemistry নামক একটি জার্নালে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে যেখানে দেখানো হয়েছে যে কোকেইন, হিরোইন এবং মরফিন যদি কারোর শরীরের ভিতর থেকে থাকে তাহলে তা শুধুমাত্র আঙুলের ছাপ ব্যবহার করেই শনাক্তকরণ সম্ভব।
তবে এখানে সমস্যা আছে। এভাবে কোনো কিছু শনাক্ত করতে গেলে অনেক সময় ভুল হতে পারে। যেমন- একজন ব্যক্তি হয়তো ড্রাগ নেয় না, কিন্তু তার হাতে সেই ড্রাগের ট্রেস পাওয়া গেলো। ড্রাগ না নিয়েও এই ট্রেস পাওয়া যেতে পারে। হয়তো আগে থেকে কোনো জায়গার কোনো অংশ সেই ড্রাগ দিয়ে দূষিত থাকতে পারে। যে ব্যক্তির হাতে ড্রাগের ট্রেস পাওয়া গিয়েছে তার হাত হয়তো সেই দূষিত জায়গার সংস্পর্শে এসেছে এবং হাতে লেগে গিয়েছে। এই দিকটার কথা বিবেচনা করে গবেষকরা এরপর দেখালেন যে এরকমটি হলে আঙুলে ড্রাগের পরিমাণ খুব কম পাওয়া যাবে। কত কম, সেটা যদিও আরেকটি গবেষণার বিষয়। কিন্তু যে ব্যক্তি আসলেই ড্রাগ নেয় তার ক্ষেত্রে এই ট্রেসের পরিমাণ হবে অনেক বেশী। তাছাড়া যে ব্যক্তি ড্রাগ তার শরীরে নিবে তার আঙুলের গ্রন্থি থেকে যে ঘাম বের হবে, সেই ঘামের সাথে সেই ড্রাগের কিছু ক্ষুদ্র উপাদান বের হবেই। এমনকি হাত পরিষ্কার করে ফেললেও তা শরীর থেকে বের হবে। তাই এই পদ্ধতিতে খুব সহজেই ড্রাগে আসক্ত ব্যক্তি শনাক্তকরণ সম্ভব। এর ফলে কারা ড্রাগ নেয় এবং কারা নেয় না, তা-ও প্রমাণসহ খুঁজে বের করা সম্ভব হবে।
একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, যেসব মানুষ ড্রাগ নেয় না, কিন্তু তাদের হাতে সেটার ট্রেস পাওয়া গিয়েছে, তার পরিমাণ প্রায় দশ পিকোগ্রামের (০.০০০০০০০০০০১ গ্রাম) মতো থাকতে পারে। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, বর্তমান চিকিৎসাবিজ্ঞানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপাদানও পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। এখন এমন সব উপাদানও পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে যেগুলো আগে হয়তো কারোর নজরে আসেনি বা সেটাকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়নি।
এখন আরেকটি গবেষণা হচ্ছে যেটার উদ্দেশ্য হচ্ছে কোনো রোগীর যেকোনো অসুখের ঠিক ঠিক ওষুধ দেয়া হচ্ছে কিনা এবং সেই ওষুধ ঠিকভাবে কাজ করছে কিনা- সেটা আঙুলের ছাপের সাহায্যে যেন বের করা যায়। কোনো রোগী যখন একজন চিকিৎসকের কাছে যায় চিকিৎসক তাকে তার অসুখ নিরীক্ষণ করে কিছু ওষুধ সেবন করতে দেয়। গবেষকদের উদ্দেশ্য হচ্ছে রোগ সেরে যাবার আগে রোগীর আঙুলের ছাপ নেয়া হবে এবং কী কী উপাদানের ট্রেস সেখান থেকে পাওয়া যাচ্ছে সেটা জেনে নেয়া হবে। এরপর রোগী ওষুধ সেবন করার পর আরও কয়েকবার তার আঙুলের ছাপ নেয়া হবে। ওষুধ নেয়ার পরে এই ছাপ পরীক্ষা করার উদ্দেশ্য হচ্ছে যদি ওষুধ ঠিকভাবে কাজ করে তাহলে ওষুধ নেয়ার আগে যে ট্রেস পাওয়া যাচ্ছিলো সেগুলো আরও পাওয়া যাচ্ছে কিনা তা দেখা। যদি পাওয়া না যায় তাহলে বুঝে নিতে হবে ওষুধ ঠিকভাবে কাজ করছে, অন্যথায় বুঝে নিতে হবে সেটার কাজ হচ্ছে না। এরকম ব্যবস্থা যদি করা যায় তাহলে বিভিন্ন দিক দিয়ে অনেক সুবিধা পাওয়া যাবে।
উপরের আলোচনা থেকে স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে যে, আঙুলের ছাপ থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। Finger Print Science আগে থেকে এখন অনেক বেশী উন্নতি করেছে। আগে শুধু মানুষ শনাক্তকরণে এটা ব্যবহার করা হতো, কিন্তু এখন বিজ্ঞানের উৎকর্ষের কারণে এই শাখা আরও উন্নতি করছে। আশা করা যাচ্ছে প্রযুক্তি এবং রসায়নের উন্নতির সাথে সাথে এই বিষয়ে গবেষণার আরও নতুন নতুন সুযোগ আসবে।
ফিচার ইমেজ সোর্স: phys.org