এবছরের ২ মে প্রখ্যাত বাঙালি চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের সাতানব্বইতম জন্মবার্ষিকী পালিত হলো। ১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল তিনি ইহলোক ত্যাগ করলেও তার স্মৃতি আজও চিন্তাশীল বাঙালির ভাবনায় অমলিন। কী করেননি সত্যজিৎ তার দীর্ঘ পরিচালনার জীবনে! ছোট-বড়-ভাবুক সব শ্রেণীর মানুষেরই হৃদয় ছুঁয়ে গিয়েছে তার কাজ। আজকের প্রজন্মের শিশুরাও সত্যজিতের চলচ্চিত্র দেখে বুঁদ হয়ে। একজন স্রষ্টা হিসেবে সত্যজিৎ রায়ের বিরাট সাফল্য এখানেই।
কিন্তু সে তো না হয় গেল সত্যজিতের কথা। বিশ্ববরেণ্য এই সৃষ্টিশীল মানুষটির হয়ে আর নতুন করে গলা ফাটানোর কিছু নেই। যতদিন এই পৃথিবীতে চলচ্চিত্র শিল্প থাকবে, ততদিন সত্যজিৎও থাকবেন। সত্যজিৎ পরবর্তী বাংলা ছবির কী দশা আজ?
সত্যজিতের মনন সত্যিই কতটা আন্দাজ করতে পারেন এখনকার চিত্রপরিচালকরা?
প্রশ্নটা জাগে অন্য জায়গায়। সমকালীন বঙ্গসমাজে সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে আগ্রহ বা উৎসব উদযাপনের কোনো অভাব নেই ঠিকই, কিন্তু সত্যি সত্যিই আমরা বা এখনকার চিত্রনির্মাতারা সত্যজিতের মননের দ্বারা কতটা প্রভাবিত? সত্যজিতের জন্ম বা মৃত্যুদিনে তাকে উদ্দেশ্য করে প্রণাম জানানো বা সত্যজিতের সৃষ্ট ছবি বা চরিত্র নিয়ে নানা আলাপ-আলোচনা বা সোশ্যাল মিডিয়ায় সত্যজিতের অমর কিছু সৃষ্টিকে নতুন আঙ্গিকে পেশ করা- এসবই তো তার সহজলভ্য দিকটিকে তুলে ধরা। কিন্তু তার অন্তর্দৃষ্টির অনুধাবন? আজকের তথ্যপ্রযুক্তিতে পণ্ডিত বা গল্পকার হিসাবে নামকরা পরিচালকরা সেই মননের খোঁজ কতটা পান?
সত্যজিতের ছবি আমাদের সাধারণ মানুষকে ছুঁয়ে যায় কারণ, তার মধ্যে থাকে একটি অত্যন্ত সরল প্রস্তাবনা। সাধারণ মধ্যবিত্ত এবং তার দৈনন্দিন মূল্যবোধকে ছুঁয়ে যাওয়া কাজগুলোর দ্বারা সত্যজিৎ পৌঁছাতে পারতেন তার দর্শকের মনের অন্তরতম কক্ষে। একঘেয়ে কমার্শিয়াল ছবির মতো কোনো পেশির ব্যবহার না করেও শুধুমাত্র বুদ্ধি-বিবেচনা দিয়ে জীবনের নানা কঠিন ও নেতিবাচকদিকগুলির সম্মুখীন হওয়া এবং তার মোকাবিলা করা- সত্যজিতের ছবিতে এই ‘সমান্তরাল ভঙ্গিমার’ উন্মেষই তাকে জনপ্রিয় করছিল। আজকের দিনে এর পরিচয় আর তেমন পাওয়া যায় কোথায়? যদিও আমরা প্রায়ই শুনে থাকি যে এই প্রজন্মের চিত্রপরিচালকরা নাকি সত্যজিতের থেকে অনুপ্রাণিত সবসময়ই।
অনুপ্রাণিত হওয়া মানে বাহ্যিক প্যাটার্নকে নকল করা নয়
অনুপ্রাণিত হওয়ার অর্থ কিন্তু তার ছবির প্যাটার্নকে নকল করা নয়। যেহেতু সত্যজিতের ‘নায়ক’ ছবিতে ট্রেনের মধ্যে একজন ছবির নায়কের নানা মুখ আমরা দেখতে পাই, পরবর্তীকালে অনেক চিত্রপরিচালকই মনে করেন, একটি চলন্ত ট্রেনের মধ্যে একটা গোটা ছবি তৈরি করে ফেলতে পারলেই বুঝি ছুঁতে পারা গেল সত্যজিৎকে। অথবা ট্রেনের বদলে যদি প্লেনে একজন ছবির নায়ককে তার জীবনের নানা অনুভূতি ছুঁয়ে যায় একজন সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলা কালীন, আমরা কি ধরে নেব যে সত্যজিতের বংশধররা তার ঐতিহ্যকে তুলে ধরছেন দুর্দান্তভাবে?
আজকালকার পরিচালকরা সত্যজিতের আরেকটি ম্যানারিজম খুব গ্রহণ করার করার চেষ্টা করেন। সেটি হলো তার ১৯৭০ সালের মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’র গাছতলায় বসে মেমারি গেম খেলা। মানুষের সম্পর্কের সূক্ষ্ম দিকগুলি তুলে ধরতে এমন একটি পরিবেশের কোনো তুলনা হয় না। সত্যজিৎ সেটি তার ছবির মেমারি গেমের মধ্যে দিয়ে দারুণভাবে দেখিয়েও ছিলেন। আজকের পরিচালকরা ওই একসাথে বসে কোনো দলগত কর্মের দিকটি তুলে ধরে সত্যজিতের স্মৃতি উস্কে দেন ঠিকই। কিন্তু ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’র অসীম-অপর্ণা বা শেখর বা সঞ্জয়-জয়ার ব্যক্তিগত সমীকরণগুলো ফুটিয়ে তোলার মনন কি তাদের আছে? একত্রে বসে শুধুমাত্র কথাবার্তা বা হাসি-মজা করলেই এই সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম দিকগুলো ক্যামেরায় এবং চিন্তাশীল দর্শকের চোখে ধরা পড়ে না।
সত্যজিতের আরও একটি ছবি ‘শাখা প্রশাখা’তেও এমন ধরনের একটি দৃশ্য রয়েছে। নিরালায় পারিবারিক পিকনিক, যেখানে পরিবেশ বেশ গম্ভীর; তিন ভাই এবং তাদের দু’জনের স্ত্রীদের মধ্যে গম্ভীর বাক্যালাপ- যেখানে মানবজীবনের আদর্শের সংকটের কথা এসে পড়ে। এই একইরকম একটি দৃশ্য থাকে ভাইদের পৈতৃক বাড়িতে খাওয়ার টেবিলেও, যেখানে ভাইদের মধ্যে বার্তালাপ ক্রমেই তপ্ত হতে শুরু করে- কারণ, সেই আদর্শের স্খলন। চূড়ান্ত আদর্শবাদী বাবার পুত্রদের নৈতিক পতন সেখানে সত্যজিৎ দেখান খুব দক্ষতার সঙ্গে। মানসিক ভারসাম্যহীন মেজোভাইয়ের প্রবল প্রবল প্রতিবাদের মধ্য দিয়েও সত্যজিৎ বোঝান, আদর্শবাদী ওই পরিবারের এই নৈতিক স্খলনের দিকটি কতটা যন্ত্রণাদায়ক একজন অসুস্থ এবং অস্বাভাবিক মানুষের কাছেও।
সত্যজিৎ তার জীবনের শেষ কয়েকটি ছবিতে বর্তমান সময়ের নানাবিধ নৈতিক সংকটের কথা দেখিয়েছেন নানাভাবে। কখনো রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক স্তরে বা ব্যক্তিস্তরে দুর্নীতির অবাধ বিচরণ; কখনোবা ক্ষুদ্রের পূজারী মানুষের নিজের হাতে সভ্যতার ধ্বজা ওড়ানোর নৈতিক দায়িত্ব তুলে নেওয়া; দুর্নীতির সঙ্গে মানুষের ক্রমশ সমঝোতা করা আর দুর্নীতিকেই প্রকৃত নিয়ম বলে স্বীকার করে নেওয়া কিংবা কুসংস্কারছন্ন সমাজের হাতে অসুস্থ মানুষের পীড়ন- সমাজের এই নানা ব্যাধির কথা এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যক্তিমানুষের জিহাদ ঘোষণা করা সত্যজিৎ দেখিয়েছিলেন অতি সাধারণ এবং সুন্দরভাবে।
আজকের চিত্রপরিচালকরা এই গভীরতায় ঢোকেন না, যদিও তারা অহোরাত্র সত্যজিতের কাজের দ্বারা উজ্জীবিত হওয়ার কথা বলেন। কিন্তু শুধু চরিত্রদের দিয়ে তালে তালে কথা বলালে বা ‘নায়ক’কে প্লেনে চড়ালে বা অন্তাক্ষরী খেললেই কি সত্যজিতের ঐতিহ্যের ধারক এবং বাহক হওয়া যায়?
এই প্রজন্মের চিত্রপরিচালকদের কিন্তু সুযোগ ছিল
অথচ এই প্রজন্মের চিত্রপরিচালকদের সত্যজিতের যথাযথ উত্তরাধিকার হওয়ার সুযোগ ছিল। এখনকার পরিচালকরা ভালো কাজ করেন, সত্যজিতের শেষের দিকের সময়ে বাংলা ছবির যে সার্বিক ‘ক্রেডিবিলিটি’র সংকট দেখা দিয়েছিল, তাও এখন নেই। কিন্তু তাও এই প্রজন্মের পরিচালকরা সেই মননের ছবি পেশ করতে পারেন না। সত্যজিতের বাহ্যিক ম্যানারিজমটাকে তারা ছোঁয়ার চেষ্টা করেন, ব্যাস ওই পর্যন্তই।
এর একটি কারণ হতে পারে শিল্পীর অভাব। একথা অনস্বীকার্য যে, সত্যজিৎ যে মাপের শিল্পীদের পেয়েছিলেন তার সিকিভাগও এখনকার পরিচালকরা পান না। আর সত্যজিতের গভীর মননকে ফুটিয়ে তুলতে যে দক্ষ অভিনেতার প্রয়োজন, তা এখন প্রায় নেই বললেই চলে।
সত্যজিতের দেখানো পথে চলতে না পারার আরও একটি কারণ হতে পারে রাজনৈতিক। সত্যজিৎ যে বিষয়গুলিকে অতি সুচারুভাবে দেখিয়েছেন তার বিভিন্ন ছবিতে, তা অনেক ক্ষেত্রেই দেশের শাসককে অখুশি করতে পারে। তা সে ‘হীরক রাজার দেশে’ হোক বা ‘গণশত্রু’- সত্যজিতের এই ছবিগুলোকে প্রতিষ্ঠান-বিরোধী বললে অত্যুক্তি হয় না। প্রয়াত পরিচালক নিজে রাজনৈতিক ক্ষমতাকেন্দ্রের সামনে মাথা না ঝোঁকালেও, আজকের দিনে সেইরকম ‘অবজেকটিভ’ অবস্থান নিয়ে ছবি বানানো খুব সহজ নয়। তাই বর্তমান পরিচালকরা হয়তো সত্যজিতের ‘ফিল গুড’ দিকটিই শুধু নেওয়ার চেষ্টা করেন, বেশি ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করেন না।
আশি বা নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় সত্যজিৎ যে সমস্ত সমস্যার কথা তার সৃষ্টির মাধ্যমে তুলে ধরেছিলেন, তা আজ আরও জ্বলন্ত কিন্তু তাও সেলুলয়েডে তাকে ধরার সদিচ্ছা খুব বেশি দেখা যায় না। ফেলুদা বারবার তৈরি হয়, কিন্তু ‘হীরক রাজার দেশে’ আর নয়। সত্যজিৎ রাজনীতি বা বাজার- কোনোটিরই অনুমতির অপেক্ষা করেননি নিজের শিল্পশৈলী দেখানোর জন্য; কিন্তু আজকের পরিচালকরা এই বাস্তবকে উপেক্ষা করতে পারেন না। সত্যজিৎ-পরবর্তী সময়ে ঋতুপর্ণ ঘোষ এই দায়িত্ব অনেকটাই নিয়েছিলেন, কিন্তু তার অকালপ্রয়াণের পরে সেই গুরুদায়িত্ব কার?
সত্যজিতের আরও একটি বড় গুণ ছিল তার সততা এবং বিস্তারিত নিয়ে যত্নবান হওয়া। এই চলচ্চিত্রশিল্পী কোনোদিন তার সৃষ্টিকার্যের গুণ-মানের সঙ্গে আপস করেননি এবং শিল্পীবৃন্দকে দিয়ে তার মনের মতো কাজ করিয়ে নিয়েছেন, এমনকি শিশুশিল্পীদেরও। আর এর জন্যে তিনি ছিলেন পরম শ্রদ্ধেয় সবার কাছে। সার্বিকভাবে সফল হওয়ার পিছনে সত্যজিতের এই গুণটি অবশ্যই একটি কারণ ছিল। তার ঐতিহ্যকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে তাই তীক্ষ্ন এবং সংবেদনশীল মনন ছাড়াও প্রয়োজন এই গুণ দুটি।
সত্যজিতের ‘নির্ঝঞ্ঝাট’ সৃষ্টিকে বারংবার নতুন মোড়কে পেশ করার মধ্যে কোনো বাহাদুরি নেই। বরং আজ সময় এসেছে তার কাজের প্রেরণা থেকে শেখার, যে কীভাবে চলচ্চিত্রকে এই অশান্ত সময়ের মোকাবিলা করার এক যোগ্য হাতিয়ার করে তোলা যায়। সত্যজিৎ কম বিষয় নিয়ে কাজ করেননি, কিন্তু আমরা আটকে আছি ফেলুদা এবং জটায়ুতেই। ‘দেবী’, ‘জলসাঘর’, ‘গণশত্রু’ বা ‘আগন্তুক’ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে সমসাময়িক ছবি কেন দেখা যায় না নতুন প্রজন্মের পরিচালকদের হাত ধরে? প্রশ্নটা রয়েই গেল।
Featured Image Source: IMDb