চ্যাম্পিয়নস লীগের কোয়ার্টার ফাইনালের প্রথম লেগের ম্যাচগুলো শেষ হয়েছে গত বুধবার। জিতেছে রিয়াল মাদ্রিদ ও বায়ার্ন মিউনিখ। নিজেদের মাঠে জয় পেয়েছে বার্সেলোনা ও লিভারপুর। হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের ম্যাচগুলো বেশিরভাগ হয়েছে এক তরফা। জুভেন্টাস ও রিয়াল মাদ্রিদের মতো উত্তাপ ছড়ানো ম্যাচ হয়েছে একপেশে। ম্যানচেস্টার সিটিকে কোনোরকম সুযোগ না দিয়ে প্রথম লেগে বড় ধরনের ব্যবধানে জিতেছে লিভারপুল।
একনজরের প্রথম লেগের ফলাফল
জুভেন্টাস ০ – ৩ রিয়াল মাদ্রিদ
সেভিয়া ১ – ২ বায়ার্ন মিউনিখ
বার্সেলোনা ৪ – ১ রোমা
লিভারপুল ৩ – ০ ম্যানচেস্টার সিটি
জুভেন্টাস বনাম রিয়াল মাদ্রিদ
জুভেন্টাস স্টেডিয়ামে যেন ফিরে এসেছিল গত বছরের চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনাল ম্যাচ। পুরনো প্রতিপক্ষ, একই মঞ্চের প্রতিযোগিতা। তবে তুরিনের অল্ড লেডিরা চেয়েছিল সবকিছু আগের মতো হলেও ফলাফল যেন ভিন্ন হয়। তাদের সেই কাঙ্ক্ষিত চাওয়া পূরণ হয়নি, সম্ভবত বুফনেরও আর ছোঁয়া হবে না আরাধ্য চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা। ঘরের মাঠে যে রিয়ালের কাছে ০ – ৩ গোলের বড় ব্যবধানে হেরে গেছে মাসিমিলিয়ানো আলেগ্রির শিষ্যরা।
কোয়ার্টার ফাইনালের প্রথম লেগে রেফারি বাঁশি ফুঁ দেবার তিন মিনিটের মাথায় জুভদের সকল আশা ভরসা চুরমার করে দিয়ে রিয়াল মাদ্রিদকে এগিয়ে নেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। গোল হজম করে যেন আরো বেশি আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে জুভেন্টাস। কিন্তু ইগুয়াইন, কস্তারা পুরো ম্যাচে হাজার চেষ্টা করেও রিয়াল মাদ্রিদের জালে বল জড়াতে পারেননি। দিবালার শর্ট রামোস রুখে দিয়ে ফ্রিকিক থেকে ইগুয়াইনের প্রায় হয়ে যাওয়া গোল নাভাস সেভ করে বরাবরই হতাশ করেছেন জুভদের।
বার বার ব্যর্থ হয়েও প্রথমার্ধে হাল ছাড়েনি জুভেন্টাস। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে রিয়াল মাদ্রিদ আক্রমণে ফেরার পর, ৬৪ মিনিটে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো অবিশ্বাস্য একটি গোল করে বসেন। এই গোলের পর চুপসে যাওয়া জুভেন্টাসের বিপক্ষে একের পর এক আক্রমণ করে যায় রিয়াল মাদ্রিদ। ৭২ মিনিটে মার্সেলোর গোলের পর শেষ মুহূর্তে প্রায় হ্যাট্রিক করে ফেলেছিলেন রোনালদো। বুফন সেভ না করলে ৪ গোলের লজ্জার পরিমাণ যে বেড়ে যেত ইতালির ক্লাবটির।
মাসিমিলিয়ানো আলেগ্রি আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ হেরে বসলেন জিনেদিন জিদানের কাছে। ব্যর্থতা শুধু দলের নয়, ব্যর্থতার ভাগীদার মাসিমিলিয়ানো আলেগ্রিও। নিষেধাজ্ঞা ও ইনজুরির কারণে পছন্দসই স্কোয়াড তিনি নামাতে পারেননি, এটা সত্য। তবে অ্যালেক্স স্যান্দ্রোকে লেফট-মিডে দিয়ে, আসামোয়াহকে লেফট-ব্যাকে পাঠিয়ে এবং অভিজ্ঞতাসম্পন্ন প্লেয়ার ক্লদিও মাকিসিওকে বেঞ্চে বসিয়ে তিনি একটু বেশিই ঝুঁকি নিয়ে ফেলেছিলেন। রিয়ালের বিপক্ষে বড় ব্যবধানে হারের পেছনে জুভেন্টাসের নিষ্প্রভ মিডফিল্ডার দায়ী। ক্ষণে ক্ষণে জুভেন্টাস মিরালেম পিয়ানিচের অভাববোধ করেছে, যেখানে রিয়াল মাদ্রিদের মিডফিল্ড ছিলো দারুণ কর্মক্ষম। পগবা ও পিরলো চলে যাবার পর জুভেন্টাস যে তাদের মধ্যমাঠ শক্তিশালী করতে পারেনি সেটা আবারো প্রমাণিত। ব্যর্থতার পেছনে দায়ী জুভেন্টাস ডিফেন্সও। প্রথম গোলে ইসকো বা রোনালদোকে কোনো জুভেন্টাস ডিফেন্ডার মার্ক করেনি, আর দ্বিতীয় বিস্ময় গোলটি হলো স্বয়ং বুফনের ভুলে।
কোয়ার্টার ফাইনালের সেকেন্ডে লেগে খেলবেন না পাওলো দিবালা ও সার্জিও রামোস। তবে জুভেন্টাসের জন্য বার্নাব্যু থেকে ক্লিনশিটসহ চার গোলের ব্যবধানে জয় নিয়ে আসা সহজ হবে না। বর্তমান রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে এমনটা হলে রূপকথার গল্প লেখার মতো হবে। তবে বেদনাময় বাস্তবতা, আরাধ্য চ্যাম্পিয়নস ট্রফিটা মনে হয় আর ছোঁয়া হলো না জিয়ানলুইজি বুফনের।
সেভিয়া বনাম বায়ার্ন মিউনিখ
মাঠের লড়াইয়ে সেভিয়া আর বায়ার্ন মিউনিখ কখনোই সমপর্যায়ের দল নয়। তবে স্প্যানিশ লা লিগায় খেলা দলটি এ কথা মানতে নারাজ। অবশ্য ইতিহাসও এমন বলে। কারণ সেভিয়ার ঘরের মাঠে এসে কোনো জার্মান ক্লাব জিতে ফিরতে পারেনি। তাই সেভিয়া এতটা সহজ প্রতিপক্ষ নয়, বিষয়টি মেনে নিয়েছেন বায়ার্ন কোচও। বায়ার্ন ১-২ গোলের ব্যবধানে জিতেছে বটে, তবে রামন সানচেজ পিজুয়ানে ম্যাচটা বায়ার্নের জন্য একদমই সহজ ছিল না।
আপাতদৃষ্টিতে দেখলে মনে হতে পারে ম্যাচটি সেভিয়াই বায়ার্নকে উপহার দিয়েছে। আত্মবিশ্বাসে পরিপূর্ণ সেভিয়া দলটিকে ৩২ মিনিটে প্রথম গোল এনে দেন স্প্যানিশ মিডফিল্ডার পাওলো সারাবিয়া। ৫ মিনিট পরই সেভিয়ার ছন্দপতন। ফ্রাঙ্ক রিবেরির ক্রস ঠেকাতে গিয়ে নিজের জালে বল জড়িয়ে গোলে সমতা এনে দেন জেসুস নাভাস। দ্বিতীয়ার্ধে বায়ার্নের দ্বিতীয় গোলেও সেভিয়ার অবদান ছিল। রিবেরির ক্রস থিয়াগো আলকান্তারা হেড করে ঠিকি তবে গোলটি হয় সেভিয়া ডিফেন্ডার এসকুদেরোর পায়ে লেগে।
ঘরের মাঠে এমন দুর্ভাগ্যের শিকার হওয়া সেভিয়ার জন্য কষ্টদায়ক। অথচ দলের প্রধান প্লেয়ার এভার বানেগা ছাড়াই দারুণ শুরু করেছিল তারা। প্রথম লেগে এ হার তাদের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়ালো, বায়ার্ন মিউনিখ তাদের কাঙ্ক্ষিত অ্যাওয়ে গোলের সুবিধা নিয়ে এগিয়ে গেছে, সেভিয়া যদি ২ – ২ গোলে ড্র করে তবেও অ্যাওয়ে গোলের সুবিধা নিয়ে সেমি ফাইনালে যাওয়ার মর্যাদা পাবে বায়ার্ন মিউনিখ। সেকেন্ড লেগে তাই নূন্যতম ২ – ০ গোলে জিততেই হবে। তবে ঘরের মাঠে জাপ হেইঙ্কেস দল কতটা ভয়ংকর, সেভিয়া কোচ তা সম্ভবত বেশ ভালো করেই জানেন।
বার্সেলোনা বনাম রোমা
ম্যাচের আগের দিন ট্রেনিংয়ে চোট পেয়ে বার্সেলোনার সাথে প্রথম লেগ থেকে ছিটকে যান রোমার মাঝমাঠের ভরসা রাদজা নাইনগোলান। তাই ম্যাচের আগে থেকে রোমা যে চাপে ছিল সেটা অনুমেয়। অন্যদিকে, দলে নেলসন সেমেদো ও সার্জিও বুসকেটসকে ফিরে পেয়ে বার্সেলোনা ছিল ফুরফুরে মেজাজে। ম্যাচ শুরুর পর সেটাই ফুটে উঠল। বার্সেলোনা স্বভাবত ছোট ছোট পাসে আক্রমণ গড়ে রোমা উপকূলে হামলে পড়ছে তেমনই রোমা যেন বার্সেলোনাকে শুধু থামানোর চেষ্টা করে গেছে। তবে বার্সেলোনার স্টাইকাররা রোমা ডিফেন্সদের ব্যস্ত রাখলেও তাদের আক্রমণে পরিপূর্ণতার অভাব ছিল। যদিও কয়েকটি জোরালো আক্রমণগুলো থেমে গেছে রোমার গোলকিপার অ্যালিসনের হাতে।
তবে ক্যাম্প ন্যু-তে এসে একরকম ভুতুড়ে অভিজ্ঞতা হলো রোমার। রক্ষণে বেশি মনোযোগ দিতে দিয়ে আত্মঘাতী দুটো গোল করেছে তারা। ৩৮ মিনিটে করা ড্যানিয়েল ডি রসির আত্মঘাতী গোলটির রেশ অনেকদিন থেকে যাবে। মেসিকে বাড়ানো ইনিয়েস্তার ডিফেন্সচেরা পাসে পা বাড়িয়ে নিজের দলের গোলকিপারকে পরাস্ত করেন তিনি। ৫৫ মিনিটে ইভান রাকিটিচের বাড়ানো বলে ডিবক্সের ভেতর গোলমেলে পরিস্থিতিতে নিজের জালে বল জড়িয়ে ফেলে মানোলোনাস। এই নিয়ে এবারের উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লীগে মোট ৫ টি আত্মঘাতী গোলের দেখা পেল বার্সেলোনা, যেখানে দলের সর্বোচ্চ গোলদাতা লিওনেল মেসির গোলসংখ্যা ৬টি। বার্সেলোনার হয়ে বাকি গোলদুটি করেন জেরার্ড পিকে ও লুইস সুয়ারেজ, রোমার হয়ে একমাত্র গোল এডিন জেকো।
৪ – ১ গোলের বড় ব্যবধানে জয় নিয়ে মাঠ ছাড়লেও বার্সেলোনার জন্য সাফল্যের একটি দিন ছিল তা কিন্তু নয়। প্রথমার্ধের বিরক্তিকর অগোছালো ফুটবলের পর তাদের নিজস্ব খেলার পদ্ধতিতে তারা ফিরতে পারেনি। সুয়ারেজ যেমন গোল হাতছাড়া করেছেন তেমনই বলের দখল হারিয়েছেন। শিশুসুলভ ভুল করেছেন উমতিতিও, মেসি পর্যন্ত তার স্বভাবসলূভ ফুটবল খেলতে পারেননি। কয়েকটি ভালো ড্রিবল ও গোলমুখে দুর্বল কয়েকটি শট ছাড়া রোমা ডিফেন্ডারদের কড়া মার্কিংয়ের ভিড়ে তিনি নিষ্প্রভই ছিলেন। কিন্তু ম্যাচের পার্থক্য গড়ে দিয়েছে রোমা। তাদের উপহার দেওয়া গোলেই বার্সেলোনা এগিয়েছিল, পরবর্তীতে সুয়ারেজের গোলও ছিল তাদের ডিফেন্ডারের ভুলে।
ঘরের মাঠে ৪ গোলের জয়ের ফলে সেমিফাইনাল একরকম নিশ্চিত হয়ে গেল বার্সেলোনার। ২০ দিনে ৭ ম্যাচের ব্যস্ত শিডিউলের ভিড়ে যা অনেকটা স্বস্তি এনে দেবে কাতালোনিয়ানদের শিবিরে।
লিভারপুল বনাম ম্যানচেস্টার সিটি
বুধবার অ্যানফিল্ডে ম্যানচেস্টার সিটির হার মেনে নেওয়া কোয়ার্টার ফাইনাল একমাত্র অঘটনই বটে। উড়তে থাকা ম্যানচেস্টার সিটিকে ৩ – ০ গোলে বিধ্বস্ত করে মাটিতে নামিয়েছে জার্গেন ক্লপের লিভারপুলের। অথচ, সিজনের শুরু থেকে ধারাবাহিক ভালো পারফর্ম করা পেপ গার্দিওলার ম্যানচেস্টার সিটি ছিল এবার চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপার অন্যতম দাবীদার।
ইনজুরির কারণে সের্হিও আগুয়েরো দলে না থাকলেও, ব্রাজিলিয়ান ওয়ান্ডার বয় গ্যাব্রিয়েল জেসুস ছিলেন দলের মূল স্ট্রাইকার হিসেবে। তবুও পেপ গার্দিওলা একাদশ নামালেন ভিন্ন এক ফরমেশনে। বরাবরের ৪-৩-৩ ফরমেশনের বাইরে ৪-২-৩-১ ফরমেশনে অনভ্যস্ত ম্যানচেস্টার সিটি প্রথম থেকেই খেলার খেই হারিয়ে ফেলেছিল। রক্ষণভাগের ৪ জন খেলোয়াড়ের মধ্যে তিন জনই ছিলেন সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার। রাইটব্যাকে কাইল ওয়াকার থাকলেও প্রায়ই তাকে উঠে যেতে হয় রাইট মিডফিল্ড পজিশনে। এছাড়াও সাথে ডেভিড সিলভা, ইকায় গুন্ডোগান ও ফার্নানদিনহোরা থাকার পরেও দলের ইঞ্জিন খ্যাত কেভিন ডি ব্রুইন ছিলেন আড়ষ্ট। ক্লপের হাই প্রেসিং ফুটবলের সামনে সিটি যে দাঁড়াতেই পারেনি। পাল্লা দিয়ে ভুল পাস দিয়েছেন কোম্পানি ও লাপোর্তেরা। একের পর এক বল হারিয়েছেন নিজস্ব পজিশনে খাপ খাওয়াতে না পারা কাইল ওয়াকার।
আর সেকারণেই ম্যাচ শুরু হতে না হতেই, ১২ মিনিটের মাথায় প্রথম গোল আসে সিটি ডিফেন্ডারদের ভুলে। ডি বক্সের ভেতর গোলমুখে শট নেন রবার্তো ফিরমিনো, এডারসন শট ঠেকিয়ে দিলেও, বল ক্লিয়ার করতে ব্যর্থ হন নিকোলাস ওটামেন্ডি। ফিরতি বল পেয়ে গোল করে লিভারপুলকে এগিয়ে নেন ‘মো’ সালাহ। ২০ মিনিটে দ্বিতীয় গোলও সিটি প্লেয়ারদের ভুলে, জেমস মিলনারের পাস থেকে আনমার্কড অ্যালেক্স অক্সলেড-চেম্বারলেইনের ডি বক্সের বাইরে থেকে চমৎকার শটে লিভারপুলের হয়ে দ্বিতীয় গোলটি করেন। ৩১ মিনিটে সাদিও মানে’র গোলে প্রথমার্ধেই ৩ – ০ এর বড় ব্যবধানে এগিয়ে যায় লিভারপুল।
দ্বিতীয়ার্ধের শুরু থেকেই ম্যাচে ফেরে ম্যানচেস্টার সিটি। কিন্ত জার্গেন ক্লপ যেন ভিন্ন কিছু ভেবে রেখেছিলেন। দ্বিতীয়ার্ধে রক্ষণ সামলাতেই বেশি মনযোগী ছিলেন তার শিষ্যরা। তাই পরবর্তী ৪৫ মিনিটে টানা আক্রমণ করে গেলেও ম্যানচেস্টার সিটির ফরোয়ার্ডেরা লিভারপুলের রক্ষণ ভাঙতে পারেনি। অ্যানফিল্ডে কোনো অ্যাওয়ে গোল পায়নি সিটি। শিরোপা জয়ের স্বপ্ন ধরে রাখতে চাইলে ঘরের মাঠে যে বড় ব্যবধানের জয় পেতেই হবে।
Featured photos: AFP