গত বছর, অর্থ্যাৎ ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে, পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলায় নিজের বাড়ি যাচ্ছিলাম ছুটিতে। মাঝে রাস্তায় একদল লোক গাড়ি আটকে চাঁদা চাইল। পশ্চিমবঙ্গে সাধারণত চাঁদার মৌসুম শুরু হয় সেপ্টেম্বর মাসে বিশ্বকর্মা পূজা থেকে, আর চলে মোটামুটি ফেব্রুয়ারিতে সরস্বতী পূজা পর্যন্ত। এই অসময়ে চাঁদা তোলা দেখে একটু বিস্মিত হয়ে যখন জানতে চাইলাম কী ব্যাপার, লোকগুলো বলল, তারা রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের স্থানীয় কর্মী। এবছর হনুমান জয়ন্তী পালন করছে, তাই চাঁদা চাইছে।
ব্যাপারটা বেশ ভাবালো। ছোট থেকে পশ্চিমবঙ্গে কোনোদিন ঢাকঢোল নিয়ে রামনবমী বা হনুমান জয়ন্তী পালিত হতে দেখিনি। যতটুকু হতো আয়োজক ছিল কোনো ব্যক্তি বা সম্প্রদায়, কিন্তু কোনো রাজনৈতিক দলকে, বিশেষ করে শাসকদলকে এই নিয়ে হৈচৈ করতে দেখা যায়নি। কিন্তু এখন এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
গেরুয়াবাহিনীর দেখাদেখি তৃণমূলও নামল রামনবমী পালন করতে
যে ভয়টা পেয়েছিলাম, এক বছরের মধ্যেই সেটা ঘটল। ২০১৮ সালের রামনবমী উদযাপনকে কেন্দ্র করে আগুন জ্বলল পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিমাঞ্চলের রানীগঞ্জ এবং আসানসোল এলাকায়। রামচন্দ্রের জন্মতিথি উপলক্ষ্যে উদযাপিত এই অনুষ্ঠানে পশ্চিমবঙ্গের ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি), রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ এবং বিশ্ব হিন্দু পরিষদের কর্মীরা অস্ত্র হাতে মিছিলে বেরোয়। আর তাদের দেখাদেখি শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসও মিছিল বের করে, পাছে সংখ্যাগুরু হিন্দু ভোট যেন তাদের হাতছাড়া না হয়ে যায়।
তৃণমূলের নেতৃত্বের ধারণা ছিল যে, এই সুবাদে আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনের জনসংযোগের কাজটিও হয়ে যাবে। আদতে দেখা গেল, এই রাম নবমীকে কেন্দ্র করে তুমুল সংঘর্ষ হলো, যাতে প্রাণও গেল কিছু মানুষের। বিশ্রীভাবে আক্রমণ করা হলো পুলিশকে।
অবস্থা বেগতিক দেখে তৃণমূল নেতারা করতে লাগলেন উন্নয়নের ভজনা
আর এই চরম অশান্তির পরে তৃণমূল কংগ্রেসের বিভিন্ন নেতাকে বলতে শোনা গেল, রাম-হনুমান জয়ন্তী উদযাপনের পরে দল চাইছে উন্নয়নের বুলি নিয়ে ঝাঁপাতে। মুখে অবশ্য বলা হয়েছে যে এটি কৌশলগত বদল। কিন্তু আসল ঘটনা হলো, গেরুয়াবাহিনীর সঙ্গে রাজনীতির খেলা খেলতে গিয়ে তৃণমূলীরা বুঝেছে গণ্ডগোলটা কোথায় হয়েছে। দলের দিশাহীনতা তো প্রকট হয়েছেই, পাশাপাশি তাদের প্রশাসনও যে শক্ত হাতে দায়িত্ব পালন করতে পারেনি, সেটিও পরিস্কার হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গে নিজেদের শক্তিবৃদ্ধি করতে মরিয়া বিজেপি রামনবমী বা হনুমান জয়ন্তীর মতো উৎসবকে হাতিয়ার করে যে এগুবে, তা নিয়ে দ্বিমত নেই কারোরই। এই রাজ্যে এখনও পর্যন্ত ক্ষমতা না পেলেও বিজেপির উত্থান গত কয়েকবছরে দ্রুত ঘটেছে। আসনের নিরিখে পিছিয়ে থাকলেও রাজ্যের সবচেয়ে সক্রিয় বিরোধী দল হিসেবে বিজেপি বাম এবং কংগ্রেসকে পিছনে ফেলে দিয়ে মমতাদেবীর অস্বস্তি বাড়িয়েছে বেশ খানিকটা।
সম্প্রতি উত্তর-পূর্ব ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে সরাসরি লড়াইতে বামদের কুপোকাত করে বিজেপির ক্ষমতা হাসিলও মমতার কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে। তৃণমূল নেতৃত্ব এতদিন চাইছিলেন যে, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি যতদিন বাম এবং কংগ্রেসের ভোটে ভাগ বসাবে, ততদিন তাদের কেল্লা ফতে। কিন্তু ভোট রাজনীতির বাইরের আঙিনায় বিজেপি এখন তৃণমূলকেই বড় চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে হিন্দুবাদী উৎসব পালন, অস্ত্রের ঝনঝনানি ইত্যাদি করে। আর তাই ঠ্যালায় পড়ে মমতার দলকেও হনুমান চালিসা পড়তে হচ্ছে।
তৃণমূলের নীতিহীনতাই তাদের দিশাহীনতার কারণ
ঘটনা হচ্ছে, তৃণমূলের এই দিশাহীনতা আখেরে প্রমাণ করে যে, দল হিসেবে তাদের কোনো রাজনৈতিক নীতি বা আদর্শ নেই। মমতা বন্দোপাধ্যায়কে প্রায়ই বলতে শোনা যায়, তার প্রশাসন পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে কোনো দাঙ্গা হতে দেবে না; বাংলার ধরণী সাম্প্রদায়িকতার রক্তে লাল হবে না। কিন্তু শেষমেশ আমরা দেখলাম, বিজেপি জুজুতে ভীত হয়ে তার দল দক্ষিণপন্থী রাজনীতির আশ্রয় নিচ্ছে এবং রামনবমীতে মিছিল বের করছে।
এই নিয়ে বেশ কয়েকবার পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িক উস্কানি এবং মারদাঙ্গা প্রত্যক্ষ করা গেল। কিন্তু রাজ্যের রাজ্যপালের সঙ্গে বাগবিতণ্ডায় জড়ানো বা বিরোধীদের সংঘর্ষের এলাকায় যাওয়া আটকানো ছাড়া মুখ্যমন্ত্রী এবং তার প্রশাসনকে বিশেষ কিছুই করতে দেখা যায় না। যদি দাঙ্গা আটকাতেই হয়, তাহলে প্রশাসনকে বজ্রমুষ্ঠি নিয়ে মাঠে নামতে হয়। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে তা কিন্তু বিশেষ দেখা যাচ্ছে না, আর ভয়টা সেখানেই।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনীতিতে কংগ্রেসের ছোঁয়া রয়েছে অনেকটাই। আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে ভারতে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির ক্রমবর্ধমান প্রভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীও (যার নেতৃত্বেই মমতার রাজনৈতিক পথ চলা শুরু) নরম হিন্দুত্ববাদীর দিকে ঝোঁকেন। কারণ, নেহেরুর ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শের ধারার বাহক হয়ে কংগ্রেসের পক্ষে কট্টর হিন্দুত্ববাদী হওয়া সম্ভব ছিল না। আর তাতেই কংগ্রেসের হয় নিদারুণ পতন।
দুই কুল রাখতে গিয়ে কংগ্রেস দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের চক্ষুশূল হয়, আর তাকে হাতিয়ার করে বাজিমাত করে বিজেপি। পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান প্রেক্ষাপটেও দেখা যাচ্ছে প্রায় একই চিত্র। বিজেপির ক্রমাগত উত্থানের জবাব না খুঁজে পেয়ে মমতার দল তাদের হিন্দুত্ববাদী খেলাই খেলতে শুরু করে। আর তাতে জনসাধারণের চোখে আরও হাস্যস্পদ হয় তারা।
গণমাধ্যম এবং সুশীল সমাজের ব্যর্থতাও কম নয়
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই রাজনৈতিক ব্যর্থতার একটি বড় কারণ হলো পশ্চিমবঙ্গের গণমাধ্যম এবং সুশীল সমাজের ব্যর্থতা। যে কোনো প্রশাসন যখন নিজের কাজ ঠিকভাবে করতে ব্যর্থ হয়, তখন গণমাধ্যম এবং সুশীল সমাজের দায়িত্ব হচ্ছে তার গঠনমূলক সমালোচনা করে তাকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনা। পশ্চিমবঙ্গে এই দুটি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের ভূমিকাই এ বিষয়ে নেতিবাচক।
এই রাজ্যের গণমাধ্যমগুলো সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের ঘটনাগুলোর ব্যাপারে আশ্চর্যরকমভাবে স্থবিরতা পালন করছে। তাদের সংবাদবর্ণনা এবং বক্তব্যগুলো যথেষ্ঠ রকম অপর্যাপ্ত এবং গা-বাঁচানো। অন্যদিকে, যে নাগরিক সমাজ অতীতে বাম সরকারের শেষ সময়ে পান থেকে চুন খসলেই গর্জে উঠত, তাদেরকেও বিশেষ বিরোধী অবস্থান নিতে দেখা যাচ্ছে না।
বিরোধী বা বিশ্লেষকদের মতে তারা চুপ রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা হারানোর ভয়ে। কিন্তু এদিকে এই স্তব্ধতা ক্ষতি করছে শাসকেরই। কারণ, সে নিজের ব্যর্থতাকে উপলব্ধি করতে পারছে না। রাজ্যের মানুষের ভবিষ্যৎ আরও গভীর বিপদের সম্মুখীন হচ্ছে।
কেন বামের থেকে রাম মমতার কাছে বেশি কঠিন বিপক্ষ
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বরাবর লড়েছেন সিপিআইএম এর বিরুদ্ধে। সেই লড়াই ছিল সাদা-কালোয়, দলীয় অপশাসনের বিরুদ্ধে ব্যক্তির আদর্শের। কিন্তু ক্ষমতাসীন মমতার কাছে বিরোধী বিজেপি বেশ কড়া চ্যালেঞ্জ। কারণ, এক তো তিনি এই হিন্দুবাদী রাজনীতিতে সেভাবে অভ্যস্ত নন। পশ্চিমবঙ্গে বিভাজনের রাজনীতি প্রধানত দলকেন্দ্রিক হয়ে থাকে। বিজেপির উত্থানের পরে সেটি সাম্প্রদায়িকও হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখানেই দিশা হারিয়েছেন।
বামদের হারানোর জন্যে তাকে হিন্দু-মুসলমানের অঙ্ক কষতে হয়নি। কারণ, ধর্ম-মত নির্বিশেষে সবারই আক্রোশ ছিল বামদের বিরুদ্ধে। কিন্তু এখন বিজেপি বিভাজনের রাজনীতি করছে সম্প্রদায়কে ঘিরে। আর যেহেতু মমতা নিজেকে সংখ্যাগরিষ্ঠদের মসিহা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন এই কয়েক বছরের নির্বাচনী কারণে, তার পক্ষে এখন বিজেপির মতো সংখ্যাগরিষ্ঠদের মন পাওয়ার চেষ্টা লোকদেখানো হয়ে দাঁড়াবে।
সম্প্রতি রামনবমী উদযাপনে সেটাই হয়েছে। আর তাছাড়া, পশ্চিমবঙ্গের এক বড় অংশ মনে করে যে এই রাজ্যে বিজেপিকে মমতাই এনেছিলেন অতীতে নিজের রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্যে। আর এখন সেই বিজেপিই তার ঘাড়ে চেপে বসেছে। এই বিশ্বাসযোগ্যতার অবক্ষয় মমতার চ্যালেঞ্জকে আরও কঠিন করে তুলছে।
একথা ঠিক যে, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কোনো বিকল্প এখনও নেই; তা সে গেরুয়াবাহিনী যতই অস্ত্র নিয়ে ঝনঝনানি করুক না কেন। বিগত ত্রিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে মমতা একজন জনপ্রিয় নেত্রী হিসেবে যে জায়গা তৈরি করেছেন, সেরকম এই মুহূর্তে আর কারও নেই।
জননেত্রী মমতা এবং প্রশাসক মমতার মধ্যে গুণগত ফারাক অনেক
কিন্তু, একই সঙ্গে এটিও ঠিক যে, লড়াকু জননেত্রী মমতা এবং প্রশাসক মমতার মধ্যে গুণগত ফারাক আছে অনেকটাই। সংখ্যালঘুদের জন্যে উন্নয়ন আদতে মমতার এক প্রতীকী রাজনীতি। তাছাড়া বাম জমানার তুলনায় মমতার পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘিষ্ঠদের উন্নয়নের হার এমন কিছু বিরাট নয়। আর এই ফারাক প্রশাসক মমতার রাশ আলগা করছে, তার সুনাম নষ্ট করছে, সুবিধা করে দিচ্ছে বিজেপিকে।
যতদিন বামেরা বিরোধী আসনে ছিল, মমতার প্রশাসনিক দুর্বলতাগুলো তাও ঢেকে যেত ‘অকর্মণ্য’ বামেদের লক্ষ্য করে আক্রমণ শানালে। কিন্তু বিজেপি বামদের থেকে এই মুহূর্ত অনেক বেশি সক্রিয় এবং শক্তিশালী ভারতীয় রাজনীতিতে। তাদের সামলাতে মমতাকে অন্যরকম রাজনীতির কথা ভাবতে হবে, আরও গভীরে গিয়ে। নতুবা আগামী নির্বাচনগুলোতে কেবল প্রবল জনপ্রিয়তা মমতার জয়ের পথ প্রশস্ত না-ও করতে পারে।
Featured Image Source: DNA India