২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে সংবাদমাধ্যমের তরফ থেকে প্রায়শই একটি প্রশ্ন করা হতো ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নরেন্দ্র মোদীকে। “বিজেপি যদি সরকার গড়ার মতো জায়গায় আসে, তাহলে দলের মুখপাত্র হিসাবে কি তিনি জোটসঙ্গীদের নিয়ে চলতে পারবেন?” এটিই ছিল প্রশ্ন। মোদী বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই “সে তখন দেখা যাবে” বলে দায় সারতেন। সেই সময়টি অবশ্য আসেনি মোদীর রাজনৈতিক জীবনে। কারণ, বিজেপি সেই নির্বাচনে একাই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়; এনডিএ বা ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স থাকলেও সরকার বাঁচাতে কখনো জোটসঙ্গীদের দরকার পড়েনি মোদীর। পড়লে তার মতো ‘বিভাজনকারী ব্যক্তিত্ব’ হিসাবে অভিযুক্ত নেতা কতটা সবাইকে নিয়ে চলতে পারতেন, সে ব্যাপারে অনেকে আজও সন্দেহ প্রকাশ করেন।
অন্ধ্রপ্রদেশ নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে টিডিপির মোদীকে সাবধানবাণী
কিন্তু ২০১৪ সালে জোটসঙ্গী সামলানোর মতো পরিস্থিতি না এলেও ২০১৮র শুরুর দিকে মোদীর সামনে সেই চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে তেলেগু দেশম পার্টি বা টিডিপি নামক জোটসঙ্গী। দক্ষিণ-পূর্ব ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্যে ক্ষমতায় থাকা এই দলটির নেতৃত্বের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের দূরত্ব অনেকদিন ধরেই বাড়ছিল অন্ধ্রকে বিশেষ রাজ্যের তকমা দেওয়ার দাবি নিয়ে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডু এই মর্মে বারবার কেন্দ্রকে আর্জি জানালেও, কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুন জেটলি সম্প্রতি এই প্রস্তাব খারিজ করে দেন। আর তারপরেই নড়েচড়ে বসে অন্ধ্রপ্রদেশের শাসকদল।
চলতি মার্চের শুরুর দিকে কেন্দ্রীয় সরকার থেকে টিডিপির দুই মন্ত্রী ইস্তফা দেন। যদিও টিডিপি সরকারিভাবে এনডিএ ত্যাগ করেছে কিনা, তা নিয়ে তারা পরিষ্কার কিছু বলেননি। তারা বলেন যে, কেন্দ্রীয় সরকার তাদের আর্থিক সাহায্য করলেও, বিশেষ তকমার মতো একটি আবেগস্থানীয় বিষয়ে কেন্দ্রের ঔদাসীন্য তাদের ব্যথিত করেছে।
অন্ধ্রপ্রদেশের জন্যে বিশেষ তকমার দাবি আসলে পপুলিস্ট রাজনীতি
চন্দ্রবাবু এবং তার টিডিপির আসল সমস্যা বিজেপি নয়। বরং ২০১৪ সালে মোদী হাওয়ার উপর ভর করেই তারা বিভাজিত অন্ধ্রপ্রদেশে ক্ষমতায় আসে জনপ্রিয় নেতা জগন্মোহন রেড্ডির ওয়াইএসআর কংগ্রেসকে হারিয়ে। টিডিপির আসল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে আগামী বছরের বিধানসভা নির্বাচনে জিতে ফের ক্ষমতায় আসা। আর সেই কারণেই তারা রাজ্যের বিশেষ তকমার দাবি নিয়ে উঠেপড়ে লেগেছে। এমনকি বিশেষ তকমার বদলে আর্থিক সাহায্য পেতেও টিডিপি নেতৃত্ব নারাজ।
টিডিপি একদিকে যেমন গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে জর্জরিত, তেমনই দলের নেতৃত্বের ভয়, ইদানিং বিজেপি বোধহয় জগন্মোহনের দিকে বেশি ঝুঁকছে। এই আশঙ্কা সত্যি হলে আগামী নির্বাচনে টিডিপির পক্ষে প্রতিষ্ঠানবিরোধী হাওয়াকে পরাজিত করা বেশ কঠিন হয়ে যাবে। আর তাই অন্ধ্রের জন্যে বিশেষ তকমার জোরদার দাবি তুলে তারা রাজ্যের জনগণকে ইতিবাচক বার্তা দিতে মরিয়া। আর যদি সেই তকমা শেষ পর্যন্ত না আসে, তাহলে চন্দ্রবাবু সরকার সোজাসুজি নরেন্দ্র মোদী সরকারের দিকে আঙুল তুলে নিজের দায় সারবে। কিন্তু চন্দ্রবাবুর দলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা থাকলেও বিজেপি জানে, একটিমাত্র রাজ্যকে বিশেষ ছাড় দিলে দেশের অন্যান্য অনেক রাজ্যই ক্ষুব্ধ হবে আর একটি সর্বভারতীয় দল হিসাবে তা বিজেপির পক্ষে স্বস্তিদায়ক হবে না।
তবে এনডিএ ছেড়ে আসার সিদ্ধান্ত টিডিপি যদি শেষ পর্যন্ত নেয়ও বা, তাদের পক্ষে অন্ধ্রপ্রদেশের রাজ্য-রাজনীতিতে কতটা সুবিধা করা সম্ভব হবে, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। কারণ, প্রথমত টিডিপির পক্ষে বিজেপির হাত ছেড়ে কংগ্রেসের হাত ধরা সম্ভব নয়। কেননা টিডিপির ভিত্তিই হচ্ছে কংগ্রেসের বিরোধিতা করা। আর তাছাড়া এখন জগন্মোহনের দল কংগ্রেসের ভোটব্যাংকে ভালোই থাবা বসিয়েছে। এদিকে যেহেতু ওয়াইএসআর কংগ্রেসের সঙ্গে টিডিপির কোনো গাঁটছড়া বাঁধাই সম্ভব নয়, তাই মোদীর সংযাগ মানে চন্দ্রবাবুর সামনে একটাই পথ খোলা- হয় একলা চলো, নয়তো নতুন যে তৃতীয় ফ্রন্ট তৈরির কথা হচ্ছে, তাতে অংশগ্রহণ করা।
কিন্তু এবারের তৃতীয় ফ্রন্ট তৈরির প্রস্তাব যেহেতু দিয়েছেন প্রতিবেশী তেলাঙ্গানা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কে চন্দ্রশেখর রাও, যিনি কিনা আবার অন্ধ্রকে পয়লা নম্বর প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবেন, সেখানে চন্দ্রবাবুর অবস্থান কতটা জোরালো হবে তা বলা শক্ত।
জোট ভাঙলে তা মোদীর পক্ষে চ্যালেঞ্জ অন্য কারণে
অবশ্য চন্দ্রবাবুর ‘প্রেশার ট্যাক্টিক’ এর একটি অন্য তাৎপর্য রয়েছে। আর সেটি মোদীর জন্য আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যদিও গণিতের দিক থেকে টিডিপির এনডিএ থেকে প্রস্থান বিশেষ পার্থক্য করে তা নয়, কিন্তু রসায়নের ক্ষেত্রে তা ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনের আগে বিশেষ বার্তা দেয় বৈকি।
মোদীকে এখনও পূর্বতন বিজেপি প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ির মতো জোটচালনার কাজ করতে হয়নি সেভাবে ঠিকই, কিন্তু চন্দ্রবাবুর টিডিপি যদি সত্যিই বেরিয়ে যায় মোদীর সঙ্গে ছেড়ে, তবে তা বিজেপির অন্যান্য জোটসঙ্গীকে এবং বিজেপি-বিরোধী দলগুলিকে আশান্বিত করবে। মহারাষ্ট্রে শিবসেনা, গোয়াতে মহারাষ্ট্র গোমন্তক পার্টি এবং গোয়া ফরওয়ার্ড পার্টি কিংবা পাঞ্জাবে শিরোমণি অকালি দলের মতো জোটসঙ্গীদের সঙ্গে বিজেপির সম্পর্কে টানাপোড়েন দেখা গেছে অনেক সময়েই। বিহারে কিছুদিন আগপর্যন্তও নীতীশকুমারের সংযুক্ত জনতা দলের সঙ্গে বিজেপির সম্পর্ক ভালো ছিল না।
এনডিএ থেকে টিডিপির বিদায় যদি ঘটে, তবে তাহলে বিজেপির অন্যান্য অনেক অসন্তুষ্ট জোটসঙ্গীও ভবিষ্যতের কৌশল তৈরি করতে কালক্ষেপণ করবে না। বিজেপির একপেশে কর্তৃত্ব এই মুহূর্তে তাদের নিজেদের অনেক জোটসঙ্গীরই অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চন্দ্রবাবু যদি বিজেপিকে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, তবে আরও অনেকেই মনে করতে শুরু করবেন যে মোদী অপরিহার্য নয়।
২০১৯ সালের জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল কোনদিকে যাবে তা বলা কঠিন। মোদীর পাল্লা ভারী থাকলেও এই নির্বাচনে তাকে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার সম্মুখীন হতে হবে, যা ২০১৪ সালে ছিল না। আর যদি বিজেপি আগেরবারের মতো একাই সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পায়, তাহলে মোদীকে জোটধর্মের পথে হাঁটতেই হবে। অন্যান্য নানা ব্যাপারে কারিকুরি দেখালেও মোদী এবং তার সেনাপতি বিজেপির জাতীয় সভাপতি অমিত শাহ এখনও এই বিষয়টিতে নিজেদের দক্ষতা দেখানোর সুযোগ সেভাবে পাননি। আর চন্দ্রবাবুর মতো ধুরন্ধর রাজনীতিবিদরা এখানেই বাজিমাত করতে চাইছেন।
সামনের বছর ভারতের জাতীয় এবং অন্ধ্রপ্রদেশের রাজ্য নির্বাচন একই সময়ে অনুষ্ঠিত হবে। আর তাই সেই সময়ে যদি বিজেপির কোনো কারণে জোটসঙ্গীর প্রয়োজন পড়ে, তবে চন্দ্রবাবুও নিজের রাজ্যের বিশেষ তকমার দাবি নিয়ে ফের সরব হতে পারেন কেন্দ্রে বিজেপিকে সমর্থন করার বিনিময়ে।
কে বলে রাজনীতিবিদরা দূরদৰ্শিতাসম্পন্ন হন না?
ফিচার ইমেজ: Indian Express