ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি রাহুল গান্ধী মার্চে নয়াদিল্লিতে তার দলের প্লেনারি অধিবেশনে সভাপতি হিসেবে প্রথম বক্তব্য পেশ করলেন। বরং বলা ভালো, রীতিমতো ঝোড়ো ব্যাটিং করলেন। রাহুল গান্ধী এর আগেও কয়েকবার কংগ্রেস দলের অধিবেশনে ক্রোধ এবং আবেগের মতো অনুভূতি প্রকাশ করেছেন; বিপক্ষকে বিধেছেন দুর্নীতি বা সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে। কিন্তু এবারে সেই সমস্ত প্রশ্ন ছাড়াও যোগ করলেন অন্য এক মাত্রাও, আর তা হলো হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির।
রাহুল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘকে (আরএসএস) তুলনা করেছেন কৌরবদের সঙ্গে, যারা শুধুমাত্র ক্ষমতার জন্যে লালায়িত। আর অন্যদিকে তিনি কংগ্রেসের তুলনা করেন পাণ্ডবদের সঙ্গে, যারা তার মতে প্রকৃত সত্যান্বেষী। রাহুল এটাও বলেন যে, ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজেকে মানুষ নয়, ভাবেন ভগবানেরই কোনো অবতার।
রাহুলের এই বক্তব্য কিন্তু যথেষ্ঠ গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের রাজনীতিতে পাণ্ডব-কৌরবদের উল্লেখ সাধারণত বিজেপির নেতা-নেত্রীদের মুখেই বেশি শোনা যায়। তাদের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির সঙ্গে মহাভারত-রামায়ণের প্রসঙ্গ খাপ খায় ভালোভাবে এবং ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের সঙ্গে হৃদয়ের সংযোগ স্থাপনে ওই দুই মহাকাব্যের ভূমিকাকে কখনই খাটো করা চলে না।
কিন্তু তাই বলে কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্বের মুখেও আজ কৌরব-পাণ্ডব?
আসলে রাজনীতিতে ঠ্যালার নাম বাবাজি। গত কয়েক বছরে একের পর এক নির্বাচনী লড়াইতে পর্যুদস্ত হতে হতে কংগ্রেস বুঝে গেছে, পুরনো সেই দিনের কথা দিয়ে চিড়া আজ আর ভিজবে না। যে নেহেরুবাদী ধর্মনিরপেক্ষতার মোড়কে কংগ্রেস এক সামাজিক-রাজনৈতিক মঞ্চ তৈরি করে সকলকে নিয়ে চলার রাজনীতি করতো, কালের প্রবাহে আজ তা চূর্ণ। ক্ষমতার মুখ কেন্দ্রীভূত করতে গিয়ে কংগ্রেস নিজেদের তৃণমূলের সংগঠনকে নড়বড়ে করেছে আর তাতেই ঘটেছে চূড়ান্ত নির্বাচনী বিপর্যয়।
পাশাপাশি, বছরের পর বছর ধরে সংখ্যালঘিষ্ঠদের ভোট নিজেদের ঝুলিতে পুরে কংগ্রেস অভিযুক্ত হয়েছে তোষণের রাজনীতি করার অভিযোগে। এর সম্মিলিত ফলে কংগ্রেসের যে পতন ঘটেছে বিগত কয়েক দশকে, তার ষোলো আনা ফায়দা তুলেছে বিজেপি এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো। রাজনৈতিকভাবে বা আঞ্চলিক বা ধর্মীয় আবেগ- বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিভিন্নভাবে কংগ্রেসের পতনের ফায়দা তুলেছে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে। আর তাই সেই হারানো জমি উদ্ধার করতে, বিশেষ করে বিজেপির গ্রাস থেকে নিজের দলের অস্তিত্ব রক্ষা করতে রাহুল গান্ধীর মুখে আজ এই সুর।
ইন্দিরা গান্ধী-রাজীব গান্ধীরাও একসময়ে নরম হিন্দুত্বের পথে হেঁটেছিলেন
কংগ্রেসের দোর্দণ্ডপ্রতাপ প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তার শাসনকালের শেষ সময়ে ভারতের রাজনীতিতে দক্ষিণপন্থী হিন্দুত্ববাদীদের উত্থান সম্পর্কে সচেতন হয়ে নিজেও একধরনের নরম হিন্দুত্বের রাজনীতির উদ্যোগ নিয়েছিলেন; লক্ষ্য ছিল দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটটি হাতছাড়া না করার। ইন্দিরার মৃত্যুর পরে রাজীব গান্ধীও সেই একই কৌশল নেন এবং সে রাস্তায় অনেকটা এগোনও।
আশির দশকের শেষের দিকে প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন রাজীব গান্ধী স্বয়ং দেশের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রককে বলেন ভারতের জাতীয় টেলিভিশনে এমন কিছু দেখাতে, যাতে দেশের অতীত মূল্যবোধ সম্পর্কে জনমানসে আরও সচেতনতা আসে। এর ফলে জন্ম হয় রামায়ণ এবং মহাভারতের মতো দুটি মেগা-সিরিয়ালের এবং কংগ্রেসের নরম হিন্দুত্বের রাজনীতি-সমাজনীতি আরও একটু বিকশিত হয়।
বিজেপি এই সুযোগেরই অপেক্ষায় ছিল। তারা জানতো যে কংগ্রেসের পক্ষে এই হিন্দুত্ববাদের রাজনীতি বেশিদূর খেলা সম্ভব হবে না। কারণ দলটির একটি নেহরুবাদী ধর্মনিরপেক্ষতার প্রেক্ষাপট রয়েছে, যার দরুন দেশের গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যালঘু ভোট তাদের ঝুলিতে যায়। সেদিক থেকে বিজেপির উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি করার পথে কোনো অন্তরায় ছিল না, কারণ তাদের জন্মই ভারতে হিন্দুরাষ্ট্র গড়ার লক্ষ্যে।
তাই কংগ্রেসের খেলা তাসকে হাতিয়ার করে বিজেপি তাকে আরও উচ্চতায় নিয়ে গেল পরবর্তী দিনগুলিতে। রামমন্দির আন্দোলন শুরু হলো, পথে নামানো হলো রথ; ভাঙা হলো বাবরি মসজিদ; মুম্বাইতে হলো দাঙ্গা ইত্যাদি। অন্যদিকে, কংগ্রেসের শীর্ষ নেতা রাজীব গান্ধীর আকস্মিক হত্যাকাণ্ডে দল যেমন দিশা হারালো, তেমনি সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটব্যাঙ্ক হারানোর ভয়ে অক্রিয়ই হয়ে রইল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পি ভি নরসিংহ রাওয়ের সংখ্যালঘু সরকার। যদিও বাবরি মসজিদ ভাঙনের পর কংগ্রেসের নেতৃত্বের সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি।
চূড়ান্ত কোণঠাসা কংগ্রেসের আজ নতুন কিছু করার প্রয়োজন, আর নতুন মানে ‘হিন্দুত্ব’ রাজনীতি
১৯৯২ সালের ডিসেম্বর মাসে বাবরি মসজিদ ভাঙা পড়ার পর ২৫ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে কিন্তু কংগ্রেস এই সময়ে বেশ কয়েকবার ক্ষমতায় এলেও তাদের সেই পুরনো কর্তৃত্ব দেখতে পাওয়া যায়নি আর। হয় মিলিজুলি সরকারের নেতৃত্ব দেওয়া, আর নয়তো বিজেপির বিরোধিতা করা- কংগ্রেসের রাজনৈতিক ভূমিকা এখন এতেই সীমাবদ্ধ। আর ভবিষ্যতে ফের ক্ষমতার মসনদে ফিরতে তাদের প্রয়োজন নতুন কিছু করে দেখানোর।
আর এই নতুন কিছুই হচ্ছে রাহুল গান্ধীর গলায় হিন্দুবাদী সুর। ২০০৪ সালে যখন রাহুল প্রথম রাজনীতিতে আসেন, তখন একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন যে, তাদের কাছে আসল ধর্ম হচ্ছে ভারত। কিন্তু আজকে মোদীময় ভারতে রাহুল বুঝেছেন, শুধু কথার কারিকুরিতে ভোটাররা আর ভোলার নয়। আর তাই বিজেপির মোকাবিলায় তিনি চলতে শুরু করেছেন বিজেপির দেখানো পথেই। অসংখ্য মন্দিরে পুজো দিচ্ছেন; কংগ্রেসকে পাণ্ডব আখ্যা দিয়ে বোঝাতে চাইছেন, তিনিও ধর্মযুদ্ধে লড়ছেন ‘অধর্মের’ বিরুদ্ধে। এই সমস্ত কাজের মধ্যে দিয়ে যে ভারতের আম ভোটারের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা সহজতর হয়, সেটা অবশেষে রাহুল গান্ধী বুঝেছেন।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, হিন্দুবাদী কথাবার্তা বললেও রাহুল প্রধানমন্ত্রী মোদীর মতো নেতৃত্ব দেবেন কোথা থেকে? প্রধানমন্ত্রীর পদবি ‘মোদী’কে লক্ষ্য করে আক্রমণ ছুঁড়ছেন; এক করে দেখানোর চেষ্টা করছেন অভিযুক্ত নীরব মোদী বা ললিত মোদীর সঙ্গে; ঠিক যেমন বিজেপি অতীতে তার বিখ্যাত পদবি ‘গান্ধী’কে লক্ষ্য করে ছুঁড়েছে উপহাস। কিন্তু ভারতের শত-কোটি সাধারণ ভোটার কতটা প্রভাবিত হবে এতে? প্রধানমন্ত্রী এবং তার সেনাপতি অমিত শাহকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করে রাহুল কতটা সাহায্য করতে পারবেন কংগ্রেসকে?
ব্যক্তিগত আক্রমণে নরেন্দ্র মোদীকে ঘায়েল করা সম্ভব নয়
এই মুহূর্তে নরেন্দ্র মোদীকে শুধুমাত্র কয়েকটি নাগরিক দুর্নীতির প্রশ্নের ঘায়েল করা সম্ভব নয়। পূর্বতন মনমোহন সিংহের সরকার দুর্নীতির নানা প্রশ্নে জর্জরিত হলেও মোদী সরকারের এ ব্যাপারে কিন্তু ভাবমূর্তি যথেষ্ঠ সচ্ছল। আর তাছাড়া নেতৃত্বের প্রশ্নে মোদী এখনও সিংহভাগ ভারতীয়র কাছেই সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য নেতা। রাহুল গান্ধী নিজেই সেখানে এখনও সেরকম জনপ্রিয় নন এবং প্রশাসক হিসেবেও তার কোনো অভিজ্ঞতা নেই। গণমাধ্যমেও রাহুলের ভাবমূর্তি খুব ইতিবাচক নয়। অতএব, এই সমস্ত প্রতিকূলতা কাটিয়ে রাতারাতি মোদীকে চ্যালেঞ্জ জানানো কংগ্রেস সভাপতির কাছে কতটা সহজ হবে, তা ভাবনার বিষয়।
হয়তো গত ডিসেম্বর মাসে মোদীর রাজ্য গুজরাটে কংগ্রেসের অপেক্ষাকৃত ভালো ফল রাহুলকে উজ্জীবিত করেছে। ওই নির্বাচনের সময়ে রাহুল বেশ কিছু মন্দিরে পুজো দিয়েছিলেন, আর তাই হয়তো কংগ্রেস ভাবছে হিন্দুত্বের তাস ফের খেলতে শুরু করলেই বিজেপিকে হারানো যাবে। ব্যাপারটি আসলে ততটা সহজ নয়। হিন্দুত্বের রাজনীতি গুরুত্বপূর্ণ হলেও রাহুলকে সর্বপ্রথমে ভাবতে হবে মোদীর বিকল্প তৈরি করার কথা। বলতে হবে, কীভাবে কংগ্রেসের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রজ্ঞা বিজেপির থেকে আলাদা। ব্যক্তিগত আক্রমণে হিতে-বিপরীত হতে সময় লাগবে না। অতীতে গুজরাট বিধানসভা নির্বাচনে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে লক্ষ্য করে কংগ্রেস তার ফল হাতেনাতে পেয়েছেও। তবুও রাহুল সেই একই রাজনীতি থেকে সরে আসতে পারছেন না; বরং তাতে আরও যোগ করছেন নৈতিক আবেদন। তবে তাতে কাজ হাসিল হওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত কম বলেই মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে।
Featured Image Source: Newsmobile