Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

নরেন্দ্র মোদী নির্বাচন জিততে ভালোবাসেন; কিন্তু সেটিই কি সব?

ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচনের রমরমা চিরকালীন। রাজনৈতিকভাবে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে আরও একবার নিজেদের জনপ্রিয়তা এবং পেশিশক্তি ঝালিয়ে নেওয়ার এক নিদারুণ সুযোগ দলগুলোকে করে দেয় ভারতের এই অন্তহীন নির্বাচনী প্রক্রিয়া। আর এখন এই নির্বাচনী লড়াইয়ে আছে উত্তরপূর্ব ভারতের বামশাসিত রাজ্য ত্রিপুরা।

কেন্দ্রের শাসকদল ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপি স্বাভাবিকভাবেই ঝাঁপিয়েছে আরও একটি রাজ্য বগলদাবা করতে। ২০১৩-১৪ সাল থেকে বিজেপির অশ্বমেধের ঘোড়া সারা দেশের অনেক রাজ্যেই দাপিয়ে বেরিয়েছে। নতুন অনেক রাজ্যে গেরুয়াদল ক্ষমতায় এসেছে। আবার অনেক রাজ্যে, যেখানে তারা সেভাবে কোনোদিন দাগ কাটতে পারেনি, সেখানেও তারা নিজেদের প্রভাব যথেষ্ঠ বাড়িয়েছে। বিশেষ করে, যেসমস্ত রাজ্যে বামেরা এতকাল কর্তৃত্ব ফলিয়ে এসেছে, সেখানে বিজেপির উত্থান সৃষ্টি করেছে এক সংঘাতপূর্ণ রাজনৈতিক আবহের। কারণটা আর কিছুই নয়: ডানপন্থী বিজেপি এবং বামপন্থী সিপিএম এর কট্টর আদর্শগত অবস্থান।

ভারতের অরুণাচল প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী পেমা খান্ডুর সঙ্গে সেদেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী; Source: Narendra Modi Twitter handle @narendramodi

দক্ষিণ ভারতের কেরালা রাজ্যে এই দুই দলের রক্তক্ষয়ী রাজনৈতিক সংঘাত ইতিমধ্যেই ভাবিয়ে তুলেছে বিশেষজ্ঞদের। এরপর ত্রিপুরা বা পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যেও যদি এই বিজেপি বনাম বাম বা বাম-ধরনের রাজনীতিতে বিশ্বাসী দলগুলোর সংঘাত তীব্র আকার ধারণ করে আগামী দিনগুলোতে, তবে তা যথেষ্ঠ আশঙ্কার বিষয় হয়ে দাঁড়াবে।

আর এখানেই বড় প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়ায় বিজেপির নেতৃত্ব এবং এই দলটির রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের নীতিপ্রক্রিয়া। চার বছর আগে নরেন্দ্র মোদী নয়াদিল্লিতে ক্ষমতায় আসার পর বিজেপির নেতৃত্বের মুখ্য লক্ষ্য হচ্ছে, সারা দেশের প্রতিটি কোণে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করা। সে লক্ষ্যে বিজেপি যে বেশ কিছুটা সফল, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু ভারতীয় রাজনীতিকে সম্পূর্ণ বিরোধীহীন করে দিয়ে নিজেদের জয়রথকে এগিয়ে নিয়ে চলার প্রবণতা বেশ উদ্বেগজনক।

উত্তরপূর্ব ভারতের বাম শাসিত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার সমর্থকদের সঙ্গে; Source: CPI(M) Twitter handle @cpimspeak

বিজেপির এই উত্থানের পিছনে কাজ করেছে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের পতন। অতীতের একমাত্র সর্বভারতীয় দল কংগ্রেসের যাত্রা নিম্নগামী হতে শুরু করে সেই আশির দশকের শেষভাগ থেকেই। তারপর কংগ্রেস বেশ কয়েকবার ক্ষমতায় এলেও তা ছিল সংখ্যালঘিষ্ঠ এবং জুলিমিলি সরকারের রূপে। ২০০৯ সালে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারের পর্বতপ্রমাণ ব্যর্থতার সুযোগ নিয়ে ক্ষমতায় আসে মোদীর বিজেপি এবং সেই থেকে, একের পর এক রাজ্যে নিজেদের বিজয়ধ্বজা ওড়াতে শুরু করে তারা।

মোদী এবং বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ প্রায়শই বলে থাকেন যে, তারা চেষ্টা করছেন এক কংগ্রেস-মুক্ত ভারত গড়তে। এই অবস্থানের পিছনে যে গণতান্ত্রিক চিন্তাভাবনার বিশেষ ছোঁয়া নেই, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। গণতন্ত্রে সকল প্রকার রাজনৈতিক রং, আদর্শ, চিন্তাভাবনা থাকার প্রয়োজন রয়েছে। বিরোধীকণ্ঠকে সম্পূর্ণরূপে উৎখাত করে দেওয়ার যে মানসিকতা, তা সমর্থনযোগ্য নয়।

বিজেপির দর্শনের সঙ্গে ভারতের দর্শন মেলে না

বিজেপির রাষ্ট্রদর্শনের সঙ্গে ভারতীয় জীবনদর্শনের বিশেষ মিল না থাকাতে আরও প্রকট হয় বর্তমান শাসকের চিন্তার সংকট। আপাতদৃষ্টিতে বিজেপি ভারতের সমস্ত রাজ্যে ক্ষমতায় এসে নিজেদের কংগ্রেসের মতো সর্বভারতীয় দল হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে চায়; মোদী নিজেকে জওহরলাল নেহেরুর চেয়ে বড় নেতা হিসেবে প্রতিপন্ন করতে চান।

কিন্তু রাজনীতিতে নির্বাচনই শেষ কথা নয়; তাতে সমান গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন সমাজ, সংস্কৃতি আর জীবন। আর এটিই নেহেরুর উচ্চতায় ওঠার পথে মোদীর সবচেয়ে অন্তরায়। নেহেরু যে উদারবাদী, মধ্যপন্থী ঘরানার মাধ্যমে নিজের নেতৃত্বকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন দুনিয়ার সমক্ষে, ভারতের মতো বহুমাত্রিক দেশে স্থাপন করেছিলেন এক সমন্বয়, মোদীর কট্টরপন্থী দলের পক্ষে তা করে দেখানো যথেষ্ট কঠিন, বা হয়তো অসম্ভবও।

ভারতের শাসকদল বিজেপির জাতীয় সভাপতি অমিত শাহ; Source: Author: Captgs; Wikimedia Commons

মোদী বারেবারে নিজেকে একজন জাতীয় নেতা হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করলেও, তার বা তার দলের কাজেকর্মে সেটি সবসময় প্রতিফলিত হয় না। গোমাংস ভক্ষণের বা গো-চুরির অভিযোগে যখন সংখ্যালঘু বা দলিতদের উপরে চলতে থাকে গোরক্ষক বাহিনীর অকথ্য অত্যাচার, মোদী বা তার দলের শীর্ষস্থানীয় নেতৃত্ব নীরবতার আশ্রয় নেন।

মোদী যে কিছুই বলেন না তা নয়, কিন্তু যেটুকু বলেন তা মিডিয়ার চাপে পড়ে বা নির্বাচনের আগে, নিজের ভাবমূর্তিটি বাঁচাতে। একজন প্রকৃত উদারবাদী শ্রোতার মনে হতেই পারে যে, মোদী মন থেকে কথাগুলি বলছেন না। আবার যখন জাতীয় রাজধানী দিল্লির বদলে বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধানদের মোদী প্রবল ঢক্কানিনাদসহ নিজের রাজ্য গুজরাটে নিয়ে যান, তখন প্রশ্নে ওঠে তার নিজের সর্বভারতীয় নেতৃত্ব নিয়েও। অভিযোগ ওঠে, মোদী শুধুমাত্র বিজেপি এবং গুজরাটের প্রধানমন্ত্রী।

মোদীর সর্বসমন্বয়ের নীতি কোথায়?

ভারতের বর্তমান শাসকদল যতই জাতীয়তাবাদী ধুয়ো তুলে নিজেদের ভোটব্যাঙ্ক সুরক্ষিত করার চেষ্টা করুক না কেন, জাতীয়তাবাদ ব্যাপারটি আসলে নেতিবাচক এবং বিশ্বসংসারে তা শান্তির চেয়ে অশান্তিই বেশি ডেকে আনে। যদি ঘরের রাজনীতি-সমাজনীতিতে মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি সর্ব-সমন্বয়ের পন্থা নিয়ে না চলতে পারে, সস্তা এবং বিপজ্জনক বিভাজনকে নৈতিক সমর্থন জোগাতে থাকে, তাহলে বহির্বিশ্বেও ভারতের নাম উজ্জ্বল হবে না বিশেষ। এটিও নেহেরুর সঙ্গে মোদীর এক বড় তফাৎ বলে ইতিহাসের পাতায় লেখা হবে।

ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ; Source: www.agenciabrasil.gov.br/

মোদী সমর্থকরা বলবেন, নেহেরুর সময়েও কংগ্রেসের সরকার কেরালায় বাম সরকারের পতনের পিছনে এক বড় ভূমিকা পালন করেছিল। সেক্ষেত্রে এটা বলা দরকার যে, নেহেরু সরকারের কাজ মোটেও গ্রহণযোগ্য ছিল না। জরুরি অবস্থা চালু করে নেহরুর কন্যা ইন্দিরা গান্ধীও ঠিক কাজ করেননি অবশ্যই। আর তাই ভুলের উত্তরে ভুল কাজ করা কাজের কথা নয়।

মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পূর্বে বিজেপির কট্টরপন্থী মুখ হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। তাই তার কাছে অটলবিহারী বাজপেয়ির মতো উদারবাদী রাজধর্ম আশা করাটাই ভুল। কিন্তু একই সঙ্গে, তিনি যদি তার শাসনকার্যকে আরও উদারবাদী করে তোলার উদ্যোগ না নেন, তবে কি তাকে ভারতের অন্যতম বড় প্রধানমন্ত্রী বলার দাবি তোলা চলে? নেহেরু তো দূর অস্ত, নিদেনপক্ষে বাজপেয়ী হয়েই দেখান তিনি প্রথমে।

মোদীর উপদেষ্টা মহলের অন্যতম বড় কৌশল হচ্ছে, জাতীয়তাবাদীর পাশাপাশি উন্নয়নের ধুয়ো তুলে সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে আড়াল করা। কিন্তু ভারতের অর্থনীতির হোচঁট খাওয়া একদিকে যেমন সেই উন্নয়নের বুলিকেই পর্যুদস্ত করেছে, অপরদিকে প্রতিবেশী দেশগুলিতে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব-প্রতিপত্তি ধাক্কা দিয়েছে জাতীয়তাবাদী গর্বকেও।

এই অবস্থায় মোদীর শাসন বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি এবং এর থেকে বেরুনোর একটিই পথ- মোদীকে নিজেকে আরও উদার শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে; দল-মত-ধর্ম-সম্প্রদায় নির্বিশেষে সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে চলতে হবে। কারণ, অতিরিক্ত রাজনৈতিক বিভাজন শেষমেশ কোনো ক্ষেত্রেই দেশকে চূড়ান্ত সাফল্যের রাস্তায় এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে না।

অতএব, শুধু নির্বাচন জিতেই কাজ হাসিল হয় না। আসল দায়িত্ব তার পরেই শুরু হয়।

ফিচার ইমেজ: digitalerra

Related Articles