শুরু হয়ে গেছে বিশ্বকাপ ফুটবলের উন্মাদনা, চার বছরের প্রতীক্ষা শেষে আবারো ফিরে এসেছে বিশ্বকাপ ফুটবল। পুতিনের দেশ রাশিয়ার বসেছে বিশ্বকাপের ২১তম আসর। ভক্তরা ছুটছেন প্রিয় দলের জার্সি আর পতাকার সন্ধানে। বিশ্বকাপ নিয়ে আগ্রহ ছেলে, বুড়ো, নারী, পুরুষ কারোরই যেন কম নেই।
উৎসাহের কমতি থাকে না বিশ্বকাপ ফুটবলের থিম গান নিয়েও। বিশ্বকাপের প্রথম আসর বসেছিল ১৯৩০ সালে উরুগুয়েতে। তবে ফিফা আনুষ্ঠানিকভাবে থিম গান প্রকাশ করে ১৯৬২ সালে চিলি বিশ্বকাপ থেকে। ক্রীড়ামোদী মানুষদের মাঝে খেলাধুলা নিয়ে আলাদা উদ্দীপনা সৃষ্টির লক্ষ্যে ফিফার এই আয়োজন। অনেক সময় এই গান হয়ে ওঠে মাঠে লড়াই করার প্রেরণা। সাধারণত থিম গান নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেওয়া হয় ইংরেজি, বিশ্বকাপের স্বাগতিক দেশের ভাষা এবং স্প্যানিশ ভাষাকে।
১. এল রক দেল মুন্ডিয়াল (বিশ্বকাপ ১৯৬২)
বিশ্বকাপের ৭ম আসরে ফিফা প্রকাশ করে তার প্রথম থিম গান। ১৯৬২ সালে বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয় লাতিন আমেরিকার দেশ চিলিতে। স্প্যানিশ ভাষায় রচিত “এল রক দেল মুন্ডিয়াল” গানটি গেয়েছিল বিখ্যাত ব্যান্ড দল ‘লস র্যাম্বলার্স’। জনপ্রিয়তার দিক থেকে গানটি এগিয়ে না থাকলেও বিশ্বকাপের প্রথম থিম গান হওয়াতে গানটি বিশ্বকাপ ফুটবল ইতিহাসের এক অংশ হয়ে আছে।
২. ওয়াল্ড কাপ উইলি (বিশ্বকাপ ১৯৬৬)
বিশ্বকাপের প্রথম মাসকট উইলি। উইলি মূলত একটি সিংহশাবক। এই সিংহ শাবকটিকে কেন্দ্র করেই তৈরি হয়েছিল বিশ্বকাপ ফুটবলের ২য় থিম গান। লাল, সাদা, ধূসর বর্ণের এই সিংহশাবকটির পরনে ছিল তৎকালীন ইংল্যান্ডের পতাকা ইউনিয়ন জ্যাক। কিং অব স্কিফল খ্যাত শিল্পী লনি ডোনেগানের গাওয়া এই গানটি ছিল “হি ইজ ওয়ার্ল্ড কাপ উইলি, উই অল লাভ হিম”। সেবার প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন হয় ইংল্যান্ড।
৩. ফুটবল মেক্সিকো ৭০ (বিশ্বকাপ ১৯৭০)
১৯৭০ বিশ্বকাপ থেকে প্রথমবারের মতো নিজের প্রিয় দলকে রঙিন জার্সিতে দেখে ভক্তরা। কিংবদন্তী পেলের সেটি ছিল শেষ বিশ্বকাপ। ফুটবল মেক্সিকো নামের সেই গানটির রচয়িতা ছিলেন রবার্তো দো নাসামিন্তো। ১৯৭০ বিশ্বকাপে ৩য় বারের মতো চ্যাম্পিয়ন হয় ব্রাজিল। ৩ বার বিশ্বকাপ জেতার ফলে বিশ্বকাপ ফুটবলের তৎকালীন ট্রফি জুলে রিমে ট্রফি রাখার অনুমতি পায় ব্রাজিল।
৪. ফুটবল (বিশ্বকাপ ১৯৭৪)
১৯৭৪ সালে তৎকালীন পশ্চিম জার্মানিতে অনু্ষ্ঠিত হয় বিশ্বকাপের ১০ম আসর। ফুটবল নামের এই গানটি ছিল স্প্যানিশ, রুশ, ইংরেজী, পোলিশ, জার্মানসহ মোট ৫টি ভাষায়। এযাবৎ এই গানটিই সর্বাধিক ভাষায় রচিত কোনো থিম গান। গানটি লিখেছিলেন পোল্যান্ডের বিখ্যাত কবি এবং গীতিকার জোনাস কোফতার। গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছিলেন তারই স্বদেশী শিল্পী মারিলা রডউইজ। সেই বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রথমবারের মতো সরাসরি থিম গান পরিবেশন করেন মারিলা।
৫. এল মুন্ডিয়াল (বিশ্বকাপ ১৯৭৮)
১৯৭৮ সালের বিশ্বকাপে কোনো থিম গান প্রকাশ করেনি ফিফা। এল মুন্ডিয়াল শিরোনামের এই সাউন্ডট্র্যাকটি ছিল মূলত একটি টিউন। ইতালির বিখ্যাত সুরকার এনিও মরিকোনের সুর করা এই টিউনটি ভায়োলিনের সাহায্যে সম্পন্ন করেছিল আর্জেন্টিনার এর বিখ্যাত অর্কেস্ট্রা কোম্পানি বুয়েন্স আয়ার্স মিউনিসিপল সিম্ফনি। সেই আসরে প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন হয় আর্জেন্টিনা।
৬. মুন্ডিয়াল (বিশ্বকাপ ১৯৮২)
স্প্যানিশ ভাষায় রচিত গানটি বিশ্বকাপের জনপ্রিয় থিম গানগুলোর মধ্যে একটি। গানটি গেয়েছিলেন জনপ্রিয় স্প্যানিশ গায়ক প্ল্যাসিডো ডমিংগো। সে বিশ্বকাপের স্বাগতিক দেশ ছিল স্পেন। এই গানটির মাধ্যমে
প্রথমবারের মতো ফিফা ফুটবল বিশ্বকাপের কোনো থিম গানকে তার স্বাগতিক দেশের নিজস্ব সুর এবং সেই দেশের ঐতিহ্যের মাধ্যমে প্রকাশ করে ।
৭. অ্যা স্পেশাল কাইন্ড অব হিরো (বিশ্বকাপ ১৯৮৬)
১৯৮৬ সালে দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্ব ফুটবলের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে আর্জেন্টিনা। ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে করা ম্যারাডোনার সেই ‘হ্যান্ড অব গড গোলটি’ এখন সমালোচিত। ‘ এ স্পেশাল কাইন্ড অব হিরো “ গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন ব্রিটিশ সংগীত শিল্পী এবং মঞ্চ অভিনেত্রী স্টেফানী লরেন্স। বিশ্বকাপ শেষে পুরো বিশ্বকাপে ম্যারাডোনার পারফর্মেন্স নিয়ে হিরো নামে একটি প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করে ফিফা।
৮. টু বি নাম্বার ওয়ান (ফ্রান্স ১৯৯০)
“টু বি নাম্বার ওয়ান” যার স্প্যানিশ ভাষায় যার অর্থ আসে ‘ভেরানা ইটালিওনা’ এবং ইতালিয়ান ভাষায় ‘উনিএস্টেট ইটালিয়ানা’।গানটির স্প্যানিশ অংশটুকু গেয়েছিলেন প্যারাগুয়ের শিল্পী সুসান ফেরার। গানটি বিশ্বকাপের জনপ্রিয় থিম গানগুলোর মধ্যে একটি। সে সময় ইতালিতে সর্বাধিক বিক্রিত গানের সিডির মধ্যে ‘উনিএস্টেট ইটালিয়ানা’ গানটির সিডি ছিল অন্যতম।
৯. গ্লোরিল্যান্ড (বিশ্বকাপ ১৯৯৪)
আমেরিকায় অনুষ্ঠিত ১৯৯৪ বিশ্বকাপের থিম গানটি পপ এবং রক এই ২ মিউজিককেই প্রাধান্য দিয়ে তৈরি করা হয়। গানটিতে কোনো একক বা যৌথ শিল্পী ছিলেন না। দলগতভাবে গাওয়া এই গানটিতে আমেরিকার বিভিন্ন স্থাপত্যশিল্পের নিদর্শন সম্পর্কে তুলে ধরা হয়।
১০. দ্য কাপ অব লাইফ (বিশ্বকাপ ১৯৯৮)
দ্য কাপ অব লাইফ, যার স্প্যানিশ অর্থ ছিল ‘লা কোপা ডে লা ভিদা’। ইংরেজি এবং স্প্যানিশ ভাষার এই গানটি পুয়ের্তো রিকান শিল্পী রিকি মার্টিনের ক্যারিয়ার এর মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। বিশ্বব্যাপী ব্যাপকভাবে সমাদৃত ছিল গানটি। ১৯৯৮ বিশ্বকাপে ব্রাজিল এবং ফ্রান্সের মধ্যকার ফাইনালের আগে গানটি পরিবেশন করেন রিকি মার্টিন।
১১. বুম (বিশ্বকাপ ২০০২)
২০০২ সালের বিশ্বকাপ যৌথভাবে আয়োজন করে এশিয়ার ২ দেশ জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়া। ‘বুম ‘নামের ফিফার আনুষ্ঠানিক থিম গানটি ছিল আমেরিকান সংগীত শিল্পী অ্যানাসটেসিয়ার গাওয়া। গানটির মিউজিক ভিডিও তৈরি করেন মার্কোস সিয়েগা, মিউজিক ভিডিওটি ধারণ করা হয়েছ লন্ডনে।
১২. দ্য টাইম অব আওয়ার লিভস (বিশ্বকাপ ২০০৬)
২০০৬ সালে জার্মানি দ্বিতীয়বারের মতো আয়োজন করে বিশ্বকাপ ফুটবল। সুইডিশ-জার্মান গীতিকবি জর্জেন এলোফসনের লেখা গানটির প্রযোজনায় ছিলেন স্টিভ ম্যাক। গানটি গেয়েছিল পপ মিউজিক ব্র্যান্ড ডিভো এবং আমেরিকান শিল্পী টনি ব্র্যাক্সটন। গানটির মিউজিক ভিডিও ধারণ করা হয়েছিল একটি ফুটবল মাঠে, যার পরিচালনায় ছিলেন নাইজেল ডিক।
১৩. ওয়াকা ওয়াকা – দিস টাইম ফর আফ্রিকা (বিশ্বকাপ ২০১০)
‘ওয়াকা ওয়াকা, দিস টাইম ফর আফ্রিকা’ কলম্বিয়ান পপ তারকা শাকিরার গাওয়া এই গানটি বিশ্বকাপের জনপ্রিয় থিম গানের মধ্যে একটি। ব্যবসাসফলের দিক থেকে শীর্ষ এই গানটি শাকিরার ক্যারিয়ারে দিয়েছে নতুন মাত্রা। গানটির মাধ্যমে খেলোয়াড়দের তুলনা করা হয়েছে সৈনিকদের সাথে এবং গোল করার যুদ্ধে খেলোয়াড়দের অংশগ্রহণের জন্যে উৎসাহ দেওয়া হয়। সে বছর ওয়েভিং ফ্ল্যাগ নামে কোকাকোলা প্রচারমূলক গান তৈরি করে। অনেকের মতে, ওয়াকা ওয়াকার চেয়ে ওয়েভিং ফ্ল্যাগ গানটা বেশি সমাদৃত তবে। ফিফার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃত গান ছিল ওয়াকা ওয়াকাই।
১৪. উই আর ওয়ান, ওলে ওলা ( ব্রাজিল ২০১৪)
“ইটস ইয়োর ওয়ার্ল্ড, মাই ওয়ার্ল্ড, আওয়ার ওয়ার্ল্ড টুডে অ্যান্ড উই ইনভাইট দ্য হোল ওয়ার্ল্ড, হোল ওয়ার্ল্ড টু প্লে” গানটির মাধ্যমে ৫ বারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল স্বাগতম জানায় বিশ্বকাপের ২০ তম আসরকে। স্প্যানিশ, পর্তুগিজ এবং ইংরেজি ভাষায় রচিত গানটি গেয়েছেন জনপ্রিয় মার্কিন গায়ক পিটবুল, জেনিফার লোপেজ এবং ক্লদিয়া নিরেট। গত ব্রাজিল বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সরাসরি গানটি গেয়েছিলেন গানটির ৩ শিল্পী।
১৫. লিভ ইট আপ (রাশিয়া ২০১৮)
চলতি বছরের ২৫ ই মে প্রকাশ পায় রাশিয়া বিশ্বকাপের থিম গান। সনি মিউজিক এর প্রযোজনায় ইংরেজি, স্প্যানিশ এবং রুশ ভাষা মিশ্রিত এই গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন মার্কিন গায়ক নিকি জ্যাম, র্যাপার অভিনেতা উইল স্মিথ এবং কসোভোর নাগরিক ইরা ইজত্রেফাই। এ প্রসঙ্গে নিকি জ্যাম জানান, বিশ্বকাপের মতো একটি আসরে নিজেকে যুক্ত করতে পারাটা আমার ক্যারিয়ারের অনেক বড় অর্জন। গানটির মিউজিক ভিডিও প্রকাশ পায় ৪ঠা জুন। মিউজিক ভিডিওতে দেখা যায় ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি রোনালদিনহোকে। এছাড়াও অাগের বিশ্বকাপের বিভিন্ন মুহুর্ত প্রকাশ পেয়েছে মিউজিক ভিডিওটিতে।
ফিচার ইমেজ :Sportskeeda.com