দ্বিতীয়বারের মতো আফ্রিকান নেশনস কাপ জয়ের পর, আন্তর্জাতিক ও পেশাদার ফুটবল থেকে অবসর নিয়ে একটু শান্তির খোঁজে ভারত মহাসাগরের রিইউনিয়ন দ্বীপে বসবাস শুরু করেছিলেন আফ্রিকান এক সিংহ। দ্বীপে ছোট একটি অপেশাদার দলের খেলোয়াড় ও কোচ তিনি, টাকার যেমন ঝনঝনানি নেই এখানে, তেমনি নেই ইউরোপ কিংবা আন্তর্জাতিক ফুটবলের পাহাড়সম চাপ। ফুটবলের প্রতি প্রবল টান থেকেই অবকাশের সাথে সাথে ভালোবাসার কাজের সাথে যতটুকু চাপহীনভাবে জুড়ে থাকা যায় আরকি। অবসরের প্রায় বছর দুই হতে চললো। হঠাৎ কোনো এক অবসরে ক্যামেরুনের প্রেসিডেন্টের ফোন এলো ৩৮ বছর বয়সী এই অপেশাদার খেলোয়াড়ের কাছে। ইতালি ‘৯০ বিশ্বকাপে ক্যামেরুন জাতীয় দলে ফিরতে হবে তাকে। প্রেসিডেন্টের আদেশ, অমান্য করার সুযোগই নেই।
শেষ পর্যন্ত অবসর ভেঙ্গে ফিরতে হলো তাকে, ক্যামেরুনের এই বুড়ো সিংহ ইতালিতে বধ করতে লাগলেন বড় বড় শিকার। অদম্য এক সিংহ ফুটবল বিশ্বে গড়ে তুললেন নতুন ইতিহাস, যার হাত ধরেই ঐতিহাসিক সাফল্য অর্জন করে ক্যামেরুনও।
তিউনিসিয়াকে পরাজিত করে ইতালি ‘৯০ বিশ্বকাপে ক্যামেরুন যখন জায়গা করে নেয়, তখনো খুব বেশি কেউ আশা করেনি কিংবদন্তি রজার মিলা আবারো জাতীয় দলের হয়ে খেলবে। টুর্নামেন্ট শুরুর ঠিক কিছুদিন পূর্বে দেশটির রাশিয়ান কোচ ভেলেরি নিপোমনিচি জার মিলাকে বিশ্বকাপ দলে অন্তর্ভুক্ত করেন। মনে করা হয়, কোচকে দেশটি প্রেসিডেন্ট পল বিয়া বিশেষভাবে অনুরোধ করেছিলেন মিলাকে বিশ্বকাপ দলে নেওয়ার জন্য। মিলাকে দলে নেওয়ার ব্যাপারে ভেলেরি অবশ্য যা বলেছিলেন, পরবর্তীতে তা প্রায় শতভাগ সত্য প্রমাণিত হয়। কোচের মতে, দলে মিলার উপস্থিতিই সবাইকে উজ্জীবিত করার জন্য যথেষ্ট। “তিনি খেলায় প্রাণের সঞ্চার করেন। যখনই তিনি আসেন, তার আশেপাশের সকল খেলোয়াড়কে উদ্যমী করে তোলেন” – বলেছিলেন ক্যামেরুনের কোচ ভেলেরি।
নিজেদের সেরা সময় পার হয়ে যাওয়ার পর, খেলায় তাদের প্রভাব কমে আসার পর কিংবা অবসরের পর খুব কম সংখ্যক স্ট্রাইকারকে সেইভাবে স্মরণ করা হয়। শুধুমাত্র অল্প কিছু সৌভাগ্যবান রয়েছেন, যাদের নামের পাশের হয়তো বিশাল সংখ্যক গোলের অংক নেই, কিন্তু হরহামেশা তাদের কথা উঠে আসে শুধুমাত্র তাদের অতিমানবীয় পার্ফরম্যান্স বা নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে গভীর প্রভাবের জন্য। এই অল্প কিছু সৌভাগ্যবানদের মধ্যে অন্যতম একজন আফ্রিকান কিংবদন্তি রজার মিলা। রজার মিলাকে শুধুমাত্র সৌভাগ্যবান বললে ভুল হবে, তিনি এমন একজন খেলোয়াড় ছিলেন যে কিনা মুহূর্তের মধ্যে খেলার গতিপথ ও ফলাফল পালটে দিতে পারতেন।
আফ্রিকান চ্যাম্পিয়নস লিগের নক আউট পর্বে রজার মিলার দল মুখোমুখি হয় শক্তিশালী হাফিয়া এফসি’র। প্রথমার্ধেই ২-০ গোলে পিছিয়ে পড়ে মিলার দল। দ্বিতীয়ার্ধে পিছিয়ে থাকা লিওপার্ড দৌলার দরকার ছিলো ম্যাচ বাঁচানো মহানায়কের, যার হাত ধরে ম্যাচটি নিজেদের করে নিতে পারবেন তারা। ম্যাচটি শেষ পর্যন্ত ৪-২ গোলে জিতে নেন লিওপার্ড, দ্বিতীয়ার্ধে হ্যাট্রিক করে ম্যাচের ফলাফল সম্পূর্ণ বদলে দেওয়ার অনবদ্য কৃতিত্ব অবশ্যই জার মিলারের। ম্যাচে রজারের প্রভাব কতটা সুদূরপ্রসারী হতে পারে, এটি তার খুব সামান্য একটি উদাহরণ। ইতালি ‘৯০ বিশ্বকাপে ক্যামেরুনের হয়ে মিলার গড়েছেন রেকর্ড, স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন আফ্রিকানদের, যা পরিণত হয়েছে দুর্দান্ত এক আফ্রিকান রূপকথায়।
ইতালি বিশ্বকাপে প্রথম ম্যাচেই ক্যামেরুনের প্রতিপক্ষ গত আসরের শিরোপাজয়ী আর্জেন্টিনা দল। আর্জেন্টিনার এই দলে রয়েছে ম্যারাডোনা নামের সেই কিংবদন্তি, যার জাদুকরী পারফর্মেন্সেই বিশ্বকাপ জিতেছিলো আর্জেন্টিনা। আফ্রিকান দল হিসেবে ইতালিতে সমীহ করার মতো কোনো দল ছিলো না ক্যামেরুন, কিন্তু পুরো ম্যাচে ম্যারাডোনাকে দারুণ ভাবে প্রতিহত আর্জেন্টিনাকে ১-০ গোলে পরাজিত করে গোটা ফুটবল দুনিয়ায় আলোড়ন সৃষ্টি করে দেশটি।
ক্যামেরুনের এই জয় হয়তো নিছক অঘটন হিসেবেই ইতিহাসে ঠাঁই করে নিতো, যদি না পরবর্তী ম্যাচ গুলোতে আফ্রিকান দেশটির দুর্দান্ত সাফল্য অব্যাহত না থাকতো। আর এই সাফল্যের এই মঞ্চে এবারে মূল ভূমিকায় ৩৮ বছর বয়সী রজার মিলা। রোমানিয়ার বিপক্ষে গ্রুপের পরবর্তী ম্যাচে প্রথমার্ধ পর্যন্ত গোল শূন্য ড্র থাকার পর, ৫৯ মিনিটে কোচ মাঠে নামায় রজারকে। ম্যাচের ৭৬ ও ৮৬ মিনিটে দুই গোল করে ক্যামেরুনকে নক আউট পর্বে পদার্পণের সুযোগ করে দেয় এই স্ট্রাইকার, আর্জেন্টিনার পর ২-১ গোলে পরাজিত হয়ে আফ্রিকান সিংহদের এবারের শিকার রোমানিয়া। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে ৪-০ গোলে পরাজিত হলেও দুই জয়ের সুবাদে রাউন্ড-১৬ তে জায়গা করে নেয় ক্যামেরুন।
রাউন্ড- ১৬ তে কলম্বিয়ার বিপক্ষে নির্ধারিত সময়ের খেলা গোল শূন্য ড্র’তে শেষ হওয়ায় ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। অতিরিক্ত সময়ে মাত্র দুই মিনিটের ব্যবধানে রজার মিলা দুই গোল করলে, একরকম কোয়ার্টার ফাইনাল নিশ্চিত করে ফেলে আফ্রিকান দেশটি। ১০৬ ও ১০৮ মিনিটে মিলারের করা দুই গোলের পর ১১৫ মিনিটে কলম্বিয়ার রেডিন এক গোল করলে আবারো ২-১ গোলের এক শ্বাসরুদ্ধকর জয় পায় ক্যামেরুন। এই ম্যাচে প্রতিপক্ষের ডি বক্সের বাইরে থেকে কিংবদন্তি গোলকিপার হিগুইতার পা থেকে বল কেড়ে নিয়ে মিলার করেছিলেন তার বিখ্যাত গোলগুলোর একটি।
কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৩-২ গোলে পরাজিত হলেও বিশ্বকাপে অসাধারণ কিছু অর্জনের মধ্য দিয়েই শেষ হয় ক্যামেরুনের বিশ্বকাপ। ক্যামেরুনের বিপক্ষে ইংল্যান্ডের জয় সূচক গোলটি এসেছে ম্যাচের অতিরিক্ত সময়ের ১০৫ মিনিটে পেনাল্টি থেকে। এই ম্যাচে রজার মিলা কোনো গোল না পেলেও ম্যাচের ৮৩ মিনিট পর্যন্ত ২-১ গোলে এগিয়ে ছিলো ক্যামেরুনই, এরপর ইংল্যান্ড টানা দুইটি পেনাল্টি পেলে অনেকটা বিতর্কিত গোলের সুবাদে বিদায় নেয় ক্যামেরুন।
দেশে ফেরার পর জনগণের উৎসবের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় ক্যামেরুন ফুটবল দল ও তাদের মহানায়ক রজার মিলার। তখন পর্যন্ত বিশ্বকাপে ক্যামেরুনের কোয়ার্টার ফাইনালে অংশগ্রহণ করা ছিলো আফ্রিকান দলগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ অর্জন। মিলারের পারফর্মেন্স ও প্রভাব এতটাই বেশি ছিলো যে, অন্যান্য আফ্রিকান দেশেও ক্যামেরুনের সাফল্য জনগণ উদযাপন করেছিলো। বদলি হিসেবে প্রতিটি ম্যাচে নামার ব্যাপারে রজার উল্লেখ করছিলেন যে, তিনি যদি শুরু থেকে মাঠে থাকতেন তাহলে হয়তো এরকম ফলাফল এনে দিতে পারতেন না। “আমি একজন রিজার্ভ অফিসার। একজন ছোটোখাটো বৃদ্ধ লোক যে এখনো কাজে লাগতে পারি।” বিশ্বকাপ শেষে বলেছিলেন রজার।
ইতালি বিশ্বকাপে একটি ম্যাচেও শুরুর একাদশে ছিলেন না রজার, তারপরও ৪ গোল করে আসরের তৃতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা ছিলেন তিনি। ৩৮ বছর বয়সে গোল করে রজার বিশ্বকাপ ফুটবলের সবচেয়ে বেশি বয়সী গোলদাতার খেতাব নিজের করে নিয়েছিলেন সেই আসরে। অবশ্য চার বছর পর আবারো এই রেকর্ড ভেঙ্গে নতুন ইতিহাস তৈরি করেন চিরতরুণ এই স্ট্রাইকার। ইতালি বিশ্বকাপে মিলার আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে একজন পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন সেই সাথে বিখ্যাত হয়ে যায় তার ‘মাকোসসা’ নাচের গোল উদযাপন। রোমানিয়ার বিপক্ষে গোলের পর কর্নার ফ্ল্যাগের কাছে গিয়ে মিলারের এই নাচ সেবারই প্রথম দেখে বিশ্ব।
ইউএসএ ‘৯৪ বিশ্বকাপে আবারো জাতীয় দলে ডাক পান সবে মাত্র ৪২ বছরে পা রাখা রজার মিলা। আফ্রিকান অদম্য এই সিংহ ক্যামেরুন দলে শুধু একজন অনুপ্রেরণাকারী হিসেবেই যোগ দেয়নি, ফুটবল বিশ্বকে উপহার দিয়েছিল স্মরণীয় এক মুহূর্ত যা শুধু মাত্র মিলার পক্ষেই সম্ভব। এই বিশ্বকাপে মিলার খেলেছিলেন এমন অনেক খেলোয়াড়দের সাথে, তাদের বেশিরভাগের হয় জন্মই হয়নি কিংবা তারা কেবলই দুধের শিশু যখন মিলার ১৯৭৬ সালে আফ্রিকার সেরা ফুটবলারের খেতাব অর্জন করেছিলেন।
১৯৯৪ বিশ্বকাপে আবারো জাতীয় দলের হয়ে খেলার ব্যাপারে মিলার বলেছিলেন, “ক্যামেরুনের জনগণ ১৯৯৪ আমাকে খেলার জন্য অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিলেন কারণ তারা মনে করতো একমাত্র আমি গোল করতে পারবো। অন্য কোনো খেলোয়াড়দের উপরে তাদের বিশ্বাস ছিলো না।” ১৯৯৪ সালে মিলা তখন ক্যামেরুনের তরেনে ইয়াওন্দে ক্লাবের হয়ে খেলছিলেন। তাই ফুটবল খেলার মতো যথেষ্ট শারীরিক সক্ষমতা মিলারের তখনো ছিলো।
রাশিয়ার বিপক্ষে ক্যামেরুনের ৬-১ গোলের লজ্জাজনক পরাজয়ে একমাত্র অর্জন ছিলো দ্বিতীয়ার্ধে বদলি হিসেবে নামার পরপরই মিলারের গোল। ৪২ বছর বয়সে মিলার ৪৬ মিনিটে গোল করলে, ৪ বছর পূর্বে তারই গড়া সবচেয়ে বেশি বয়সে গোলদাতার রেকর্ড ভেঙ্গে নতুন করে রেকর্ড গড়েন এই কিংবদন্তি। ম্যাচের প্রথমার্ধেই সালেঙ্কো হ্যাট্রিক করে বড় ব্যবধান তৈরি করেছিলেন। মিলারের গোল ব্যবধান সামান্য কমালেও সালেঙ্কোর রেকর্ড ৫ গোলের কল্যাণে বড় পরাজয় দেখেই গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নিয়েছিলো ক্যামেরুন। ৩টি বিশ্বকাপে অংশ নেওয়া মিলারের এটিই ছিলো শেষ বিশ্বকাপ। অবশেষে প্রায় ৩৪ বছরের ফুটবল ক্যারিয়ারের ইতি টানেন মিলার ১৯৯৯ সালে।
মিলার ফুটবল বিশ্বে বিখ্যাত একজন হয়ে ওঠার মূলমঞ্চ বিশ্বকাপ হলেও ইউরোপে স্ট্রাইকার হিসেবে তার ক্যারিয়ার ছিলো যথেষ্ট প্রশংসনীয়। ক্যামেরুনের হয়ে ৩২ গোল করা এই স্ট্রাইকার ক্যারিয়ারের একটা বড় সময় কাটিয়েছেন ফ্রেঞ্চ লিগে। সেখানে তিনি খেলেছেন বাসিয়া (১১৩ ম্যাচে ৩৫ গোল), ভ্যালেনসিয়েনেন (২৮ ম্যাচে ৬ গোল), মোনাকো (১৭ ম্যাচে ২ গোল), মপিলিয়ে (৯৫ ম্যাচে ৩৭ গোল), সেন্ট এতিয়েনের (৫৯ ম্যাচে ৩১ গোল) মতো বেশ নামিদামী ক্লাবে। মোনাকো ও বাসচিয়ার হয়ে জিতেছেন ফ্রেঞ্চ কাপ শিরোপা, ক্যামেরুনের হয়ে ১৯৮৪ ও ১৯৮৮ সালে জিতেছেন আফ্রিকান নেশনস কাপ। মিলারের এই পরিসংখ্যানই বলে দেয়, বিশ্বকাপের পারফর্মেন্স এক পাশে রেখেও যদি বিবেচনা করা হয়, তবুও আফ্রিকার সেরা স্ট্রাইকারদের একজন ছিলেন।
বৃদ্ধ বয়স হলো সেই সময়, যখন আপনি বলতে শুরু করেন যে, নিজেকে কখনো আমার এতটা তরুণ মনে হয়নি। ফ্রেঞ্চ লেখক জুলে রেনার্ডের এই কথাটি সম্ভবত সবচেয়ে ভালো মানায় রজার মিলারের হার না মানা সুদীর্ঘ ক্যারিয়ারের সাথে। মিলার প্রমাণ করেছেন, বয়স নিতান্তই কিছু সংখ্যা। মনের শক্তি ও ইচ্ছা থাকলে সবই সম্ভব। ইতালি বিশ্বকাপে মিলার ও ক্যামেরুনের দুর্দান্ত পারফর্মেন্স বদলে দিয়েছিলো আফ্রিকান ফুটবলের প্রতি গোটা বিশ্বের দৃষ্টিভঙ্গি। বলা হয়, এই বিশ্বকাপেই বিশ্ব ফুটবলে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে আফ্রিকান ফুটবল। তাই আফ্রিকানদের এই ফুটবল কিংবদন্তি শুধু একজন অসামান্য ফুটবলারই নন, তিনি এমন এক অদম্য আফ্রিকান সিংহ, যার অবদান আজও প্রেরণা যোগায় আফ্রিকানদের।
ফিচার ইমেজ- starsandstripesfc.com