প্রাণীজগতে বৈচিত্র্যের শেষ নেই। তবু মানুষের কল্পনায়, ভাবনায় আর সাহিত্যের পাতায় বারবার ফিরে আসে এমন কিছু জীবজন্তুর নাম, যাদের অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহ আছে। তবুও দেশ-বিদেশের নানা সাহিত্য উপন্যাসে নানা অচেনা জীবজন্তুর ছড়াছড়ি। সাহিত্যের পাতা থেকে উঠে আসা এসব জীবজন্তু নিয়ে সারা বিশ্বের মানুষের রয়েছে অগাধ কৌতূহলও। এদের কেউ জ্ঞানের প্রতীক, কেউবা জয়ের। এদের মধ্যে কেউ যেমন বন্ধুবৎসল, কেউবা বেশ ভয়ঙ্কর। এরা সহজে ধরা দেয় না, লোকচক্ষুর আড়ালে থাকতেই ভালবাসে।
পৃথিবীর প্রায় সব সংস্কৃতিতেই এদের উপস্থিতি বেশ লক্ষ্যণীয়। গ্রিক সাহিত্যে, পারস্য উপকথায়, চীনা লোকগাঁথা থেকে শুরু করে বিশ্বের প্রাচীন সব সভ্যতার নানা কাহিনীতে সন্ধান পাওয়া অচিন এক প্রাণীজগতের। যেমন- গ্রিক সাহিত্যে হাইড্রা নামের দানব, গালিভার’স ট্রাভেলসের লিলিপুট, লর্ড অব দ্য রিংসের ড্রাগন ইত্যাদি। গল্প-উপন্যাসের পাতা থেকে উঠে আসা এমনই কয়েকটি জীবজন্তুর রোমহর্ষক গল্প নিয়ে সাজানো আজকের এই আয়োজন।
শিংওয়ালা ঘোড়া ইউনিকর্ন
ঘোড়ার বিষয়ে আমরা কম-বেশি সকলেই জানি। কিন্তু সেই ঘোড়ার কপালে যদি থাকে একটি মাত্র শিং, তাহলে? গ্রিক সাহিত্যে প্রথম এক শিংবিশিষ্ট ঘোড়ার কথা জানা যায়, যাকে ইউনিকর্ন বলা হয়। অনেকের মতে, ইউনিকর্ন হলো একটি মস্ত বড় ঘোড়া, যার কপাল থেকে লাল, কালো কিংবা সাদা রঙের শিং রয়েছে। শুধু তা-ই নয়, এই শিংয়ের নাকি রয়েছে অনেক রকম জাদুশক্তি। ইউনিকর্নের শিংয়ের এই ক্ষমতাকে বলা হয়ে থাকে এলিকর্ন। কথিত আছে, এদের শিংয়ের আশ্চর্য ছোঁয়ায় অনেক জটিল অসুখ-বিসুখ যেমন সেরে যায়, তেমনি দূষিত কিংবা বিষাক্ত জলকেও করে তোলে একবারে বিশুদ্ধ। এ নিয়ে গ্রিক উপকথায় একটা চমৎকার গল্প আছে।
জঙ্গলের মধ্যে থাকা এক বিশাল জলাশয়ে জঙ্গলের বিভিন্ন পশুপাখি এসে পানি পান করতো। কিন্তু একবার এক বিষাক্ত সাপ সেই জলাশয়ের পানিকে বিষাক্ত করে ফেলে। ফলে জঙ্গলের কোনো পশুই আর সেই পানি পান করতে পারছিল না। তখন সকলে মিলে অপেক্ষা করতে লাগলো ইউনিকর্নের। ইউনিকর্ন এসে যে-ই না তার জাদু শিং দিয়ে জলাশয়ের পানির মধ্যে ডুবিয়ে ক্রুশ চিহ্ন আঁকলো, অমনি জলের সমস্ত বিষাক্ত পদার্থ দূর হয়ে গেলো। জলাশয়ের পানি পানে আর বাধা রইলো না।
ইউনিকর্নের শিঙের এই অাশ্চর্য ক্ষমতার কারণে বারেবারে শিকারিরা ইউনিকর্নের খোঁজে বেরিয়ে পড়েছেন নানা অচেনা অজানা বিপদসঙ্কুল সব স্থানে। ইউনিকর্ন শিকার করার পদ্ধতিটাও বেশ অভিনব এবং অন্য পশুদের চেয়ে পুরোপুরি আলাদা। কথিত আছে, ইউনিকর্ন বেশ শান্তশিষ্ট ও নির্দোষ প্রাণী। তারা সুন্দর এবং সুগন্ধের পূজারি। আর তাই ইউনিকর্নকে ধরতে শিকারিরা প্রথমে সুন্দরী মেয়ের ছদ্মবেশ ধারণ করে, নিজেদের পোশাকে ছড়িয়ে রাখে সুগন্ধ। এরপরেই শুধু অপেক্ষা। নতুন সঙ্গী আর সুগন্ধীর টানেই নাকি ইউনিকর্নরা শিকারির কাছে ছুটে আসে। তারপর শিকারির কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে। এটাই হলো শিকারির সুযোগ, ঘুমন্ত ইউনিকর্নের কপাল থেকে জাদুর শিংটি উপড়ে নেয়ার। তবে পৃথিবীতে ইউনিকর্ন নামের কোনো প্রাণীর অস্তিত্ব ছিল কি না তা আজও প্রমাণিত হয়নি।
পুনর্জন্ম হয় ফিনিক্স পাখির
গ্রিক, মিশরীয় বা পারস্য কিংবদন্তী মতে, ফিনিক্স পাখি হলো নবজাগরণের প্রতীক। নামের মতো পাখিটা দেখতেও অপরূপ। পালকে ঢাকা উজ্জ্বল সোনালি রংয়ের লেজ, যা দেখলে নাকি আর চোখ ফেরানো যায় না। বিভিন্ন দেশের সাহিত্য ও উপকথায় এই পাখিটি নানা নামে পরিচিত। গ্রিক সাহিত্যে ফিনিক্স, মিশরিয় সাহিত্যে বেনু পাখি, ইহুদিদের কাছে মিল্কম, পারস্যে সিমুরঘ, ন্যাটিভ আমেরিকানদের কাছে থান্ডারবার্ড, রাশিয়ানরা ফায়ারবার্ড, চীনারা ফেং হুং এবং জাপানি সাহিত্যে হো হো পাখি নামে পরিচিত।
কথিত আছে, এই ফিনিক্স পাখি অমর। ৫০০-১,০০০ বছর বেঁচে থাকার পর ফিনিক্স পাখি নিজের বাসায় নিজে নিজেই আগুনে পুড়ে ভস্মীভূত হয়ে যায়। আর এই ছাই থেকেই আবার নবজন্ম হয় ফিনিক্সের।
ফিনিক্স পাখির এই অত্যাশ্চর্য গল্পের কথা পাওয়া যায় রোমান কবি ওভিডের বইয়ে। ট্যাসিটাস, হিরোডোটাস এবং প্লিনির উপখ্যানেও উপস্থিত ফিনিক্স পাখি। মানুষের বন্ধু, রাজকীয় পাখি বলে পরিচিত, হ্যারি পটারের কাহিনীতে ডাম্বলডোরের পোষ্য ফিনিক্স পাখি হ্যারির প্রাণও বাঁচায়। ফিনিক্সের আকার-আকৃতি নিয়ে নানা সাহিত্যে নানা মত রয়েছে। কোথাও তাকে ঈগল পাখির মতো, আবার কোথাও অস্ট্রিচ সদৃশ আকৃতির বলে বর্ণনা করা হয়েছে। তবে ফিনিক্স পাখির চোখ দুটো বেশ কোমল।
ফিনিক্সের নবজন্মের পেছনে লুকায়িত রয়েছে এক গভীর অন্তর্নিহিত ব্যাখ্যা। মানুষ যখন নানা বাধা-বিপত্তি কাটিয়ে ব্যর্থতার ভেতর দিয়ে সাফল্যের সাফল্যের সন্ধান পায়, আমরা তাকে ফিনিক্স পাখির সাথে তুলনা করি।
সমুদ্রের সুন্দরী মৎস্যকন্যা
মৎস্যকন্যাকে নিয়ে যেন রহস্যের শেষ নেই। প্রায় সব দেশের গল্প, উপকথায় বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে মৎস্যকন্যারা। এমনকি শিশুদের কমিক্স জগতে মারমেইড চরিত্রটি বেশ জনপ্রিয়। মৎস্যকন্যার দেহের উপরিভাগ দেখতে অনেকটা মানুষের মতো আর নিচের অংশটা থাকে মাছের মতো। তারা দেখতে অপরূপ সুন্দরী, মাথায় রয়েছে কোমর ছাপিয়ে যাওয়া একরাশ সোনালি চুল।
তাদের নাকি চিরুনি আর আয়না হাতে সমুদ্রের বুকে জেগে ওঠা জনমানবহীন কোনো দ্বীপে বসে আপনমনে গান গাইতে প্রায়ই দেখা যায়। আর তাদের রূপের ছটায় দিগভ্রান্ত হয়ে পড়ে সমুদ্র পথচলতি নাবিকেরা।
প্রাচীনকালে বহু নাবিক মৎস্যকন্যার অস্তিত্বে রীতিমতো বিশ্বাসী ছিলেন। বহু দূর দেশে পাড়ি দিয়ে দেশ-বিদেশ ঘুরে এসে তারা নানা ধরনের গল্প শোনাতেন। তাদের মধ্যে অনেকে দাবি করেন, তারা নাকি মৎস্যকন্যাকে দেখেছেন। মনে করা হয়ে থাকে, মৎস্যকন্যার গল্প প্রথম শোনা গিয়েছে প্রাচীন অ্যাসিরিও সভ্যতায়। এই গল্প অনুযায়ী, দেবী অ্যাটারগেটিস নাকি একবার ভুল করে হত্যা করে ফেলেন তার একজন মানুষরূপী বন্ধুকে। আর তারপর দুঃখে এবং লজ্জায় দেবী থেকে পরিণত হন মৎস্যকন্যায়।
প্রাচীন গ্রিক সাহিত্যে সাইরেন নামের একধরনের কাল্পনিক সামুদ্রিক প্রাণীর নাম শোনা যায়, যারা নাকি নানা রূপ ধারণ করতে পারে। অনেকে মৎস্যকন্যাদের সাইরেনেরই একটি রূপ মনে করেন। সাইরেনরা নাকি মৎস্যকন্যা বা সুন্দরী মেয়ে সেজে মাঝসমুদ্রে দারুণ মিষ্টি গলায় গান গায়। তাদের সেই গানের আকর্ষণে নাবিকরা দিক ভুল করে পৌঁছে যায় অন্যদিকে। তখন মৎস্যকন্যার সেই জাহাজ ডুবিয়ে দেয়। আর জাহাজের মানুষদের মেরে ফেলে, নাহলে নিয়ে যায় সমুদ্রের তলায় থাকা তাদের পাতালপুরীতে।
তবে মৎস্যকন্যা মানেই দুষ্টু তা কিন্তু নয়। অনেক দেশের গল্পে আবার উল্টোটাই রয়েছে, যেখানে মৎস্যকন্যারা বর দিতো মানুষকে।১৮৩৭ সালে হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসন ‘দ্য লিটল মারমেইড’ নামে এমনই এক অসাধারণ গল্প লিখে গেছে যা আজও শিশুদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয়।
উড়তে পারে পেগাসাস
গ্রিক উপকথায় এমন এক ঘোড়ার বর্ণনা রয়েছে যার রয়েছে দুটো মস্ত ডানা এবং যে আকাশে উড়তে পারে। এর নাম পেগাসাস। গ্রিক উপকথা অনুসারে, তিন গর্গন (রাক্ষসী) বোনের মধ্যে একজন হলো মেডুসা। এই বোনেরা অদ্ভুত দেখতে। এদের একেকটি চুল হলো একেকটি বিষাক্ত সাপ। তাদের চোখের দৃষ্টি খুব ভয়ঙ্কর, কারণ তাদের দিকে কেউ তাকালেই পাথরে পরিণত হতো যে কেউ।
মহাশক্তিশালী পার্সিয়াস ভগবানদের কাছ থেকে পাওয়া অস্ত্রের সাহায্যে এবং নানা কৌশল করে সেই ভয়ঙ্কর মেডুসার শিরশ্ছেদ করে। আর তার থেকেই জন্ম হয় পেগাসাসের। জন্মের পর পেগাসাস হেলিকন পাহাড়ে বসবাস করতো। একদিন বেলেরোফোন নামে এক শক্তিশালী যুবক পেগাসাসকে পোষ মানিয়ে নেয়। এরপর পেগাসাসের পিঠে চেপে বেলেরোফোন কাইমেরা নামক এক জন্তুর বিরুদ্ধে এক ভয়ঙ্কর যুদ্ধে নামে।
যুদ্ধে জয়লাভের পর বেলেরোফোন ভাবলো, পেগাসাসের পিঠে চেপে সে অলিম্পাস পাহাড়ে পৌঁছে যাবে। এই অলিম্পাস পাহাড়েই ছিল দেবতাদের বাসস্থান। দেবতাদের মতো বেলেরোফোনও অলিম্পাস পাহাড়ে বাস করার সিদ্ধান্ত নেয়। আর এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন দেবতাদের রাজা জিউস। বিনা আমন্ত্রণে স্বর্গে আসার চেষ্টা করায় জিউস অত্যন্ত রেগে যান এবং তিনি একটি পোকাকে পাঠান পেগাসাসকে কামড়ে দেওয়ার জন্য। কামড় খেয়ে পেগাসাস এমন ঝাঁকুনি দিল যার ধাক্কা সামলাতে না পেরে বেলেরোফোন পেগাসাসের পিঠ থেকে সোজা মাটিতে এসে পড়ে। তৎক্ষণাৎ তার মৃত্যু ঘটে।
এরপর পেগাসাস একা গিয়ে পৌঁছায় অলিম্পাস পর্বতে। জিউস তাকে সাদর আমন্ত্রণ জানান। পেগাসাসকে আকাশে বিদ্যুৎ বয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজ দেয়া হয়। কথিত আছে, জিউস তাকে পেগাসাস তারামন্ডলে পরিণত করেন। আজও পরিষ্কার বসন্তের আকাশে ডানাওয়ালা ঘোড়ার মতো যে তারকামন্ডল দেখা যায়, সেটাকেই আমরা পেগাসাস বলে থাকি।
ফিচার ইমেজ- pinterest.com