একটি কাহিনী শোনাই। ১৯৬৯ সালের গরমের ছুটিতে কানাডা দেশের এক সাদা বালক একটি গিটার কিনেছিল। তা-ও পুরো পাঁচ টাকা দশ পয়সা দিয়ে। এরপর খুব বাজিয়েছিল। এতই বাজিয়েছিল যে, ওর আঙ্গুল কেটে গিয়েছিল, রক্ত পড়ছিল। পরে আর বাজাতে পারেনি। তবু ও আশা হারায়নি। স্কুলের দুই বন্ধু জিমি আর জোডিকে নিয়ে একটা ব্যান্ড খুলেছিল। সেই ব্যান্ডও চলেনি। কারণ জিমি ছিল খুবই ছিঁচকাঁদুনে। সে ব্যান্ড ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। আর জোডি; সে বেচারার সাথে তো খুব খারাপ হয়েছিল। বিয়ে হয়ে গিয়েছিল তার। তখন ওই সাদা বালকের মনে হয়েছিল, ‘৬৯-এর গরমকাল ওর জীবনের সবচেয়ে বাজে গরমকাল। কিন্তু ১৫ বছর পর তার একটা গানই এমনকি আলতাফ রাজার কাওয়ালির চেয়েও বেশি চলেছিল। ওই গানে সে লিখেছিল, ওই দিনগুলো ছিল আমার জীবনের সেরা। এখন একটা কথা বলি? এতক্ষণ যা বললাম, তা একটা সত্য ঘটনা। এখন ওই বালককে আমরা ব্রায়ান অ্যাডামস নামে চিনি!
আরো ১৪ বছর পর, ‘৯৮-এর গরমকালে এসে এই কাহিনী হারশু শুনছে তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু শ্যাঙ্কির কাছে। কারণ ব্রায়ান অ্যাডামসের মতো তার গরমকালটাও খুব বাজেভাবে শুরু হয়েছে। কিংবা বলা যায়, তার অবস্থা ঢের বেশি খারাপ। গরমের ছুটির প্রথম দিনই সে জেনে গেছে, গরমকালটা কেটে যাবে তার হিন্দি টিউশন নিতে নিতে। তার মানে যখন খুশি বাসার বাইরে যাওয়া, খেলাধুলা করা, কোনোকিছুই চলবে না। সকাল সকাল গোসল সেরে, সুবোধ বালক সেজে বসে থাকতে হবে স্যারের অপেক্ষায়। ওদিকে মায়ের কড়া শাসন, আর পান থেকে চুন খসতেই বড় ভাই ডাব্বুর মায়ের কাছে সব কথা লাগিয়ে দেয়ার অভ্যাস, কিছুক্ষণ পরপর বিদ্যুৎ চলে যাওয়া – এসব তো আছেই। সব মিলিয়ে হারশুর অবস্থা এতটাই শোচনীয় যে, আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে তার এবারের গরমকালটা ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে গরমকাল না হয়ে যায়ই না। ঠিক এমন পরিস্থিতিতেই সান্ত্বনা দিতে শ্যাঙ্কি তাকে শুনিয়েছে ব্রায়ান অ্যাডামসের দারুণ মোটিভেশনাল কাহিনীটি। এখন প্রশ্ন হলো, হারশুও কি পারবে ‘৯৮-এর গরমকালটাকে তার জীবনের শ্রেষ্ঠ গরমের ছুটিতে পরিণত করতে?
এই প্রশ্নেরই জবাব আমরা পাব টিভিএফ অরিজিনালস ‘ইয়ে মেরি ফ্যামিলি’ নামক সাত পর্বের ওয়েব সিরিজটিতে। সিরিজটি লিখেছেন সৌরভ খান্না, আর পরিচালনা করেছেন ট্রিপলিং, পার্মানেন্ট রুমমেটস খ্যাত সামীর সাক্সেনা। ২০১৮ সালের ১২ জুলাই টিফিএফ প্লে অ্যাপ, ওয়েবসাইট এবং ইউটিউবে একযোগে স্ট্রিমিং শুরু হয় সিরিজটির প্রথম দুই পর্বের। ২০ জুলাই থেকে স্ট্রিমিং হয় বাকি পাঁচ পর্বও। পরবর্তীতে ইউটিউবে ফ্রি স্ট্রিমিং বন্ধ হয়ে গেলেও সিরিজটি যুক্ত হয় নেটফ্লিক্সে। এখন আগ্রহী দর্শক চাইলে টিভিএফ প্লে কিংবা নেটফ্লিক্সে সিরিজটি দেখতে পারেন।
কাস্টিং
চলুন এক নজরে পরিচিত হয়ে নিই সিরিজের মুখ্য চরিত্রসমূহ, এবং সেসব চরিত্রে রূপদানকারী অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সাথে।
হারশাল গুপ্তা/হারশু – বিশেষ বানসাল
পূর্বা গুপ্তা/মাম্মি – মোনা সিং
দেবেন্দ্র গুপ্তা/পাপা – আকর্ষ খুরানা
দেবানশ গুপ্তা/ডাব্বু – অহন নির্বাণ
ধ্বনি গুপ্তা/চিটঠি – রুহি খান
শ্যাঙ্কি – প্রসাদ রেড্ডি
বিদ্যা এম. রঙ্গনাথ – রেবাথি পিল্লাই
ভার্মা স্যার – ব্রিজ ভূষণ শুকলা
কাহিনী বিশ্লেষণ
ইয়ে মেরি ফ্যামিলি মূলত একটি সিটকম বা সিচুয়েশন কমেডি। প্রথম পর্বেই সিরিজের প্রধান সকল চরিত্রের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়, এবং এরপর থেকে প্রতিটি পর্বের কাহিনী আবর্তিত হয় নির্দিষ্ট কোনো চরিত্র কিংবা ঘটনাকে কেন্দ্র করে। যেমন- প্রথম পর্বে সকল চরিত্রের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হলেও, সবচেয়ে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে হারশুর মাকে। পরের পর্বে কাহিনীতে গুরুত্ব পেয়েছে হারশুর জন্মদিন। এরপর একে একে তার পরিবারের সকল সদস্যকে নিয়ে এক একটি আলাদা পর্বের কাহিনী ঘুরপাক খেয়েছে, এবং এভাবেই সামগ্রিকভাবে সিরিজটির কাহিনী একটি পরিণতির দিকে এগিয়েছে। তবে সিটকমের মতোই এই সিরিজটির বিশেষত্ব এখানেই যে, প্রতিটি পর্বের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে দেখার কোনো প্রয়োজনই পড়ে না। প্রথম পর্ব দেখে চরিত্রদের সম্পর্কে প্রাথমিক একটি ধারণা পেয়ে গেলে, পরবর্তীতে সিরিজের যেকোনো পর্ব বা যেকোনো দৃশ্য থেকে দেখা শুরু করলেও, বুঝতে এতটুকু বেগ পেতে হবে না।
এই সিরিজটির সবচেয়ে বড় তিনটি ইউএসপি হলো পরিবার, কৈশোর আর নস্টালজিয়া।
পরিবার
পারিবারিক বন্ধনটাকে খুবই গুরুত্বের সাথে দেখানো হয়েছে এই সিরিজে। এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই, ৯০’র দশকের প্রেক্ষাপটে নির্মিত বলে, এই সিরিজের পরিবারটিও তিন বাচ্চার পরিবার। কেননা ওই সময়ে ভারতের মধ্যবিত্ত সমাজে সবচেয়ে বেশি তিন বাচ্চার পরিবারই দেখা যেত। তিন বাচ্চার পরিবারের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক ব্যাপারটি হলো, প্রথম বাচ্চার প্রতি বাবা-মায়ের আলাদা একটা টান তো থাকেই, আর শেষ বাচ্চাও হয়ে থাকে সবার চোখের মণি। সমস্যাটা হয় মাঝখানের বাচ্চাটিকে নিয়ে। সে সবার প্রথমও না, সে সবার শেষও না। পৃথিবীতে আসার ক্ষেত্রে যেমন সে মাঝারি, তার প্রতি সকলের ভালোবাসাও যেন মাঝারি। বড় ও ছোট বাচ্চার মতো সকল স্নেহ-মমতা পায় না সে, বরং তার ক্ষেত্রেই জোটে বেশিরভাগ বকুনি ও মার খাওয়া। এই সিরিজের হারশুও তেমনই বাবা-মায়ের মেজো সন্তান, আর সে কারণে প্রায়সই তার কাছে মনে হয় সে সবচেয়ে বেশি ‘নেগলিজেন্স’-এর শিকার। কিন্তু তার কাছে যা মনে হয়, তা যে আসলে সত্যি না, বরং তার প্রতিও বাবা-মায়ের সমান ভালোবাসা আছে, এই জিনিসটি ধীরে ধীরে পরিষ্কার হতে থাকে তার কাছে।
ভাই-ভাই, ভাই-বোন, মা-ছেলে, মা-মেয়ে, বাবা-ছেলে, বাবা-মেয়ে এবং স্বামী-স্ত্রী, প্রতিটি সম্পর্কেরই যে নির্দিষ্ট মাত্রা ও সৌন্দর্য রয়েছে, হারশুর কাছে পেঁয়াজের খোসা ছাড়াবার মতো করেই যেন একে একে সবকিছু খোলাসা হতে থাকে। জীবনে পারিবারিক বন্ধনের চেয়ে বড় আর কিছুই যে হতে পারে না, এই চরম সত্য হারশু যেমন শিখতে পারে, তার সাথে সাথে শিখতে পারি আমরা সাধারণ দর্শকরাও। পরিবার সম্পর্কে খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা একেবারে সহজ ভাষায় তুলে ধরা হয়েছে এই সিরিজে,
পরিবারকে কেউ ভোলে না। বাচ্চারা আয়নায় নিজের মুখ চেনার আগে, পরিবারের অন্যদের মুখ চিনে যায়। নিজের নাম সে পরে জানে, আগে সে পরিবারের অন্যদের নাম জানে। নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়ার আগেই সে পরিবারের অন্যদেরকে বুঝতে পারে। এজন্যই, মানুষ পরিবারের নয়, পরিবার মানুষের অংশ হয়। এবং হয়তো সে কারণেই, আমরা নিজেদের স্বার্থের চেয়ে পরিবারের স্বার্থকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকি। এই বিশাল মহাজগতের মাঝে আমাদের পরিবারকে হয়তো খুবই ছোট মনে হয়, কিন্তু আমাদের কাছে পরিবারই আমাদের মহাজগৎ।
কৈশোর
এই সিরিজের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো কৈশোর। আমাদের দৈনন্দিন পারিবারিক জীবনচিত্রকেই এই সিরিজে দেখানো হয়েছে, তবে কোনো পরিণত দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, ১২ বছর বয়সী হারশুর দৃষ্টিকোণ থেকে। তাই তো প্রায় সকল ক্ষেত্রেই হারশুর মা সঠিক, এবং হারশু ভুল হলেও, শুরুতে আমরা অবচেতন মনেই হারশুর পক্ষ নিতে থাকি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মা-ই যে সঠিক, তা হারশু উপলব্ধি করতে পারে। তখন হারশুর পাশাপাশি আমাদেরও তা মেনে নিতে একদমই কষ্ট হয় না।
কৈশোর জীবনের খুঁটিনাটি ব্যাপারগুলোকে অনেক বেশি বাস্তবসম্মত করে দেখানো হয়েছে এই সিরিজে। একটি উদাহরণ দিই। নেটফ্লিক্সের মতে এই সিরিজ দেখতে পারবে ৭ বছরের উর্ধ্বে যে কেউই। তার মানে এই সিরিজে অশ্লীল বা ছোটদের অনুপযোগী কিছু নেই অবশ্যই। কিন্তু এই সিরিজেরই একটি পর্বে আমরা দেখতে পাই মাঝরাতে উঠে টিভি খুলে ফ্যাশন টিভিতে বিকিনি পরা মেয়েদের র্যাম্পওয়াক দেখা বা ছাদে পর্ন ম্যাগাজিন নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে নগ্ন নারীদেহ দেখা। এই সিরিজেই আমরা হারশুর মায়ের মুখে বলতে শুনি, “এবার বুঝলাম ও (হারশু) কেন আজকাল বাথরুমে গিয়ে এত বেশি সময় লাগায়,” এবং তারপর তাকে আরো দেখি ছেলেরা যেন বাথরুমে গিয়ে ‘কিছু’ করতে না পারে সেজন্য বাথরুমের দরজায় শ্রীকৃষ্ণের ছবি লাগিয়ে দিতে।
আবার এই সিরিজেই আমরা দেখি হারশু তার ‘ক্রাশ’ বিদ্যার কথা চিন্তা করে রাতের ঘুম হারাম করছে, বিদ্যাকে ‘ইমপ্রেস’ করতে শ্যাঙ্কির কথামতো নিত্যনতুন পরিকল্পনা করছে। প্রতিটি বিষয়ই এই সিরিজে খুবই সহজসরলভাবে দেখানো হয়েছে, দর্শকমনে কোনোপ্রকার সুড়সুড়ি না জাগিয়েই। কারণ এই সিরিজের লেখক ও পরিচালক কৈশোর ও বয়ঃসন্ধিকালীন সময়টাকে শতভাগ বাস্তবসম্মত করে তুলতে চেয়েছেন, সুড়সুড়িজাতীয় অশ্লীলতার মাধ্যমে বিষয়গুলোকে অতিরঞ্জিত করতে চাননি। আর সেটি তারা খুব ভালোভাবেই পেরেছেন। কখনোই বিষয়গুলোকে আরোপিত মনে হয়নি।
কৈশোরজীবনের অপর যে বিষয়টি দর্শকমনে নাড়া দেয়ার মতো, তা হলো হারশু-শ্যাঙ্কির বন্ধুত্ব। প্রায় প্রতিটি কিশোরের জীবনেই একজন এমন বন্ধু থাকে, যার কাছে জীবনের গোপনতম কথাটাও খুলে বলা যায়, তার পরামর্শ নেয়া যায়। হারশুর ক্ষেত্রে শ্যাঙ্কি ঠিক তেমনই একজন। যেকোনো সমস্যাতেই হারশুর পরম ভরসাস্থল হলো শ্যাঙ্কি। দুই কিশোরের মধ্যকার রসায়ন কখনো কখনো এতটাই উপভোগ্য ছিল যে, তার কাছে সাধারণ নাটক-সিনেমায় নায়ক-নায়িকার রসায়নকেও নেহাতই পানসে মনে হবে।
নস্টালজিয়া
অপর যে বিষয়টির কথা না বললে এই লেখা অপূর্ণ থেকে যাবে, সেটি হলো নস্টালজিয়া। ‘নাইন্টিজ কিড’-দের কাছে এই সিরিজটিকে মনে হবে যেন গুপ্তধনের অফুরন্ত ভাণ্ডার। ৯০’র দশকে যাদের ছেলেবেলা ছিল, তারা মনে করে তাদের মতো ভাগ্যবান আর কেউই হতে পারবে না। আসলেই যে তারা কতটা ভাগ্যবান ছিল, তার ছাপ লেগে আছে এই সিরিজের প্রতিটি পরতে পরতে। ৯০’র পপ-কালচার রেফারেন্সগুলোর এত সুন্দর ব্যবহার করা হয়েছে যে, দর্শকের কাছে মনে হবে সে যেন হঠাৎ করে ৯০-র দশকেই ফিরে গেছে। তখনকার সময় হয়তো আজকের মতো ঘরে ঘরে কম্পিউটার, হাতে হাতে স্মার্টফোন ছিল না, কিন্তু একটি ওয়াকম্যান কিংবা একটি হাল্ক হোগান কার্ড, কিংবা ‘মারিও’, ‘মনোপলি’ ও ‘ফ্লেমস’ কীভাবে কাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠতে পারে, সে দৃষ্টান্তের দেখা মিলবে এই সিরিজে।
কিংবা শুধু সময়ের নস্টালজিয়াই কেন বলছি, নস্টালজিয়া হতে পারে বয়সেরও। ১২ বছর বয়সী হারশুর চিন্তাধারা দর্শককেও ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারে তাদের শৈশবে, আর হারশুর বাবা-মায়ের চিন্তাধারা দর্শককে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারে তাদের সন্তান লালন-পালনের শুরুর দিনগুলোতে। আপনি কোন দশকে বেড়ে উঠেছেন, কিংবা সন্তানের বাবা-মা হয়েছেন, তাতে কিছু যায় আসে না। নস্টালজিয়ায় আপনি আক্রান্ত হবেনই। কারণ যে চেতনাগুলোর কথা বলছি, সেগুলো চিরন্তন, চিরস্থায়ী।
খলনায়ক যখন সময়
এই সিরিজে কোনো খলনায়ক নেই। নেই কোনো দুষ্টু-দুশমন। কিন্তু এই সিরিজের মাধ্যমে আমরা আরো একবার অনুধাবন করতে পারি, আমাদের জীবনে আরো ভয়ংকর একটি জিনিস আছে। সেটি হলো চিরবহতা সময়। সময় গেলে যে সাধন হবে না, তা হাড়ে হাড়ে টের পাই আমরা। তাই তো সাত পর্বের সিরিজটি শেষ হয়ে গেলে কষ্ট পাই। কিংবা এই সিরিজের আধেয় বিশ্লেষণ করেও যদি দেখি, তিন মাসের গরমের ছুটি শেষ বলে কষ্ট পায় হারশু। অথবা সময় থাকতে কেন বড় ভাইয়ের কদর করেনি সে, এজন্য তার দুঃখ ও অনুশোচনা আকাশ ছোঁয়। সময়ের স্রোতে সম্পর্কগুলোর বাহ্যিক অবয়বেও দূরত্ব জন্মাতে দেখি। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গাব্বু যখন বাসা ছাড়তে থাকে, তখন তার বাবা মাকে বলে, “কেঁদো না, ও তো দুই বছর পরেই আবার ফিরে আসবে,” আর তখন মায়ের সরল প্রশ্ন, “আসলেই কি আসবে?” কারণ সে-ও জানে, সন্তান একবার ঘরছাড়া হলে তার ফিরে আসার সম্ভাবনা খুবই কম।
এরও বেশ আগে, অন্য এক পর্বে আমরা উপলব্ধি করি, বাবা-মা সন্তানের মাঝে তাদের নিজেদের শৈশব-কৈশোরকে খুঁজে পায়। তাই তো হারশু তাড়াতাড়ি বড় হয়ে উঠে ‘স্বাধীনতা’ লাভ করতে চাইলেও, তার মা তাকে বলে, ‘ডোন্ট বি এ ম্যান, বি এ চাইল্ড,” কারণ তিনি জানেন বড় হওয়ায় আসলে কোনো আনন্দ নেই, জীবনের সেরা সময়টুকু কাটে আসলে কৈশোরেই, মায়ের আঁচলের তলাতেই।
অসাধারণত্ব সেট-আপে
এই সিরিজের প্লট খুবই অসাধারণ কিছু, তেমনটা দাবি করবেন না খোদ লেখক-পরিচালকও। কারণ তাদের কাছে কাহিনীর চেয়েও কাহিনীর সেট-আপই গুরুত্ব পেয়েছে বেশি। সেজন্য কাহিনীর সেট-আপ তারা এত অনবদ্যভাবে সৃষ্টি করেছেন যে, প্রথম এক-দুই পর্ব দেখার পর দর্শক নিজেই সম্পৃক্ত হয়ে যাবেন পর্দায় ঘটমান ঘটনাগুলোর সাথে, সংযোগ তৈরি করতে পারবেন পর্দার চরিত্রগুলোর সাথে। আর একটি সিরিজ হৃদয়ের খুব কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়ার মূল শর্ত তো এটিই।
আমরা ছোটবেলায় পাগলের মতো তিন গোয়েন্দা পড়েছি কাহিনীর অসাধারণত্বের কারণে নয়, কিশোর-মুসা-রবিনের মাঝে নিজেদেরকে খুঁজে পেয়েছিলাম বলে। কিংবা এখনো আমরা অধীর আগ্রহ নিয়ে স্ট্রেঞ্জার থিংসের জন্য অপেক্ষা করি এ জন্য নয় যে এমন কাহিনী আমরা আগে কখনো দেখিনি, বরং এজন্য যে মাইক-ডাস্টিন-লুকাস-ইলেভেনরা আমাদের আপসাইড ডাউনে নিয়ে যাক না যাক, স্মৃতির ভেলায় চড়িয়ে অতীতে ঠিকই নিয়ে যায়। ইয়ে মেরি ফ্যামিলির ক্ষেত্রেও ঠিক একই কথাই প্রযোজ্য। এই সিরিজটি দেখার পরও দর্শকের কখনো নিজেকে হারশু, কখনো শ্যাঙ্কি, আবার কখনো ডাব্বু বলে মনে হবে। আরেকটু বেশি বয়সী যারা, অর্থাৎ পিতৃত্ব-মাতৃত্বের স্বাদ পেয়েছে, তাদের কাছে বাবা-মায়ের চরিত্র দুটিকেও অনেক বেশি আপনার মনে হবে। সব মিলিয়ে সিরিজটি দর্শককে এতটাই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলবে যে, সেই দর্শক যদি খুব বেশি কঠিন হৃদয়ের অধিকারী না হয়, তবে শেষ পর্বে ‘ধাগা’ গানটি শুরু হওয়ার পর নাকের জলে চোখের জলে এক করতে বাধ্য হবে।
অভিনয়
ও হ্যাঁ, অভিনেতা-অভিনেত্রীদের কথা তো বলতে ভুলেই গেছি। কারণ ইয়ে মেরি ফ্যামিলি দেখতে গিয়ে একবারও কাউকে মনে হয়নি সে অভিনয় করছে। এমনকি যে মোনা সিংকে ইতিপূর্বে বেশ অনেকবার আমরা ছোট পর্দা, বড় পর্দায় দেখেছি, তিনিও মা চরিত্রের সাথে দারুণভাবে মিশে গিয়েছেন। বাবা চরিত্রে অভিজ্ঞ অভিনেতা আকর্ষ খুরানাও চমৎকার অভিনয় করেছেন। বড় ভাই চরিত্রে অহন নির্বাণ মানানসই, আর ছোট বোন চিটঠি হিসেবে রুহি খান খুবই মিষ্টি। শেষ দুই পর্বের আগ পর্যন্ত বিদ্যা চরিত্রটি তেমন প্রাধান্য পায়নি, তবে যখন থেকে চরিত্রটি আলাদা গুরুত্ব লাভ করতে শুরু করেছে, এ চরিত্রে অভিনয় করা রেবাথি পিল্লাইও মুগ্ধ করেছেন। তবে এই সিরিজের সেরা অভিনেতা কে- হারশু হিসেবে বিশেষ বানসাল নাকি শ্যাঙ্কি হিসেবে প্রসাদ রেড্ডি, তা নির্ধারণ করতে যথেষ্ট বেগ পেতে হবে। দুই কিশোরের ভূমিকায় দুজনেই পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেছেন। দর্শক হিসেবে হারশুর সাথে একাত্ম হয়ে যাওয়ার পরও, মনে মনে আফসোস লাগবে, কেন আমাদেরও শ্যাঙ্কির মতো একজন বন্ধু নেই। আর এখানেই প্রসাদ রেড্ডির সার্থকতা। বিশেষের মতো অত বেশি স্ক্রিন টাইম না পাওয়ার পরও, তিনি নিজের জন্য আলাদা একটা অবস্থান গড়ে নিতে পেরেছেন। কেন শুধু তাকে উপজীব্য করে আলাদা একটি পর্ব হলো না, এই বিষয়টি সত্যিই অবাক লাগার মতো।
পরিচালনা ও নির্মাণ
এত সুন্দর একটি সিরিজের আইডিয়া যার মাথা থেকে এসেছে, সেই সৌরভ খান্না, আনন্দেশ্বর দ্বিভেদীর পাশাপাশি এই সিরিজটির সৃজনশীল পরিচালকও। তার যতই প্রশংসা করি, কম হয়ে যাবে। ৯০’র দশককে যতটা মনোমুগ্ধকরভাবে তিনি তার লেখায় নিয়ে এসেছেন, অন্য কেউ হলে বোধহয় তা সম্ভব ছিল না। আর একদম শেষে উল্লেখ করতেই হবে জাহাজের নাবিক সামীর সাক্সেনার কথা। ক্রমশই নিজেকে ছাড়িয়ে যাচ্ছেন তিনি। ট্রিপলিং কিংবা পার্মানেন্ট রুমমেটসে তিনি হয়তো তার প্রতিভার অর্ধেকটা দিয়েছিলেন, কিন্তু ইয়ে মেরি ফ্যামিলিতে ঘটেছে তার প্রতিভার পূর্ণাঙ্গ বিচ্ছুরণ। সম্ভবত সেজন্যই, অনেকের মতে ইয়ে মেরি ফ্যামিলিই টিভিএফ নির্মিত এযাবৎকালের সেরা ওয়েব সিরিজ। কনটেন্ট নির্মাণে তারা যে ঠিক কতটা ডেডিকেটেড, এবং কাজটা যে তারা শুধু মাথা দিয়ে নয়, পুরো হৃদয় দিয়ে করে, তার একটি বাস্তব প্রমাণ ইয়ে মেরি ফ্যামিলি।
শেষ কথা
যারা নস্টালজিক হতে ভালোবাসেন, পরিবারের সবার সাথে মিলে কয়েক ঘণ্টা আনন্দময় সময় কাটাতে চান, নিজেদের ফেলে আসা অতীতের স্মৃতি রোমন্থন করতে চান, কিংবা নিছকই বিনোদিত হতে চান, তাদের জন্য দারুণ একটি অপশন হতে পারে ইয়ে মেরি ফ্যামিলি। মাত্র সাত পর্বের সিরিজ, প্রতিটি পর্বও গড়ে মাত্র ৩০-৩২ মিনিট করে। তাই এক বসায় পুরো সিরিজটি দেখে শেষ করতে কোনো সমস্যাই হবে না। তবে একবার সিরিজটি দেখলে, নিঃসন্দেহেই এই অভিজ্ঞতার রেশ থাকবে বহুক্ষণ। শুরু হবে নতুন অপেক্ষাও, কবে আসবে দ্বিতীয় সিজন!
চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/