কোঁকড়ানো চুলগুলোকে জেল দিয়ে সোজা করে রাখতেন ব্র্যাড ডেলসন। উদ্দেশ্য একটাই, ছোটবেলা থেকে গান্স এন রোজেস ও মেটালিকার ভক্ত ব্র্যাডকে যে তার হিরোদের মতোই চুলের স্টাইল করতে হবে!
কিন্তু কে জানত, কয়েকবছর পর তা কোঁকড়ানো চুলই আলাদা স্টাইল নিয়ে আসবে রক মিউজিকের জগতে, সাথে কানের মধ্যে হেডফোনও!
কনসার্টে লিড গিটার বাজানোর সময় কেন হেডফোন পরেন তিনি, তা ব্র্যাড ডেলসনের নিজেরও অজানা। কোনো একসময় পড়ার পর থেকে ভালো লেগে যাওয়াও সেটি ধরে রাখেন এখনো অব্ধি।
জোম্বা মিউজিকে ইন্টার্নশিপ করতে এসে অফিসের দেয়ালে কর্ন আর লিম্প বিজকিট ব্যান্ডের পোস্টার দেখে নিজের ভেতরেও ব্যান্ড গড়ে তোলার সুপ্ত ইচ্ছা জেগে ওঠে তার। জোম্বা মিউজিক অফিসের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেফ ব্লু কে নিজের ইচ্ছার কথাও জানান ব্র্যাড। জিরো নামের ব্যান্ড দিয়ে বিশ্বকে নিজেদের আগমনী বার্তা দেওয়ার জন্যও দ্রুত তৈরিও হয়ে যায় তারা।
অতঃপর ব্র্যাডের কথায় রাজি হয়ে জেফ ব্লু তাদের কিছু গান শুনে আপ্লুত হয়ে সর্বোচ্চভাবেই উৎসাহী করে তোলেন স্বপ্নে বিভোর কয়েকজন তরুণকে। উৎসাহ পেয়ে অধিক উদ্যমে ঝাপিয়ে পড়ে তারা। এর পরেই আর পিছে ফিরে তাকাতে হয়নি জিরো ব্যান্ডের। আজ বিশ্বব্যাপী সেই ব্যান্ডটি পরিচিত লিংকিন পার্ক নামে।
মাইক শিনোদা ও ব্র্যাড ডেলসনের বন্ধুত্ব ১৩ বছর থেকেই। জাপানী-আমেরিকান বাবার সন্তান মাইক ছোটবেলা থেকেই র্যাপ সঙ্গীতের ভক্ত। কলেজে কাজে লাগবে এই ভেবে ছোটবেলা থেকেই তার মা তাকে পিয়ানো শিখতে উৎসাহী করে তোলেন।
তবে মাইক ছিলেন সঙ্গীত প্রডিজি। তাই তার প্রতিভা শুধু পিয়ানোতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। কিবোর্ড, গিটার, ড্রামসসহ প্রায় ২৭টি বাদ্যযন্ত্রে পারদর্শী তিনি। ১৯৯৬ সালে মাইক দুই বন্ধু ব্র্যাড ডেলসন আর রব বার্ডনকে নিয়ে তৈরি করেন জিরো ব্যান্ড।
নিজের বেডরুমকে ছোটখাট স্টুডিওতে পরিণত করে সেখানে চারটি ট্র্যাকও তৈরি করেন মাইক। রব বার্ডনের রুমমেট ডেভ ফ্যারেলও দলে যোগ দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। তখনও দলে বেজ গিটারিস্টের জায়গাটি শূন্য। সেই জায়গাটিই দখল করে নেন ডেভ ফ্যারেল।
এদিকে আর্ট স্কুলে থাকার সময় মাইকের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে জো হানের। নিজেদের হিপ হপ প্রীতি ও সঙ্গীত নিয়ে চিন্তা ধারার মিল পেয়ে মাইক হানকেও দলে নিয়ে নেন। জো হান বনে যান জিরো ব্যান্ডের ডিজে। কো ভোকাল হিসেবে মাইক নিজে থাকলেও ভোকাল হিসেবে মার্ক ওয়েকফিল্ডকে নিয়ে পুরো পরিপূর্ণ একটি ব্যান্ডে রুপান্তরিত করেন জিরোকে।
কিন্তু বেশিদিন আগ্রহ থাকেনি ওয়েকফিল্ডের। তখনো কোনো স্টুডিও না পেয়ে ওয়েকফিল্ড দল ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন।
মাইক শুরু থেকেই চেয়েছেন এমন একজনকে, যার গান ও ব্যান্ডের প্রতি আবেগ ও তুমুল ভালোবাসা কাজ করবে- পেশাদারিত্বের বাইরেও আবেগ দিয়ে গান গাইবেন, এমন কেউ।
ঠিক সেই সময়টাতে অ্যারিজোনার ফিনিক্সে আরেক তরুণ রকস্টার হওয়ার স্বপ্নে মত্ত। স্থানীয় এক রকব্যান্ড গ্রে ডেইজে গানও গাইত সেই তরুণ। তবে চেস্টার বেনিংটন নামের সেই তরুণের ছিল আরো বড় উচ্চাকাঙ্ক্ষা। আবার চেস্টার নিজেও জানত, অ্যারিজোনায় পড়ে থাকলে তার আশা কখনো পূরণ হবে না! এদিকে জিরো ব্যান্ডও তাদের ভোকাল খুঁজছিল।
পরবর্তীতে এই চেস্টারকেই আবিষ্কার করেন জেফ ব্লু। তিনি জিরোর কিছু গানের টেপ পাঠিয়ে দেন চেস্টারের কাছে। ‘অ্যা প্লেস ফর মাই হেড‘ গান শুনে চেস্টার অভিভূত হন। পরবর্তীতে তিনি জানান যে, মাইকের র্যাপিংয়ে তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন, এবং ভেবেছিলেন এই ব্যান্ডের সাথে যুক্ত হলে নিজের গানের গলারও উন্নতি হবে।
চার মাস ধরে অডিশন নেওয়া জিরো ব্যান্ডের সাথে এবার লস এঞ্জেলসে দেখা করতে গেলেন চেস্টার। সবেমাত্র বান্ধবী সামান্থাকে বিয়ে করেছেন চেস্টার। অ্যারিজোনাতে একটি ভালো চাকরিও জুটেয়েছিলেন। কিন্তু নিজের গানের প্রতি টান থেকেই সব ছেড়ে চলে আসেন লস এঞ্জেলসে। আর চেস্টারের জাদুকরী গলায় জিরো ব্যান্ডও সন্তুষ্ট হয়।
চেস্টার দলে যোগ দেওয়ার পর জিরো থেকে ব্যান্ডের নাম হয় হাইব্রিড থিওরি। কিন্তু নামটা কিছুদিন পর কারো কাছেই জুতসই মনে হলো না। পরবর্তীতে চেস্টার সান্তা মনিকার লিংকন পার্কের নামানুসারে নাম করার পরামর্শ দেন।
কিন্তু ওয়েবসাইট ডোমেইন কিনতে গেলে দেখা গেলো, লিংকন পার্ক নামে কোনো ডোমেইন খালি নেই। আশেপাশের নামের মধ্যে রয়েছে লিংকিন পার্ক নামে একটি নাম। অবশেষে এই নামেই সবাই একমত হন। ব্র্যাড জানান সবাই একদিক থেকে খুশি ছিল, কেননা এই নামের কোনো অর্থ নেই। অর্থহীন নাম লিংকিন পার্ক দিয়েই যাত্রা শুরু রক জগতের অন্যতম জনপ্রিয় এই ব্যান্ডের।
কিন্তু এরপরই আসে দুঃস্বপ্ন। সব স্টুডিও থেকে প্রত্যাখাত হওয়া শুরু হয় লিংকিন পার্কের। ৪২টি স্টুডিও থেকে খালি হাতে ফিরে অবশেষে ১৯৯৯ সালে ওয়ার্নার ব্রোস রেকর্ডারের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয় লিংকিন পার্ক। এর পরের বছরেই তারা কাজ শুরু করে নিজেদের প্রথম অ্যালবামের।
২০০০ সালের মার্চ মাসে উত্তর হলিউডের এনআরজি স্টুডিওতে কাজ শুরু করে লিংকিন পার্ক। যে অ্যালবামের বেশিরভাগ গানই মাইক নিজের বাসায় বসে বসে লিখেছেন ব্যান্ড হওয়ার শুরুর দিনগুলোতেই। কিছু গান স্টুডিওতেও লেখা হলো।
চেস্টারের প্রচেষ্টায় গানের কথাগুলোর গূঢ় অর্থ আরো গভীর করা হলো। অ্যালবামের ক্রলিং গানটির লিরিক্স পুরোটাই নিজে লিখেছেন চেস্টার বেনিংটন। আর এই অ্যালবামের কাজ করার মধ্য দিয়ে চেস্টার আর মাইকের মধ্যে গড়ে উঠলো গভীর বন্ধুত্ব।
হাইব্রিড থিওরি নামের সেই অ্যালবামটি প্রকাশ পাবার আগেই একটি ঘটনা সবাইকে জানান দিয়েছিল যে, এই অ্যালবামটি পুরো বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিতে যাচ্ছে।
একটি রেডিও স্টেশন প্রথম সিঙ্গেল ‘ওয়ান স্টেপ ক্লোজার’ এর ভিডিও প্রকাশ করেছিল। সেটি ফেলেছিল অভূতপূর্ব সাড়া। অ্যালবাম প্রকাশ পাবার কয়েকদিন আগে চেস্টার মেক্সিকোতে ছুটি কাটানোর সময় দুই তরুণী এসে চেস্টারের হাতের ট্যাটুর দিকে ইঙ্গিত করে বলাবলি করছিল, এই লোকটিই সেই ভিডিওতে ছিল না!
মোটামুটি তখন সব জায়গায় নতুন অল্টারনেটিভ রক অ্যালবাম হাইব্রিড থিওরি নিয়ে আগ্রহ জন্মে গিয়েছিল। যা অনুমান করা হয়েছিল, তা-ই হলো। ২০০০ সালের ২৪ অক্টোবর মুক্তি পায় হাইব্রিড থিওরি। প্রথম দিনেই ইউএস বিলবোর্ড ২০০ চার্টে ২৯ নাম্বার জায়গা দখল করে অ্যালবামটি, পরবর্তীতে সর্বোচ্চ উঠেছিল ২ নম্বরে।
প্রথম সপ্তাহে শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই অ্যালবামটি বিক্রি হয় ৫০ হাজার কপি। চার সপ্তাহ পরে ৫ লাখ কপি বিক্রয় করে সার্টিফাইড গোল্ড খেতাব পায় অ্যালবামটি। এমনকি দুই বছর পরও সপ্তাহে ১ লাখের মতো অ্যালবাম বিক্রি হয়েছে। এখন পর্যন্ত ৩২ মিলিয়ন কপি বিক্রয় হওয়া হাইব্রিড থিওরি একবিংশ শতাব্দীর অন্যতম সেরা বিক্রিত হওয়া অ্যালবাম।
ব্র্যাড ডেলসনের প্রিয় ব্যান্ড গান্স এন রোজেস এর ১৩ বছর আগে বের হওয়া অ্যালবাম এপেটাইট ফর ডেস্ট্রাকশন এর পর ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি বিক্রিত হওয়া অভিষিক্ত অ্যালবাম হলো হাইব্রিড থিওরি।
শুধু ব্যবসায়িক সাফল্য নয়, ক্রিটিক্সেও বাজিমাত করে হাইব্রিড থিওরি। নবাগত ব্যান্ড হিসেবে গ্র্যামি নমিনেশন ছাড়াও ক্রলিং এর জন্য বছরের সেরা রক গানের পুরষ্কার জিতে নেয় লিংকিন পার্ক। গ্র্যামি ছাড়াও আমেরিকান মিউজিক এওয়ার্ড, এমি এওয়ার্ডসহ অনেক পুরস্কারই ঘরে তোলে ব্যান্ডটি।
হাইব্রিড থিওরির পর মূল ধারার আরো ছয়টি এলবাম প্রকাশ করে লিংকিন পার্ক। সব অ্যালবামই বিলবোর্ড টপ চার্টে স্থান করে নেয়। তবে তাদের উত্থানের শুরু হাইব্রিড থিওরি দিয়েই।
পেপারকাট, ইন দ্য এন্ড, ক্রলিং, ওয়ান স্টেপ ক্লোজার এর মতো গানগুলো দিয়েই পৃথিবী জুড়ে লাখো ভক্ত তৈরি করেছে লিংকিন পার্ক। কে জানতো, যদি না ব্র্যাড ডেলসন ইন্টার্নশিপ করার সুযোগ পেতেন জোম্বা মিউজিকে, তাহলে আদৌ কি আমরা লিংকিন পার্ক পেতাম, শুনতে কি পারতাম হাইব্রিড থিওরি!