কোনো দেশকে জানতে চাইলে সেই দেশের ইতিহাস, ভূগোল, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা থাকা প্রয়োজন। শুধু তা-ই নয়, সেখানকার উৎসবগুলোও দেশটিকে জানতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উৎসবের মধ্য দিয়ে একটি জাতির স্বকীয়তা, নিজস্ব ধ্যান-ধারণা, আশা-আকাঙ্খা ও আনন্দ-উদ্দীপনার এক উজ্জ্বল রূপ প্রকাশিত হয়।
কেরালার জাতীয় উৎসব ‘ওনাম’ সেখানকার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে জানার এক প্রধান উৎস। কেরালা, তামিলনাড়ু, কর্ণাটক ও অন্ধ্র প্রদেশের মধ্যে ভাষা ও জাতিগত মিল যেমন আছে, তেমনি সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক অমিলও প্রচুর। সময় ও উৎসব পালনের রীতিনীতির দিক থেকে কেরালার জাতীয় উৎসব ওনামের সাথে প্রতিবেশী তামিলনাড়ুর পঙ্গল বা কর্ণাটকের দশেরার কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না।
সার্বজনীন ও ধর্ম নিরপেক্ষ এক উৎসব ওনাম
প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাসে কেরালার ওনাম উৎসবটি পালিত হয়। এটি সেখানকার সবচেয়ে বড় এবং ঐ অঞ্চলের সবার কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় এক উৎসব। ভারতের অন্যান্য প্রদেশের উৎসবের সাথে ওনামের পার্থক্য আছে। এই উৎসব সার্বজনীন ও ধর্ম নিরপেক্ষ।
ওনামের উৎসবের সাথে জড়িয়ে আছে হিন্দু পুরাণের এক কাহিনী। তা সত্ত্বেও কেরালার সব ধর্মাবলম্বী মানুষষের কাছে ওনাম বেশ তাৎপর্যবাহী এক উৎসব হিসেবে বিবেচিত। এর পেছনে কারণও রয়েছে। খ্রিস্টান ও ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের সাথে সংখ্যাগুরু হিন্দুদের শান্তি ও বন্ধুত্বপূর্ণ সহাবস্থান কেরালার এক ঐতিহাসিক সত্য। সমাজ জীবন, পোশাক-আশাক এবং শিক্ষা-সংস্কৃতির জগতে কেরালার হিন্দু, খ্রিস্টান এবং মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত লোকদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।
কেরালার সবচেয়ে জনপ্রিয় সাহিত্যিক মুহম্মদ বশির, কমলা সুরাইয়া এবং জনপ্রিয় চিত্রাভিনেতা মামুট্টি ছিলেন মুসলমান। একসময়ের জনপ্রিয় গায়ক যিশু দাস ছিলেন খ্রিস্টান। এমনকি হিন্দু ধর্মের ঐতিহ্যমন্ডিত বিখ্যাত কথাকলি নৃত্যের আবহসঙ্গীতের নামকরা একজন জনপ্রিয় গায়কের নাম হায়দার আলী। শুধু তা-ই নয়, সামাজিক অনাচার ও কুপ্রথার বিরুদ্ধে সব সম্প্রদায়ের যুবকরা সমানে উৎসাহী। বহু বছরের অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধারক কেরালার জনগণ তাই এই ওনাম উৎসবকে নিজেদের জীবনের সাথে একাত্ম করে নিয়েছে। সব ধর্মের মানুষের এক মিলন মেলা এই উৎসব। রাজ্যের সমস্ত ধর্মের, জাতের মানুষ একত্রিত হন এই উৎসবে।
ওনাম উৎসবের সাথে জড়িয়ে আছে এক পৌরাণিক গল্পগাঁথা
পুরাণের যে চরিত্রের স্মৃতির উদ্দেশ্যে এই উৎসব পালিত হয়, তিনি কোনো দেবতা নন, তিনি একজন অসুর। তার নাম মহাবলী। পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী, পুরাকালে এই অসুররাজ কেরালায় রাজত্ব করতেন। তখন কেরালার স্বর্ণযুগ। অসুর হয়েও রাজ্যের সকল প্রজার প্রতি ছিল তার উদার দৃষ্টিভঙ্গি। রাজ্যে ছিল না কোনো অভাব, ছিল না ঐশ্বর্যের কমতি।
সেই সাথে মহাবলী ছিলেন তেজস্বীও। তার দাপটে দেবতারা সর্বদা থাকতেন তটস্থ। দেবতাদের আসন তখন টলমল অবস্থায়। ফলে দেবতারা ভগবান বিষ্ণুর শরণাপন্ন হলেন। অসুররাজকে দমন করার জন্য ভগবান বিষ্ণু বামন অবতার রূপে কেরালায় অবতীর্ণ হলেন। মহাবলী যেমন বীর, তেমনি দানশীল। সাহায্যপ্রার্থী কাউকে তিনি ফেরাতেন না। এই সুযোগটি নিলেন বিষ্ণু। তিনি সাহায্যপ্রার্থী হয়ে মহাবলীর কাছে উপস্থিত হলেন।
বামন দেব মহাবলীর কাছে বসবাসের জন্য তিন পদক্ষেপ মাপের জমি চাইলেন। মহাবলি বামনরূপী বিষ্ণুকে চিনতে পারলেন না। তাই বামনের প্রার্থনা মঞ্জুর করলেন। প্রথমবার পা রাখতেই বিষ্ণু গোটা পৃথিবী অতিক্রম করেন। দ্বিতীয়বার শেষ করেন স্বর্গ ও পাতাল। তৃতীয়বার পা তুলে মহাবলিকে প্রশ্ন করেন, “কই? আর একবার পা রাখার জায়গা কোথায়? স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল যে শেষ।”
মহাবলি সবই বুঝলেন, কিন্তু তিনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। মাথা নিচু করে মহাবলী বামন দেবকে তার মাথায় পা রাখতে বললেন। বামন তখন মহাবলির মাথায় পা রেখে এত জোরে চেপে দেন যে মহাবলী মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়েন। শেষ মুহূর্তে মহাবলি কাতর কন্ঠে বিষ্ণুর কাছে অনুরোধ জানালেন, তিনি যেন তার প্রিয় রাজ্যে প্রতিবছর একবার এসে প্রিয় প্রজাদের দেখে যেতে পারেন। বিষ্ণু মহাবলীর প্রার্থনা মঞ্জুর করেন। বামন দেবের আশীর্বাদে পৃথিবীর অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন মহাবলী। ধারণা করা হয়, ওনাম উৎসবের মাধ্যমে অসুররাজ মহাবলী তার প্রিয় কেরালায় ফিরে আসেন। তার আগমন উপলক্ষে পালিত হয়ে থাকে এই ওনাম উৎসব।
দশ দিনের আয়োজন
প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসে দশ দিনব্যাপী চলে এই ওনাম উৎসব। এই দশ দিন নানা আচার ও আয়োজনের মধ্যে দিয়ে পালিত হয়। তবে উৎসবের প্রথম ও শেষ দিনটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
১ম দিন: আত্তম
ওনামের দশদিন আগে হলো ‘আত্তম’ নক্ষত্র। সকালে স্থানীয় মন্দিরে দেবতার কাছে প্রসাদ নিবেদন করে ওনাম উৎসবের আয়োজন শুরু হয়। সেদিন প্রত্যেক বাড়ির উঠোনে ফুলের এক বৃত্ত এঁকে ওনাম উৎসবের সূচনা হয়। এই আল্পনাকে বলা হয় পোক্কালম। প্রতিদিন এই বৃত্তের সংখ্যা বাড়ে একটি করে। অর্থাৎ, ওনাম দিনের সকালে বৃত্তের সংখ্যা দাঁড়ায় দশটি। সেদিন সকালে ছেলেমেয়েরা শেষ বৃত্ত রচনা করে নানা বর্ণের ফুল দিয়ে। তবে প্রথমদিন হলুদ ফুলের প্রাধান্য থাকে। উৎসবের পরের দিনগুলোয় বিভিন্ন ফুল আল্পনাতে যুক্ত হতে থাকে।
২য় দিন: চিথিরা
উৎসবের দ্বিতীয় দিন সকলে তাদের বড়িঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখে। স্থানীয়রা উৎসব উপলক্ষে ঘর-বাড়িতে রং করে, আলোকসজ্জা দিয়ে বাড়ির চারপাশ সাজিয়ে তোলে। বাড়ির সদর দরজায় আল্পনা আঁকা হয়।
৩য় দিন: চোধি
উৎসবের তৃতীয় দিন যেন কেনাকাটার উৎসব। উৎসব উপলক্ষে সকলেই তাদের সাধ্যমতো নিজেদের জন্য, পরিবারের জন্য এবং আত্মীয়-স্বজনদনের জন্য উপহার সামগ্রী, উৎসবের পোশাক কিনে থাকেন।
৪র্থ দিন: ভিসাকাম
উৎসবের এই দিন দুপুরে আয়োজন করা হয় মহাভোজের। স্থানীয় মালয়ালম ভাষায় তাকে বলা হয় সাদ্য। কেরালার প্রতিটি বাড়িতেই তা বানানো হয়। একেবারে যাকে বলে পঞ্চব্যঞ্জন সহকারে রান্না। ২৬ এর অধিক পদ থাকে খাবারের তালিকায়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো তিনরকম কলা ভাজা, পাঁপড়, থোরান, মেজহুক্কুপুরাত্তি, কালান, ওলান, আভিয়াল, সাম্বার, ভাত, ডাল, চার রকম আচার, দুই-তিন পদের পায়েস- সে এক এলাহি ব্যাপার।
৫ম দিন: আনিঝাম
ওনামে নৌকা বাইচ নিয়ে প্রচুর হইচই হয়। কেরালা হলো নদীনালা ও হ্রদের দেশ। সমুদ্রের সমান্তরালে যে লবণ হ্রদমালা রয়েছে, সেসব এলাকা এই নৌকা বাইচের উত্তম স্থান। আর উৎসবের পঞ্চম দিন সারা রাজ্য জুড়ে আয়োজিত হয়ে থাকে নৌকা বাইচ। বড়-বড় নৌকার সত্তর-আশিজন লোক গান করতে করতে মহা উৎসাহে এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। যে নৌকা প্রথম হয়, তার চালকরা পুরস্কৃত হন। এই প্রতিযোগিতায় চল্লিশ থেকে পঞ্চাশটি পর্যন্ত নৌকা থাকে, যা দেখার জন্য হ্রদ বা নদীর ধারে লোকেরা ভিড় করে নিজ নিজ গ্রামের দলকে উৎসাহ দেন।
৬ষ্ঠ দিন: থিরিকেটা
উৎসবের এই দিনে পোক্কলমের আকার বাড়তে থাকে। অনেকে এই দিনটিতে প্রিয়জন, আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে বেড়াতে যান। অনেকে আবার পূর্বপুরুষদের শ্রদ্ধা জানাতে তাদের ভিটেমাটি থেকে ঘুরে আসেন।
৭ম দিন: মুলাম
উৎসবের সপ্তম দিনে উৎসব যেন আরও জাঁকজমকপূর্ণ হয়ে ওঠে। পরিবার পরিজন নিয়ে সবাই মেতে ওঠে উৎসবের আনন্দে। মন্দিরগুলোতে বিশেষ প্রসাদ সাদ্যর আয়োজন করা হয়। বাড়িতে, উৎসবের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মেয়েরা কেরালার বিখ্যাত লোকনৃত্য কায়কোট্টিকলির আয়োজন করে থাকে। এছাড়াও থিরুভাতিরাকলি, পুলিকলি, থুম্বি থুল্লাল ও কথাকলির মতো নৃত্যকলা পেশ করা হয়। শুধু নারীরাই নন, পুরুষরাও এতে অংশ নেয়। প্রতিটি নৃত্যই একে অপরের চেয়ে আলাদা।
৮ম দিন: পুরাদম
উৎসবের অষ্টম দিনে মহাবলী ও বামন দেবতার ছোট মূর্তি এনে ফুলের সাজানোর আল্পনার মাঝে স্থাপন করা হয়। এর মধ্য দিয়ে মহাবলীকে রাজ্যবাসী তাদের বাড়িতে আনুষ্ঠানিকভাবে আমন্ত্রণ জানায়। পোক্কালমের কারুকাজ যেন আরও আকর্ষণীয় ও বর্ণিল হয়ে ওঠে।
৯ম দিন: উথরাদম
ওনাম সন্ধ্যা হিসেবে দিনটি পালিত হয়। পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী, উৎসবের শেষ চারদিন রাজা মহাবলী রাজ্য ভ্রমণে বের হয়ে প্রজাদের আশীর্বাদ করেন। তাই উৎসবের শেষ দিনগুলো শুভদিন হিসেবে মানা হয়। নানা উপাদেয় খাবার-দাবার, নানা আনন্দ আয়োজনের মধ্যে দিয়ে উৎসবের এই দিনটি পালিত হয়।
১০ম দিন: থিরুভুনাম
ওনাম উৎসবের শেষ দিন হলো থিরুভুনাম। সকালে স্নান সেরে নতুন কাপড় পরে ঘরবাড়িতে নতুন করে আল্পনা দেয়া হয়। সরকারিভাবে সারা রাজ্যে আলোকসজ্জা ও আতশবাজির ব্যবস্থা করা হয়। শহরজুড়ে বের হয় বর্ণিল শোভাযাত্রা। এসব শোভাযাত্রায় থাকে কেরালার ঐতিহ্যবাহী সঙ্গীত ও নৃত্য। উৎসব উপলক্ষে রাজ্যের গ্রামগুলোতে স্থানীয় নানা ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলার আয়োজন করা হয়।
এভাবে বেশ জাঁকজমক আর ধুমধামের সাথে উৎসবের শেষ দিনের সমাপ্তি ঘটে। আর উৎসবের সমাপ্তির মধ্য দিয়ে বছরব্যাপী সুদীর্ঘ অপেক্ষায় বসে থাকেন কেরালাবাসী, কবে তিনি আসবেন।
ফিচার ইমেজ- BhagwanBhajan.com