স্বর্ণকেশী সৌন্দর্যের রানী মেরিলিন মনরো। লাস্যময়ী হাসি, সুমিষ্ট কণ্ঠ আর তীক্ষ্ণ চাহনিতে তিনি ঝড় তুলেছিলেন, এবং এখনো তুলে চলেছেন, বিশ্বব্যাপী লক্ষ লক্ষ মানুষের হৃদয়ে।
তাই তো মনরোর অকাল মৃত্যু, যেটিকে অনেকে আত্মহত্যা হিসেবে চিহ্নিত করে থাকেন, গণমানুষের মনোজগতে ফেলেছিল ব্যাপক প্রভাব। দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদন বলছে, মনরোর মৃত্যুর এক সপ্তাহ পর নিউ ইয়র্ক শহরে আত্মহত্যার সংখ্যা পূর্বের সকল রেকর্ডকে ছাপিয়ে গিয়েছিল। একই দিনে আত্মহত্যা করেছিল ১২ জন, যাদের মধ্যে একজন তো সরাসরিই সুইসাইড নোটে লিখে গিয়েছিল,
“যদি জগতের সবচেয়ে চমৎকার, সুন্দর সৃষ্টিটিই বেঁচে থাকার কোনো কারণ খুঁজে না পায়, তাহলে আমিই বা কীভাবে পাই!”
অর্থাৎ বেশিরভাগ মানুষ মনরোর বাহ্যিক রূপটাই দেখেছে, সেই রূপে হয়েছে মোহাবিষ্ট। তবে আজ আমরা মনরোর রূপ-সৌন্দর্য নিয়ে কথা বলব না, কেননা সেটি ইতোমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত সত্য। বরং আমরা কথা বলব তার ব্যক্তিত্বের এমন কিছু দিক নিয়ে, যেগুলো অনেকেরই অজানা।
একজন বইপ্রেমী
চলচ্চিত্র জগতের অনেকেই আড়ালে মনরোকে ডাকত ‘ডাম্ব ব্লন্ড’ হিসেবে। তার চেহারাটাই কেবল সুন্দর, মাথায় কিছু নেই, এমনটিই ছিল তাদের ধারণা। সুতরাং তাকে এমন একজন ব্যক্তি হিসেবে কল্পনা করা কঠিনই বৈকি, যে বিভোর হয়ে বইয়ের পাতায় ডুবে আছে, পাতার পর পাতা পড়ে চলেছে অপরিসীম বিস্ময়ে।
কিন্তু বিস্ময়কর হলেও সত্য, মনরো প্রকৃতপক্ষেই ছিলেন এমন একজন ব্যক্তি। তার ছিল ব্যক্তিগত বইয়ের মোটামুটি সমৃদ্ধ একটি সংগ্রহ, যেখানে ছিল ৪৩৭টি বই। প্রায় প্রতিটি বই-ই অরিজিনাল কপি, কিছু কিছু আবার প্রথম সংস্করণের, এবং বইগুলোর পাতায় পাতায় ছিল তার স্বহস্তে রচিত চিরকুট।
কেউ যেন মনে না করেন মনরো শুধু বই জমাতেন। তিনি সেগুলো পড়তেনও। এবং বই পড়ার স্থান নির্বাচনে কোনো বাছ-বিচার করতেন না তিনি। সুযোগ পেলে যেকোনো জায়গায় বই হাতে নিয়ে বসে পড়তেন। এমনকি একবার পরিচালক জোসেফ মানকিউইচ তো মনরোকে ‘অল অ্যাবাউট ইভ’ (১৯৫০) ছবির সেটেও বই পাঠরত অবস্থায় আবিষ্কার করেছিলেন।
সেদিন মনরোর হাতে ছিল রেইনার মারিয়া রিলকের লেখা ‘লেটার্স টু আ ইয়ং পোয়েট’ বইটি। মানকিউইচ তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কীভাবে তিনি ওই নির্দিষ্ট বইটি বেছে নিয়েছিলেন পড়ার জন্য। প্রত্যুত্তরে মনরো বলেছিলেন:
“যেসব রাতে আমার আর কিছু করার থাকে না, আমি হলিউড বুলভার্দের পিকউইক বুকস্টোরে চলে যাই, এবং এলোপাতাড়িভাবে একেকটি বই খুলতে থাকি। যখনই আমি এমন কোনো পাতা বা অনুচ্ছেদ খুঁজে পাই যেটি আমার মনে ধরছে, আমি বইটি কিনে ফেলি। তো এভাবেই আমি গত রাতে এই বইটি কিনেছি। কাজটি কি ভুল?”
সম্ভবত এ কারণেই, মনরোর লাইব্রেরির বইগুলো ছিল বিষয়বস্তুর দিক থেকে বৈচিত্র্যময়। ধ্রুপদী সাহিত্য থেকে শুরু করে শিল্পকলা, নাটক, জীবনী, কবিতা, রাজনীতি, ইতিহাস, দর্শন, মনোবিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব—কী ছিল না তার সংগ্রহে!
কিছু বইয়ের দুর্লভ প্রথম সংস্করণও ছিল তার মালিকানায়। যেমন: রালফ এলিসনের ‘দ্য ইনভিজিবল ম্যান’, জ্যাক কেরুয়াকের ‘অন দ্য রোড’, উইলিয়াম স্টাইরনের ‘দিস হাউজ অন ফায়ার’। কেবল একজন প্রকৃত বইপ্রেমীর পক্ষেই সম্ভব এসব বইয়ের প্রথম সংস্করণের তাৎপর্য উপলব্ধি করা। তাই স্বীকার করতেই হবে, মনরোও ছিলেন তেমন কেউ, যিনি বইয়ের কদর করতে জানতেন।
ধ্রুপদী সব বই দিয়েও ছিল মনরোর বইয়ের তাক ঠাসা। মার্ক টোয়েন থেকে লিও তলস্তয়, সবার বই ছিল তার মালিকানায়। ‘দ্য গ্রেট গ্যাটসবি’, ‘অ্যালিসেস অ্যাডভেঞ্চার্স ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড’, ‘ডাবলিনার্স’ কিংবা ‘দ্য সান অলসো রাইজেস’ এর মতো বই জ্বলজ্বল করত সেখানে। এছাড়া ফরাসি অস্তিত্ববাদী লেখক আলবেয়ার কামুর প্রতিও বিশেষ ভালোলাগা ছিল তার মনে।
উচ্চমার্গীয় সাহিত্যের পাশাপাশি একই কাতারে মনরো রাখতেন বাগান করা, গার্হস্থ্যবিজ্ঞান কিংবা শিশুতোষ বিভিন্ন বই। ব্যক্তিগত বাইবেলও জায়গা করে নিয়েছিল সেখানে।
জ্ঞানই শুধু নয়, ভালোলাগা জ্ঞানীর প্রতিও
মনরোর ভালোলাগা কিংবা আকর্ষণ শুধু পুঁথিগত জ্ঞানেই সীমাবদ্ধ ছিল না। বরং তিনি সহজেই আকৃষ্ট হতেন জ্ঞানী ব্যক্তিদের প্রতিও। তাই অনেকে তাকে চিহ্নিত করে থাকে স্যাপিওসেক্সুয়াল হিসেবেও, অর্থাৎ যাদের মস্তিষ্কে প্রেম ও যৌনতার অনুভূতি আবর্তিত হয় বুদ্ধিমত্তাকে কেন্দ্র করে।
মনরোর ক্ষেত্রে এ ধারণা যে কিছুটা হলেও সত্য, তার প্রমাণ পাওয়া যায় তার তৃতীয় স্বামী আর্থার মিলারকে দেখে। মিলার ছিলেন তৎকালীন সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠ নাট্যকার। অনুমান করা যায়, মিলারের বুদ্ধিবৃত্তিরই প্রেমে পড়েছিলেন তিনি।
অবশ্য মিলারের সাথে বিচ্ছেদের ঘটনাটি মনরোর জন্য ছিল একটা বড় ধাক্কা। মিলারের ডায়েরিতে মনরো দেখতে পেয়েছিলেন, মিলার নাকি স্ত্রীর ব্যাপারে বিব্রতবোধ করতেন। এ সত্যের উন্মোচনে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন মনরো। তখন স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে তিনি বেছে নিয়েছিলেন নিজের প্রিয় শখটিকে- কবিতা লেখা।
জ্ঞানী মানুষদের প্রতি আকৃষ্ট পেছনে আরেকটি সম্ভাব্য কারণ হলো শৈশব-কৈশোরে বাবার অনুপস্থিতি। তিনি কখনোই জানতেন না তার আসল বাবা কে। আর সে কারণে জীবনে পিতৃতুল্য একজন ব্যক্তিত্বের শূন্যতা তিনি বরাবরই অনুভব করতেন। ফলে রোমান্টিক সঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রেও তার পছন্দ ছিল বাবার বয়সী পুরুষেরা, যারা একাধারে তার চেয়ে বয়সে অনেকটা বড়, পরিণতমনস্ক এবং শক্তিশালী বুদ্ধিমত্তার অধিকারী।
১৯৮৭ সালে একটি সাক্ষাৎকারে এ বিষয়টির ব্যাখ্যা করেন অভিনেত্রী শেলি উইন্টার্স, যিনি হলিউড ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে মনরোর রুমমেট ছিলেন। তিনি বলেন:
“আমি যখন ব্যস্ত ছিলাম সুদর্শন, তরুণ চলচ্চিত্র তারকাদের সাথে বাইরে যেতে, সে আকৃষ্ট হতো পিতৃতুল্য ব্যক্তিদের প্রতি…বৃদ্ধ ব্যক্তিদের, যারা ছিল অত্যন্ত বুদ্ধিমান।”
১৯৮৯ সালে ডেভিড লেটারম্যানের ‘লেট নাইট শো’ অনুষ্ঠানে এসে শেলি আরো বলেন:
“মেরিলিন পঞ্চাশের নিচে বয়স এমন কাউকে পছন্দ করত না…যদি না সে হতো ধূসর চুলের অধিকারী। একদিন, আমরা যখন খুবই হতাশ ছিলাম আমাদের প্রেম নিয়ে, তখন আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে আমাদের কোনো পুরুষকে পছন্দ করা উচিৎ না…শুধু যাদেরকে আমাদের আকর্ষণীয় মনে হয় তাদের সাথেই রাত কাটাতে হবে। যা-ই হোক, আমরা ঠিক করেছিলাম একটি তালিকা বানাব (আকর্ষণীয় পুরুষদের) এবং আধাঘণ্টা পর একে অন্যকে তা দেখাব। ওর তালিকায় ছিল আইনস্টাইন, রালফ বাঞ্চির মতো মানুষেরা… আর আমার তালিকায় ছিল ক্লার্ক গ্যাবল, ব্র্যান্ডো এবং এমন কিছু নাম।”
আইনস্টাইনের প্রতি আকর্ষণ
হ্যাঁ, সত্যিই আলবার্ট আইনস্টাইনের প্রতি ভালোলাগা ছিল মনরোর মনে, যার প্রমাণ মেলে শেলির বক্তব্য থেকেই। মনরোর ভালোলাগার মানুষদের তালিকায় আইনস্টাইনের নাম দেখে শেলি সেদিন বলেছিলেন:
“মেরিলিন, কোনোভাবেই তোমার পক্ষে আলবার্ট আইনস্টাইনের সাথে রাত কাটানো সম্ভব নয়। তিনি এই শতকের সবচেয়ে বিখ্যাত বিজ্ঞানী। তাছাড়া, তিনি একজন বৃদ্ধ মানুষ।”
মনরোর জবাব ছিল:
“ওটার (বৃদ্ধ হওয়ার) সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। আমি শুনেছি তিনি অনেক স্বাস্থ্যবান।”
কিন্তু এরপরও যে প্রশ্নটি থেকেই যায় তা হলো, মনরো কি কখনো আইনস্টাইনের সাথে সামনাসামনি দেখা করেছিলেন, এবং যেমনটি অনেকেই দাবি করে থাকে, আসলেই কি আইনস্টাইনের সাথে তার প্রেম ছিল?
এ ব্যাপারে ডেভিড লেটারম্যানের অনুষ্ঠানে শেলি বলেছিলেন:
“তার (মনরোর) মৃত্যুর অনেক বছর পড় আমি স্ট্রাসবার্গদের (মনরোর পালক বাবা-মা) অ্যাপার্টমেন্টে (নিউ ইয়র্কে) গিয়েছিলাম, এবং সেখানে রূপালী ফ্রেমে পিয়ানোতে বসা আলবার্ট আইনস্টাইনের একটি ছবি দেখতে পেয়েছিলাম। সেটির উপর লেখা ছিল: ভালোবাসা, সম্মান ও ধন্যবাদের সাথে। আলবার্ট আইনস্টাইন।”
আইনস্টাইনের চেয়েও বেশি বুদ্ধিমান?
আজকাল মনরোর ব্যাপারে একটি চমকপ্রদ তথ্য প্রায়ই শোনা যায়। বলা হয়ে থাকে, মনরোর আইকিউ নাকি আইনস্টাইনের চেয়েও বেশি ছিল। ঠিক কত আইকিউ, সেটিও বলা হয়ে থাকে: ১৬৮! কিন্তু এই তথ্য কি আদৌ সত্য? নাকি এটি পুরোটাই বানোয়াট?
দুঃখজনক ব্যাপার, এখন পর্যন্ত মনরোর আইকিউ বিষয়ক বিশ্বাসযোগ্য কোনো তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি। কবে তার আইকিউ টেস্ট হয়েছিল, সেটি কী ধরনের টেস্ট ছিল, আর কী কারণেই বা তাকে টেস্টটি দিতে হয়েছিল, এসব ব্যাপারেও কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। প্রথম মনরোর আইকিউ বিষয়ক তথ্যটির আবির্ভাব ঘটেছিল ২০১৩ সালের ৫ আগস্ট। বাজফিডের একটি লিস্ট আর্টিকেলে এ দাবি করা হয়েছিল।
তবে, এ তথ্যের সাথে প্রাসঙ্গিক কোনো রেফারেন্স সংযুক্ত ছিল না। তাই আর্টিকেলটির রচয়িতা কোথা থেকে এ তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন, তা-ও জানা যায় না।
আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের ‘মনিটর অন সাইকোলজি’ থেকে জানা যায়, আইকিউ টেস্টিংয়ের আধুনিক রূপের প্রবর্তন ঘটে ১৯৪৯ সালে। তবে সেটি ছিল মূলত শিশুদের জন্য। এদিকে মনরোর জন্ম ১৯২৬ সালে। অর্থাৎ ১৯৪৯ সাল নাগাদ তার বয়স ছিল ২৩।
প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ওই টেস্টিংয়ের একটি সংস্করণ আসে ১৯৫৫ সালে, যখন মনরোর বয়স প্রায় ৩০। তবে মনরোর ওই টেস্ট নেয়ারও কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। কেননা ওই টেস্টটিও নেওয়া হতো মূলত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সেনাবাহিনীতে। এমনকি হলিউডের সবচেয়ে বড় তারকাদের জন্যও ওই সময়ে আইকিউ টেস্ট নিতান্তই আনকোরা একটি বিষয় ছিল।
মনরোর আইকিউ প্রসঙ্গে বিস্তারিত জানতে স্নোপস ডট কমের পক্ষ থেকে কিম লাকাপ্রিয়া যোগাযোগ করেছিলেন মেরিলিন মনরো বিশেষজ্ঞ স্কট ফোর্টনারের সঙ্গে। ফোর্টনার জানিয়েছিলেন যে মনরোর আইকিউ বিষয় ‘গুজব’-এর ব্যাপারে তিনিও অবগত, কিন্তু এর সত্যতা তিনি খুঁজে পাননি।
শেষ কথা
অন্য কিছুর প্রমাণ মিলুক কিংবা না মিলুক, মনরোর ব্যাপারে এটুকু মোটামুটি জানা যায় যে তথাকথিত মূর্খ সুন্দরী তো তিনি ছিলেনই না, বরং নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতার ব্যাপারে ছিলেন অত্যন্ত স্পর্শকাতর। হাই স্কুল থেকে গ্র্যাজুয়েশন করা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি, কেননা তার আগেই জীবনযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হয়েছিল তাকে। পরবর্তীতে, খ্যাতির শীর্ষে আরোহণের পরও, অভিজাত মহলে সর্বদা খাটো হওয়ার ফলে তার মনে তীব্র দুঃখবোধ জন্ম নিয়েছিল।
তাই মনরো সারাজীবন চেষ্টা চালিয়ে গেছেন প্রচুর বই পড়ে আত্মোন্নয়নের, যার প্রমাণ মেলে তার ব্যক্তিগত লাইব্রেরির বইগুলো থেকে। ফলে আইকিউ ১৬৮ কিংবা ‘আইনস্টাইনের চেয়ে বেশি” যদি না-ও হয়ে থাকে, মনরো যে তার পাবলিক পারসোনার চেয়ে অনেক বেশি বুদ্ধিমতী ও বিদুষী ছিলেন, এবং তার ছিল অতলান্ত জ্ঞান পিপাসা, সে ব্যাপারে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।