এক ডিস্টোপিয়ান ভবিষ্যতের জেলখানা সদৃশ ভার্টিকাল সেলফ ম্যানেজমেন্ট সেন্টার, যার নাম দ্য হোল। বিভিন্ন ধরনের মানুষের জায়গা হয় সেখানে। অপরাধীরা চিরাচরিত জেলখানার বন্দিদশা থেকে বাঁচতে বেছে নিতে পারে এটিকে। আবার কেউ কেউ স্বেচ্ছায়ও থাকতে আসে এখানে, ডিপ্লোমা সার্টিফিকেট কিংবা অন্য কিছুর আশায়।
এই দ্বিতীয় শ্রেণীভুক্ত গোরেং। একদিন ঘুম ভাঙতে সে নিজেকে আবিষ্কার করে দ্য হোলের ৪৮তম লেভেলে। ধীরে ধীরে নিজের সেলমেট ত্রিমাগাসির কাছ থেকে সে জানতে পারে, দ্য হোল অনেকটা টাওয়ারের মতো, যার সেলগুলো সব একটার পর একটা সাজানো, এবং প্রতিটি সেলে বাস করে দুজন করে। প্রত্যেক বন্দি তার পছন্দসই যেকোনো একটি বস্তু রাখতে পারে সাথে, যেমন গোরেং রেখেছে ‘ডন কিহোতে’ বইটি।
তবে দ্য হোলের সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হলো, এখানে প্রতি সেলের জন্য আলাদা কোনো খাবারের ব্যবস্থা নেই। একদম প্রথম লেভেলের সেলে প্রচুর পরিমাণ খাবার একটি প্ল্যাটফর্মে থরে থরে সাজিয়ে দেয়া হয়। ক্রমে সেই প্ল্যাটফর্মটি নিচে নামতে থাকে, আর প্রতি লেভেলের বন্দিদ্বয় খেতে থাকে তাদের পূর্ববর্তী সেলের মানুষের উচ্ছিষ্ট খাবার।
এভাবেই সবচেয়ে উঁচুতে অবস্থানকারী সেলের মানুষদের খাবারের কোনো অভাব হয় না। কিন্তু খাদ্যবাহী প্ল্যাটফর্ম যতই নিচের দিকে নামতে থাকে, খাবারের পরিমাণ ততই কমতে থাকে। এবং এক পর্যায়ে খাবার পুরোপুরি নিঃশেষ হয়ে যায়। মাঝামাঝি লেভেলের সেলবাসীরা যদিও বা কিছু পায়, নিচের দিকের সেলবাসীদের খাওয়ার জন্য কিছুই বেঁচে থাকে না।
তবে প্রকৃত বাস্তবতা হলো, দ্য হোলের প্রশাসন কিন্তু খাবারের পরিমাণ নেহাত কম দেয় না। তারা শুরুতে যত খাবার দেয়, প্রত্যেক সেলবাসী তা পরিমিত পরিমাণে খেলে দ্য হোলের সব সেলবাসীরই পেট পুরে খাওয়া ও ক্ষুধা মেটানো সম্ভব। কিন্তু উপরের লেভেলের সেলবাসীরা যথেচ্ছ খাবার খেতে থাকে, এবং কেউই তাদের নিম্নস্থ সেলবাসীদের কথা চিন্তা করে না বলেই, অর্ধেক লেভেল পেরোনোর আগেই খাবার প্রায় শেষ হয়ে যায়।
এদিকে আরেকটি চমকপ্রদ বিষয় হলো, সকল বন্দির অবস্থানের ক্ষেত্রে কিন্তু কোনো চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নেই। প্রত্যেক লেভেলে তাদের অবস্থানের সময়সীমা এক মাস করে। এ মাসে যারা মাঝামাঝি কোনো লেভেলে আছে, পরের মাসেই তারা সর্বোচ্চ কিংবা সর্বনিম্ন লেভেলে চলে যেতে পারে। আবার একমাস পর সেই অবস্থানেরও পরিবর্তন ঘটবে।
অর্থাৎ যারা আজ উপরের লেভেলগুলোতে আছে, তারা কিন্তু খুব ভালো করেই জানে পরের কোনো মাসে তাদেরকে নিচে নেমে যেতে হবে, এবং তখন তাদেরও খাদ্যাভাবে ভুগতে হবে। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা যথেচ্ছ খাওয়া অব্যাহত রাখে।
এদিকে যারা ইতঃপূর্বে নিচের কোনো লেভেলে বাস করেছে, তাদের সরাসরিই অভিজ্ঞতা হয়েছে তীব্র ক্ষুধার যন্ত্রণা সহ্যের। তারপরও সময়ের পরিক্রমায় উপরের লেভেলে পৌঁছে তারাও অবিবেচকের মতো যত-খুশি খেতে শুরু করে দেয়। তারা অতীতবিস্মৃত হয়ে পড়ে, কিংবা ভাবে, “এতদিন তো আমরাও কত কষ্ট সহ্য করেছি। আজ আমাদের উপভোগের দিন। যারা নিচে আছে তাদের মুখে খাবার জুটল কি জুটল না, তা ভেবে কী লাভ!”
ঠিক এমন প্রেক্ষাপটেই গড়ে উঠেছে স্প্যানিশ সায়েন্স-ফিকশন হরর থ্রিলার ‘দ্য প্ল্যাটফর্ম’। মূল স্প্যানিশ শিরোনাম অবশ্য ‘এল হোয়ো’, যার ইংরেজি করলে দাঁড়ায় ‘দ্য হোল’। অনেকটা কাফকায়েস্ক কাহিনী বিশিষ্ট এই ছবিটির নির্মাতা ৪৬ বছর বয়সী পরিচালক গালদের গাজতেলু-উরুতিয়া।
২০১৯ টরন্টো ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ‘মিডনাইট ম্যাডনেস’ ক্যাটাগরিতে দর্শক ভোটে সেরা নির্বাচিত হয়েছিল ছবিটি। এবং সেখান থেকেই ছবিটি জিতে নিয়েছিল নেটফ্লিক্সের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী স্ট্রিমিং ডিল। এ বছরের ২০ মার্চ থেকে নেটফ্লিক্সে পাওয়া যাচ্ছে ছবিটি।
কাহিনী সংক্ষেপে যা বলা হয়েছে, সেটিকে কেউ স্পয়লার বলে মনে করবেন না। আক্ষরিক অর্থেই ওটুকু কেবল ছবির মূল প্রেক্ষাপট, যার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে কাহিনী।
কোমল হৃদয়ের, নীতি ও আদর্শে বলীয়ান গোরেংয়ের দ্য হোলের জীবন ঠিক কোনদিকে ধাবিত হয়, সে কি অন্যান্য বন্দিদের মতোই হিংস্র পশুতে পরিণত হয়, নাকি নিজের মনুষ্যত্ব ধরে রাখতে সমর্থ হয়? অর্থাৎ বিদ্যমান সিস্টেমকে ভাঙা আদৌ কোনো ব্যক্তিবিশেষের পক্ষে সম্ভব, নাকি তাকেও ওই সিস্টেমের কাছেই আত্মসমর্পণ করতে হয়, সে প্রশ্নকে সামনে রেখেই সামনের দিকে এগিয়ে ছবির কাহিনী। এবং এ প্রশ্নের উত্তর লাভের একমাত্র উপায় মাত্র ১ ঘণ্টা ৩৪ মিনিটের, টানটান উত্তেজনাময় ছবিটি নিজে দেখে ফেলা।
তবে বলাই বাহুল্য, সবার দেখার উপযোগী নয় ছবিটি। এতে একাধারে রয়েছে ক্যানিবালিজম, আত্মহত্যা, ক্ষুধার তাড়নায় ধুঁকে ধুঁকে মরা, প্রচুর রক্তপাত, এবং এমন সব কর্মকাণ্ড, যা কোনো বিবেকবান মানুষের পক্ষে করা অসম্ভব। কিন্তু হ্যাঁ, এগুলো তো সার্ভাইভাল জনরার চলচ্চিত্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ। যেহেতু ‘দ্য প্ল্যাটফর্ম’-এর চরিত্রদেরও প্রধানতম লক্ষ্য ক্ষুধার বিরুদ্ধে লড়াই করে টিকে থাকা, তাই এটিও স্পষ্টতই একটি সার্ভাইভাল জনরার ছবি।
অবশ্য অধিকাংশ সার্ভাইভাল জনরার চলচ্চিত্রে প্রতিকূল পরিবেশের সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকতে অনুপ্রেরণার রসদ জোগানো হলেও, এই ছবির মূল আকর্ষণ এর সামাজিক ধারাভাষ্য। এবং সেই ধারাভাষ্য যে খুব সূক্ষ্ম ও রূপকায়িত, সে কথাও বলা যাবে না। কেননা আপনি যদি এই লেখাটি শুরু থেকে মন দিয়ে পড়ে থাকেন, তাহলে ইতোমধ্যেই আপনার বেশ বুঝে যাওয়ার কথা, এখানে পুঁজিবাদী সমাজের বীভৎসতাকে চিত্রায়িত করা হয়েছে, যে কারণে এ ছবিকে অনেকে “ক্যাপিটালিস্ট হরর” আখ্যাও দিয়েছে।
পুঁজিবাদের বিরোধিতা করা মানেই যে শতভাগ সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদের জয়গান গাওয়া, তা-ও কিন্তু নয়। কেননা এ ছবিতে “স্বতঃস্ফূর্ত সংহতি” কতটা ফলপ্রদ, সে বিষয়েও আলোকপাত করা হয়েছে। এবং “অন্তিম ন্যায্যতা” অর্জনে এক পর্যায়ে যে “বৈপ্লবিক সহিংসতা”-র পথেও পা বাড়াতে হতে পারে, সে বিষয়টিও মূর্তমান হয়েছে।
তবে এমন একটি সময়ে ছবিটি বিশ্বব্যাপী অবমুক্ত হয়েছে যে, এর প্রাসঙ্গিকতা কেবল পুঁজিবাদ বনাম সমাজতন্ত্র/সাম্যবাদেই সীমাবদ্ধ নেই। বরং চলমান করোনাভাইরাস মহামারীর গোড়ার দিকে যে প্যানিক বায়িং-এর দৃষ্টান্ত দেখা গিয়েছিল, এবং এখনো বিশ্বের অনেক জায়গাতেই দেখা যাচ্ছে, সেটির সাথেও যোগসূত্র স্থাপন করা যায় এ ছবির ধারণার।
খেয়াল করে দেখুন, প্যানিং বায়াররা কী করেছে। তারা শুধু নিজেদের কথাই ভেবেছে। সঙ্কটাপন্ন সময়ে তারা কেবল নিজেদের নিরাপদ ও সুস্থ থাকা নিশ্চিত করতে চেয়েছে, তাই উদ্যত হয়েছে দোকানের সব নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য। তারা ভাবেনি, আরো অনেকেই তো আছে যাদেরও একই পণ্যের প্রয়োজন, তাদের অবস্থা কী হবে।
দ্য হোলের বাসিন্দাদের মানসিকতাও ঠিক একই রকম। উঁচু লেভেলের মানুষগুলো যত পারে খেয়ে নিতে চায়, নিচের লেভেলের মানুষদের কথা ভাবে না। এই স্বেচ্ছাচারী মানসিকতার পরিণাম কী হতে পারে, চোখ মেলে চারিদিকে তাকিয়েও যদি আপনি অনুধাবন করতে না পারেন, ‘দ্য প্ল্যাটফর্ম’ ছবিটি আপনাকে ঠিকই তা অনুভব করাতে পারবে।
এ কারণেই বলা হচ্ছে, অন্য কোনো সময়ে যদি ‘দ্য প্ল্যাটফর্ম’ ছবিটি নেটফ্লিক্সে আসত, তাহলেও হয়তো এটি ঠিকই বিপুল সংখ্যক মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারত। কিন্তু যেহেতু করোনাকালীন সময়ে সমাজের শ্রেণীবিভাজন আরো মোটা দাগে প্রকট হয়ে উঠেছে, তাই এ ছবির প্রাসঙ্গিকতাও বেড়ে গিয়েছে কয়েকগুণ। ফলে এ ছবি নিয়ে বর্তমানে প্রত্যাশাতীত আলোচনা হচ্ছে, বিশ্বব্যাপী নেটফ্লিক্সে সবচেয়ে বেশি দেখা ছবিগুলোর তালিকায়ও এটি জায়গা করে নিয়েছে।