গল্পের শুরুটা ২০০৮ সালে। শন ফিনেগ্যান, কনর ম্যাককেনা ও শন ফ্ল্যানাগান নামের তিন আইরিশ তরুণ ইউনিভার্সিটি কলেজ ডাবলিনে যথাক্রমে স্থাপত্যবিদ্যা, বংশগতিবিদ্যা ও প্রকৌশল নিয়ে পড়ছেন। পড়াশোনার ক্ষেত্র আলাদা হলেও তিন জনের মধ্যে একটা বিষয়ে মিল ছিলো – প্রত্যেকের মন পড়ে রইত বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্য সম্প্রদায় UCD DramSoc এ। সেখানেই তিন জনের বন্ধুত্বের শুরু। একত্রে অভিনয় করতে করতে আবিস্কার করলেন কমেডির প্রতি তিন বন্ধুরই রয়েছে প্রবল ভালোবাসা, মানুষকে হাসাতে পারলেই তাঁদের আনন্দ। ২০০৮-২০০৯ এর অর্থনৈতিক মন্দায় তখন গোটা বিশ্বের সাথে আয়ারল্যান্ডও ধুঁকছে, চাকরির বাজারেও তার প্রভাব পড়েছে। তখন তিন বন্ধুরই মনে হল মিছে চাকরির পেছনে না ছুটে নিজেদের প্রতিভা কাজে লাগিয়ে কিছু করা উচিত, তাতে আনন্দটাও ষোল আনা খাঁটি। এভাবে জন্ম হল আয়ারল্যান্ডের একমাত্র স্কেচ কমেডি গ্রুপ “ফয়েল আর্মস অ্যান্ড হগ” এর, যারা নিজ দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে এখন পুরো পৃথিবীতে সমাদৃত। প্রিয় পাঠক, তাঁদের পথচলার গল্পই আজ আপনাদের সামনে তুলে ধরবো।
চলুন আগে একটু ঝালাই করে নেয়া যাক স্কেচ কমেডি বলতে কি বোঝায়। স্কেচ কমেডি হলো হাস্যরসাত্মক নাটিকা যা দলগতভাবে পরিবেশন করা হয়। নাটিকাগুলো সাধারণত এক থেকে দশ মিনিট দীর্ঘ হয়ে থাকে। স্কেচ কমেডির বিষয়বস্তু বৈচিত্র্যপূর্ণ, যা নির্ভর করে লেখক ও অভিনয়শিল্পীদের ওপর। রাজনীতি, সাম্প্রতিক বিষয় থেকে শুরু করে উদ্ভট বা আবোলতাবোল কোন বিষয় – সব কিছুই স্কেচ কমেডির বিষয়বস্তু হতে পারে।
নিশ্চয়ই ভাবছেন “ফয়েল আর্মস অ্যান্ড হগ” এর নাম কেন “ফয়েল আর্মস অ্যান্ড হগ?” তিন বন্ধু একে অন্যকে মজা করে যে ডাক নামে ডাকেন, সেই নামেই দলের নাম রেখে দিয়েছেন। “কমেডিক ফয়েল” থেকে শন ফিনেগ্যানের নাম হয়েছে ফয়েল, কমেডিক ফয়েল হলেন সেই ব্যক্তি যিনি যে কোন পরিবেশনায় কৌতুকের ভিত্তি স্থাপন করে দেন, তিনি এক অর্থে মূল চরিত্র, কিন্তু তিনি বাকি চরিত্রগুলোকেও উজ্জ্বল হয়ে উঠতে সাহায্য করেন। কনর ম্যাককেনা পরিচিত আর্মস নামে, বন্ধুরা তাঁকে খেপান এটা বলে যে তিনি মঞ্চে অনেকটা এলোমেলো, যেন হাত-পা কোথায় রাখবেন ভেবে পান না, (“All arms and legs”)। কথ্য ইংরেজিতে কোন কিছু hog করা বলতে বোঝায় স্বার্থপরের মত নিজে বেশি করে নিয়ে নেয়া, সেই অর্থে শন ফ্ল্যানাগানের ডাক নাম হগ, বন্ধুদের মতে যিনি যে কোন পরিবেশনায় সব মনোযোগ নিজের দিকে টেনে নেন। তাছাড়া হগ বলতে শুকরও বোঝায়, যেটা “ফয়েল আর্মস অ্যান্ড হগ” এর লোগো ও ব্র্যান্ড পরিচয়ের একটা বড় অংশ।
“ফয়েল আর্মস অ্যান্ড হগ” মূলত রেডিও, টিভি, মঞ্চ ও অনলাইনে স্কেচ কমেডি পরিবেশন করে থাকে। শুরুর দিকে আয়ারল্যান্ডের কিছু টিভি অনুষ্ঠানে কাজ করেছে এই দলটি। এখন মঞ্চে ও অনলাইনেই স্কেচ কমেডি উপস্থাপন করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন তাঁরা। প্রতি বৃহস্পতিবার ইউটিউব, ফেসবুক ও ইন্সটাগ্রামে নতুন কমেডি ভিডিও প্রকাশ করে থাকে “ফয়েল আর্মস অ্যান্ড হগ”। এর মাধ্যমে একটি বৈশ্বিক ফ্যান ফলোয়িং গড়ে উঠেছে তাঁদের। অসংখ্য ভাইরাল ভিডিও রয়েছে, যা অর্জন করে নিয়েছে মিলিয়নের বেশি ভিউ। এখন পর্যন্ত তাদের ইউটিউবে আপলোড করা ভিডিওর সংখ্যা ৪৩০, যা দেখা হয়েছে ১৮ কোটি বারের বেশি। দলটি নিয়মিত ইউ কে, আয়ারল্যান্ড, জার্মানি, ফিনল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ইউ এস এ, কানাডা ইত্যাদি দেশে লাইভ শো করে থাকে। স্বীকৃতি হিসেবে ঝুলিতে রয়েছে কিছু পুরস্কারও।
“ফয়েল আর্মস অ্যান্ড হগ” এর অনলাইন স্কেচ কমেডির ভিডিওগুলো বৈচিত্র্যে ভরপুর। তাঁরা কখনো বাস্তবিক পৃথিবীর গুরুগম্ভীর কোন বিষয় ভিডিওতে তুলে আনেন, কখনো বা উদ্ভট, আবোলতাবোল ও আজগুবি কিছু। তাঁদের কমেডি ধরাবাঁধা কোন একটি ধারার মধ্যে ফেলা যায় না, বরং দর্শক ও সমালোচকদের মতে তাঁদের কমেডিকে বলা যায় পর্যবেক্ষণমূলক (Observational), মাঝে মাঝে যাতে সাম্প্রতিক বিষয়াবলী তুলে ধরা হয় (topical)। অনলাইন স্কেচ কমেডির ভিডিও ও লাইভ শো, সর্বত্রই বারবার ঘুরে ফিরে আসে আয়ারল্যান্ডের কথা। হাস্যরসের ছলে নিজেদের খোঁচা মারতে “ফয়েল আর্মস অ্যান্ড হগ”-এর জুড়ি মেলা ভার, কখনো আইরিশদের মদ্যপান প্রীতি (An Irish intervention), কখনো নিজ মাতৃভাষা বলতে না পারার অক্ষমতা (When Irish people can’t speak Irish), কখনো বা সেন্ট প্যাট্রিক ডে-এর ইতিহাস নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি (St Patrick’s Day isn’t Irish) – সবই তাদের পরিবেশনার অংশ হয়েছে। অনলাইন স্কেচ কমেডি ভিডিওগুলোর উল্লেখযোগ্য কিছু সিরিজ হলো ইমিগ্রেশন, কান্ট্রিজ অফ দ্য ওয়ার্ল্ড, হাউজ পার্টি, অ্যান ফ্ল্যানাগান ও ওশিন, ম্যাককরম্যাক ফ্যামিলি ইত্যাদি। ইমিগ্রেশন সিরিজে দেখা যায় দেশে ঢুকতে দেবার আগে দুই অভিবাসীর সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন এক ইমিগ্রেশন অফিসার, এই প্রশ্ন আর উত্তরে হাস্যরস, করুণ রস ও নির্মম বাস্তবতার এক দারুণ মিশেলের স্বাদ পাওয়া যায়। দেশগুলোর স্টেরিওটাইপ নিয়ে করা কৌতুক ইমিগ্রেশন সিরিজের বড় বৈশিষ্ট্য। কান্ট্রিজ অফ দ্য ওয়ার্ল্ড সিরিজে দক্ষতার সাথে রাজনীতি, ইতিহাস, ও সাম্প্রতিক বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে। হাউজ পার্টি সিরিজে পেয়ে যাবেন আবোলতাবোল আনন্দের স্বাদ, যেখানে ফল, সবজি, বছরের বারো মাস বা ভ্যাক্সিনেরা পার্টি করে। অ্যান ফ্ল্যানাগান একজন আদর্শ আইরিশ মা, ছেলে ওশিনের সাথে তার মজার ভিডিওগুলো দেখতে গিয়ে অ্যানের মধ্যে নিজের মায়ের ছায়া খুঁজে পেলে অবাক হবেন না যেন, দুনিয়া জুড়ে সব মায়েরা যে একই রকম! ম্যাককরম্যাক ফ্যামিলি সিরিজে তুলে ধরা হয়েছে একটি খেয়ালী ও পাগলাটে আইরিশ পরিবারকে, যাদের সদস্যরা কখন কি করবে আর বলবে তা বোঝা মুশকিল, ফলে ঘটতে থাকে মজার সব ঘটনা! এ সিরিজ গুলো ছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ের ওপর স্কেচ তৈরি করেন তাঁরা। সঙ্গীত “ফয়েল আর্মস অ্যান্ড হগ”-এর কমেডির একটা বড় অংশ, কখনো মৌলিক গান আবার কখনো প্যারোডিতে মাতিয়ে তোলেন দর্শকদের। স্কেচ লেখা, সেট ডিজাইন করা, অভিনয় করা, পরিচালনা করা, সম্পাদনা করা, গান লেখা, সুর করা, গাওয়া থেকে এ সংক্রান্ত সমস্ত কাজ দলের তিন সদস্য মিলে সামলে থাকেন। ভিডিওগুলো দেখতে চাইলে ঘুরে আসতে পারেন তাদের ইউটিউব চ্যানেল থেকে।
“ফয়েল আর্মস অ্যান্ড হগ”-এর কাজের একটা বড় অংশ অনলাইনের স্কেচ কমেডি ভিডিও হলেও তিন জনই এক বাক্যে স্বীকার করেন যে তাদের প্রথম প্রেম মঞ্চ। দর্শকদের প্রতিক্রিয়া সামনাসামনি দেখতে পাওয়ার যে অনুভূতি, তার তুলনা হয় না। তাই দর্শকদের জন্য প্রতি বছর নতুন লাইভ শো নিয়ে আসে দলটি। অনলাইনে করা স্কেচ থেকে এগুলো আলাদা হয়, ফলে লাইভ শোয়ের জন্য চলে আলাদা করে স্কেচ লেখা, গান তৈরি করা ও মহড়া। লাইভ শোয়ের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ দর্শকদের সাথে কথোপকথন, তাদের শোয়ের অংশ করে নেয়া ও আশুরচনা (improvisation)। দর্শক ও সমালোচক – সকলেই এক মত যে মঞ্চে “ফয়েল আর্মস অ্যান্ড হগ”-এর উপস্থিতি অত্যন্ত প্রাণবন্ত, এবং এটি সম্ভব হয় কারণ দলটি উপস্থিত দর্শকদের সাথে শোয়ের সুর ও মেজাজের তাল মিলিয়ে নিতে পারে। লাইভ শোয়ের চিত্রনাট্য থাকে, কিন্তু সেরা মুহূর্তগুলোর সৃষ্টি যেন তখনই হয় যখন “ফয়েল আর্মস অ্যান্ড হগ”-এর সদস্যরা চিত্রনাট্যের ছাঁচ ভেঙে বেরিয়ে আসেন। বুদ্ধিদীপ্ত কৌতুক, মজার গান, দুষ্টুমি, দম ফাটানো হাসি আর প্রাণোচ্ছল স্বতঃস্ফূর্ততা লাইভ শোগুলোকে নিয়ে যায় অন্য উচ্চতায়। আয়ারল্যান্ডের কমেডি ক্লাব ও পাবে ছোট আকারে দলটির লাইভ শোয়ের যাত্রা শুরু হলেও এখন দেশে বিদেশে মর্যাদাপূর্ণ সব থিয়েটার ও ভেন্যুতে দাপটের সাথে জায়গা করে নিয়েছে দলটি। ইউটিউবে লাইভ শোয়ের টুকরো স্কেচের ভিডিও পাওয়া যাবে, এছাড়া ছয়টি পূর্ণাঙ্গ লাইভ শো ডাউনলোড করা যাবে তাদের অফিশিয়াল ওয়েবসাইট থেকে।
ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব, ইন্সটাগ্রামসহ সব মূল ধারার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে “ফয়েল আর্মস অ্যান্ড হগ” এর রয়েছে সরব উপস্থিতি। এছাড়া পাঁড় ভক্তদের জন্য রয়েছে একটি প্যাট্রিয়ন চ্যানেল, যেখানে নিজের পছন্দমতো মাসিক ফি’র বিনিময়ে ভক্তরা পেয়ে যান সবগুলো লাইভ শো দেখার সুযোগ, সেই সাথে দেখতে পান এক্সক্লুসিভ ছবি, ট্যুর ভ্লগ, স্কেচ তৈরির পেছনের গল্প, মজার সব লাইভস্ট্রিমসহ আরো অনেক কিছু।
২০০৮ সালে শুরু হওয়া “ফয়েল আর্মস অ্যান্ড হগ”-এর যাত্রা ১৪ বছর পরও চলছে দাপটের সাথে, নিরন্তর শিখতে ও পরীক্ষা করতে থাকা দলটি এখন আরো পরিণত। তাদের কাজ দেখলে যে বিষয়টি সব ছাপিয়ে চোখে পড়তে বাধ্য সেটি হল কাজটি তারা কতটা উপভোগ করেন। আয়ারল্যান্ডের একমাত্র স্কেচ কমেডি গ্রুপ হিসেবে এই যাত্রাপথে তাদের অনেক বাধা ও সংগ্রামের মুখোমুখি হতে হয়েছে, কিন্তু সব উতরে গেছেন প্রতিভা, পরিশ্রম ও বন্ধুত্বের জোরে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের তিন বন্ধু যেভাবে কর্ম জীবনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ভালোবেসে কাজ করছেন, তাতে তাদের বন্ধুত্বের শক্তিই প্রকাশ পায়। আর অমিত প্রতিভার পাশাপাশি এই দৃঢ় বন্ধুত্বই “ফয়েল আর্মস অ্যান্ড হগ”-এর সবচেয়ে বড় সম্পদ।