১.
ফলোঅনে পড়ে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নামলেন হানিফ মোহাম্মদ আর ইমতিয়াজ আহমেদ। তখন টেস্টের মাত্র তৃতীয় দিন চলে। ৬ দিনের টেস্টের বাকি তখনও ৩ দিন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের রানসমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে আছে পাকিস্তান, চোখ রাঙাচ্ছে ইনিংস পরাজয় নামের লজ্জা।
১৯৫৮ সালে ৫ টেস্টের একটা সিরিজ খেলতে ওয়েস্ট ইন্ডিজে গিয়েছিল পাকিস্তান, সেই সফরেরই প্রথম টেস্টে এই বিপর্যয়ে পড়ে তারা।
টসে জিতে ব্যাটিং নিয়েছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্যাপ্টেন জেরি অ্যালেক্সান্ডার। নিজের অভিষেক টেস্টে সেঞ্চুরি করেন কনরাড হান্ট, মাত্র ৩ রানের জন্য ডাবল মিস করেন এভারটন উইকস। এদের সাথে স্যার গ্যারি সোবার্স আর কলি স্মিথের দুটো হাফ সেঞ্চুরিতে ৫৭৯ রানের পাহাড়ে উঠে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ, এরপরই ইনিংস ঘোষণা করে দেন ক্যাপ্টেন অ্যালেক্সান্ডার। অ্যালেক্সান্ডার ছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের শেষ শ্বেতাঙ্গ অধিনায়ক।
২.
টানা দু’দিন ধরে ব্যাট হাতে প্রতিপক্ষের রাজত্ব দেখতে হয়েছিল পাকিস্তানিদের, সেই সাথে প্রচণ্ড গরমে বোলিং আর ফিল্ডিং করতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল তারা। সেই ক্লান্তির প্রভাব পড়লো ব্যাটিংয়ের সময়। আকাশ থেকে আগুন ঝরাচ্ছিল সূর্য, আর বল হাতে পিচে আগুন ঝরাতে শুরু করলেন রয় গিলক্রিস্ট। ফলাফল, পাইকারি হারে হত্যাযজ্ঞ! মাত্র ১০৬ রানে অলআউট হয়ে গেল পাকিস্তান। সর্বোচ্চ এল ওপেনার ইমতিয়াজ আহমেদের ব্যাট থেকে, ২০ রান।
৪৭৩ রানে পিছিয়ে থেকে আবার ব্যাটিংয়ে নামল পাকিস্তান। তারা যে এই ম্যাচ হারবে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহই ছিল না। হারের ব্যবধান কী হবে, আলোচনার বিষয় ছিল সেটিই।
৩.
টেস্ট ক্রিকেট নাকি ‘পরীক্ষা’ নেয়! তাই এর নাম টেস্ট ক্রিকেট। মনোযোগ, ধৈর্য্য, ব্যাটিং সক্ষমতা, বোলিং দক্ষতা, সবকিছুরই পরীক্ষা দিতে হয় একজন টেস্ট ক্রিকেটারকে। কীসের পরীক্ষা তাকে দিতে হবে, তা ওপেনার হানিফ মোহাম্মদ জানতেন না। তাই তিনি সবকিছু বাদ দিয়ে মনোযোগের পরীক্ষা দেওয়া শুরু করলেন, অখণ্ড মনোযোগ। প্রত্যেকটা ডেলিভারি তার কাছে হয়ে উঠলো রানসমুদ্র পার হওয়ার একেকটি পদক্ষেপ।
খুব সাবধানে খেলতে লাগলেন তিনি। আরেক ওপেনার ইমতিয়াজ আহমেদের সঙ্গে গড়লেন ১৫২ রানের জুটি। কোনো উইকেট না হারিয়ে যখন দিন শেষ করার অপেক্ষা করছেন দু’জন, ঠিক তখনই ইমতিয়াজকে এলবিডব্লিউ’র ফাঁদে ফেললেন রয় গিলক্রিস্ট। দিনশেষে ফেরার সময় হানিফ মোহাম্মদের রান ৬১। পাকিস্তান পিছিয়ে আছে ৩২১ রানে।
সেদিন রাতে ঘুমানোর সময় বিছানার পাশে একটা চিরকুট পেলেন হানিফ। চিরকুটে লেখা, ‘তুমিই আমাদের শেষ ভরসা।’ সতীর্থের কাছ থেকে সেরাটা বের করে আনার জন্য চিরকুটটা লিখেছেন অধিনায়ক আবদুল হাফিজ কারদার।
৪.
পরদিন সকালে আবার খেলা শুরু হলো। মাত্র চতুর্থ দিন চলছিল ম্যাচের, তখনও হারের খাঁড়া ঝুলছিল পাকিস্তানের মাথার উপরে। এটা ঠিক যে, পাকিস্তান দ্বিতীয় ইনিংসে বেশ ভালো খেলছে। কিন্তু ওয়েস্ট ইন্ডিজের বোলাররা যেভাবে আগুন ঝরাচ্ছেন, তাতে যে মড়ক লাগবে না, তা কে বলতে পারে?
অধিনায়কের কথার দাম রাখলেন হানিফ। আর তার ব্যাটিংয়ে উজ্জীবিত হয়ে উঠলেন অপর প্রান্তের ব্যাটসম্যানরাও। ওয়ান ডাউনে নামা আলিমুদ্দিন করলেন ৩৭, কিন্তু হানিফের সাথে তার ১১২ রানের যে জুটিটা হল, তা অমূল্য বললেও কম বলা হয়। দলের ২৬৪ রানে ফিরে গেলেন আলিমুদ্দিন, এলেন সাইদ আহমেদ।
চারদিন খেলা হওয়ার পরে পিচ তখন ফেটে চৌচির। কোনো বল স্বাভাবিকভাবে আসছে, আবার কোনো বল কারণ ছাড়াই লাফাচ্ছে। কোনো বল আবার আসছে প্রত্যাশার চেয়েও নিচ দিয়ে। এসবে হানিফ মোহাম্মদের থোড়াই কেয়ার! মনোযোগের যে ধ্যানে তিনি বসেছেন, বলের এরকম বিচিত্র আচরণের সাধ্য কী সেই ধ্যান ভাঙানোর!
সাইদ আহমেদের সাথে ১৫৪ রানের জুটি হলো হানিফের, দল চলে গেল ৪১৮’তে। ফলোঅনের শঙ্কা অনেকটাই দূর হলো তাতে। তবে পরাজয় এড়ানো তখনও বহুদূর! চতুর্থ দিন শেষে হানিফের স্কোর হলো ১৬১। আগের দিনের সাথে ঠিক ১০০ রান যোগ করলেন, পাকিস্তান দিন শেষ করলো ৩৩৯/২ স্কোরে।
সেই রাতে আবার একটা চিরকুট পেলেন হানিফ, তাতে লেখা, ‘ইউ ক্যান ডু ইট।’ কে পাঠিয়েছেন, তা পাঠক নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছেন।
৫.
পঞ্চম দিনের খেলা শুরু হল। কোনো কিছুতেই কাজ হচ্ছে না দেখে হাতের সকল অস্ত্র বের করতে লাগলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্যাপ্টেন অ্যালেক্সান্ডার। রয় গিলক্রিস্ট, আলফ ভ্যালেন্টাইনরা আগে থেকেই ছিলেন, হাত ঘোরাতে বাদ গেলেন না ক্লাইড ওয়ালকটও। কিন্তু কিছুতেই হানিফ মোহাম্মদের মনোযোগে বিঘ্ন ঘটানো গেল না।
একটা সময়ে আউট হয়ে গেলেন সাইদ, উইকেটে এলেন হানিফেরই বড় ভাই ওয়াজির। দুই ভাই মিলে সারাদিন ব্যাট করলেন, ইনিংস পরাজয় তো এড়ালেনই, দলকে এনে দিলেন ৫২ রানের লিডও। হানিফ দিনশেষ করলেন ২৭০ রানে।
তবে এত কিছুর পরও পাকিস্তান বিপদমুক্ত ছিল না। কারণ, ব্যাটিং অর্ডারে একবার ধ্বস নামলেই এলোমেলো হয়ে যেত সব। তাই সেদিন রাতেও একটা চিরকুট পেলেন হানিফ। তাতে লেখা, ‘তুমি যদি কাল টি পর্যন্ত ব্যাট করতে পারো, এই ম্যাচ বাঁচাতে পারব আমরা।’
৬.
ষষ্ঠ দিনের খেলা শুরু হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে গেলেন ওয়াজির। লিড তখন মাত্র ৬৬ রানের। এরপর এলেন ওয়ালিস ম্যাথিয়াস। পাকিস্তান লাঞ্চে গেল ৫৬৬ রানে, হানিফের রান তখন ২৯৭। লাঞ্চের ঠিক পরেই ট্রিপল সেঞ্চুরি পূর্ণ করে ফেললেন তিনি।
ম্যাথিয়াস আউট হয়ে গেলেন কিছুক্ষণ পরই। উইকেটে এবার তার সাথে যোগ দিলেন ক্যাপ্টেন কারদার। হানিফ খেলতেই থাকলেন, খেলতে খেলতে পূর্ণ করলেন অধিনায়কের ইচ্ছাও। টি’তে যখন গেলেন, তখন তিনি অপরাজিত আছেন ৩৩৪ রানে। দলের রান ৫ উইকেটে ৬২৩। লিড ১৫০ রানের।
টানা প্রায় চারদিন ব্যাট করে নিশ্চিত হারা ম্যাচ বাঁচিয়ে ফেললেন হানিফ মোহাম্মদ!
হানিফের ইনিংস শেষ হয় ৩৩৭ রানে। সম্ভবত ম্যাচ হারছেন না, তা নিশ্চিত হওয়ার পর মনোযোগে একটু হলেও ব্যাঘাত ঘটেছিল তার। ডেনিস অ্যাটকিনসনের একটা নিরীহদর্শন বল হুট করেই লাফিয়ে উঠলো, উঠে ব্যাটের কানায় লেগে আশ্রয় নিল ক্যাপ্টেন ও উইকেটকিপার অ্যালেক্সান্ডারের গ্লাভসে।
আর এর মধ্য দিয়ে শেষ হল হানিফ মোহাম্মদের ৯৭০ মিনিটব্যাপী ইনিংস। সব মিলিয়ে ১৬ ঘণ্টার উপরে, যা কি না টেস্ট ইতিহাসের সর্বোচ্চ। এই ৩৩৭ রান, দ্বিতীয় ইনিংসে যেকোনো ব্যাটসম্যানের সর্বোচ্চ স্কোর, আজ ৬১ বছর পরও।
পাকিস্তান শেষ পর্যন্ত ৬৫৭ রানে ডিক্লেয়ার করে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে জয়ের জন্য ১৮৫ রানের টার্গেট দেয়। কিন্তু সময়টা ছিল শেষ দিনের বিকেল। তাই ওয়েস্ট ইন্ডিজের রান যখন ২৮, তখন ম্যাচ ড্র ঘোষণা করা হয়।
৭.
কোন বিশেষ ঘটনা ঘটার পরে তা মানুষের মুখে মুখে ফেরে। আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে মানুষ সেই ঘটনায় রঙ চড়ায়। হানিফ মোহাম্মদের ইনিংসের পরও সেরকমই হয়েছিল। সেই মজার গল্পটা দিয়েই লেখাটার ইতি টানা যেতে পারে। গল্পটা আদৌ সত্যি কি না, সে ব্যাপারে সন্দেহ থাকলেও গল্পটা যে আসলেই চমৎকার, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।
গল্পটা এরকম: খেলা দেখতে মাঠে এসেছিল এক ছেলে, মাঠের পাশের এক গাছে বসে খেলা দেখছিল সে। পাকিস্তান যখন প্রথম ইনিংসে অলআউট হয়ে যায়, সে ভেবেছিল দ্বিতীয় ইনিংসেও পাকিস্তান খুব তাড়াতাড়িই আউট হয়ে যাবে। নিজের প্রিয় দল ওয়েস্ট ইন্ডিজের জয় দেখেই বাড়ি ফিরতে পারবে সে।
কিন্তু হানিফ মোহাম্মদ এমনই ব্যাটিং শুরু করলেন যে, কিছুক্ষণের মধ্যেই সে বিরক্ত হয়ে গেল। আরে, কেউ আউট হয় না কেন? এমনিতেই গরম পড়েছিল, সেই গরমে গাছে বসে খেলা দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়ল। এবং এর পরই দুর্ঘটনাটা ঘটলো, গাছ থেকে পড়ে গিয়ে পা ভেঙে ফেলল সে।
হাসপাতালে তার জ্ঞান ফিরল দিনদুয়েক পরে। জ্ঞান ফেরামাত্রই ডাক্তারের কাছে তার প্রথম জিজ্ঞাসা ছিল,
‘হানিফ মোহাম্মদ কি এখনও ব্যাট করছেন?’
ডাক্তারও কম রসিক ছিলেন না। তিনি বললেন,
‘হ্যাঁ, এখনও ব্যাট করে চলেছেন হানিফ মোহাম্মদ। তবে আপনার সৌভাগ্য, মাঠে গিয়ে ইনিংসটা আপনাকে আর দেখতে হবে না। পা ভেঙে ফেলেছেন কি না!’