যদি প্রশ্ন করা হয়, বেলজিয়াম কিসের জন্য বিখ্যাত, তবে নিঃসন্দেহে একাধিক উত্তর আসবে। বেলজিয়ামের চকলেট, বর্ণময় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, ঐতিহ্যবাহী খাবার, এমনকি বেলজিয়ামের বিখ্যাত ফ্রেঞ্চ ফ্রাই ও বিয়ারের কথাও আসতে পারে। উৎসবপ্রেমীদের জন্যও বেলজিয়াম বেশ আনন্দের জায়গা হয়ে উঠতে পারে। বেলজিয়াম যেসব বর্ণীল জমকালো উৎসবের জন্য বিখ্যাত, তার মধ্যে কার্নিভাল দ্যু বাশ্চ ঐতিহ্য ও জাঁকজমকের জন্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
সাধারণত ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে অ্যাশ ওয়েন্সডে নামক খ্রিস্টান উৎসব চলার সময় বেলজিয়ামের ওয়ালোনিয়া এলাকার বাশ্চ অঞ্চলে এই উৎসব উদযাপন করা হয়ে থাকে। বর্ণাঢ্য মিছিল, জমকালো পোশাক, বৈচিত্র্যময় গানবাজনার শব্দে চারিদিক আমোদিত হয়।
ইউরোপের সংস্কৃতিতে বেলজিয়াম বেশ উল্লেখযোগ্য অবস্থানে আছে। বিশেষ করে চিত্রকলায় পরাবাস্তব আন্দোলনের অনেক দিকপাল বেলজিয়ামে জন্মেছিলেন। তাদের মধ্যে রেনে ম্যাগ্রিতে উল্লেখযোগ্য। বলা হয়ে থাকে, পরাবাস্তব আন্দোলনের লৌকিক উৎসের মধ্যে কার্নিভাল দ্যু বাশ্চ অন্যতম।
বেলজিয়ামের ওয়ালোনিয়া অঞ্চলের অধিবাসীদের বেশিরভাগই ফরাসি ভাষায় কথা বলেন। এই উৎসবে এ অঞ্চলের ছেলে-বুড়ো নির্বিশেষে সকল পুরুষ বিশেষ পোশাক পরে মিছিলে অংশ নেন। এই পোশাকটি আলোচ্য উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ হিসেবে বিবেচিত হয়। পোশাক পরিহিত পুরুষ সে অঞ্চলে ‘গিলে’ নামে পরিচিত। এতে ‘অ্যাপারতিনতেইলে’ নামক ঘন্টা যুক্ত একটি বেল্ট লাগানো থাকে।
আরো থাকে মন্দের পরাজয়ের প্রতীক হিসেবে শস্য, উর্বরতার প্রতীক হিসেবে কাঠের জুতো, মিছিলে ছোঁড়ার জন্য কমলালেবুর ঝুড়ি এবং নান্দনিক শৈলীর গোঁফ যুক্ত মোমের তৈরি মুখোশ। এছাড়াও থাকে উটপাখির পালকে তৈরি বিশাল এক টুপি, যা দৈর্ঘ্যে প্রায় দেড় মিটার লম্বা এবং ওজনে প্রায় তিন কেজি!
‘গিলে’ কস্টিউম পরিহিত পুরুষদের মিছিল বিভিন্ন বয়সের মানুষ নিয়ে শুরু হয়। সাধারণত তিন বছর বয়সী শিশুরা এই মিছিলের সবচেয়ে কম বয়সী সদস্য হয়ে থাকে। পোশাক পরিহিত মহিলারা সাধারণত ‘প্যেসেন’ নামে পরিচিত। মহিলাদের পোশাক উজ্জ্বল নীল রঙের ঝলমলে পোশাক ও মুখোশের সমন্বয়ে তৈরি হয়। এছাড়া ‘পেরিয়োত’ ও ‘হার্লেকুইন’ নামক বিশেষ চরিত্রের জন্যও আলাদা পোশাক ব্যবহৃত হয়।
কার্নিভাল দ্যু বাশ্চ শুরু হবার আগে দীর্ঘদিন ধরে এর প্রস্তুতি চলতে থাকে। এর প্রস্তুতির বিশেষ দিক হচ্ছে মিছিলে ব্যবহৃত পোশাকের ডিজাইন ও লোকজ গানের দল ও বিভিন্ন ব্যান্ড সংগঠনের রিহার্সেল। মিছিলে ‘গিলে’ হিসেবে অংশ নেওয়া বিশেষ সম্মানজনক হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। একজন মধ্যবয়সী পুরুষ এতে অংশ নেয়ার জন্য যথাসাধ্য খরচ করে থাকেন। শুধু উটপাখির পালকে তৈরি হ্যাটই ন্যূনতম প্রায় এক হাজার ইউরো দামের হয়ে থাকে।
কার্নিভাল দ্যু বাশ্চ সাধারণত তিন দিন ধরে উদযাপিত হয়ে থাকে। বিশেষ খ্রিস্টিয় উৎসব ‘শ্রভ সানডে’ এই উৎসবের আনুষ্ঠানিক শুরু হিসেবে বিবেচিত হয়। এদিনে ড্রাম ও ভায়োলার মতো বাদ্যের সুমধুর সুরে আকাশ-বাতাস আলোড়িত হতে থাকে। প্রথমদিনের মিছিলে অংশগ্রহণকারী পুরুষ ও নারীরা সমকালীন বিভিন্ন ঘটনাবলী ও চরিত্রের আদলে সজ্জিত হন। এদিনের কস্টিউম সাধারণত সকল সদস্যের জন্য অভিন্ন হয়ে থাকে। উৎসবের শুরুর দিন হিসেবে এই দিন উৎসাহ আর উদ্দীপনার ক্ষেত্রে অনন্য হয়ে থাকে।
খ্রিস্টিয় উৎসব ‘শ্রভ মানডে’ উৎসবের দ্বিতীয় দিন হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। সাধারণত শিশু ও কিশোরদের জন্য দ্বিতীয় দিন উৎসর্গ করা হয়ে থাকে। বিভিন্ন মনোহর ঝলমলে পোশাক পরিহিত তরুণ-তরুণীরা শহরের বিভিন্ন ক্যাফেতে গিয়ে ভায়োলার সুমধুর আওয়াজে নেচে-গেয়ে আনন্দে মেতে ওঠে। দুপুরের কিছু জমকালো রঙিন কাগজের বৃষ্টিতে আকাশ বাতাসও যেন উৎসবের আমেজে একসাথে গেয়ে ওঠে। এমনকি উৎসবের এমন দিনে চার্চও গুরুগম্ভীর ভাব ছেড়ে পিয়ানোর শব্দে আমোদিত হয়ে ওঠে। দ্বিতীয় দিনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বাজি পোড়ানো ও বিভিন্ন রকম বাহারী আতশবাজি।
খ্রিস্টিয় উৎসব ‘শ্রভ টুয়েসডে’ কার্নিভাল দ্যু বাশ্চের তৃতীয় ও শেষ দিন হিসেবে বিবেচিত। মূলত এই দিনটিই আলোচ্য উৎসবের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহ্যবাহী দিন। কাকডাকা ভোরে প্রত্যেক বাড়ি থেকে উৎসবের বিশেষ পোশাক পরে প্রতিটি পরিবার মিছিলে সমবেত হবার উদ্দেশ্যে বের হন। অন্ধকার থাকতে থাকতেই প্রত্যেক ‘গিলে’ পাড়ার অন্যান্য ‘গিলে’ সদস্যের সাথে একত্র হবার জন্য যাত্রা করেন।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, ‘গিলে’ সদস্যদের একত্র হবার বিশেষ নিয়ম আছে। সাধারণত তারা ড্রামের তালে তালে হেঁটে মিলিত হন। ফলে এই যাত্রা এক অভিনব নৈশ প্যারেডের মতো মিছিলে রূপ নেয়। সকাল ৭টায় তারা ওস্টার (শামুকের একরকম ডিশ) ও শ্যাম্পেইন দিয়ে সকালের নাশতা সম্পন্ন করেন। এমনকি তিন বছর বয়সী ছেলে শিশুও শ্যাম্পেইন থেকে বঞ্চিত হয় না! নাশতার পর তারা বাদ্যের তালে তালে নেচে-গেয়ে মূল মহাসড়কের দিকে যাওয়া বিভিন্ন পথে এগিয়ে যেতে থাকেন।
সকাল সাড়ে আটটা থেকে মিছিলের ‘গিলে’ সদস্যরা ‘প্যাসেন’, ‘হার্লেকুইন’ ও ‘পিঁয়েরো’দের সাথে একত্রে সমবেত হন। এখানে সিটি হলে শহরের মেয়র তাদের অভ্যর্থনা জানান এবং কোনো কোনো সদস্যকে মেডেল প্রদান করেন। বিকেল তিনটা থেকে এক বিশাল মিছিল বের হয়। এতে প্রায় ১,০০০ ‘গিলে’ সদস্য যোগ দেন। এই মিছিলেই তারা সেই ঐতিহ্যবাহী উটপাখির পালকের হ্যাট পরিধান করেন। ভায়োলা ও ড্রামের মিলিত ঐতিহ্যবাহী সুরের তালে তারা অগ্রসর হন।
উৎসবের একপর্যায়ে শ্যাম্পেইন ছিটানো শুরু হয়। তার পরপরই শুরু হয় আনুষ্ঠানিক কমলা ছোঁড়ার উৎসব। সমবেত মিছিলকারীরা এসময় কমলা ছুঁড়তে শুরু করে। এই কমলা ছোঁড়ার বিশেষ নিয়ম আছে। কোনো ব্যক্তিবিশেষের প্রতি কমলা ছুঁড়ে মারাকে সাধারণত নিরুৎসাহিত করা হয়। মিছিলকারীরা বিশেষ কাউকে লক্ষ্য না করেই কমলা ছুঁড়ে থাকেন। ওয়ালোনিয়া অঞ্চলে কমলা সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে। মানুষজন সাধারণত একে অপরের দিকে কমলা ছুঁড়ে থাকেন। অনেক সময় আশেপাশের বাড়ি-ঘরের জানালার কাঁচ কমলা ছোঁড়ার কারণে ভেঙে থাকে।
কমলা ছোঁড়ার উৎসব শেষ হলে সমবেত মানুষজন আবার আগের স্থানে ফিরে আসেন। এখানে ‘গিলে’ সদস্যরা বৃত্তাকারে নাচতে নাচতে গান করতে থাকেন। এই প্রক্রিয়াকে ‘রঁদ্যু’ বলা হয়। এরপর শুরু হয় বাজি পোড়ানো ও ফায়ারওয়ার্ক। নাচা-গাওয়া ও সমবেত কল্যাণের জন্য পানাহার চলতে থাকে একেবারে ভোর পর্যন্ত। কার্নিভাল দ্যু বাশ্চ এভাবেই আনুষ্ঠানিকভাবে সমাপ্ত হয়।
জনপ্রিয় সাহিত্য ও কমিক সিরিজের ঘটনায় অনেক সময়ই ‘বাশ্চ কার্নিভাল’ এর সরব উপস্থিতি দেখা যায়। উদাহরণ হিসেবে সাড়া জাগানো গোয়েন্দা সিরিজ ‘টিনটিন’ এর কথা বলা যেতে পারে। ‘টিনটিন অ্যান্ড দ্য পিকারো’স’ পর্বে এই কার্নিভালের ‘গিলে’র মতো একদল মিছিলকারীর দেখা মেলে। পর্বটিতে কল্পিত এক লাতিন আমেরিকান স্বৈরাচারী শাসককে উৎখাত করতে একদল বিদ্রোহীকে কার্নিভালের আশ্রয় নিতে দেখা যায়। মজার ঘটনা, কিউবায় ১৯৫৩ সালে অত্যাচারী শাসক বাতিস্তার বিরুদ্ধে বিপ্লবী নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো একবার ‘বাশ্চ কার্নিভাল’ এর মতো একরকম আয়োজনকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন।
‘কার্নিভাল দ্যু বাশ্চ’কে বেলজিয়ামের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে ধরা হয়। বেলজিয়ামের সাধারণ মানুষ এই উৎসবের মাধ্যমে তাদের সংস্কৃতির শিকড় ও তার আকুল আহ্বান উৎসবের স্বর্গীয় আমোদের মাধ্যমে অনুভব করে থাকে। বর্তমানে এটি খ্রিস্টিয় রীতিনীতির সাথে বেশ জাকজমকের সাথে পালিত হয়। তবে গভীরভাবে দেখলে বেলজিয়ামের গ্রামীণ ও লোকঐতিহ্যের সাথে এর নিবিড় যোগাযোগ বেশ স্পষ্ট বোঝা যায়। ইউরোপের অন্যতম সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে বেলজিয়ামের মানুষ নিজেদের পূর্বপুরুষের এই সমৃদ্ধ ঐতিহ্য বেশ সার্থকভাবেই ধরে রেখেছে।
২০০৩ সালে ইউনেস্কো বেলজিয়ামের ‘কার্নিভাল দ্যু বাশ্চ’কে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘মাস্টারপিস অব দ্য ওরাল অ্যান্ড ইনট্যানজিবল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। এই উৎসব ঐতিহ্য, গ্রাম্য ও লোকজীবন এবং আধুনিকতার সার্থক মিলন হিসেবে বেলজিয়ামের অধিবাসীদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মানবিক ও সাংস্কৃতিক অর্জন।