Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

সর্বকালের সেরা ১২টি ছবির উপাখ্যান

আমরা যদি আমাদের আদিম পূর্বপুরুষদের কথা চিন্তা করি, তবে প্রথমেই আমাদের মনে ভেসে ওঠে গুহার ভেতর খোঁদাই করে আঁকা কিছু ছবির কথা। শিকারের ছবি, আরাধনার ছবি, মৃত্যুর ছবি কিংবা কোনো অনুষ্ঠানের। ছবি আঁকা আর তা দিয়ে নিজের ভাবকে প্রকাশ করা, চিন্তার ব্যাপ্তি আর তার সঞ্চার ঘটানোর ইচ্ছের প্রাচীন সুতো ধরে টান দিলে আমাদের সামনে একে একে হাজির হন জগৎখ্যাত সব আঁকিয়ে। তারা তাদের আঁকা ছবির মতন ভাস্বর হয়ে আছেন, থাকবেন আজকের পৃথিবীর ইতিহাস যতোদিন না বিলীন হয়ে যাবে তার আগ পর্যন্ত।
ইতিহাসের সেই সব কিংবদন্তী আঁকিয়ে এবং তাদের আঁকা কিছু ছবির সংক্ষিপ্ত আলোচনাই আমাদের আজকের নিবেদন।

১. দ্য স্টারি নাইট (The Starry Night)

দ্য স্টারি নাইট; ছবিসত্ত্ব: commons.wikimedia.org

ভিনসেন্ট ভ্যান গগ পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বিখ্যাত এবং গুণী চিত্রকরদের একজন। তার বিখ্যাত চিত্রকর্ম দ্য স্টারি নাইট পেয়েছে অগণিত মানুষের ভালোবাসা। অনেক চিত্রবোদ্ধাদের মতে, এটিই তার জীবনের সেরা কাজ। মৃত্যুর ঠিক এক বছর আগে ১৮৮৯ সালে জুন মাসে এ ছবিটি আঁকেন ভ্যান গগ। তিনি সেবার মানসিক বিকারগ্রস্থ হয়ে নিজের কান নিজেই কেটে ফেলেছিলেন। আবার নিজ থেকেই ভর্তি হয়েছিলেন এক মানসিক হাসপাতালে। ভোর হবার কিছুক্ষণ আগে তার ঘরের জানলা থেকে বাইরে তাকান এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই ছবিটি এঁকে ফেলেন তিনি। তিনি বলতেন, আমার প্রায়ই মনে হয় যে, রাতেই অন্ধকার দিনের চে’ অনেক বেশি রঙিন। রাত্রির সেই চঞ্চলতা, আলোর ছুটোছুটি বা টার্বুলেন্সের অপরূপ নির্মাণ স্টারি নাইট। ক্যানভাসের উপর তেল রঙে আঁকা ছবিটি বর্তমানে রয়েছে নিউ ইয়র্কের মিউজিয়াম অফ মডার্ন আর্টে।

১৮৯০ সালে মাত্র ৩৭ বছর বয়সে আত্মহত্যা করেন এই ক্ষণজন্মা। তিনি মনে করতেন, তার সারা জীবনের সব কাজ ব্যর্থ হয়েছে। কেননা, সাতাশ/আঠাশ বছর বয়সে আঁকতে শুরু করা ভ্যান গগ মৃত্যু অবধি তেলরঙে এঁকেছেন প্রায় ৯০০ ছবি, কিন্তু জীবদ্দশাতে বিক্রি করতে পেরেছিলেন মাত্র একটি! আবার, তিনি গুণ্ডার গুলিতে খুন হয়েছিলেন, এমন কথাও বলেছেন কেউ কেউ।

২. গার্ল উইথ আ পার্ল ইয়ারিং (Girl with a Pearl Earring)

গার্ল উইথ আ পার্ল ইয়ারিং; ছবিসত্ত্ব: commons.wikimedia.org

আচ্ছা বলতে পারেন, ছবির এই মেয়েটি আপনার দিকে তাকাচ্ছে নাকি আপনার থেকে চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে? আদতে কেউ তা হলফ করে বলতে পারে না। ডাচ আঁকিয়ে ইয়োহানেস ভারমিয়ারের কীর্তি আশ্চর্যময়ী এ বালিকার ছবিকে বলা হয়ে থাকে ‘মোনা লিসা অফ নর্থ’। ১৬৬৫ সালে ক্যানভাসের উপর তেলরঙে ছবিটি আঁকেন ভার্মিয়ার। মেয়েটির চাহনি, কিছু বলতে চাওয়ার অভিব্যক্তি, নীলরঙা স্কার্ফ আর বেশ বড় ওই মুক্তোর কানের দুল আমাদের অনেকগুলো গল্প বলে যায় একে একে। কানের ওই দুলটি মুক্তোর না হয়ে পালিশ করা টিনের হলে ছবিটি ভিন্ন মাত্রা পায়, বলেন অনেকে।

বর্তমানে ছবিটি ঝুলছে নেদারল্যান্ডের হেগ শহরের মাওরিটশাওস জাদুঘরের কোনো এক দেয়ালে।

৩. দ্য ফ্লাওয়ার ক্যারিয়ার (The Flower Carrier)

দ্য ফ্লাওয়ার ক্যারিয়ার; ছবিসত্ত্ব: commons.wikimedia.org

দ্য ফ্লাওয়ার ক্যারিয়ার মেক্সিকান আঁকিয়ে দিয়েগো রিভেরার সেরা ছবিগুলোর একটি। ছবিটি বেশ কিছু কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের যে স্বাভাবিক সৌন্দর্যবোধ, তা পূরণের মাধ্যম হয়ে যায় আমাদের সমাজের শ্রমজীবী মানুষেরা। অথচ সেই সৌন্দর্য ভোগ করার ফুসরত নেই তাদের। উজ্জ্বল সব রঙের ব্যবহার ছবিটিকে আকর্ষণীয় করেছে যেমন, স্বভাবজাত আমাদের সৌন্দর্যপ্রিয়তার কারণে আমদের নজর কেড়ে নেয় বিশাল সেই ঝুড়ির ফুলগুলো। কিন্তু ছবিটির সাবজেক্ট, যে ফুলের ঝুড়িটি কাঁধে করে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করছেন, তার সে সুযোগ কোথায়? আমরা ধরে নিতেই পারি, পেছনের সাহায্যকারী নারীটি সাবজেক্টের স্ত্রী এবং কালো বর্ণ ও শারীরিক গঠন রায় দেয় – তারা মেক্সিকান। ছবিটিতে মেক্সিকোর সামাজিক রীতিনীতির একটি দিক ভালোভাবে ফুটে উঠেছে। শারীরিক আকার আর কাজের সামর্থ্যের প্রশ্নে আঁকিয়ে আমাদের ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছেন তা সচেতন পাঠকমাত্রই বুঝতে পারবেন।

৪. আর্নোফিনি পোর্ট্রেইট (Arnolfini Portrait)

নর্দার্ন রেঁনেসার একজন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধি য্যান ভ্যান আইক। তার সেরা কাজ এই আর্নোফিনি পোর্ট্রেইটটি তিনি এঁকেছিলেন ১৪৩৪ সালে, বর্তমানে তা সংরক্ষিত আছে লন্ডনের ন্যাশনাল গ্যালারিতে। অনেকে মনে করেন, এটি পৃথিবীর সবথেকে দামি এবং গুরুত্বপূর্ণ চিত্রকর্ম।

আর্নোফিনি পোর্ট্রেইট; ছবিসত্ত্ব: commons.wikimedia.org

এ ছবিটি সম্পর্কে একটি ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। তা হলো, অনেকে এ ছবিটিকে বলেন, আর্নোফিনি ওয়েডিং পোর্ট্রেইট। প্রায় সব গবেষকই এ ব্যাপারে একমত যে, ছবিটিতে নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ কোনো ঘটনা ঘটছে – দুজনে হাত একত্রে রাখা, পুরুষ সাবজেক্টের ডান হাত উঁচুতে ধরা, দুজনেই জুতা খুলে রাখা ইত্যাদি তারই ইঙ্গিত দেয় – কিন্তু এখানে বিবাহসংক্রান্ত কোনো বিষয় ঘটছে না। কারণ, স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে যে, আমাদের নারী সাবজেক্ট প্রেগন্যান্ট। তাই এ যুগলকে পূর্ববিবাহিত বলেই সাব্যস্ত করেন তারা।

ঘরের আসবাব, সাজসজ্জা, পোশাক সবকিছুই বুঝিয়ে দেয় ছবিটি ধনী পরিবারের। সাথে ঝাড়বাতিতে একটি মাত্র মোমবাতি জ্বলতে থাকা ঈশ্বরের সাথে ঘটনাটির সংযোগ স্থাপন করে। আবার, ভ্যান আইক ঝাড়বাতির ঠিক নিচে আঁকিয়ের স্বাক্ষরের ঢঙে জানান দিয়েছেন নিজের উপস্থিতির কথা। তিনি লিখেছেন, ‘Johannes V Eyck fuit hic 1434’ অর্থাৎ, ‘জোহানেস ভ্যান আইক এখানে উপস্থিত ১৪৩৪!’ কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে পরিবারটির সাম্ভ্রান্তের প্রতীক আয়নাটি। আঁকিয়ের কম্পোজিশানও আমাদেরকে আয়নাটিকে মূল কেন্দ্র হিসেবে ভাবায়। নিবিষ্টভাবে আয়নাটিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, দুজন অতিথি এসেছেন বাড়ির দরজায়, বাড়ির কর্তা হয়তো তাই হাত উঁচু করে অভিবাদন জানাচ্ছেন ওদের। ছবিটি আরো বেশি আগ্রহ উদ্দীপক হয়ে ওঠে যখন দেখা যায় আয়নায় চারপাশে বাড়তি অংশগুলোতে আরো দশটি মিনিয়েচার এঁকেছেন তিনি, যার মধ্যে একটি হলো ক্রুসিফাইড যীশু! ক্যানভাসের উপর তেলরঙের এমন সূক্ষ্ম কাজ পৃথিবীবাসী খুব কমই দেখেছে।

এক্ষেত্রে লেখক পাওলো কোয়েলহোর একটি মন্তব্য উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি বলেছিলেন,

মোনা লিসা বিষয়ে আমাদের বড্ড বাড়াবাড়ি! আসলে – লিওনার্দো দা ভিঞ্চির প্রতি সম্মান দেখিয়েই বলছি – পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান ছবি হলো আর্নোফিনি পোর্ট্রেইট।

৫. দ্য সন অফ ম্যান (The Son of Man)

বেলজিয়ান আঁকিয়ে রেনে মাগ্রিতের একটি জনপ্রিয় সুররিয়ালিস্ট পেইন্টিং দ্য সন অফ ম্যান। ছবিটি মাগ্রিত এঁকেছিলেন সেল্ফ পোর্ট্রেইট হিসেবে। ছবিটিতে আমরা দেখতে পাই ওভারকোট এবং বোলার হ্যাট পরিহিত একজন মানুষের মুখ প্রায় ঢেকে দিয়েছে পড়ন্ত একটি সবুজ আপেল। মানুষটি দাঁড়িয়ে আছেন একটি নিচু দেওয়ালের সামনে আর ছবিটির ব্যাকগ্রাউন্ড তৈরি করেছে সমুদ্র এবং মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। আরেকটি ব্যাপার লক্ষ্যণীয়, তা হলো, লোকটির বাঁ হাতের কনুই উল্টোদিকে ভাঁজ করা!

মাগ্রিত এ ছবিটি এঁকেছিলেন ১১৬ সেমি বাই ৮৯ সেমি ক্যানভাসের উপর তেলরঙে, ১৯৬৪ সালে।

দ্য সন অফ ম্যান; ছবিসত্ত্ব: commons.wikimedia.org

ছবিটি সম্পর্কে রেনে মাগ্রিতের উক্তিটি উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেন,

এটি মুখের কিছু অংশ ঢেকে ফেলছে আবার কিছু অংশ দেখতে সাহায্য করছে। অর্থাৎ, এটি একই সাথে কিছু দেখাচ্ছে আর কিছু গোপন করছে। এ ব্যাপারটি আমাদের সাথে প্রতিনিয়তই হতে থাকে: আমরা যা কিছুই দেখি না কেন, তা অন্যকিছুকে আমাদের থেকে আড়াল করছে। আমরা সবসময় দেখতে চেয়েছি যা আমাদের থেকে আড়াল করা, আর সে বিচার আমরা করি – যা আমরা দেখতে পাই তা দিয়ে। আমরা তাই সিদ্ধান্তে আসতে পারি না যে কি আসলে আমাদের চোখের সামনে রয়েছে আর কি আড়াল করা হয়েছে। এ ব্যাপারটি আমাদের জন্য মহা বিভ্রান্তির।”

৬. দ্য পারসিসটেন্স অফ মেমোরি (The Persistence of Memory)

সুররিয়ালিজম বা পরাবাস্তববাদের আরেকজন ফেরিওয়ালা স্প্যানিশ চিত্রকর সালভাদর দালি। তার সবচেয়ে আলোচিত ছবি দ্য পারসিসটেন্স অফ মেমোরি। ছবিটি বর্তমানে সংরক্ষিত আছে নিউ ইয়র্কের মিউজিয়াম অফ মডার্ণ আর্টে

দ্য পারসিসটেন্স অফ মেমোরি; ছবিসত্ত্ব: commons.wikimedia.org

এ ছবির প্রধান সাবজেক্ট ‘সময়’ আর তা আমাদের কাছে ধরা দেয় ঘড়ি হয়ে। ফ্রান্সের বিখ্যাত পনির ক্যামোবের গ্রীষ্মের উষ্ণতায় গলে গলে পড়তে দেখে ভিশনারী সালভাদোর দালির মনে হলো সময়ও তো বয়ে চলছে এভাবেই! গলে পড়ছে, রূপান্তরিত হচ্ছে। অযৌক্তিক সময়ের বেড়াজালে লুপ্ত হয়ে যাওয়া বর্তমানকে দালি ধরতে চেয়েছেন ছবিতে। আমরা তাই দেখতে পাই, এখানে সময় গলে পড়েছে মাখনের মতো, সময় ঝুলে পড়েছে কাপড়ের মতো। কালো পিঁপড়ার সামষ্টিক আক্রমণে ক্ষত হয়েছে সময়ের দেয়াল। মাছি শুষে পান করছে সময়ের শান্ত নীল জল। সময়ের বহুরূপতায় তাই দালির এ ছবিটি হয়ে উঠেছে অনন্য, অদ্ভুত।

৭. দ্য স্ক্রিম (The Scream)

নরওয়ের এক্সপ্রেশানিস্ট আঁকিয়ে এডওয়ার্ড মুংখ মানবীয় মনস্তত্ত্বের নানা দিক ফুটিয়ে তুলতেন তার পটে। ১৮৯৩ সালে আঁকা ‘দ্য স্ক্রিম’ নামক এই ছবিটির জন্য তিনি বিখ্যাত হয়ে আছেন। চার ছবির একটি সিরিজ এঁকেছিলেন তিনি, নাম দিয়েছিলেন, দ্য স্ক্রিম অফ ন্যাচার। মূলত এই একটি ছবিকেই চার মাধ্যমে এঁকেছিলেন তিনি। ১৮৯৩ থেকে ১৯১০ সাল নাগাদ তিনি ছবিগুলো আঁকেন।

দ্য স্ক্রিম; ছবিসত্ত্ব: commons.wikimedia.org

এক বিকেলে হাঁটছিলাম বন্ধুদের সাথে। রোজকার মতো সন্ধ্যে ঘনিয়ে এলো, রোজকার মতোই সূর্য লুকিয়ে যাবার তোড়জোড় করছে। কিন্তু আমার মনে হলো আজকের সন্ধ্যে, আজকের সূর্যাস্ত রোজকার সন্ধ্যে আর সূর্যাস্ত থেকে ভীষণ রকম আলাদা। আমি দেখলাম আকাশ একেবারে রক্তলাল বর্ণ ধারণ করলো। আমরা অনেক হেঁটেছিলাম, ক্লান্ত লাগছিলো। তাই রাস্তার ধারের বেড়ায় হেলান দিয়ে দাঁড়ালাম। এ রাস্তার নিচ দিয়ে বয়ে গেছে সমুদ্রখাঁড়ি। আমি দেখলাম, নীলচে কালো সমুদ্রপানির উপরের আকাশ কেমন যেন রক্তাক্ত হয়ে পড়েছে। আমি আমার সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করলাম, প্রকৃতি যেন চিৎকার করছে! সে চিৎকার স্থান কাল ছাপিয়ে চিরন্তন হবার আকাঙ্খায় ব্যাপ্ত হচ্ছে সারা পৃথিবী জুড়ে। আমি সে প্রাকৃতিক চিৎকারকেই আঁকতে চেষ্টা করেছি।

এডওয়ার্ড মুংখ এমনটিই লেখেন তার নোটবুকে।

এখানে যে ছবিটি দেখানো হয়েছে, তার বর্তমান অবস্থান নরওয়ের ন্যাশনাল গ্যালারিতে। কার্ডবোর্ডে প্যাস্টেলে আঁকা তার ‘দ্য স্ক্রিম অফ ন্যাচার’ সিরিজের আরেকটি ছবি বিখ্যাত হয়ে আছে আরেকটি কারণে। সে ছবিটি যে এখনও পর্যন্ত নিলামে বিক্রি হওয়া সবচে’ দামি ছবি! সোথেবি ২০১২ সালে সে ছবিটি বিক্রি করেছিলো প্রায় বারো কোটি মার্কিন ডলার মূল্যে!

৮. উইসলার’স মাদার (Whistler’s Mother)

ক্যানভাসের উপর তেলরঙে আঁকা বিখ্যাত এই পোর্ট্রেইটটির আঁকিয়ে আমেরিকান চিত্রকর জেমস ম্যাকনেইল উইসলার। ১৮৭১ সালে ছবিটি আঁকেন তিনি। ছবিটির সাবজেক্ট হলেন তার মা অ্যানা ম্যাকনেইল উইসলার। ১৮৭২ সালে রয়েল অ্যাকাডেমির এক্সিবিশানে ছবিটি জমা দেওয়ার সময় অবশ্য তিনি এর নাম দিয়েছিলেন, ‘অ্যারেঞ্জমেন্ট ইন গ্রে অ্যান্ড ব্ল্যাক – পোর্ট্রেইট অফ দ্য পেইন্টার’স মাদার’। উইসলার ছবিটি এঁকেছিলেন লন্ডনে বসে, তার স্টুডিওতে। খুঁতখুঁতে স্বভাবের উইসলার সাধারণত একটি ছবি আঁকতে অনেক বেশি সময় নিতেন। কিন্তু এ মাস্টারপিসটি আঁকতে তিনি সময় নিয়েছিলেন মাত্র তিন মাস।

উইসলার’স মাদার; ছবিসত্ত্ব: commons.wikimedia.org

প্রথমে স্ট্যান্ডিং ফুলবডি পোর্ট্রেইট আঁকতে শুরু করলেও খানিক বাদে উইসলারের মা অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাই উইসলার মাকে বসিয়ে নিয়ে এঁকেছিলেন ছবিটি। উইসলারের বাবার মৃত্যু পর থেকে এক শোকের পোষাক ছাড়া আর কিছু পরেননি উইসলারের মা। ছবিটিতে সেই শোকের পোষাকের উপস্থিতি ভিন্ন এক মাত্রা এনে দেয়। মাতৃত্বের প্রতীক হিসেবে ছবির এ বসার ভঙ্গিতেই উইসলারের মায়ের একটি পাথরের মনুমেন্ট আছে যুক্তরাস্ট্র্রের পেনসিলভেনিয়ায়।

আইকনিক ছবির বিচারে মোনা লিসা কিংবা স্টারি নাইট ছবিগুলোর সাথে একসাথে উচ্চারিত হয় এ ছবিটি। ছবিটি যেমনটি কম্পোজিশানের জন্য বিখ্যাত হয়ে আছে, তেমনি বিখ্যাত হয়ে আছে উইসলারের এক্সপেরিমেন্টাল টোনাল হারমনির জন্য। ১৯৩৩ সালে ছবিটি ল্যুভর মিউজিয়াম থেকে নিউ ইয়র্কের মিউজিয়াম অফ মডার্ন আর্টে স্থানান্তরিত করা হয়। ১৯৩৪ সালে আমেরিকার ডাকবিভাগ এ ছবিটি নিয়ে তিন সেন্ট মূল্যের একটি ডাকটিকিট প্রকাশ করে, তাতে এ ছবিটির পাশাপাশি লেখা ছিলো, “আমেরিকার সকল মায়ের সম্মানে এবং তাদের স্মৃতির উদ্দেশে”।

বর্তমানে ছবিটির অবস্থান দ্য আর্ট ইনস্টিটিউট অফ শিকাগোতে

৯.  গের্নিকা (Guernica)

১৯৩৭ সাল। পাবলো পিকাসো তখন পারীর স্থায়ী বাসিন্দা। স্পেনের গৃহযুদ্ধ তখন তুঙ্গে। ন্যাশনালিস্ট পার্টির নেতা ফ্যাঙ্কোর আহবানে হিটলারের নাৎজি পার্টি এবং ফ্যাসিস্ট মুসোলিনীর বিমানবাহিনী অদ্ভুত ধ্বংসলীলা এবং গণহত্যায় মেতে ওঠে স্পেনের বাস্ক প্রদেশের ছোট্ট শহর গের্নিকায়। কোনোরকম পূর্ব সংকেত ছাড়াই বিকেল চারটা নাগাদ জার্মান আর ইতালীয় বিমানগুলো থেকে নেমে আসতে থাকে একের পর এক বোমা। তিন ঘন্টার ধ্বংসযজ্ঞে তিন হাজারেরও বেশি বোমা ফেলা হয়, হত্যা করা হয় দেড় সহস্রাধিক মানুষ। সড়ক এবং সেতুগুলো আগেই ধ্বংস করা হয়েছিলো, তবু যারা স্থলপথে পালাতে চেষ্টা করেছিলো, তাদেরকে মেশিনগানের গুলিতে হত্যা করা হয়।

পাবলো পিকাসোর গের্নিকা; ছবিসত্ত্ব: commons.wikimedia.org

সে যুগ এখনকার মতো অন্তর্জালের যুগ নয়; স্পেন থেকে সে খবর পিকাসো পর্যন্ত পৌছাতে তাই বেশ কদিন সময় লাগলো। ১ মে তিনি নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত হওয়া জর্জ স্টির নাম্মী এক প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিকের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা পড়লেন, প্রকম্পিত হলেন। নিজ দেশ, দেশের মানুষের জন্য ব্যথিত হলেন। আবার কবি ও প্রাবন্ধিক উয়ান লারেয়া অনুরোধ করলেন খুব করে, এই গের্নিকার বোমা হামলা নিয়ে প্রতিবাদী কোনো ছবি আঁকার জন্য। তখন পিকাসো স্পেনের তৎকালীন রিপাবলিক সরকারের অনুরোধে ফ্রান্সে একটি প্রদর্শনীর জন্য একটি মুরাল আঁকছিলেন। কিন্তু এতো বড় ধাক্কা তাকে সে প্রজেক্ট থেকে সরে আসতে বাধ্য করে। তিনি আঁকলেন কয়েকটি ছবির একটি সিরিজ আর তা হয়ে থাকলো পৃথিবীর ইতিহাসের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় প্রতিবাদ, সবচেয়ে জোরালো চিৎকার।

সাদা চোখে সাধারণ মানুষের কাছে দুর্বোধ্য মনে হতে পারে ছবিটি, ছবির শুরু ধরতেই হিমশিম খেয়ে যাই আমরা। উন্মত্ত ষাঁড়ের সামনে মৃত সন্তানকে কোলে নিয়ে মায়ে আর্ত চিৎকার, লণ্ঠন হাতে ছুটে পালাতে থাকা মানুষ কিংবা আগুনে পুড়তে থাকা বাড়ি থেকে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসা সাদাকালো পৃথিবীর মাঝে অভাবনীয় গতির সঞ্চার করে। ছবিটিতে ভিন্নমাত্রা এনে দেয় শতচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া একজন মানুষের ভাঙা তলোয়ারের সাথে ধরা থাকা ফুলটি

পিকাসো নিজে ছবিটির ব্যাখ্যা দেননি, তিনি চেয়েছেন, দর্শক যেন নিজের মতো করে একটা ব্যাখ্যা গুছিয়ে নেন। আমরাও তাই চাই, তবে আগ্রহী পাঠক চাইলে এ ভিডিওটি থেকে সাহায্য নিতে পারেন।

১০. দ্য লাস্ট সাপার (The Last Supper)

ইতালীর বিখ্যাত মানুষ লিওনার্দোর দ্য ভিঞ্চিই হলেন একমাত্র চিত্রশিল্পী যার দুটো চিত্রকর্ম আমাদের এ তালিকায় স্থান পেয়েছে। দ্য লাস্ট সাপার লিওনার্দোর বিখ্যাত দেয়াল চিত্রকর্ম অর্থাৎ এটি একটি ফ্রেস্কো। এর অবস্থান ইতালীর মিলান শহরের সান্তা মারিয়া ডেলা গ্রেইজি চার্চের ডায়নিং হলের পেছনের দেয়ালে।

দ্য লাস্ট সাপার; ছবিসত্ত্ব: commons.wikimedia.org

ছবিটি বিখ্যাত হয়ে আছে এর পেছনের গল্পের জন্য। যদিও যীশু খ্রিষ্টের লাস্ট সাপার বিষয়ে আরও অনেক আঁকিয়ে এঁকেছেন, তবু এ ছবিটিই সবচেয়ে বিখ্যাত এবং আলোচিত চিত্রশিল্পবোদ্ধাদের দুনিয়ায়। ছবিটিতে আমরা দেখতে পাই, খ্রিস্টান ধর্মমতে, যীশু শেষবারের মতো বসেছেন তার শিষ্যদের নিয়ে নৈশভোজে। মদ-রুটি খাওয়ার পর তিনি বললেন, পরদিন তোমাদের মধ্য থেকে কেউ একজন আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে। যীশুর সে ভবিষ্যদ্বাণী শোনার পর তার শিষ্যরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছে, কে সেই বিশ্বাসঘাতক? ছবিটিতে ধরা পড়েছে তিনজন করে চারটি দলে ভাগ হয়ে আলোচনা করা শিষ্যদের চাঞ্চল্য, উদ্বিগ্নতা, চাটুকারিতা, ভয় ইত্যাদি, অপরদিকে যীশুর ভয়াবহ নির্মোহ নির্লিপ্ততা। এ ঘটনাটি বাইবেলের বর্ণিত আছে লুক গ্রন্থে, অধ্যায় ২২:১-২৩

যীশুর খুব নিকটে ডান দিকে বসে থাকা কালো বর্ণের শিষ্যটি হলো সেই জুডাস। সে-ই রোমানদের কাছ থেকে মাত্র ৩০টি রৌপ্যমুদ্রার বিনিময়ে এ বিশ্বাসঘাতকতা করে। ছবিতে দেখা যায়, ডান হাতে জুডাস সেই রৌপ্যমুদ্রার থলি ধরে আছে।

১১. দ্য স্কুল অফ অ্যাথেন্স (The School of Athens)

প্রাচীন পৃথিবীর ইতিহাসের যেসব মহান মানুষ গড়ে গিয়েছিলেন আধুনিক পৃথিবীর ভিত্তি, তাদেরকে একই ফ্রেমে আবদ্ধ করেছিলেন ইতালীয় চিত্রশিল্পী রাফায়েল। মাইকেল অ্যাঞ্জেলো আর লিওনার্দো দা ভিঞ্চির যুগের শিল্পী রাফায়েল হাই রেঁনেসার যুগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চিত্রকর। বেঁচেছিলেন মাত্র ৩৭ বছর, তবে এই ক্ষুদ্র জীবনে তিনি বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে গেছেন।

দ্য স্কুল অফ এথেন্স; ছবিসত্ত্ব: commons.wikimedia.org

তার সেরা কাজ স্কুল অফ এথেন্স। রেঁনেসাকালীন ইতালীর একটি ফ্রেস্কো আর্ট। ছবিটির মাঝে আমরা প্লেটো এবং তার শিষ্য এরিস্টটলকে দেখতে পাই। রাফায়েল এখানে লিওনার্দোর শরীরে প্লেটোকে এঁকেছেন, বয়সের প্রবীণতা এখানে তাকে জ্ঞানী হিসেবে ফুটিয়ে তুলেছে। প্লেটোর পরনের পোশাকের যে রঙ তার অর্থ বাতাস ও আগুন, অর্থাৎ দুটোই ভরহীন বস্তু। এটি তার ভাববাদিতার পরিচায়ক। অপরদিকে বস্তুবাদী দার্শনিক এরিস্টটলের পোশাকের রঙ মাটি আর পানিকে প্রকাশ করে, অর্থাৎ তা পৃথিবীর ভরের সিংহভাগ। প্লেটোর চিন্তাভাবনার মূলে থাকা আধ্যাত্মিকতা, ধর্মবিশ্বাস, আত্মার অমরত্ব ইত্যাদির প্রকাশ ঘটে তার ভঙ্গিতে। তিনি উপরের দিকে আঙুলের ইশারায় তার শিষ্যকে বোঝাতে চাচ্ছেন, এ মহাবিশ্বের জাগতিক জ্ঞানের চেয়েও মহান কিছু জ্ঞান রয়েছে। অপরদিকে বাস্তববাদী এরিস্টটল নিচের দিকে ইশারা করে হয়তো বলছেন, না গুরু, আমাদের আগে জগতকে বুঝতে হবে। রাফায়েল তাই প্লেটোর দিকে ভাববাদী দার্শনিকদের এবং এরিস্টটলের দিকে বস্তুবাদী দার্শনিকদের সাজিয়েছেন।

লিওনার্দোর পাশাপাশি রাফায়েল তার যুগের আরেকজন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী মাইকেল অ্যাঞ্জেলোকেও রেখেছেন ছবিটিতে। একেবারে সামনে একটা বাক্সে কনুইতে ভর দিয়ে চিন্তামগ্ন হয়ে থাকতে দেখি তাকে। বামদিকে কোণায় মহান পিথাগোরাস কিছু লিখছেন আর ডান কোণায় শিষ্যদের কোনো উপপাদ্য বোঝাচ্ছেন ইউক্লিড। উপরের সারির বাঁ পাশে সক্রেটিসের সাথে দেখা যায় আলেকজান্ডার দি গ্রেটকে। আর সিঁড়ির ওপর এলোমেলোভাবে বসে আছেন ডায়োজিনিস দ্য সিনোপ। এতসব মহান মানুষদের মাঝে নিজেকে দেখার লোভ সামলাতে পারেননি রাফায়েল, একদম ডানে দেখা যায় তাকে। জ্ঞানীদের মাঝে জানতে আগ্রহী এক তরুণের মতো দেখা যাচ্ছে তাকে।

রাফায়েলের এই মাস্টারপিসটির অবস্থান ভ্যাটিকান সিটির পোপের অফিসিয়াল বাসভবন অ্যাপোস্তোলিক প্যালেসের ‘স্তানজা দেল্লা সেগনেতুরা’ বা ‘রুম অফ সেগনেতুরা’ নামক কক্ষে। ১৫০৯ থেকে ১৫১১ সাল নাগাদ তিনি আঁকেন এ ফ্রেস্কোটি। এর উল্টোদিকেই আছে রাফায়ালের আরেকটি বিখ্যাত ফ্রেস্কো ‘ডেসপিউটেশান অফ দ্য হলি স্যাক্রামেন্ট’।

১২. মোনা লিসা (Mona Lisa)

মোনা লিসা সম্পর্কে নতুন করে বলবার মতো কিছু হয়তো বাকি নেই। শুধুমাত্র যেসব রহস্যের জাল এখনও শিল্প গবেষকরা ভেদ করতে পারেননি, সেসব ছাড়া। মোনা লিসা নামের এই চিত্রকর্মটির নাম শোনেননি এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর। পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে আলোচিত এই ছবিটির আঁকিয়ে ইতালীয় রেনেসাঁর বহুমুখী গুণের অধিকারী সেই মানুষটি, ‍লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি। ধারণা করা হয় ১৫০৩ থেকে ১৫০৬ সালের মধ্যে তিনি এ ছবিটি এঁকেছিলেন।

মোনা লিসা; ছবিসত্ত্ব: commons.wikimedia.org

কিন্তু কে এই মোনা লিসা? অনেক শিল্প গবেষক পোর্ট্রেটের এই বিখ্যাত নারীকে ফ্লোরেন্টাইনের বণিক ফ্রান্সিসকো দ্য গিওকন্ডোর স্ত্রী লিসা গেরাদিনি বলে সনাক্ত করেছেন। আবার প্রায় লোমহীন মুখটায় অনেকে দাড়ি লাগিয়ে স্বয়ং লিওনার্দোকেই আবিষ্কার করে ফেলেন, অর্থাৎ তারা দাবি করেন, এ চরিত্রটি লিওনার্দো দা ভিঞ্চির নারীসত্ত্বা!

বর্তমানে মোনা লিসার যে আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা গত শতকেও কিন্তু এমনটি ছিলো না। তখনও মানুষ মোনা লিসা নিয়ে আলোচনা করেছে, বই লিখেছে, কিন্তু গত কয়েক দশক যাবত যে হাইপ আমরা লক্ষ করছি তেমন নয়। মূলত ১৯১১ সালে ফ্রান্সের ল্যুভর মিউজিয়াম থেকে চুরি হওয়ার পর থেকেই যেন রাতারাতি বিখ্যাত বনে যায় মোনা লিসা। মজার ব্যাপার হলো, ল্যূভরে এখনও পর্যন্ত শুধু মোনা লিসাকে দেখতে প্রতিদিন যত মানুষ ভিড় করে তাতে একজন দর্শনার্থী সময় পান মাত্র পনেরো সেকেন্ড করে!

ফিচার ইমেজ: ‍Wikimedia Commons

Related Articles