শত কোটি বছর ধরে প্রাকৃতিকভাবে জীবের যে ছাপ তৈরি হয়ে আসছে, তা হলো ফসিল বা জীবাশ্ম। আর এরপরই ছাপ তৈরিতে রয়েছে মানুষের অবদান, অস্ট্রেলিয়ান রক থেকে শুরু করে গুহাচিত্র পর্যন্ত। এখন যে সময়টির কথা বলবো, সেই সময় ক্যামেরা আবিষ্কৃত হলেও ততটা প্রসার লাভ করেনি। আর ছবি বা প্রমাণ সংরক্ষণের জন্য ছিল না কোনো আধুনিক প্রযুক্তিও।
জাপানে তাই কেউ সব থেকে বড় মাছটা ধরলেও গর্ব করে তা কাউকে দেখানোর উপায় ছিল না। সেজন্যেই জাপানীরা মাছ ধরার পর ‘ট্রফি’ বা স্মারক হিসেবে সংরক্ষণের জন্য সেটির একটি ছবি ছাপানোর উপায় শিখে নিলো। হাতে আঁকার জন্য রং-তুলি বা ক্যানভাস ব্যবহার করে না, বরং আস্ত মাছটাকেই ব্যবহার করতেন তারা সেটির ছবি ছাপানোর জন্য। অদ্ভুত উপায়ে মাছের ছবি ছাপানোর পদ্ধতি জাপানের ইতিহাসে গিয়োতাকু নামে পরিচিত। একসময় হারিয়ে গেলেও বর্তমানে জাপানে বেশ জনপ্রিয় এটি, সাথে সাথে এটি জাপানী সংস্কৃতির একটি অংশও। কীভাবে এলো এই গিয়োতাকু আর কীভাবে করা হতো এই কাজ, সেটা এবারে জেনে নেওয়া যাক তাহলে।
গিয়োতাকু
জাপানের কথা শুনলে প্রথমেই মাথায় আসে জনপ্রিয় সুশির কথা, যা তৈরি হয় কাঁচা মাছ দিয়ে। এ থেকেই বোঝা যায়, জাপানীদের সংস্কৃতির সাথে মাছ জড়িয়ে আছে গভীরভাবে। গিয়োতাকু হলো একটি ভিন্নধর্মী প্রাচীন চিত্রাঙ্কন পদ্ধতি, যার শুরু হয়েছে জাপানের জেলেদের হাতে। ধারণা করা হয়, প্রায় ১৮০০ সালের দিকে গিয়োতাকু আবিষ্কৃত হয়। জাপানীজ শব্দ গিয়োতাকু (Giyotaku 魚拓) দুইটি শব্দের সমন্বয়ে এসেছে। Gyo অর্থ মাছ (Fish) আর Taku অর্থ ছাপ (Impression)।
জেলেরা যেই মাছটি ধরেন, তার চিত্র সংরক্ষণের জন্য মাছটির গায়ের একপাশে সুমি-ই নামের একধরনের বিষাক্ত নয় এমন কালি লাগাতেন। সেই পাশটি রাইস পেপার নামের একধরনের কাগজের উপর রেখে চাপ দিতেন আর সেই কালি কাগজের গায়ে লেগে মাছের অবয়ব তৈরি করতো।
শুরুর গল্প
গিয়োতাকু কীভাবে এসেছে তার উপর প্রচলিত আছে অনেক গল্প। প্রথম দিকে জাপানী জেলেরা এই পদ্ধতি ব্যবহার করে তাদের জালে ধরা পড়া মাছের জাত আর আকারগুলো লিপিবদ্ধ করার জন্য গিয়োতাকু ব্যবহার করতেন। তারা সেই সময় সাগরে মাছ ধরতে যাবার সময় সাথে নিয়ে যেতেন সুমি-ই কালি, কাগজ আর ব্রাশ। ফিরে এসে তারা শোনাতেন সাগরে মাছ ধরার দুঃসাহসিক সব গল্প আর গিয়োতাকু ব্যবহার করে মাছের ছবি দেখাতেন অন্যদের। জাপানীরা আবার কিছু কিছু মাছের পূজারী ছিল, সেক্ষেত্রে সেসব মাছ ধরে ছবি আঁকার পর ছেড়ে দিতেন। এতে মাছের গায়ের কালি পানিতে ধুয়ে যেত।
শুরুর দিকে কেবল কালো কালির অবয়ব তৈরি করতে পারলেও ১৮ শতকের প্রথম দশকের মাঝামাঝিতে চোখ এবং অন্য বৈশিষ্ট্যগুলো আরো নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করতেন জাপানীরা। জেলে ছাড়াও শখের বসে কেউ মাছ ধরলে সে সময় অনেকেই বাড়িয়ে বলতো তাদের ধরা মাছের ব্যাপারে। কেউ বা আবার সত্যিই বড় কোনো মাছ ধরলে তার কোনো প্রমাণ রাখতে পারতেন না। আর সেই সমস্যার সমাধান হিসেবে জাপানীরা ব্যবহার করতো গিয়োতাকু। তবে এর সবথেকে বেশি ব্যবহার ছিল মাছের স্মারক সংরক্ষণের জন্য।
এডো পিরিয়ডের সময় (১৬০৩ থেকে ১৮৬৮ সাল পর্যন্ত) গিয়োতাকু বেশ জনপ্রিয়তা পায়। সেই সময় অভিজাত বংশীয় বেশ লোভী স্বভাবের এক ব্যক্তি, নাম লর্ড সাকাই, গিয়োতাকুর মাধ্যমে ধৃত মাছের ছবি আঁকার জন্য লোক ভাড়া করতেন। জেলেরা তাদের চিত্র নিয়ে তাকে দেখাতো আর যদি তার সেগুলো পছন্দ হয়ে যেত, তাহলে ভাড়া করে নিয়ে যেত সাকাই। তার প্রাসাদ ভর্তি ছিল গিয়োতাকু আর্টে। কিন্তু এডো পিরিয়ডের শেষের দিক থেকে গিয়োতাকু জনপ্রিয়তা হারাতে থাকে। এক পর্যায়ে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায় গিয়োতাকু।
বর্তমানকালে গিয়োতাকু
শুরুর দিকে গিয়োতাকু কেবলমাত্র ট্রফি আর রেকর্ড হিসেবে ব্যবহার হলেও, ধীরে ধীরে তা শিল্পে পরিণত হতে থাকে। এডো পিরিয়ডের পর গিয়োতাকু প্রায় হারিয়ে গেলেও বর্তমানে জাপানের ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির একটি অংশ এই চিত্রগুলো। এখনো জাপানের প্রায় অনেক দোকানেই গিয়োতাকু ঝুলিয়ে রাখতে দেখা যায়। কিন্তু কেবল মাত্র জাপানেই নয়, বরং বিশ্বের অনেক জায়গাতে এখনো এই শিল্পের চর্চা করা হয়। বর্তমানের গিয়োতাকু যেভাবে আঁকানো হয়, তা প্রাচীনকালের নিয়ম থেকে খানিকটা আলাদা। বর্তমানে এই শিল্পে দুই ধরনের রীতি প্রচলিত আছে। একটি হলো প্রত্যক্ষ আর্ট বা চকুসেতসু-হো, আরেকটি হলো অপ্রত্যক্ষ আর্ট বা কানসেতসু-হো।
প্রত্যক্ষ রীতিটি প্রাচীন রীতির মতোই। এতে সরাসরি মাছটিকে কালি দিয়ে রাঙানো হয়। প্রথমে মাছকে পরিস্কার করে শুকিয়ে নিয়ে তার উপর খুব সাবধানে সুমি-ই কালির আস্তরণ লাগিয়ে দিতে হয়। এরপর কালি লাগানো অংশটি রাইস পেপারের উপরে রেখে চাপ দিলে কাগজে মাছটির ছবি ফুটে উঠে। এরপর এতে চোখ বা অন্যান্য নকশা করে তৈরি করা হয় চিত্র। আগে কেবলমাত্র কালো কালি ব্যবহার করা হলেও, বর্তমানে তা আরো আকর্ষণীয় করে ফুটিয়ে তুলতে ব্যবহার করা হয় নানান রঙের কালি।
আর পরোক্ষ বা অপ্রত্যক্ষ রীতি প্রাচীন রীতি থেকে কিছুটা ভিন্ন। প্রথমে পরিস্কার করে মাছটিকে একটি বোর্ডের সাথে পিন দিয়ে আটকে দিতে হয়। এরপর একটি রাইস পেপার সামান্য ভিজিয়ে মাছটির গায়ে লাগিয়ে দিতে হয়। এরপর একটি নরম ব্রাশ রঙে ডুবিয়ে তা কাগজটির উপর ঘষা দিলে মাছের চিত্রটি ফুটে উঠে।। কিন্তু শেষ হবার পর কাগজটি তোলার সময় এক্ষেত্রে সাবধান থাকতে হয়। কারণ, কাগজটি খুব পাতলা আর ভেজা হওয়াতে ছিঁড়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে।
কিন্তু এই দুই ধরনের চিত্র দেখতে একরকম নয়। দুইটি চিত্রে কিছুটা পার্থক্য থাকে।
গিয়োতাকু আর্ট ও আর্টিস্ট
গিয়োতাকু কেবল জাপানেই নয় বরং ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে। সেই সাথে অনেকেই একে বেছে নিয়েছেন নিজের পছন্দের পেশা হিসেবে, নাম লিখিয়েছেন শিল্পীর খাতায়। জাপানসহ অনেক দেশেই বেশ জনপ্রিয় এই শিল্প। হাওয়াই দ্বীপের এমনই দুজন শিল্পী হলেন নাওকি এবং হেথার ফর্টনার। হেথারের প্রায় ৪০ বছরের গিয়োতাকু আর্টের অভিজ্ঞতা রয়েছে। অনেক শিল্পী আবার নিজের মতো করে বিশেষ কিছু পদ্ধতি ব্যবহার করেন। বর্তমানের নবাগত শিল্পীরা নিজেরা চেষ্টা করে শিখতে থাকেন ভুল আর সংশোধনের মাধ্যমে। হেথার একেকটি চিত্রে একাধিক মাছের ছাপ নেন। যা আরো মনোমুগ্ধকর চিত্র তৈরি করে। অনেক শিল্পী আবার মনের মতো করে সাজান তাদের চিত্র, তাতে যোগ করেন রঙের বাহার যা ছবিতে দেয় এক অনন্য মাত্রা।
জনপ্রিয় গিয়োতাকু শিল্পী নাওকি বলেন,
“যদি আমি কেবল কালো কালি ব্যবহার করি আর সেটিকে ওভাবেই ছাপিয়ে রেখে দেই, তাহলে তা কেবল কালো রঙের দাগ ছাড়া আর কিছুই হবে না।”
আর তাই তিনি কালো রঙের পাশাপাশি ব্যবহার করেন বিভিন্ন রং আর মনের মাধুরী মিশিয়ে তা নিয়ে যান এক অনন্য পর্যায়ে। আবার হেথার ফর্টনার তার চিত্রের মাধ্যমে কিছু বার্তা পৌঁছে দিতে চান মানুষের কাছে। তিনি নতুন মাছ ধরে আনেন না, বরং যে মাছগুলোকে সমুদ্রতীরে মৃত অবস্থায় পান, সেগুলোকে ব্যবহার করেন এই কাজে। কখনো কখনো একই মাছ ব্যবহার করেন একাধিকবার। পরে সেগুলো পুঁতে ফেলেন নিজের বাগানে, যাতে মাটি উর্বর হয়।
শিল্পের মধ্য দিয়ে ফর্টনার বোঝাতে চান, এই মৎস্য সম্পদ সীমিত আর এর অপব্যবহার তাই একেবারেই কাম্য নয়। হেথার আরো বলেন, “বিশ্বের সেরা শিল্পীদের সাথে অংশ নিয়ে গিয়োতাকু আপনাকে প্রাকৃতিক বিশ্বের জন্য একটি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার সুযোগ দেয়।”
গিয়োতাকু ছোট বাচ্চা থেকে শুরু করে বৃদ্ধ অনেকেরই পছন্দের আর্ট। এর মাধ্যমে মাছের অ্যানাটমি কিংবা চিত্রাঙ্কন কিংবা মাছ ধরার প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়। চিত্রাঙ্কনকে গৎবাঁধা কিছু নিয়মের বাইরে নিয়ে যায় গিয়োতাকু। এর ইতিহাসের মাধ্যমে উঠে আসে জাপানের প্রাচীনকালের অনেক মজার তথ্য। অনেক প্রতিষ্ঠান গিয়োতাকু আর্টের প্রশিক্ষণ দেয়, আবার বাজারে বেশ ভালো দামে বিক্রয় হয় এই আর্ট। চাইলে আপনিও বাসায় বসেই আজই শুরু করে দিতে পারেন। আর চমকে দিতে পারেন সবাইকে, অসাধারণ গিয়োতাকুর আর্টের মাধ্যমে।