ল্যুভরের ইতিহাস নিয়ে আগের লেখাটি পড়ে অনেক পাঠকই জানতে চেয়েছিলেন সেখানে প্রদর্শিত শিল্পকর্মগুলো সর্ম্পকে। এ লেখাটিতে ল্যুভরে প্রদর্শিত বিশ্বখ্যাত কিছু শিল্পকর্ম ও দর্শনীয় বস্তুর বর্ণনা দেয়া হলো।
ল্যুভর এত বড় আর এত হাজার বস্তু সেখানে প্রদর্শিত হয়েছে যে, কোনটি ছেড়ে কোনটি দেখবেন আর কোনদিকেই বা যাবেন, তা নিয়ে রীতিমত দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়তে হবে আপনাকে। এজন্য অনেকে সেখানে গাইডের সাহায্য নিয়ে থাকেন।
ল্যুভর একদিনে ঘুরে দেখা সম্ভব নয়। এক হিসেবে দেখা গেছে, জাদুঘরে থাকা প্রতিটি বস্তু যদি ৩০ সেকেন্ড করে দেখেন, তাহলে পুরো জাদুঘর ঘুরে দেখতে ১০০টি পূর্ণ দিন লাগবে! নেপোলিয়নের সময়ে লুভরের নাম পরিবর্তন করা হয়েছিল এবং তিনি পরাজিত হওয়ার পর পাঁচ হাজারেরও বেশি লুট করে আনা বস্তু (প্রদর্শিত) তার প্রকৃত মালিকের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয়। তবে পাঁচ হাজারেরও বেশি বস্তু জাদুঘর থেকে চলে গেছে বলে যে প্রদশর্নীর বস্তু কম পড়েছে ব্যাপারটা মোটেই তেমন নয়। বরং ল্যুভরে বর্তমানে ৩,৮০,০০০ এর বেশি বস্তু রয়েছে প্রদর্শনের জন্য। এতসব বস্তু একসাথে প্রদর্শন করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তাই কিছু বস্তু থেকেই যায় সংরক্ষণাগারে।
লুভরে গিয়ে যা না দেখলেই নয়
প্রায় ২,২০০ বছরের পুরনো এক ভাস্কর্য রয়েছে, যার নাম দ্য উইংড ভিক্টরি অফ স্যামোথ্রেস । যদিও এর ভাস্করের নাম জানা যায় না, এটি বেশ বিখ্যাত। মার্বেলের তৈরি এ ভাস্কর্যটি পাখাওয়ালা এক নারীর অবায়ব, ঠিক যেন গ্রিক পুরানের কোনো দেবী। আর সেই দেবী যেন আছে বিজয়ী বেশে। সমসাময়িক ভাস্কর্যগুলোর মধ্যে এটিই টিকে আছে বাহু ও মুন্ডুহীন অবস্থায়। তবুও এর প্রতি দর্শনার্থীদের আকর্ষণের কোনো কমতি নেই।
ইতালিয়ান ভাস্কর অ্যান্টোনিও ক্যানোভার শ্রেষ্ঠ কর্মগুলোর একটি সাইকি রিভাইভড বাই কিউপিডস কিস । কিউপিড আর রাজকন্যা সাইকির প্রেম কাহিনীর উপর ভিত্তি করে মার্বেলে তৈরি অনবদ্য এক ভাস্কর্য এটি।
ভেনাস ডি মিলো র ভাস্কর্যটি বিশ্ব জুড়ে এতটাই পরিচিত যে, জনপ্রিয়তার দিক থেকে মোনা লিসা ও ডেভিডের পরই এর অবস্থান। প্রায় ২,০০০ বছরের পুরোনো এ ভাস্কর্যটি নারীর সৌন্দর্যের প্রতিরুপ। এটি পাওয়া গিয়েছিল গ্রিসের মিলো দ্বিপে। এটি মূলত গ্রিক দেবী অ্যাফ্রোডাইটির একটি ভাস্কর্য, যা মিলোতে পাওয়া গিয়েছিলো বলে ভেনাস ডি মিলো হিসেবে পরিচিতি পায়।
থিউডো জেরিকোর দ্য র্যাফ্ট অফ মেডুসা চিত্রকর্মটি এমন এক চিত্রকর্ম, যা ফরাসি রোমান্টিসিজম আন্দোলনকে সংজ্ঞায়িত করতে সাহায্য করে। ফরাসি যুদ্ধজাহাজ মেডুসা বিধ্বস্ত অবস্থায় যখন মরিশাস দ্বীপে পৌঁছায়, তখন এর ৪০০ জন নাবিকের মধ্যে কেবল ১৫১ জন জীবিত ছিল। তাদের কাছে প্রচুর মদ থাকলেও ছিল না খাদ্য ও পানি। জীবন বাঁচাতে সেখান থেকে তারা এক ভেলা তৈরি করে রওয়ানা হয়। একপর্যায়ে তারা বেঁচে থাকার জন্য একে অপরের মাংস খেতে শুরু করে। অবশেষে যখন উদ্ধার করা হয়, তখন ১৫১ জনের মধ্যে মাত্র ১৫ জন জীবিত ছিলো।
লিবার্টি লিডিং দ্য পিপল নামের এই চিত্রকর্মটি হয়তো আপনি আগেও দেখেছেন। এটি ইউজেন ডেলেক্রর আঁকা। ফ্রান্সে একে অঘোষিত জাতীয় চিত্রকর্মের মর্যাদা দেয়া হয়। চিত্রকর্মটিতে দেখা যায়, ১৮৩০ সালের ‘জুলাই বিপ্লব’ এর সময় যোদ্ধাদের পরিচালিত করেছেন এক নারী। এটি মূলত স্বাধীনতার ব্যক্তি তথা নারী রূপ। উন্মুক্ত বক্ষে এক হাতে পতাকা আর অন্য হাতে বেয়োনেটসহ মাসকেট (একধরনের রাইফেল) নিয়ে ধাবমান এ নারী চরিত্রটি ম্যারিয়েন নামে পরিচিত। যখন এ চরিত্রটি প্রথম আঁকা হয়, মানুষের কাছে এটি ফরাসি প্রজাতন্ত্রের এমন এক প্রতীক হিসেবে ধরা দেয়, যা রাজতন্ত্রের বিরোধীতা করে। ম্যারিয়েনের হাতে ফরাসি বিপ্লবের যে পতাকা দেখা যায়, এটিই পরে ফ্রান্সের জাতীয় পতাকা হিসেবে গৃহীত হয়। আর বিজয়ী মারিয়েনের পায়ের নিচে মৃতদেহগুলো দেশটিকে স্তম্ভিত করা ৪০ বছরের গৃহযুদ্ধে রাজনৈতিক ও সামাজিক উত্থানকে প্রকাশ করে। ৮×১০ ফুট আকারের এ চিত্রকর্মটি দেশপ্রেমের ধারণা দেয়।
দ্য করেনেশন অভ নেপোলিয়ন বিশাল আকারের এক চিত্রকর্ম। নেপোলিয়নের আদেশে তাঁর রাজ্যাভিষেক উপলক্ষে জাক লুইস ডেভিড এটি অঙ্কন করেন। তিনি ছিলেন নেপোলিয়নের নিজস্ব চিত্রকর। ৩২.১×২০.৪ ফুটের এ চিত্রকর্মটি লুভরে বিশ্ববিখ্যাত বড় আকৃতির চিত্রকর্মগুলো অন্যতম। চিত্রকর্মটির দাপ্তরিক নাম: Consecration of the Emperor Napoleon I and Coronation of the Empress Josephine in the Cathedral of Notre-Dame de Paris on 2 December 1804। চিত্রে দেখা যায়, নেপোলিয়ন তাঁর প্রথম স্ত্রী জোসেফিনকে মুকুট পরিয়ে দিচ্ছেন এবং সেখানে উপস্থিত আছে তাঁর পরিবারের সদস্যরা, চিত্রকর নিজে এবং রাষ্ট্রের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ।
স্লিপিং হারম্যাফ্রডিটাস মার্বেল পাথরের তৈরি ভাস্কর্য। এতে হারম্যাফ্রডিটাসকে গদির উপরে উপুড় হয়ে ঘুমাতে দেখা যায়। ভাস্কর্যটি সতের শতকে রোমে মাটির নিচে আবিষ্কার করা হয়। তবে ভাস্কর্যের নিচের গদিটি মূল ভাস্কর্যের অংশ নয়। এটি পরবর্তী সংযোজন। বিখ্যাত ভাস্কর বারনিনি এটি তৈরি করেন। হারম্যাফ্রডিটাসের ভাস্কর্যটি আগে রোমের বরগিজ গ্যালারিতে ছিলো। ভাস্কর্যটি প্রথম দৃষ্টিতে মনে হতে পারে নারীর অবয়ব, কিন্তু একটু ভালোভাবে দেখলে খটকা লাগবে। এ অবায়বটিতে উপস্থিত আছে নারী-পুরুষ উভয়েরই লৈঙ্গিক বৈশিষ্ট্য।
এটি মূলত গ্রিক দেবতা হারম্যাফ্রডিটাস এর দৈহিক বৈশিষ্ট্যের অদলে তৈরি। অনেকে ভাবেন, হারম্যাফ্রডিটাস থেকে হারম্যাফ্রডাইট শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে। ভাস্কর্যটি একদিক থেকে দেখে মনে হবে নারী দেহ আবার বিপরীত দিক থেকে দেখলে মনে হবে পুরুষ দেহ। এতে যে দৈহিক বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পেয়েছে তা আমাদের অনেকের কাছে অস্বস্তিকর লাগলেও প্রাচীন গ্রিস ও রোমে বেশ জনপ্রিয় ছিলো হারম্যাফ্রডিটাস। তাই এই দৈহিক ধারণার সন্ধান পাওয়ায় যায় সেসময়ে তৈরি অনেক চিত্রকর্ম ও ভাস্কর্যে।
বিভিন্ন সময়ে বিখ্যাত সব স্থপতিরা যে প্রাসাদে সংস্কার ও সংযোজন করেছেন, সেটিতে স্থাপত্যকলার নিদর্শন থাকাটা খুবই স্বাভাবিক। ল্যুভরে প্রাচীন স্থাপত্যকলার সাথে আধুনিক স্থাপত্যকলার সমন্বয় লক্ষ্য করার মতো। ল্যুভরের প্রবেশপথে সকলের নজর কেড়ে সে কথা জানান দেয় গ্লাস পিরামিডটি। ফরাসি বিপ্লবের ২০০ বছরপূর্তি উপলক্ষে ১৯৮৯ সালে এটি উদ্বোধন করা হয়। সেসময় অনেকেই এই স্থাপনাটির বিরোধীতা করলেও এখন এটি এতই জনপ্রিয় যে ল্যুভরের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
১৯৮৩ সালে প্রবেশপথে একটি আধুনিক স্থাপনা নির্মাণ করে সুসজ্জিত করার জন্য স্থপতি আই. এম. পে-কে নিয়োগ করা হয়। তাঁরই নকশায় এ পিরামিডটি নির্মিত হয়। মিশরের দ্য গ্রেট পিরামিড অভ গিজার মাপের সাথে আনুপাতিক মিল রয়েছে গ্লাস পিরামিডের মাপের। বড় পিরামিডটির তিনদিকে এমনভাবে তিনটি ছোট পিরামিড নির্মাণ করা হয়েছে যাতে আলো প্রতিফলিত সৃষ্টি হয়। পিরামিডটি তৈরি করতে ৬৭৩টি কাঁচের প্যানেল ব্যবহার করা হয়। মজার ব্যাপার হলো, এ সংখ্যাটি অ্যাপোক্যালিপ্সে থাকা দানব ও শয়তানের সংখ্যা হিসেবে উল্লেখ করা ৬৬৬ এর কাছাকাছি বলে অনেকের ধারণা ছিলো পিরামিডটি তৈরি হয়ে গেলে পৃথিবী ধ্বংস হতে শুরু করবে।
এখানেই শেষ নয়, রয়েছে একটি উল্টো পিরামিডও। এটি ১৯৯৩ সালে আই. এম. পে নির্মাণ করেন। এটি ভূগর্ভস্থ বলে এটি দেখতে হলে ল্যুভরে প্রবেশ করতে হবে ভূগর্ভস্থ পথে, যেটি Carrousel du Louvre শপিং মলের ভেতরে অবস্থিত।
পাঠক, লেখার শেষে এসে আপনি হয়তো একটু হতাশ হচ্ছেন মোনালিসাকে না পেয়ে। হয়তো ভাবছেন, এমন বিখ্যাত শিল্পকর্ম কেন বাদ পড়লো! মোনালিসাকে কি বাদ দেয়া যায়, বলুন? মোনালিসা থাকছে লেখার পরবর্তী পর্বে।