নিকুঞ্জ: হ্যাঁ কাল সকাল থেকেই ভাঙা শুরু হবে। (একটু থেমে) আমি আজকাল আর আমার কথা ভাবিনে ম্যাডাম। ভাবি, তোমার কথা।
ম্যাডাম: আর ভেবো না।
নিকুঞ্জ: না ভেবে আর পারছি কই? রঙ্গমঞ্চের নাট্যসুন্দরী সারদাসুন্দরী ওরফে ম্যাডাম। এই স্টেজে দাড়িয়ে লক্ষ লক্ষ লোককে তুমি হাসিয়েছো কাঁদিয়েছো। তোমাকে বাংলা স্টেজ ভুলে গেল কী কোরে?
ম্যাডাম: কেন? কাগজেই তো পড়েছো যে নিকুঞ্জ- সারদাসুন্দরীর বস্তাপচা অ্যাক্টিং আর চলবে না। দেশে নব নাট্যের হাওয়া বইতেছে।
১৯৭৭ সালে বিধায়ক ভট্টাচার্যের লেখা এই ‘সরীসৃপ’ নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র ম্যাডাম–এ অভিনয় করেছিলেন অভিনেত্রী সরযূবালা দেবী। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, নাটকটি দেখলে খুব সহজেই মনে হবে ম্যাডাম চরিত্রটি যেন সরযূবালার বাস্তব জীবনের প্রতিচ্ছবি। সত্যিই! নাট্যস্ম্রাজ্ঞী সরযূবালা দেবীকে আজ আমরা কেউ মনে রাখিনি। রঙ্গমঞ্চে যিনি ‘সরযূ মা’ নামে পরিচিত ছিলেন, স্মৃতির অতলে আজ যেন একেবারেই বিলীন হয়ে গিয়েছেন। অথচ না জেনেও যাকে জানা হয়ে যায়; না চিনেও যাকে এক নিমেষে চিনে ফেলা যায়, সরযূবালা ছিলেন এমনই একজন।
প্রাক-স্বাধীনতা আমলে এ দেশে থিয়েটার জগতের নারীদের যেখানে সম্মানজনক কোনো অবস্থানই ছিল না, সেখানে যেসব নারী থিয়েটার অঙ্গনে পা রেখে অভিনয় শিল্পকে আরও অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন- সরযূবালা দেবী ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। কিন্তু এই অভিশপ্ত সময়ের মাঝেও সরযূবালার জীবন ছিল অজস্র মানুষের ভালোবাসায় পরিপূর্ণ।
১৯১২ সালে দক্ষিণেশ্বরের এড়েদায় সরযূবালার জন্ম। বাবা ভূতনাথ দত্ত এবং মা ইন্দুমতী দেবী। বাবা গান-বাজনা জানতেন। সে হিসেবে সরযূও গান শিখেছিলেন। কিন্তু আটপৌরে গরিব ঘরে অল্প বয়সে বাবা-মাকে হারিয়ে একা হয়ে পড়েন সরযূ। অর্থাভাবে মাত্র নয় বছর বয়সে দক্ষিণেশ্বরের এমিনেন্ট থিয়েটার দলের সাথে যুক্ত হন। এতে করে ঝামাপুকুর স্কুলে পড়াকালীন লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায় তার। সেই এমিনেন্ট থিয়েটারেই ‘কুমার সিংহ’ নাটকে ভিখারি বালকের ভূমিকায় তার প্রথম মঞ্চে পা রাখা। গান গেয়েই সেদিন মন্ত্রমুগ্ধ করেছিলেন সবাইকে। পেয়েছিলেন একটা রৌপ্যপদক। সেই পদকটিকেই আজীবন আগলে সামনে এগিয়ে গেছেন সরযূবালা।
এমিনেন্ট থিয়েটারে ছোটবড় সব চরিত্রে কাজ করতে থাকেন তিনি। ‘সাজাহান’ নাটকে সিপারের ভূমিকায় অভিনয় করেন। সে সময় জাতীয়তাবাদ আন্দোলনের আলোয় রঙ্গমঞ্চ আলোকিত হয়ে উঠেছিল ক্রমেই। সে আলো সরযূবালার জীবনেও প্রভাব ফেলেছিল। এমিনেন্ট থিয়েটার থেকে তিনি অনাদি বসুর ট্যুরিং থিয়েটার কোম্পানিতে চলে আসেন। সেখানে তার অভিনয়ের দীক্ষাগুরু হয়ে উঠেন নির্মলেন্দু লাহিড়ী। তখন সরযূর বয়স ছিল ১৫ বছর। এমিনেন্ট থিয়েটারে ‘চন্দ্রশেখর’ নাটকে শৈবলিনীর ভূমিকায় ছিলেন তিনি। সেখানেই তার অভিনয় নজর কাড়ে নির্মলেন্দু লাহিড়ীর। এরপর তিনি নিজের থিয়েটার কোম্পানিতে নিয়ে আসেন সরযূকে, আর পরপর সাতটি নাটকে নায়িকা চরিত্রে অভিনয় করেন সরযূ।
নির্মলেন্দু লাহিড়ীর হাতেই তার অভিনয়ের স্বর্ণযুগের সূচনা। কখনো ‘চন্দ্রগুপ্ত’ তে ছায়া, কখনো ‘বঙ্গে বর্গী’তে মাধুরী, আবার নাম ভূমিকায় ‘প্রফুল্ল’, ‘দেবলাদেবী’, ‘শ্রীদুর্গা’ ও ‘ষোড়শী’ নাটকে। তার নাটকের মঞ্চ ঢাকা, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, বরিশাল, সিরাজগঞ্জ, চট্টগ্রাম, খুলনা থেকে একেবারে রেঙ্গুন পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে পড়ল। পরের বছর ‘বিষবৃক্ষ’ নাটকে কুন্দনন্দিনী করা হলো সরযূকে। আর তার পাশে সেবার ছিলেন দানীবাবু, নির্মলেন্দু, তারাসুন্দরী, কুসুমসুন্দরী, ইন্দুবালার মতো অভিনেতা-অভিনেত্রী। এখানেও সবার নজর কাড়লেন সরযূ। এ নাটক সম্পর্কে প্রবীণ বয়সে একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন,
“বাইরে দর্শকের অভিনন্দন আর মঞ্চে পেয়েছিলাম আরেক মহার্ঘ পুরস্কার। শেষ দৃশ্য ছিল নগেন্দ্রের কোলে মাথা রেখে মারা যাচ্ছে কুন্দনন্দিনী। আমি তার কোলে মাথা রেখে পড়ে আছি। ড্রপসিন পড়ে গেছে। আমরা তা-ও একই ভঙ্গিতে আছি। দানীবাবু কোলে আমার মাথা রেখে বসে আছেন। হঠাৎ আচ্ছন্নের মতো মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘আমি তোকে আশীর্বাদ করে বলছি, তুই একদিন মস্ত বড় অভিনেত্রী হবি। সারাদেশে তোর নাম ছড়িয়ে পড়বে’।”
সে আশীর্বাদ ফলেছিল বৈকি। বিষবৃক্ষের পরে ‘দক্ষযজ্ঞ’ নাটকেও দানীবাবু, নির্মলেন্দুর সাথে একেবারে কেন্দ্রীয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন সরযূবালা। এরপর আর পেছনে ফিরে দেখতে হয়নি তাকে।
এরপর মণিলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের শেষে’ নাটকে নায়িকা চরিত্র পারুলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। কলকাতা প্রসেনিয়াম থিয়েটারে সবদিক থেকে মধ্যমণি হয়ে ওঠেন তিনি; তাও মাত্র ১৬ বছর বয়সে। মনোমোহন থিয়েটারে মঞ্চস্থ হলো শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের ‘রক্তকমল’। তাতে হেমেন্দ্রকুমার রায়ের সাথে গান লিখলেন কাজী নজ্রুল ইসলাম। সুরকার ছিলেন কাজী নজ্রুল ইসলাম নিজেই। এ সুবাদে প্রথমবারের মতো নজরুলের কাছে গান শেখার সুযোগ পেলেন সরযূ। ‘পুরুষবেলা লীলাখেলা, পাপ লিখেছো নারীর বেলা’- এরকম একটি প্রতিবাদ করে নাটকটি লেখা হয়েছিল। এ নাটকে সরযূবালা অভিনীত চরিত্রের নাম ছিল মমতা। নাটকটি বেশিদিন না চললেও মমতা চরিত্রটি তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। এর পরের নাটক ‘প্রাণের দাবি’। এখানে তিনি অচলার ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। সেই সময় বেঙ্গলী পত্রিকায় একটি উদ্ধৃতি ছিল,
“Miss Sarjubala in the role of Achola were also quite remarkable.”
১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ ডিসেম্বর, ‘মহুয়া’ প্রথম মঞ্চে অভিনীত হয় এবং সফল হয়। এখানেও মহুয়ার ভূমিকায় সরযূবালা। এছাড়া তিনি স্বদেশী আন্দোলনের স্রোতে মিশে যাওয়া মন্মথ রায়ের ‘কারাগার’ নাটকে কঙ্কার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন।মনোমোহন থিয়েটার ভেঙে যাওয়ার পর ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে শিশির কুমার ভাদূড়ীর নির্দেশনায় ‘শ্রী শ্রী বিষ্ণুপ্রিয়া’তে নারায়ণীর ভূমিকায় কাজ করেন সরযূবালা। নাট্যনিকেতনে ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে ‘মা’,১ ৯৩৫ সালে ‘খনা’ নাটকেও নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন তিনি।
তবে ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে শচীন সেনগুপ্তের ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকে লুৎফুন্নিসার ভূমিকায় সরযূবালার অভিনয় যেন তার খ্যাতির সব কূল ছাপিয়ে গেল। কে না দেখেছে সে অভিনয়! এই নাটক দেখে আবেগপ্রবণ হয়ে গিয়েছিলেন স্বয়ং সুভাষচন্দ্র। সেই সময় এ নাটকের গ্রামোফোন রেকর্ড বিক্রি করে ৪৫ হাজার টাকা কমিশন পাওয়া গিয়েছিল, যা তৎকালীন হিসেবে সর্বোচ্চ ছিল। সমগ্র বাঙালি দর্শকসমাজের মনেই দাগ কেটেছিল নাটকটি।
সেই সময়ের সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতার মধ্যে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল সিরাজউদ্দৌলার দেশপ্রেমিক চেতনা। ১৯৭০ সালে এই নাটকটির লংপ্লেয়িং রেকর্ড বের হয়। পরের ১০ বছরের মধ্যে বের হয় ক্যাসেট, আবার সেই ক্যাসেটের নকলও বের হয়! ১৯৫৪ সালে ‘শ্যামলী’ নাটকে উত্তমকূমারের মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করেন সরযূ। সেখানে তার চরিত্রের নাম ছিল সরলা। এতে কলকাতা থিয়েটারে মাতৃমূর্তি হিসেবে প্রামাণ্যতা পান তিনি। আর এ থেকেই তিনি হয়ে উঠেন ‘সরযূ মা’।
নাটকের পাশাপাশি সিনেমাতেও কাজ করেছেন সরযূবালা। স্বয়ং প্রমথেশ বড়ুয়াও তাকে দিয়ে অভিনয় করাতে উন্মুখ ছিলেন। ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দের ‘ঋষির প্রেম’ থেকে ১৯৭৭ এর ‘ফুলশয্যা’ পর্যন্ত বেশ লম্বা সময় পার করেছিলেন তিনি। ‘কৃষ্ণা কাবেরী’, ‘শ্রীদুর্গা’র কেন্দ্রে ছিলেন তিনি। এছাড়াও ‘কালিন্দী’ চলচ্চিত্রে উত্তম কুমারের সঙ্গেও অভিনয় করেছেন সরযূবালা।
ব্যক্তিজীবনে নির্মলেন্দু লাহিড়ীর সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সে সম্পর্ক স্থায়ী হয়নি। বিবাহ বিচ্ছেদের পর নির্মলেন্দু লাহিড়ী আবার অন্যত্র বিবাহ করেন। সকলের ভালোবাসা পাওয়া সরযূর পারিবারিক জীবন সুখের হয়নি। তিনি ছিলেন অহংবোধ বিবর্জিত একজন মানুষ। চিরকাল ছিলেন অসম্ভব বিনয়ী। বিনয় ও প্রতিভার পরিমিত সমন্বয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন নাট্যসম্রাজ্ঞী।
১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের রাষ্ট্রপতির কাছে নাট্যাভিনয়ের জন্য সর্বোচ্চ সম্মাননা সঙ্গীত নাটক আকাদেমির দেওয়া সম্মান গ্রহণ করেন তিনি।
১৯৯৪ সালের ২২ জুলাই সরযূবালা দেবী শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। দক্ষিণ কলকাতার বালিগঞ্জে যেখানে তিনি থাকতেন, সেখানে রয়েছে সরযূবালা সরণি। ঐ পর্যন্তই শেষ। তারপর আর কোনো চর্চা হয়নি তাকে নিয়ে। অথচ থিয়েটার জগতকে কতই না অনন্য জায়গায় বসিয়েছেন তিনি, তাকে ছাড়া রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসের কথা ভাবাই যায় না। তিনি যেন আজো দখল করে আছেন মঞ্চের ঠিক মাঝের জায়গাটা।