Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ঈনিয়াসের ভ্রমণগাথা: কার্থেজ থেকে সমাপ্তি

পূর্ববর্তী পর্ব (ঈনিয়াসের ভ্রমণকাহিনী: ক্রিট থেকে কার্থেজ)-এর পর থেকে। 

গ্রিসের ছলচাতুরীর ফলে পতন ঘটল ট্রয়ের মতো মহান এক নগরীর। কিন্তু এখানেই ট্রয়ের কিংবদন্তির শেষ নয়। কথা দিয়েছিলেন জুপিটার- ট্রোজানদের বংশধররা একসময় শাসন করবে বিশ্ব। কিন্তু কীভাবে? ঈনিয়াসের হাত ধরে। 

ধ্বংসপ্রাপ্ত ট্রয় থেকে কোনোক্রমে জান নিয়ে বাঁচলেন ঈনিয়াস। চলার পথে থামলেন ক্রিটে, কিন্তু ভাগ্যের ফেরে সেখান থেকেও চলে আসতে হলো। এরপর সমুদ্রদেবতা নেপচুন তাদেরকে নিয়ে এলেন কার্থেজে। কিন্তু প্রেমিকা ডিডোকে ছেড়ে কার্থেজ থেকেও চলে যেতে হলো তাকে, সমুদ্রে ভাসাতে হলো জাহাজ।

তিনি জানতেন না, ডিডো আত্মাহুতি দিয়েছেন। এমনকি শেষ সময়ে অভিশাপ দিয়েছেন ট্রোজানদের। এটাও জানতেন না, সেই অভিশাপকে বাস্তব করার সর্বোচ্চ চেষ্টায় রত আছেন জুনো। ভেনাসের উপর রাগ কমেনি দেবতাদের রানীর। তাই ঈনিয়াসদের বিরুদ্ধে নেমেছেন কোমর বেঁধে।

কিন্তু জুপিটারের প্রতিজ্ঞা? তার কী হবে? কে জিতবে শেষ পর্যন্ত? প্রতিশোধের নেশায় উন্মত্ত জুনো নাকি দেবরাজ জুপিটারের স্নেহধন্য ট্রোজানরা?

শেষ হলো ঈনিয়াসের যাত্রা

সমুদ্র নামলেন বটে ঈনিয়াস, তবে তার মন পড়ে আছে কার্থেজে ডিডোর কাছে। বারবার পিছু ফিরে চাইলেন তিনি। দেখতে পেলেন- আগুনের উজ্জ্বল আভা ভেসে আসছে কার্থেজের তীর থেকে। ওই আগুনে যে আত্মাহুতি দিয়েছেন ডিডো, তা জানা ছিল না ট্রোজান বীরের। কিন্তু তারপরও মনে হলো- অশুভ কিছু একটার আভাস দিচ্ছে যেন ওই আগুন।

হলোও তা-ই। আচমকা তার কানে ভেসে এলো প্যালিনোরাসের কণ্ঠ। প্যালিনোরাস জাহাজের চালক। চিৎকার করে সে জানাল, মেঘ দেখা যায় আকাশে। বাঁচতে হলে সিসিলির রাস্তা ধরা ছাড়া উপায় নেই।

মাত্র এক বছর আগেই, অবিকল এমন এক পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছিল ট্রোজানদের। সিসিলি থেকে উত্তর আফ্রিকার এই উপকূলে নৌবহরকে ভাসিয়ে এনেছিল ঝড়। এখন আবার। কিন্তু এর ভেতরেও সান্ত্বনা খুঁজে নিলেন ঈনিয়াস। দেবতারা যখন চান, তখন তিনি যাবেন সিসিলিতে। অন্তত পিতা এনকাইসিসের কবরের তো দেখা মিলবে।

কিন্তু বাস্তবেই যখন তিনি গিয়ে দাঁড়ালেন পিতার কবরের সামনে, শোকের তীব্রতা তাকে প্রায় পঙ্গু করে দিল। হৃদয়ের রক্তক্ষরণকে প্রশমিত করার উদ্দেশ্যে ঈনিয়াস ঠিক করলেন- পিতার সম্মানে অনুষ্ঠানের আয়োজন করবেন। খেলাধুলায় নিজেদের ডুবিয়ে দিল ট্রোজানরা। খেলা, গল্প করা আর আনন্দ উল্লাসে কাটিয়ে দিল বেশ কয়েকটা মাস।

ঈনিয়াস ঠিক করলেন পিতার সম্মানে অনুষ্ঠানের আয়োজন করবেন; Image: circeinstitute.org

আসলে ট্রোজানরা না বলে, ট্রোজান পুরুষরা বলাই ভালো। কেননা তারা আনন্দের সাগরে ডুব দিলেও, নারীরা বাধ্য হলো ক্যাম্পের দেখভাল করতে।

দিন পার হয়ে এল সপ্তাহ, সপ্তাহ শেষে মাস। অধৈর্য হতে লাগল ট্রোজান নারীরা। এভাবে আর কত? একপর্যায়ে নিজেদের মাঝেই আলোচনা করতে লাগল তারা। বলতে লাগল, সিসিলিতে অনেক হয়েছে। আর না। যতদ্রুত সম্ভব চিরস্থায়ীভাবে বাস করার জায়গাটা খুঁজে বের করতেই হবে।

জুনো এমন সুযোগ ছাড়বেন কেন? নিজস্ব বার্তাবাহক, আইরিসকে পাঠিয়ে দিলেন তিনি। এক বুড়ির ছদ্মবেশে আইরিস মিশে গেলেন মেয়েদের সঙ্গে। তাদেরকে বোঝালেন- কী দরকার এত কষ্টের? সিসিলিতেই তো ট্রোজানরা থেকে যেতে পারে। এখানেই নতুন এক আবাস গড়ে নেওয়া যাবে।

রোমান দেবী, আইরিস; Image: thought.co

কাজ হলো জাদুর মতো। হয়তো উদ্বাস্তুর মতো ভ্রমণে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল ট্রোজান নারীরা। হয়তো জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নতুন করে ভাসতে চাইছিল না সাগরে। আগুন ধরাবার জন্য কাঠ জড়ো করল তারা। তারপর সে আগুন ধরিয়ে দিল জাহাজে।

ভাগ্য ভালো ট্রোজানদের, আগুন নজরে পড়েছিল ঈনিয়াসের। এক ছুটে তিনি চলে এলেন সৈকতে, প্রার্থনা করলেন জুপিটারের কাছে। যুবক ট্রোজানের এই আত্মসমর্পণ দেখে খুশি হলেন জুপিটার। সবগুলো জাহাজ পুড়ে ছাই হবার আগেই বৃষ্টি নামিয়ে নিভিয়ে দিলেন আগুন।

টনক ফিরল ঈনিয়াসের। সিসিলিতে যে প্রয়োজনেরও বেশি সময় কাটিয়ে দিয়েছেন, সেটা টের পেলেন অক্ষরে-অক্ষরে। যদিও পুরুষরা আনন্দেই সময় কাটিয়েছে এখানে, কিন্তু নারীদের মনে বাসা বাঁধার অদম্য ইচ্ছেটা কেবল গাঢ়ই হয়েছে। অবশিষ্ট জাহাজগুলোকে দ্রুত মেরামতের নির্দেশ দিলেন তিনি, জানালেন যে কাজ শেষেই দ্বীপ ছাড়বেন।

ঈনিয়াসের মা, দেবী ভেনাস, আগ্রহ ভরে অপেক্ষা করছিলেন এই দিনের। সমুদ্র-দেবতা, নেপচুনের কাছে ছুটে গেলেন তিনি। ইতালির মূল ভূখণ্ডে পা রাখার আগে যেন সমুদ্র শান্ত থাকে- সেই অনুরোধ করলেন তিনি নেপচুনকে।

তবে ইতালি পৌঁছাবার আগে, কুমেই-এ থামল ট্রোজানরা। এখানকার সিবিলের সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন ঈনিয়াস। অ্যাপোলোর এই যাজিকা সরাসরি অ্যাপোলোর বাণী শুনতে পেত।

ঈনিয়াসের অনুরোধ রাখতে সম্মত হলো যাজিকা, আচ্ছন্ন অবস্থায় চলে গেল সে। এর কিছুক্ষণ পরেই সম্বিত ফিরে পেয়ে জানাল- দেবতার ভবিষ্যদ্বাণী বড়ই করুণ। ট্রোজানদের সামনে রয়েছে লম্বা, বিপদ-সংকুল পথ। এমনকি ইতালিতে পা রেখেই তাদেরকে জড়িয়ে পড়তে হবে রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধে।

সাহস হারালেন না ঈনিয়াস। সিবিলকে জানালেন, কষ্ট করেই এতদূর এসেছেন তিনি। সামনে যা-ই আসুক না কেন, সেটাকে অতিক্রম করবেন। তবে কুমেই ছাড়ার আগে একবার স্বীয় পিতা, এনকাইসিসের সঙ্গে দেখা করতে চান।

এহেন অনুরোধের কারণ ছিল। কুমেইয়ের সিবিল শুধু যে দেবতার বাণীই শুনতে পেত তা না, মৃত্যুপুরীতেও ছিল তার যাতায়াতের ক্ষমতা। একটা গুহায় সে নিয়ে এল ট্রোজান যুবক। লম্বা একটা সুড়ঙ্গ পাড়ি দিলেন তারা, পথে পড়ল অগণিত দরজা। সেসব দরজা দিয়ে ঈনিয়াস দেখতে পেলেন পিলে চমকে দেয়া সব দৃশ্য। দীর্ঘ পথ অতিক্রমের পর একটা সুন্দর ছায়াময় ঘাসের মাঠে এসে দেখা পেলেন তারা এনকাইসিসের আত্মার। বন্ধুদের আত্মার সঙ্গে তখন ট্রয়ের এই সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি গল্পে মগ্ন!

সিবিলের সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন ঈনিয়াস; Image:historian-hut-articles.blogspot.com

পুত্রকে দেখতে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলেন এনকাইসিস, পরিচয় করিয়ে দিলেন উত্তরসূরিদের সঙ্গে- রেমুলাস ছিলেন সেখানে, ছিলেন নুমা, অগাস্টাস সিজার এবং আরো অনেকে। জানালেন, তার বংশধরের হাত ধরেই মানবজাতি লাভ করবে শৃঙ্খলা, শান্তি, দয়া এবং সুবিচার।

ঈনিয়াসকে এনকাইসিস পরিচয় করিয়ে দিলেন উত্তরসূরিদের সঙ্গে; Image: classicalanthology.theclassicslibrary.com

ঈনিয়াসের উদ্দীপিত হতে আর কী লাগে? ট্রোজানদের আসল ভূমি খুঁজে পাবার জন্য তৎক্ষণাৎ মৃত্যুপুরী ছাড়ার অনুমতি চাইলেন তিনি পিতার কাছে। এনকাইসিসও পুত্রের এই আগ্রহে খুশি হয়ে অনুমতি প্রদান করলেন।

আবার পাল তুলে সাগরে ভাসল ট্রোজান নৌ-বহর। টাইবার নদীর মুখের কাছে পৌঁছোবার আগে থামলই না। এখানে তারা যাত্রাপথ পালটে বেছে নিল নদীর শান্ত পানি। নারীরা ধরেই নিল যে অবশেষে তারা পৌঁছতে পেরেছে লক্ষ্যে। নদীর শান্ত, ঘাসে ঢাকা তীর ধরে এগিয়ে তারা প্রবেশ করল ল্যাটিয়াম নামক স্থানে।

কিন্তু এলাকা সুন্দর হলে কী হবে? খাবার লাগবে না? সেটার অভাবই দেখা দিল। এতটাই যে বাধ্য হয়ে স্বাদহীন পিঠা বানাতে বাধ্য হলো মেয়েরা। তার উপরে বসিয়ে দিল সদ্য তোলা জাম। খিদের জ্বালায় এতটাই কাতর ছিল ট্রোজানরা যে সেই কাঠের মতো স্বাদযুক্ত খাবার গিলতেও দ্বিতীয়বার ভাবল না। আর এভাবেই সত্যি হলো হার্পিদের করা ভবিষ্যদ্বাণী।

এর পরেরদিনই, রাজা ল্যাটিনাস, যিনি ছিলেন ল্যাটিয়ামের শাসক, ট্রোজানদের সঙ্গে দেখা করে তাদের আগমনের হেতু জানতে চাইলেন। ঈনিয়াসের দূত, ইলিয়োনিয়াস রাজাকে ট্রয়ের পতনের খবর জানালেন। যে লম্বা পথ অতিক্রম করে ট্রোজানরা তাদের আদি মাতৃভূমিতে এসে পৌঁছেছে, সেটাও বাদ দিলেন না। তারপর রাজার সামনে পেশ করলেন অনেক উপহার, যার মাঝে রাজা প্রিয়ামের আলখাল্লা এবং এনকাইসিসেস স্বর্ণ-নির্মিত কাপও ছিল। এসব দামী উপহার সাদরে গ্রহণ করলেন রাজা ল্যাটিনাস, সেই সঙ্গে ট্রোজানদেরকে বাস করার অনুমতিও দিলেন।

বিদেশি হলেও, ট্রোজানদের পেয়ে খুশিই হলেন ল্যাটিনাস। এই ক’দিন আগেই তিনি স্বপ্নে দেখেছেন, এক বিদেশির সঙ্গে বিয়ে হবে তার অপরূপা কন্যা, রাজকুমারী ল্যাভিনিয়ার। তাদের বংশধরদের হাত ধরে ল্যাটিয়াম হয়ে উঠবে অনন্য এক দেশ। ঈনিয়াসই সেই বিদেশি- এই বদ্ধমূল ধারণা জন্মালো রাজার মনে। তবে সে কথা ঈনিয়াসকে সরাসরি বললেন না ল্যাটিনাস। কেননা আগেই যে তার কন্যার সঙ্গে দক্ষিণের এক গ্রিক রাজকুমার, টার্নাসের বাগদান হয়ে গিয়েছে। রানী আমাটা যে এই সম্পর্কে দারুণ প্রীত, সে কথাও জানালেন না। টার্নাসের গোত্র ‘রুটুলিয়ান’ নামে পরিচিত।

জুনো যখন টের পেলেন যে রাজা ল্যাটিনাস ট্রোজানদের তার ভূমিতে আবাস বাঁধার অনুমতি তো দিয়েইছেন, সেই সঙ্গে ঈনিয়াসের সঙ্গে রাজকুমারীর বিয়েও দিতে চাচ্ছেন তখন ক্ষেপে খেলেন খুব। এতটা রাগ তার আগে কখনো হয়ননি। এমনিতেই তিনি ট্রোজানদের উপর খুব বিরক্ত, অনেক চেষ্টা করেও তাদের সমূলে বিনাশ করতে পারছেন না। আবারো ওঁৎ পেতে বসে রইলেন তিনি।

কিন্তু সুযোগ আসছিল না হাতে। তাই সিদ্ধান্ত নিলেন যে পাতালপুরীতে যাবেন। সেখানে গিয়ে অ্যালেকটো নামের এক ফিউরিকে নির্বাচন করলেন তিনি। তার হাতে তুলে দিলেন টার্নাসকে খেপাবার ভার। ফিউরিরা অত্যন্ত কুটিল প্রাণী, অশুভ এবং বাজে কাজ করতে তারা খুব আনন্দ বোধ করত। অ্যালেকটোর স্বভাবও তেমনই।

অ্যালেকটো নামের এক ফিউরিকে নির্বাচন করলেন জুনো; Image: wikimedia.org

যেই কথা সেই কাজ, টার্নাসের প্রাসাদে গিয়ে সব উগড়ে দিল অ্যালেকটো। ট্রোজানদেরকে এখুনি না তাড়ালে যে বাগদত্তাকে হারাতে হবে- সে কথার উপর জোর দিল সে। কিন্তু কাজ হলো না, অ্যালেকটোর কথায় কানই দিল না টার্নাস। বাধ্য হয়ে তাই ইস্কানিয়াসের কাছে গেল ফিউরি। ছেলেটা তখন শিকারে ব্যস্ত। সুযোগ বুঝে একটা তীরের দিক পালটে বিশেষ এক হরিণের দিকে করে দিল অ্যালেকটো। রুটুলিয়ানদের পোষা ছিল এই হরিণ।

চোখের সামনে অবলা পশুটার এই দশা সহ্য হলো না ল্যাভিনিয়ার। সঙ্গীদের তিনি নির্দেশ দিলেন- এখুনি যেন শিকারিকে ধরে নিয়ে আসা হয় তার কাছে। নির্দেশ পালনে ট্রোজানদের দিকে অগ্রসর হলো তারা। লড়াইয়ে মারা গেল বেশ কিছু রুটুলিয়ান সৈন্য।

টার্নাস তাড়িয়ে দিয়েছিলেন বটে অ্যালেকটোকে, কিন্তু ট্রোজানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার সুযোগের অপেক্ষায় চোখ-কান খোলাও রেখেছিলেন। এই ঘটনা তার সামনে সেই সুযোগ এনে দিল। সঙ্গে সঙ্গে ট্রোজানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে দিলেন তিনি। সেই সময়ের নিয়মানুসারে, যুদ্ধ ঘোষণার পর নগরীর দুই দরজা খোলা রাখতে হয় রাজার। জ্যানাসের প্রতি সম্মানার্থে বহুবছর ধরে পালিত হয়ে আসছে এই নিয়ম।

কিন্তু রাজা ল্যাটিনাস এবার তার ব্যত্যয় ঘটালেন। তিনি নির্দেশ দিলেন দরজা বন্ধ রাখার। এদিকে জুনো কি আর বসে আছেন? যুদ্ধ শুরুর ইচ্ছায় তিনি নেমে এলেন ধরণীতে, নিজে খুলে দিলেন দরজা।

ঈনিয়াস বুঝতে পারলেন, টার্নাসের বিরুদ্ধে লড়তে হলে আরও লোক লাগবে তার। তাই টাইবার নদী ধরে তিনি চলে এলেন রাজা এভান্ডারের কাছে। এই রাজার পূর্বপুরুষরাও ছিল ট্রোজান, তাই সানন্দে তিনি বরণ করে নিলেন ঈনিয়াসকে। গর্বের সঙ্গে দেখালেন নিজের রাজত্ব- যদিও সেটা একটা গ্রামের চাইতে বড় ছিল না তেমন। প্যালাস, রাজার কমবয়সী ছেলে, ঈনিয়াসের সঙ্গে যোগ দিতে সম্মত হলো। তার বুদ্ধিতেই টাইবার পেরিয়ে এট্রুরিয়ায় পা রাখার সিদ্ধান্ত ট্রোজান বীর। এট্রুস্কানরা নিজেদের রাজার ওপরে বিরক্ত বলে, সেখান থেকে সেনা পাবার সম্ভাবনা প্রচুর।

কিন্তু নদীর কাছে পৌঁছোবার আগেই ভেনাস আবির্ভূত হলেন তাদের সামনে। স্বর্গ থেকে ভলকানকে দিয়ে তিনি বানিয়ে এনেছেন বিশেষ বর্ম এবং অস্ত্র, অবশ্যই তার ছেলের জন্য।

ঈনিয়াসকে ভলকানের নির্মিত অস্ত্র ও বর্ম দিচ্ছেন ভেনাস; Image: arthive.com

এদিকে টার্নাস যখন জানতে পারলেন যে ঈনিয়াস এই মুহূর্তে ল্যাভিনিয়াম নগরীতে (ল্যাটিয়ামের একটি শহর) নেই, সৈন্য এক করে সঙ্গে-সঙ্গে করে বসলেন আক্রমণ। কিন্তু শহরের ভেতরে থাকা রোমানরা ফাঁদে পা দিল না।

নিরুপায় টার্নাস দ্বিতীয়বার আক্রমণ চালালেন। কিন্তু এবারো কোন জবাব মিলল না। তার জানা ছিল না যে ঈনিয়াস ট্রোজানদের নির্দেশ দিয়ে গিয়েছেন- তারা যেন কোনভাবেই ঈনিয়াস ফিরে আসার আগে যুদ্ধে জড়িয়ে না পড়ে। তাই ট্রোজানদের নৌবহরে আগুন ধরিয়ে দিলেন টার্নাস। মনে মনে ভাবলেন, ‘এবার বাইরে না বেরিয়ে যাবে কই?’

কিন্তু জুপিটার তো সব দেখছেন ওপর থেকে। ট্রোজানদের সাহায্য করার জন্য তিনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তাই জাহাজগুলোকে তিনি পরিণত করলেন সমুদ্র-পরীতে, সাগরের আরও গভীরে ছুটে গেল তারা।

পরেরদিন সকালে তৃতীয়বারের মতো ল্যাভিনিয়ামের উপর আছড়ে পড়ল টার্নাসের সৈন্যরা। এবার দরজা খুলে দলবেঁধে ছুটে বেরোল ট্রোজানরা। হাতে তাদের পাথর আর বর্শা, সেগুলোই ছুঁড়ছে রুটুলিয়ানদের লক্ষ্য করে। দৃঢ়তার সঙ্গে এগিয়ে গেলেন টার্নাস, পথে যে ট্রোজানকে পেলেন তাকেই কচুকাটা করলেন। লম্বা এই রুটুলিয়ান যোদ্ধাকে দেখে ভয় পেয়ে গেল অবশিষ্ট ট্রোজানরা। পেছাতে লাগল তারা, কিন্তু আচমকা ওদেরই মধ্য থেকে কেউ একজন মনে করিয়ে দিল- মাত্র একজন মানুষের ভয়ে পালাচ্ছে ওরা। টার্নাসের ব্যক্তিত্ব এতটাই প্রবল যে এতক্ষণ যেন তা বুঝতেই পারেনি কেউ।

কিন্তু সম্বিত ফিরে পাওয়ায়, আচমকা ঘুরে দাঁড়িয়ে হামলে পড়ল তারা টার্নাসের ওপর। পেছাতে বাধ্য হলেন তিনি, টাইবারে ঝাঁপ দিলেন। দলনেতার পথ অনুসরণ করল বাকি সৈন্যরাও।

এদিকে ঈনিয়াসের এট্রুরিয়া সফল হয়েছে। এভান্ডারের দেয়া সৈন্যদের সঙ্গে ত্রিশটির মতো জাহাজ ভর্তি সৈন্য পেয়েছেন তিনি। সবাইকে নিয়ে ল্যাটিয়ামে ফিরে, একেবারে সঠিক সময়েই ঝাঁপিয়ে পড়লেন যুদ্ধে।

এদিকে টার্নাসের পশ্চাৎপদ হওয়াটাও একটা ধোঁকা ছাড়া আর কিছু না। পানি থেকে বেরিয়ে এসে তিনি ধাওয়া করলেন এভান্ডারের ছেলে, প্যালাসকে। ঈনিয়াসের নজর এড়ায়নি তা। কিন্তু আফসোস, সাহায্য করতে পারলেন না ট্রোজান বীর। তার আগেই যুবক প্যালাসের বুক এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিল টার্নাসের বর্শা। এরপর যা করলেন রুটুলিয়ান নেতা, তা অকল্পনীয়। প্যালাসের কারুকার্যময়, তলোয়ার ঝোলাবার কোমর-বন্ধনী খুলে নিয়ে, ট্রফির মতো ঝুলিয়ে দিলেন কাঁধে। বেচারা এভান্ডার নিজেকে সামলাতে পারলেন না, পুত্রের লাশ আঁকড়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন।

প্যালাসের কোমর-বন্ধনী খুলে নিলেন টার্নাস; Image: dcc.dickinson.edu

আচমকা ঈনিয়াসের শোক রূপ নিল চণ্ডাল-রাগের। উন্মত্তের মতো রুটুলিয়ান সৈন্যদের কচুকাটা করতে লাগলেন তিনি। বেশ কয়েকদিন ধরে চলল এই হত্যাকাণ্ড। এরপর লাশের সৎকার করার নিমিত্তে সাময়িক সন্ধিতে একমত হলো দুই পক্ষ।

পুত্রের মৃত্যুতে শোকাহত হলেও, ট্রোজানদের সাহায্য করার জন্য আফসোস নেই মনে এভান্ডারের। কিন্তু পুত্র-হত্যার প্রতিশোধ চান তিনি, চান নিজ হাতে টার্নাসকে খুন করতে।

কিন্তু আফসোসের কথা, দীর্ঘদিন ধরে চলল এই যুদ্ধ। একপর্যায়ে এসে টার্নাসের সহযোগীরা বুঝতে পারল, এই যুদ্ধের মূল্য অনেক বেশিই হয়ে যাচ্ছে তাদের জন্য। রুটুলিয়ানদের পক্ষে যে সমর্থন ছিল তাদের, সেটা তুলে নেয়া হলো। রাগে পাগল হয়ে টার্নাস নিজের অবশিষ্ট সৈন্য নিয়ে আবার পা রাখলেন যুদ্ধক্ষেত্রে।

জুনো, ট্রোজানদের সবচাইতে ভয়ঙ্কর শত্রু, বুঝতে পারলেন যে টার্নাসের পতন অনিবার্য। শেষ মুহূর্তে তিনি অনুরোধ জানালেন জুপিটারকে- দেবরাজ যেন ল্যাটিনদের নাম এবং ভাষা টিকিয়ে রাখতে পারে। বিনিময়ে এই যুদ্ধের সমাপ্তি টানবেন তিনি।

জুনোর অনুরোধে সাড়া দিলেন জুপিটার। তিনি স্ত্রীকে জানালেন, ল্যাটিন এবং ট্রোজানদের বংশধররা হবে বিশ্বের বুকে সবচাইতে বিখ্যাত এক জাতি। ল্যাভিনিয়া এবং ঈনিয়াসের বংশধররা দুই জাতির সেরা গুণগুলো ধারণ করবে নিজেদের মাঝে।

এদিকে যুদ্ধক্ষেত্রে ক্রমাগত হেরেই চলছেন টার্নাস। কিন্তু অহংকার তার কমেনি এক বিন্দুও। অবশেষে ঈনিয়াসের মোকাবিলা করতে রাজি হলেন তিনি। এদিকে ট্রোজান বীর আগেই এভান্ডারকে কথা দিয়েছেন- প্যালাস হত্যার প্রতিশোধ তিনি নিয়েই ছাড়বে। তাই প্রয়োজনীয় সব প্রস্তুত সেরে নিলেন।

যুদ্ধের দিন দেখা গেল, ভুলে নষ্ট একটা তলোয়ার বেছে নিয়েছেন টার্নাস। ওটা দিয়ে ঈনিয়াসকে আঘাত করতেই, ভেঙ্গে গেল অস্ত্র। অবশ্য সেটার জন্য ভলকান নির্মিত বর্মও একটা কারণ হতে পারে।

সঠিক তলোয়ারটা দেয়ার নির্দেশ দিলেন টার্নাস তার সৈন্যদের। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গিয়েছে। ঈনিয়াস এই ঈর্ষাকাতর, অহংকারী যোদ্ধাকে পেড়ে ফেললেন মাটিতে; কালক্ষেপণ না করে চালিয়ে দিলেন নিজের বর্শা। টার্নাসের একটা উরু ভেদ করে সেটা স্পর্শ করল মাটি! টার্নাস জানতেন, পরের আঘাতটা বুক পেতে নিতে হবে তাকে। শেষ মুহূর্তে অনুরোধ করলেন তিনি- ঈনিয়াস যেন যোদ্ধার সম্মান দেখিয়ে সৎকার করে তার লাশ।

এক মুহূর্তের জন্য ইতস্তত করলেন ঈনিয়াস, একবার তো ভাবলেন- টার্নাসকে জান ভিক্ষে দেবেন। কিন্তু পরক্ষণেই তার চোখ গিয়ে পড়ল প্যালাসের কোমর-বন্ধনীর দিকে। তখনও টার্নাস সেটা কাঁধের ওপরেই ঝুলিয়ে রেখেছিল। মায়া-দয়া সব পরিত্যাগ করে, রুটুলিয়ান নেতার বুক ফুটো করে দিলেন তিনি।

রুটুলিয়ান নেতার বুক ফুটো করে দিলেন ঈনিয়াস; Image: fineartamerica.com

টার্নাসের মৃত্যুর পর, যুদ্ধের আর কোনো কারণ রইল না। ল্যাটিন এবং ট্রোজানরা শান্তিতে বসবাস করতে লাগল। ঈনিয়াস এবং রাজকুমারী ল্যাভিনিয়ার বিয়ের ফলে ট্রোজানদের বংশধর বলে নিজেদের দাবী করত রোমানরা।

ঈনিয়াসের প্রয়াণ

ঈনিয়াস কীভাবে মারা যান, তা নিয়ে রয়েছে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব। কারো কারো মতে, মেযেনটিয়াসের সৈন্যদের সঙ্গে লড়তে গিয়ে মারা যান তিনি। মেযেনটিয়াস ছিলেন টার্নাসের হাতে গোনা মিত্রদের মাঝে একজন। অন্যদের মতে তিনি মারা যান থ্রেসেই, ইতালিতে পা রাখার আগে। আর নয়তো ট্রোজানদের ইতালিতে পৌঁছে দিয়ে ফিরে আসেন ট্রয়ে, হন ট্রয়ের রাজা।

নেকটার এবং অ্যাম্ব্রোশিয়া দিয়ে সাদরে পুত্রকে বরণ করে নেন ভেনাস; Image: maicar.com

তবে ঈনিয়াসের মৃত্যুর পর, দেবতা জুপিটারের কাছে প্রার্থনা জানান ভেনাস। সেই প্রার্থনায় জুপিটার সাড়া দিলে, নদীর দেবতা নুমিসিয়াস ঈনিয়াসের সব ‘মরণশীল-অংশ’ ধুয়ে ফেলেন। নেকটার এবং অ্যাম্ব্রোশিয়া (গ্রিক এবং রোমান ধর্মানুসারে দেবতাদের খাবার) দিয়ে সাদরে পুত্রকে বরণ করে নেন ভেনাস। দেবত্ব লাভ করেন ট্রোজান বীর, মহান ঈনিয়াস।

 

Related Articles